<p>আধুনিক প্রযুক্তির ইস্পাত, উন্নতমানের ইট আর তার সঙ্গে প্রাকৃতিক উপকরণ মাটি ও বাঁশের সমন্বয়ে নির্মাণ করা হয়েছে চাটমোহরের একটি স্কুল ভবন। কাঠমিস্ত্রিদের নিপুণ হাতের ঐতিহ্যবাহী ঘরানার কাঠের কাজ একে সমৃদ্ধ করেছে। বিদ্যালয়টির পাঠাগারটি স্থাপন করা হয়েছে একটি মাটির ঘরে!</p> <p>শুধু নির্মাণশৈলীতেই ভিন্নতা নয়, বড়াল বিদ্যানিকেতন নামে এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাঠদানের ধরনও আলাদা। শিশুরা সেখানে পড়াশোনা করে হাসি, আনন্দ, নাচ, গান আর খেলার মধ্য দিয়ে।</p> <p>বড়াল নদের পারে হওয়ায় স্কুলটির নাম দেওয়া হয়েছে বড়াল বিদ্যানিকেতন। পাবনার চাটমোহর উপজেলার কুমারগাড়া গ্রামে কিছুদিন আগে নতুন রূপে যাত্রা শুরু করেছে পরিবেশবান্ধব ও গ্রামীণ পরিবেশে পাঠদান করা এই স্কুলটি। ভবনের ব্যতিক্রমধর্মী কাঠামো আর পাঠদানের অভিনবত্বে এরই মধ্যে তা এলাকাজুড়ে নজর কেড়েছে।</p> <p>দোতলা স্কুল ভবনের নিচতলায় খোলা বারান্দা। সেখানে পাতা বাঁশের চাটাইয়ের সামনে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে শিক্ষামূলক বিভিন্ন ছবি। চাটাইতে বসে মনের আনন্দে পাঠ নিচ্ছে শিশুরা। পাশের মাটির ঘরটিতেই পাঠাগার। শিশুরা তাদের ইচ্ছামতো সেখানে গিয়ে বই পড়তে পারে। কম্পিউটার চালানো শেখার জন্য দোতলায় রয়েছে আলাদা শ্রেণিকক্ষ। সপ্তাহে এক দিন স্কুলে থাকে সাংস্কৃতিক চর্চা। শিক্ষার্থীদের সংস্কৃতিমনা হিসেবে গড়ে তোলা এর লক্ষ্য। শিশু শ্রেণি থেকে ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত পাঠদান করা হয় এখানে।</p> <p>স্কুলটির প্রাঙ্গণজুড়ে গাছের ছায়া। সবুজে ঘেরা পরিবেশ। শিক্ষার্থীদের জন্য চালু রয়েছে দুপুরে খাবারের ব্যবস্থা। প্রথম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের সকালে ১০ টাকার নাশতাও দেওয়া হয়। খাওয়ার সময় শিশুরা প্রতিনিয়ত চর্চা করে স্বাস্থ্য সচেতনতা ও শৃঙ্খলার। সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে নিজেরাই যার যার খাবার নিয়ে নেয় তারা। একসঙ্গে বসে খাওয়া শেষে উচ্ছিষ্ট ফেলে বাঁশ দিয়ে তৈরি করা পরিবেশবান্ধব ঝুড়িতে। শ্রেণিকক্ষগুলোতে প্রচলিত ধরনের জানালা নেই। তবে দেয়ালের বড় একটা অংশ উন্মুক্ত, যা দিয়ে যথেষ্ট আলো আসে। তা দিয়ে শিক্ষার্থীরা সহজেই গাছ, পাখিসহ প্রকৃতি দেখতে পারে। ছুঁয়ে দেখতে পারে বৃষ্টি।</p> <p>শিশুরা যেন প্রাকৃতিক পরিবেশে মাটির গন্ধ নিয়ে মনের আনন্দে পাঠ নিতে পারে সে লক্ষ্যেই এমন ব্যতিক্রমী বিদ্যায়তন খুলেছেন এর উদ্যোক্তারা। তাঁরা বলেছেন, এর পেছনে প্রেরণা পেয়েছেন বিশ্বকবির শান্তিনিকেতন থেকে।</p> <p>কুমারগাড়া গ্রামে ২০১৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় বড়াল বিদ্যানিকেতন। আর এর নবযাত্রা উদ্বোধন করা হয় গত মার্চে। তখন থেকে সুষ্ঠুভাবে চলছে এর কার্যক্রম।</p> <p>শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির নতুন যাত্রার বর্ণাঢ্য আয়োজনে উপস্থিত ছিলেন কয়েকজন স্থপতিসহ স্থানীয় বিশিষ্টজনরা। অনুষ্ঠানের মধ্যে ছিল শিশু শিক্ষার্থীদের কুচকাওয়াজ ও দৃষ্টিনন্দন ডিসপ্লে। মঙ্গল প্রদীপ প্রজ্বালনের মাধ্যমে বিদ্যালয়টির নতুন যাত্রার উদ্বোধন করেন ঢাকার স্থাপত্য বিষয়ক প্রতিষ্ঠান ‘ভিত্তি’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক স্থপতি ইসতিয়াক জহির। প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য দেন এর নকশার দায়িত্ব পালনকারী স্থপতি ইকবাল হাবিব।</p> <p>স্কুলটির পরিকল্পনা নিয়ে ইকবাল হাবিব বলেন, ‘গতানুগতিক ধারার বাইরে ব্যতিক্রমী পরিবেশবান্ধব ও খোলামেলা পরিবেশের চিন্তা থেকেই স্কুলটি করা হয়। এখানে প্রচলিত ধরনের জানালা নেই, কিন্তু আলো আছে। বৃষ্টি পড়ছে, কিন্তু ক্লাসের শিক্ষার্থীদের কোনো অসুবিধা হচ্ছে না। তারা হাত দিয়ে বৃষ্টি ছুঁতে পারছে। আবদ্ধতার বিপরীতে উন্মুক্ততার অভিনব উদ্যোগ এটি। আবহমান বাংলার মাটি, বাংলার উঠানের পরিবেশটাকে ধারণ করার চেষ্টা করেছি আমরা।’</p> <p>স্থপতি ইসতিয়াক জহির বলেন, ‘চলনবিলের একটি প্রত্যন্ত অঞ্চলে এমন একটি স্কুল আমরা অনেকেই আশা করি না। কিন্তু এখন সেটি হচ্ছে। আমি মনে করি, এই স্কুল বাংলাদেশের জন্য একটা দৃষ্টান্ত।’</p> <p>বড়াল বিদ্যানিকেতনের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক এস এম মিজানুর রহমান। এর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে তিনি বললেন, পরিবেশবান্ধব ও মানবিক মানুষ গড়ার জন্যই স্কুলটি প্রতিষ্ঠা করেছেন তাঁরা। শুরুতে তাঁদের তেমন সামর্থ্য ছিল না। এক পর্যায়ে স্থপতি ইকবাল হাবিব সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেন। প্রতিষ্ঠার সময় স্কুল ভবনের নকশা করার পাশাপাশি অর্থ দিয়েও সহযোগিতা করেছেন তিনি। শিক্ষার্থীদের বেতন থেকে পাওয়া অর্থে পুরো পরিচালন ব্যয় উঠে আসে না বলে উদ্যোক্তারাই ঘাটতিটা মেটাচ্ছেন এ পর্যন্ত।</p> <p> </p> <p> </p>