আরজু লাইট হাউস
১৯৪৮ সালে সূত্রাপুরের দুই ভাই হরিপদ ঘোষ ও দয়াল ঘোষ মিলে একটি দোকান চালু করেন। নাম আরজু লাইট হাউস। লাইট হাউস নাম হলেও লাইটের পাশাপাশি গ্রামোফোনও ভাড়া দেওয়া হতো। বিয়ে-শাদিতে লাইটের সঙ্গে গ্রামোফোনও ভাড়া নিত লোকজন।
আরজু লাইট হাউস
১৯৪৮ সালে সূত্রাপুরের দুই ভাই হরিপদ ঘোষ ও দয়াল ঘোষ মিলে একটি দোকান চালু করেন। নাম আরজু লাইট হাউস। লাইট হাউস নাম হলেও লাইটের পাশাপাশি গ্রামোফোনও ভাড়া দেওয়া হতো। বিয়ে-শাদিতে লাইটের সঙ্গে গ্রামোফোনও ভাড়া নিত লোকজন।
১৯৪৮ সালে দেশ ভাগের পর থেকেই পূর্ব পাকিস্তানে আন্দোলন দানা বাঁধতে শুরু করে। আন্দোলনের নেতা-কর্মীরা মাইক ভাড়া নিতে শুরু করেন আরজু লাইট হাউস থেকে। চাহিদা বাড়তে থাকে দিনে দিনে।
হলো কল-রেডী
বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের পর থেকে সভা-সমাবেশ বেড়ে যায়। এ ছাড়া সামাজিক আর ধর্মীয় অনুষ্ঠানেও মাইক ভাড়া যাচ্ছিল।
উত্তাল সময়ের সাক্ষী
ভালো সেবা দেওয়ার সুনাম থাকায় যেকোনো সভা-সমাবেশ ও বড় বড় অনুষ্ঠানে ডাক পড়তে থাকে কল-রেডীর। ১৯৫৪ সালে কল-রেডীর কর্মী ছিল ২০ জন। সভা-সমাবেশ সুনামের সঙ্গেই সম্পন্ন করতেন হরিপদ ও দয়াল ঘোষ। মাঝেমধ্যে তাঁদের ছোট দুই ভাই গোপাল ঘোষ ও কানাই ঘোষও সাহায্য করতেন। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ১৯৬৬ সালের ৬ দফা আন্দোলন, ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থান এবং ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনের সভা-সমাবেশেও যোগ দিয়েছে কল-রেডী। কল-রেডীর মাইক্রোফোনের সামনে দাঁড়িয়ে ভাষণ দিয়েছেন পূর্ব পাকিস্তানের বাঘা বাঘা নেতা।
এলো ৭ই মার্চ
এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম-হাটে-মাঠে-ঘাটে সব জায়গায় তখন স্বাধিকারের চেতনায় ফুঁসছে মানুষ। সত্তরের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুকে সারা দেশের মানুষ ভোট দিয়েছে। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ক্ষমতা হস্তান্তর করে না। দফায় দফায় মিটিং করেও হচ্ছে না সুরাহা। চলে এলো মার্চ। কল-রেডীর মালিক হরিপদ ঘোষ ও দয়াল ঘোষকে ধানমণ্ডির বাসায় ডেকে পাঠালেন বঙ্গবন্ধু। নির্দেশ দিলেন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে [তৎকালীন রেসকোর্স ময়দান] মাইক লাগাতে। কাজে নেমে পড়েন হরিপদ ও দয়াল ঘোষ। তখন রেসকোর্সে মাইক লাগানো সোজা ছিল না-শাসকগোষ্ঠীর চোখ ছিল সদা সতর্ক। রাতের অন্ধকারে লুকিয়ে লুকিয়ে মাইক লাগাতে লাগলেন দুই ভাই। ৭ই মার্চের বাকি আর তিন দিন। মাইক লাগিয়ে কাপড় দিয়ে ঢেকে দিলেন হরিপদ আর দয়াল ঘোষ। কিছু বাড়তি মাইক বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় মজুদ রাখেন যেন সমাবেশের দিন তাৎক্ষণিকভাবে লাগিয়ে নিতে পারেন। তিন দিন ধরে ৩০ জন কর্মী নিয়ে বাঁশ, খুঁটি গাঁথার কাজ করেন ঘোষেরা। তারপর সেই দিনটি আসে-৭ই মার্চ। কবি গিয়ে দাঁড়ান জনতার মঞ্চে। মুখের সামনে
কল-রেডী। বলেন, 'এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা।'
বঙ্গবন্ধুর ভাষণকালে যেন কোনো যান্ত্রিক ত্রুটি না হয়, সে জন্য নিজে উপস্থিত থাকার পাশাপাশি একজন সাউন্ড ইঞ্জিনিয়ার নিয়োগ দিয়েছিলেন হরিপদ ঘোষ। অতিরিক্ত তিনটি মাইক্রোফোন সঙ্গে রেখেছিলেন দয়াল ঘোষ।
এত বড় একটি সমাবেশে মাইক সার্ভিস দিয়ে কত টাকা পারিশ্রমিক নিয়েছিল কল-রেডী? জানতে চাইলে হরিপদ ঘোষের ছেলে কল-রেডীর বর্তমান পরিচালক সাগর ঘোষ জানান, সেই সময় পারিশ্রমিকের কথা চিন্তা করার সুযোগ বাবা ও জ্যাঠা মশাইয়ের ছিল না। বঙ্গবন্ধু নির্দেশ দিয়েছেন সেটাই বড় কথা। আর তা ছাড়া দেশের পরিস্থিতি তখন সবাই কম-বেশি জানতেন। আর বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে বাবা-কাকার ভালো সম্পর্ক থাকার কারণে বাবা শুধু খরচটাই নিতেন। আরো বললেন, 'সেদিন সেই সমাবেশে আমার বাবার হাতে তৈরি অনেক হ্যান্ড মাইক ব্যবহৃত হয়েছিল।'
সেসব আজও আছে
৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানে দাঁড়িয়ে কল-রেডীর যে মাইক্রোফোনে বঙ্গবন্ধু তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণ দিয়েছিলেন সেই মাইক্রোফোন, মাইক্রোফোনের স্ট্যান্ড আজও আছে কল-রেডীর কাছে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আর অন্য কেউ সেই মাইক্রোফোনের সামনে দাঁড়িয়ে ভাষণ দেননি। এরপর বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি দেশে ফিরে আবারও কল-রেডীর মাইক্রোফোনের সামনে দাঁড়িয়ে ভাষণ দিয়েছিলেন।
এখন কল-রেডী
রাজনৈতিক সভা-সমাবেশ, ধর্মীয় ও সামাজিক অনুষ্ঠানের পাশাপাশি কনসার্ট, বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন বা বিয়েতে মাইকের পাশাপাশি এখন সাউন্ড সিস্টেম সার্ভিস দিয়ে থাকে
কল-রেডী। সার্বক্ষণিক সেবাদানের জন্য রয়েছে ২০ জন কর্মী। চাহিদা বেশি হলে অস্থায়ী শ্রমিক নিয়োগ করা হয়। কল-রেডী এখন একই দিনে তিনটি মহাসমাবেশ সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার সামর্থ্য রাখে।
বয়স হলো ৬৭
প্রতিষ্ঠার পর কল-রেডীর ৬৭ বছর পেরিয়ে গেছে। শুরুর সেই জায়গায়ই আছে কল-রেডী। একটি মাইকের দোকানের এই দীর্ঘ পথ চলাকে কিভাবে দেখেন জানতে চাইলে সাগর বলেন, অনেক পথ কল-রেডী পাড়ি দিয়েছে এটা সত্য। তবে এতটা পথ পাড়ি দেওয়া খুব একটা সহজ ছিল না। প্রতিষ্ঠার পর থেকে অনেক পটপরিবর্তনের মধ্য দিয়ে আজকের এই অবস্থানে এসেছে প্রতিষ্ঠানটি। এখনো সারা দেশের মানুষ এক নামে কল-রেডীকে চেনে। দেশে বড় বড় অনুষ্ঠানের আয়োজকরা এখনো অনুষ্ঠানের জন্য প্রথমে কল-রেডীকেই ডাকেন। সুন্দর-সুষ্ঠু এবং যথাযথ সেবা দানের কারণে কল-রেডীর প্রতি মানুষের এই আগ্রহ বলে আমি মনে করি। আমার জানা মতে, কখনো কল-রেডী সেবাদানের সময় বড় কোনো যান্ত্রিক গোলযোগের মুখোমুখি হয়নি। এর কারণ সব সময় আমাদের সঙ্গে একজন সাউন্ড ইঞ্জিনিয়ার থাকেন।
সম্পর্কিত খবর
রংপুরের গুপ্তপাড়ার ইসহাক আলী ও শাহিদা বিবির সন্তান ইকবাল ঘুরতে ঘুরতে রংপুর থেকে নওগাঁয় আসেন প্রায় ৪৪ বছর আগে। এখন বয়স ৭২ বছর। বাবা ইসহাক আলী চাকরি করতেন বগুড়ার জামিল গ্রুপে। ইকবাল থাকতেন মায়ের সঙ্গে রংপুরে।
সেই থেকে ইকবাল জীবনের সব দুঃখ-কষ্ট বুকে চেপে রেখে হাসিমুখে কথা বলেন শিশু থেকে নানা বয়সী মানুষের সঙ্গে। নওগাঁ শহরের প্রায় সবাই তাঁকে চেনে বই ফেরিওয়ালা হিসেবে। সকালে যা পারেন রান্না করে খেয়ে বের হন বাসা থেকে। বাসা বলতে শহরের দয়ালের মোড়ে ভাড়া নেওয়া টিনের ছাপরা দেওয়া একটি ছোট্ট ঘর।
সারা দিন ঘুরে যা আয় হয়, তা দিয়ে কোনোভাবে খেয়েপরে দিন চলছে তাঁর। করোনা মহামারির সময় খুব কষ্টে কেটেছে তাঁর দিন। জমানো টাকা যা ছিল তা খরচ হয়ে যায়; এমনকি ঘরভাড়ার ৭০০ টাকা জোগাড় করতেও হিমশিম খেতে হয়েছে। তবু কারো কাছে হাত পাতেননি।
হায়দার আলী ইকবাল বলেন, ‘নওগাঁ আমাকে মায়ার বাঁধনে বেঁধে ফেলেছে। স্ত্রী মারা যাওয়ার পর বিয়ে থা আর করা হয়নি। জীবনের সবটাই তো পেরিয়ে এসেছি। আগামী দিনে কী আছে তা নিয়ে আর ভাবি না। বই আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছে, খাবার জুগিয়েছে। তাই বইয়ের কাছে আমি ঋণী। দুই পায়ে ভর দিয়ে চলতে কষ্ট হয়। একটি ভ্যানগাড়ি তৈরি করে নিয়েছি। কিন্তু শিশুতোষ পণ্য ওঠানোর মতো টাকাকড়ি নেই। শিশুতোষ বইয়ের সঙ্গে খেলনাসামগ্রী তুলে স্কুলের সামনে বিক্রি করব। একটি অটোভ্যান পেলে খুব ভালো হতো।’
এখন বাজারে নানা ধরনের কফি পাওয়া যায়, যা বিভিন্ন কম্পানি তাদের নিজস্ব পদ্ধতিতে কৃত্রিম উপায়ে তৈরি করে। বাজারজাতকরণের জন্য এসব কফি পাউডারের সঙ্গে নানা কৃত্রিম উপাদানের মিশ্রণও ঘটানো হয়। তবে বাগান থেকে কফির বীজ সংগ্রহ, পরিচর্যা, গুঁড়া তৈরি—কোনো ক্ষেত্রেই কৃত্রিম কোনো উপাদান ব্যবহার না করে তৈরি কফিই গুণে-মানে সেরা। স্বাদও অপূর্ব।
লুয়াকের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এই কফির বীজ বিড়াল আকৃতির এক ধরনের মঙ্গুস (বেজি) গোত্রের প্রাণীকে খাওয়ানো হয়। বাগানে খাঁচার মধ্যে প্রাণীটিকে রেখে এই ফল খাওয়ানো হয়। কারণ প্রাণীটি এই ফল খায়, তার পাকস্থলীতে গিয়ে এই ফল জার্মিনেটেড হয়; তবে ওই ফল আবার বর্জ্য হিসেবে বের করে দেয়।
বাগানে ওই বর্জ্য সংগ্রহ করা হয়।
এই কফির মান কেমন? মান পরীক্ষা করানোর জন্য বাগানের কর্মী তাঁদের নির্ধারিত স্থানে নিয়ে বসালেন। তবে এখানে কফিপান বিনা মূল্যে নয়। সাধারণ ছোট এক কাপ কফির দাম ৫০ হাজার ইন্দোনেশিয়ান রুপিয়া। বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৩৫০ টাকা। অবশ্য স্বাদের পার্থক্য অনুভবের জন্য আপনাকে পাশাপাশি আরো সাত রকমের কফি দেওয়া হবে। চুমুক দিয়ে দেখলাম, স্বাদে অনন্য। এই কফি পাউডার প্যাকেট বা বোতলজাত করে বিক্রি করা হয়। ১০০, ২০০ বা ৫০০ গ্রামের প্যাকেট। পরিমাণ বা প্যাকেটের ধরনের ওপর দাম কমবেশি হয়ে থাকে। ১০০ গ্রাম লুয়াক কফি পাউডারের দাম সাত লাখ ২০ হাজার ইন্দোনেশিয়ান রুপিয়া, বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার টাকা। এই কফি থেকেই তৈরি করা হয়েছে চকোলেট।
ইন্দোনেশিয়ায় পর্যটকদের জন্য তীর্থভূমি বালিজুড়ে এ রকম অনেক কফিবাগান ছড়িয়ে আছে, যেখানে একেবারে প্রাকৃতিক উপায়ে কফি তৈরি ও বিপণন করা হয়।
আমার পাশের সিটটা বলা যায় নীলুর জন্য রেজিস্ট্রিই করা। সেই যে নীলু, শহর থেকে আসা হ্যাংলা মেয়েটা, এক দুপুরে আমার পাশে বসল, সেটা এক দিনের জন্যও বদলায়নি। দিন দিন আমাদের নৈকট্য বেড়েছে। সহপাঠী থেকে আমরা হয়ে গেলাম সই।
ঘণ্টা পড়ে গেছে, কিন্তু নীলু এখনো এলো না। আমার খুব একা একা লাগছে। যদিও মন বলছে সে এক্ষুনি চলে আসবে।
কিন্তু সে আসে না। প্রথম পিরিয়ড শেষ হয়, দ্বিতীয় পিরিয়ড শেষ হয়, শেষ হয় শেষ পিরিয়ডও; তবু সে আসে না। ছুটির পরে আমি বাবার সঙ্গে বাড়ি ফিরছি।
উঠানে পা দিতেই দেখি একটা বকুলগাছের তলায় নীলু শুয়ে আছে। পাশেই তার ছোট ভাই বাবু নীলুর মতোই নিস্তব্ধ, নিথর! যেন এইমাত্র ঝরে পড়া দুটি হলুদ পাতা জড়াজড়ি করে শুয়ে আছে!
আমার নীলু! আমার খেলার সাথি! আমার হরিণী! নিবিড় বনের মতো আচ্ছন্ন চোখের চাহনি তার নীল হয়ে গেছে। এই চোখে তাকিয়ে আমি কত দিন মুগ্ধতায় অবশ হয়েছি। কী হয়েছে নীলুর?
বাবা নীলুকে উপুড় করে কোলে তুলে নিলেন। মুখের ভেতর হাত দিলেন, মুখ দিয়ে গড়গড়িয়ে এক কলসির মতো পানি বেরোলো। বাবা নীলুর মুখে মুখ লাগিয়ে শ্বাস দিলেন; হাতের তালু, পায়ের তালু ঘষে ঘষে গরম করতে চাইলেন। দুই হাতের আঙুল ওপর-নিচে ধরে তার বুকের ওপর চাপ দিলেন। চোখের পাতা উল্টে দেখলেন, হাতের কবজিতেও কী যেন দেখলেন! নীলুর কোনো সাড়া নেই। বাবা নীলুর ভাই বাবুকেও একই রকম করলেন। তার ঠোঁটও নীলচে হয়ে গেছে, হাতের তালু কুচকে গেছে।
নীলুর মা আর্তনাদ করে বাবাকে বললেন, ‘স্যার, কিছু বলছেন না কেন? ওরা কি আর নেই?’
বাবা বললেন, ‘ডাক্তার নিয়ে এসো।’ বলেই পাঞ্জাবির পকেট থেকে রুমাল বের করে বাবা চোখ মুছলেন।
‘আল্লাগোওওওও’ বলে চিৎকার দিয়ে নীলুর মা জ্ঞান হারালেন।
বাড়ি ভর্তি মানুষ গিজগিজ করছে। কানাঘুষা চলছে। একজন বললেন, মা-টা এমন বেখেয়ালি! শোকের বিলাপ তুলে আরেকজন বললেন, আজ ভোরেও চোখ বন্ধ করে ঝরা বকুলের সুবাস নিয়েছিল নীলু। সেই নীলু এখন লাশ হয়ে শুয়ে আছে তারই মৃত ভাইয়ের পাশে!
নীলুর লোটন আপু বললেন, উঠোনে কাপড় শুকাতে দিতে গিয়ে দেখি দুই ভাই-বোন গোসল করছে, মগ কেটে গায়ে পানি ঢালছে। হয়তো বাবু পা পিছলে পানিতে পড়ে যায়, আর নীলু তাকে তুলতে ঝাপ দেয়। কিন্তু নীলু ভুলে যায় সে সাঁতার জানে না। সাঁতার না জানার মতো সামান্য অক্ষমতার কাছে ভাইয়ের প্রতি ভালোবাসার পরাজয় হতে পারে না। তাই বুঝি একসঙ্গে বাঁচতে চেয়ে দুই ভাই-বোন একসঙ্গেই তলিয়ে যায় দিঘির মতো দীর্ঘ পুকুরের অতল জলে। হয়তো ডুবন্ত ভাই-বোনের দপাদপিতে পাতিহাঁসের দল ডানা ঝাপটে উঠে আসে পারে। বেজি কিংবা বাগডাশ ভেবে আমরা ওদিকে যাইনি। আহা যদি একবার যেতাম!
কত অসংখ্য দিন নীলু আমাকে তাদের বাড়ি যেতে বলেছিল! নানা ছুতোয় যাইনি। আজ কোনো অনুরোধ ছাড়াই এসেছি। পিঁপড়ার দলার মতো গিজগিজ করা মানুষের ভিড়ের মধ্যে নীলুর লাশের পাশে বসে আছি।
নীলু বলেছিল, আমাদের একটা বকুলগাছ আছে, বড় একটা পুকুর আছে, তার শান-বাঁধানো ঘাট, পুকুরে পাতিহাঁস সাঁতার কাটে, রক্তজবার ঝোপের ভেতর টুনটুনির বাসা, লজ্জাবতীর ঝাড় স্পর্শ পেলেই নুয়ে পড়ে, একটা সাদা বিড়াল আছে মিনি। বলেছিল, আমার লোটন আপু আছে, সে অনেক বড় বড় নভেল পড়ে আর রেডিওতে অনুরোধের আসরে চিঠি লেখে। আমার ভাইটা খুব দুষ্ট। বাবা খুব ব্যস্ত, খালি ঢাকা যেতে হয়। আর মা? মা আমার খুব প্রিয়। কেক বানাতে পারে, পুডিং বানাতে পারে। এত মজা করে পায়েস রাঁধে যে খেলে তুই ভুলতেই পারবি না! আমার শান্ত জ্যাঠা এমন পাওয়ারের চশমা পরে যে তাকালে চোখ দুটিকে অনেক দূরের মনে হয়। আমাদের কাকাতুয়ার মতো ঝুঁটিওয়ালা মোরগ আছে, খুব ভোরে চিৎকারে করে আমাদের ঘুম ভাঙিয়ে দেয়। আয় না একদিন আমাদের বাড়ি!
চিৎকারে করে বলতে ইচ্ছা করছে, নীলু, আমি এসেছি নীলু!
এই উঠোন পার হয়েই কি পুকুরে গিয়েছিল নীলু? ওই তো ছোট্ট পায়ের ছাপ এখনো মুছে যায়নি! ইচ্ছা করছে সেখানে চুমু খাই। উঠোনের বকুলগাছটাকে দেখি। নীলুর শোকেই কি সব ফুল ঝরে পড়ে আছে?
ঝরা ফুলের বেদনা বুকে নিয়ে আমি আর বাবা ফিরে আসি। আমাদের মন পড়ে থাকে বকুলগাছটার তলায়। নীলুর কাছে। নীলুর ভাইয়ের কাছে। আমার চোখ ভিজে উঠে বারবার। যতই চোখ মুছি নীলুর স্মৃতির কোলাজ বারবার জ্বলে ওঠে মনের মাঝে।
ঢোলকলমির ফুল দিয়ে নীলু প্রায়ই মাইক বানাত। হাবিজাবি মাইকিং করত। স্কুলের পেছনে আমগাছের ডালে বসে একেক দিন একেক ঘোষণা দিত : একটি হারানো বিজ্ঞপ্তি, একটি হারানো বিজ্ঞপ্তি... নীলু নামের একটি মেয়ে হারিয়ে গিয়েছে। তার পরনে ছিল লাল স্কার্ট, সাদা টপস...
নীলু সত্যিই হারিয়ে গেছে। হারিয়ে গেছে বুকের কাছের বকুল ফুলের ঘ্রাণ। হারিয়ে গেছে ‘আয়রে আমার কনকচাঁপার আনন্দ উদ্যান।’
—কাইছুন নেছা কুহেলী
সুবর্ণচর, নোয়াখালী।
বিদ্যালয়টি নাগেশ্বরী উপজেলা শহর থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে সুখাতী গ্রামে অবস্থিত। গত বছরের ৩ ডিসেম্বর মিরপুরে জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশনের অনুষ্ঠানে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় প্রতিবন্ধতা উত্তরণে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখায় প্রতিষ্ঠান ক্যাটাগরিতে ‘সুখাতী বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী ও অটিজম বিদ্যালয়’কে দেশসেরার পুরস্কার দেয়।
শুরুর কথা
বগুড়ার সরকারি আজিজুল হক কলেজ থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর আলমগীর। ছাত্রাবস্থায় বন্ধুদের নিয়ে ‘উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ সামাজিক সেবা’ নামের একটি সংগঠন গড়ে তোলেন এক দশক আগে।
আব্দুল্লাহ আল নোমানও এখন সুস্থতার পথে।
ব্যতিক্রমী এক প্রতিষ্ঠান
সরকারি হিসাবে কুড়িগ্রামে প্রতিবন্ধীর সংখ্যা প্রায় ৬৪ হাজার।
আলমগীর জানান, কুড়িগ্রাম জেলায় বিশেষ শিশুদের জন্য সমন্বিত উদ্যোগের একমাত্র প্রতিষ্ঠান এটি। অটিজম, সেরিব্রাল পালসি, ডাউন সিনড্রোম, সেন্সরি ডিস-অর্ডার, বিলম্বে কথা বলা, বুদ্ধিপ্রতিবন্ধিতা এবং অতিচঞ্চল শিশুদের জন্য প্রতিষ্ঠানটি গড়ে তোলেন তিনি। ওদের সমাজের মূলধারায় এনে স্বাভাবিক জীবন নিশ্চিত করাই ছিল উদ্দেশ্য। শুরু থেকে অভিভাবকদের কাছে আস্থা আর বিশ্বাসের প্রতীক হয়ে ওঠে আলমগীরের প্রতিষ্ঠানটি।
এখানে প্রতিবন্ধী শিশুদের চাহিদামতো অকুপেশনাল থেরাপি, ফিজিও থেরাপি, স্পিচ অ্যান্ড ল্যাঙ্গুয়েজ থেরাপি, মিউজিক, ডান্স ও ইয়োগা থেরাপি এবং গ্রুপ থেরাপির মাধ্যমে শিশুদের সুরক্ষায় কাজ করছেন একদল তরুণ-তরুণী।
যেভাবে চলে
এখন কোনো অভিভাবক তাঁর বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন সন্তানকে স্কুলে নিয়ে এলে প্রথমেই ম্যানেজমেন্ট টিমের মাধ্যমে তার শারীরিক ও মানসিক সমস্যা বা প্রতিবন্ধিতার ধরন চিহ্নিত করা হয়। অভিভাবকসহ শিশুটিকে একটি কক্ষের ভেতরে রেখে সিসি ক্যামেরায় তার আচরণ পর্যবেক্ষণ করা হয়। খোলা হয় তার জন্য পৃথক ফাইল। তারপর শুরু হয় পুনর্বাসনের কাজ।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, পুরো প্রতিষ্ঠান প্রাঙ্গণ সাজানো চিত্রাঙ্কন ও শিশুদের ভালো লাগা ছবিতে। মাঠে শিশুদের খেলার সরঞ্জাম। বিশেষ শিশুদের ভোকেশনাল ট্রেনিং, ডেইলি লিভিং অ্যাক্টিভিটি ট্রেনিং, ভারী কাজ করানো, সোশ্যালাইজেন, আইইপি স্কুলিং ছাড়াও বহির্বিভাগ থেরাপি কার্যক্রম, শিশুদের ১:১ পদ্ধতিতে বিশেষ শিক্ষাদান চলে।
প্রাক-প্রাথমিক থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পাঠদান, অভিভাবক প্রশিক্ষণসহ আউটিং কার্যক্রম রয়েছে। প্রয়োজনে আসেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও থেরাপিস্ট। কখনো শিক্ষার্থীদের নেওয়া হয় তাঁদের কাছে। আর প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষকরা তো আছেনই।
শিক্ষকের সঙ্গে খেলায় মেতেছে মেঘলা। ছবি : লেখক
সাফল্য আসছে
আলমগীর চেষ্টা করেন এখানে আসা সবাইকে সুলভে সেবা দেওয়ার। তাঁদের সেবায় সেরিব্রাল পালসিসম্পন্ন পাঁচ শিশু এখন স্বাভাবিক হয়ে ফিরেছে পরিবারে। একই লক্ষণের ২৩টি শিশু ধীরে ধীরে সুস্থতার দিকে যাচ্ছে। এরই মধ্যে ১৭ জনকে এরই মধ্যে মূলধারার শিক্ষাক্রম অনুযায়ী শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে। এখন মোট ১১০টি শিশু রয়েছে প্রতিষ্ঠানটিতে।
সুস্থ হয়ে ফেরা শিশুদের একজন সাত বছর বয়সী মেঘলা শীল। তার মা তৃষ্ণা রানী বলেন, ‘আমার বাচ্চা আগে হাঁটতে পারত না। কথা বলতে পারত না। কিন্তু এখন সে হাঁটতে পারে, কথাও বলতে পারে।’ সারাবান তহুরা পুষ্পর বয়স ১০ বছর। তার মা সালেমা বেগম বলেন, ‘আমার মেয়ে ছিল অস্থির (হাইপার) ও শ্রবণপ্রতিবন্ধী। এখন প্রায় ৭০ শতাংশ সুস্থ হয়েছে। স্কুলটিতে সরকারি সহায়তা পেলে অনেক বাচ্চার উপকার হতো।’ সেরিব্রাল পালসিতে আক্রান্ত ১২ বছরের আব্দুল্লাহ জয়ের মা জাহানারা বেগম এসেছেন হাসনাবাদ থেকে। বললেন, ‘ও আমার প্রথম সন্তান। মাত্র ছয় মাসে সবার চেষ্টায় ওর অনেক উন্নতি হয়েছে।’ এই সাফল্যের স্বীকৃতিও মিলেছে। জেলা-উপজেলা পর্যায়ে একাধিক সম্মাননাসহ ২০২০ সালে শেখ হাসিনা ইয়ুথ ভলান্টিয়ার অ্যাওয়ার্ড জিতেছিল প্রতিষ্ঠানটি। এবার তো হয়েছে দেশসেরা।
ভিডিও লিঙ্ক : https://www.facebook.com/watch/?v=1312484092657030&ref=sharing
ভবিষ্যতের ভাবনা
সহানুভূতিশীল মানুষের আর্থিক অনুদানে প্রতিষ্ঠানটি চলছে। আলমগীর বলেন, ‘স্কুলটি পরিচালনা করতে প্রতি মাসে লক্ষাধিক টাকা খরচ হয়। আয় হয় প্রায় ২২ হাজার টাকা। প্রতিষ্ঠানটিতে শিক্ষক, কর্মচারীসহ মোট ২৮ জন কর্মরত। কাউকে নিয়মিত বেতন দিতে পারছি না।’ তিনি বলেন, ‘প্রতিষ্ঠানটি আমার স্বপ্ন। কিন্তু দিন যত যাচ্ছে কুলিয়ে উঠতে পারছি না। আমার দরকার প্রতিষ্ঠানের স্বীকৃতি এবং নিয়মিত অনুদান পাওয়ার নিশ্চয়তা। সব শর্ত মেনে আবেদন করা হলেও এখনো সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বীকৃতি মেলেনি।’
কর্মকর্তারা বললেন
নাগেশ্বরী উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা জামাল হোসেন বলেন, ‘গ্রামের প্রতিষ্ঠান হলেও সেবার মান উন্নত। অনেক অটিজম শিশুর উন্নতি হয়েছে তাদের মাধ্যমে। আশা করি, অচিরেই প্রতিষ্ঠানটি স্বীকৃতি পেয়ে যাবে।’ নাগেশ্বরী ইউএনও ফারজানা জাহান বলেন, ‘স্কুলটি পরিদর্শন করে খুব ভালো লেগেছে। আমরা আলমগীরকে সহযোগিতার চেষ্টা করছি।’