<p>সাম্প্রতিক সময়ে আন্তর্জাতিক চাপ উপেক্ষা করে গাজায় হামলা চালিয়ে যাওয়া এবং জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে সর্বসম্মত যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব পাস হওয়ার পরও ইসরায়েলের পক্ষ থেকে গাজায় অনবরত হামলা চালিয়ে যাওয়া নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ইসরায়েলের সম্পর্ক ভালো যাচ্ছিল না। এরই মধ্যে গত ১ এপ্রিল সিরিয়ার দামেস্কের ইরানের কনসুলেট ভবনে ইসরায়েলের হামলায় ইরানের রেভল্যুশনারি গার্ড কোরের দুই শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তাসহ ১৩ জন নিহত হওয়ার জেরে ইরানের পক্ষ থেকে ইসরায়েলের ভূখণ্ডে পাল্টা ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা পরিচালনার পর পরিস্থিতি সম্পূর্ণ যেন ভিন্নরূপ ধারণ করল! এই হামলা এককভাবে মোকাবেলার সক্ষমতা ইসরায়েলের ছিল না—এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। মধ্যপ্রাচ্যে মোতায়েনকৃত যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্যের ঘাঁটিগুলো থেকে এবং মধ্যপ্রাচ্যের দেশ জর্দানের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় ইরানের প্রায় প্রতিটি নিশানা ইসরায়েলের লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করার আগেই নিষ্ক্রিয় করা হয়। তার পরও ইসরায়েলের দক্ষিণাঞ্চলীয় কয়েকটি সামরিক স্থাপনা কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে জানানো হয়েছে। ইরানের তরফ থেকে এই হামলা ইসরায়েলের সাধারণ নাগরিকদের জন্য ব্যাপক ভীতিকর একটি পরিস্থিতি সৃষ্টি করলেও এর মধ্য দিয়ে প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু সরকারের জন্য সবচেয়ে বড় যে বার্তাটি এসেছে তা হলো ইসরায়েলের নিরাপত্তা রক্ষায় তার পশ্চিমা মিত্ররা সর্বদা প্রস্তুত রয়েছে, যা এই হামলার পর পুনর্ব্যক্ত করা হয়েছে। আর এর জেরেই ইসরায়েল অনেকটা মারমুখী অবস্থায় রয়েছে।</p> <p><img alt="ইরান-ইসরায়েল টানাপড়েন এবং লাভ-ক্ষতি বিশ্লেষণ" height="300" src="https://cdn.kalerkantho.com/public/news_images/share/photo/shares/1.Print/2024/04.April/20-04-2024/4_kaler-kantho--20-4-2024 (1).jpg" style="float:left" width="500" />এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ইরানের হামলার মধ্য দিয়ে ইসরায়েলের লক্ষ্যবস্তুতে কাঙ্ক্ষিত ক্ষতিসাধন করতে না পারার ফলে ইরানের জন্য কী প্রাপ্তি ঘটল? ইরানের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, এই হামলার মধ্য দিয়ে তারা দামেস্ক কনসুলেট ভবনে ইসরায়েলের হামলার প্রতিবাদে তাদের সার্বভৌম সত্তার জানান দিয়েছে, যা আন্তর্জাতিক আইনে বৈধ। এ ক্ষেত্রে তারা জাতিসংঘ সনদের ৫১ অনুচ্ছেদের আলোকে তাদের অধিকার প্রয়োগ করেছে বলে জানানো হয়েছে। ওই অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘জাতিসংঘের কোনো সদস্য রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সশস্ত্র হামলা হলে ওই রাষ্ট্র যদি ব্যক্তিগত বা সম্মিলিত আত্মরক্ষার সহজাত অধিকার চর্চা করতে চায়, তবে তা ক্ষুণ্ন করা যাবে না।’ কিন্তু পশ্চিমা দেশগুলোর পক্ষ থেকে ইরানের হামলার নিন্দা জানানো হলেও ইসরায়েল যে ছয় মাস ধরে গাজা ভূখণ্ডে একের পর এক হামলা এবং ধ্বংসযজ্ঞ ঘটিয়ে চলেছে তার নিন্দা করা হয়নি। একটি সর্বসম্মত যুদ্ধবিরতি পাস করতে প্রায় ছয় মাস সময় লেগে গেল এবং এর পরও গাজার ধ্বংসযজ্ঞ চলার বিপরীতে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের পক্ষ থেকে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি, যা চরম হঠকারিতার শামিল। এদিকে কূটনীতিক মিশনে ইসরায়েলের হামলার মধ্য দিয়ে ১৯৬১ সালের কূটনীতিবিষয়ক ভিয়েনা কনভেনশনের লঙ্ঘন ঘটালেও এটি নিয়েও ইসরায়েলের প্রতি কোনো ধরনের নিন্দাবাক্য উচ্চারিত হয়নি। যা হোক, ইরানের পক্ষ থেকে সতর্ক করে দিয়ে বলা হয়েছে, তারা এই হামলার মধ্য দিয়ে দামেস্কের ঘটনার জবাব দিয়েছে এবং ইসরায়েলের তরফ থেকে কোনো ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখানো না হলে তাদের দিক থেকে আর কোনো হামলা চালানোর অভিপ্রায় ইরানের নেই। সেই দিক বিবেচনায় ইরান তার লক্ষ্য অর্জনে সক্ষম হয়েছে বলে ধরে নেওয়া যেতে পারে। </p> <p>ইরানের এই হামলার মধ্য দিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষপাতিত্বের আরেকটি চিত্র স্পষ্ট হয়েছে। এত দিন ধরে তারা যেভাবে ইসরায়েলের আত্মরক্ষার নামে গাজায় নির্বিচার হত্যাকাণ্ডকে সমর্থন দিয়ে গেছে, নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য সব রাষ্ট্রের সমর্থন থাকা সত্ত্বেও কেবল তাদের ভেটো ক্ষমতা প্রয়োগের কারণে একটির পর একটি যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব পাস হতে পারেনি। গত বৃহস্পতিবার জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকে ফিলিস্তিনের পূর্ণ সদস্য পদ প্রাপ্তির প্রস্তাবে আবারও ভেটো প্রদান করেছে যুক্তরাষ্ট্র। এসব যে একটি জাতিকে নিশ্চিহ্ন করার ঘৃণ্য প্রয়াস, তার সব কিছুই আজ স্পষ্ট।</p> <p>এরই মধ্যে রাশিয়া সার্বিক পরিস্থিতি আঁচ করতে পেরে ভূমধ্যসাগরে তাদের যুদ্ধজাহাজ মোতায়েন করেছে। বিষয়টি ইসরায়েলের ভূখণ্ডে ইরানের হামলার কারণকে আরো পরিষ্কার করেছে। সুতরাং ইরানের নিরাপত্তাব্যবস্থা কোনো কারণে হুমকির কারণ হতে পারে—এ ধরনের যেকোনো অবস্থায় রাশিয়া কী ভূমিকা রাখবে সেটার এক ধরনের নমুনা তারা প্রস্তুত করেছে। আমরা এটাও জানি, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে রাশিয়ার সঙ্গে চীনের সম্পর্ক নতুন উচ্চতায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ইরানের পক্ষ থেকে ইসরায়েলে হামলায় চীনের বর্তমান অবস্থা পর্যবেক্ষণে এক ধরনের মৌন সমর্থনের আলামত লক্ষ করা যাচ্ছে। তা ছাড়া এটা তো সবারই জানা যে চীন হচ্ছে কট্টর যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী। সেদিক বিবেচনায় যুক্তরাষ্ট্র যদি ইরানে হামলার পরিকল্পনায় ইসরায়েলের সমর্থনে এগিয়ে আসে, তাহলে তাদের কেবল ইরানকে নয়, চীন এবং রাশিয়ার সম্মিলিত শক্তিকেও মোকাবেলা করতে হবে। যদি এমনটাই হয়, তাহলে এটি কেবল আরেকটি আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ নয়, তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণও সৃষ্টি করতে পারে, আর এ রকম কিছু হলে তা হবে সর্বগ্রাসী এবং নিঃসন্দেহে একটি পারমাণবিক যুদ্ধ। ইরানের পক্ষ থেকে বলে দেওয়া হয়েছে, ইসরায়েল যদি কোনো ধরনের পাল্টা পদক্ষেপ নেওয়ার চেষ্টা করে, তাহলে তারা আগের চেয়েও ১০ গুণ শক্তি নিয়ে ইসরায়েলকে মোকাবেলা করতে প্রস্তুত রয়েছে। তাদের এ ধরনের বক্তব্য থেকে এটাই বোঝা যায়, ইসরায়েল যেমন বহিঃশক্তির ওপর নির্ভরশীল, ইরানও এ রকম কিছু দেশের ওপর নির্ভরশীল এবং প্রচ্ছন্ন সমর্থন পেয়ে আসছে। আর তাদের নিজেদের শক্তির সঙ্গে এ ধরনের বহিঃশক্তির সমন্বয়ের কারণেই তারা হামাস, হিজবুল্লাহ, হুতি এবং ইসলামী জিহাদসহ বেশ কিছু গোষ্ঠীকে লালন-পালন করে যাচ্ছে গোটা মধ্যপ্রাচ্যে, যারা চাওয়া মাত্র ইরানের সহায়তায় এগিয়ে আসবে। কাজেই এসব কিছু বিবেচনায় ইসরায়েলের পক্ষে এই মুহূর্তে পশ্চিমাদের সাহায্য নিয়ে কিছু করা সম্ভব নয়, যদি কিছু করতে হয়, সেটা করতে হবে একক প্রচেষ্টায়, যার ফল হতে পারে আরো ভয়াবহ।</p> <p>সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে লাভের পাল্লা ইরান, না ইসরায়েল—কোন দিকে বেশি ঝুঁকল, সেটা যদি মূল্যায়ন করা হয়, তাহলে ইরানের এই হামলার মধ্য দিয়ে ইসরায়েল বেশ কিছুদিন নিষ্ক্রিয়তার পর যুক্তরাষ্ট্রের সহমর্মিতা অর্জন করলেও আপাতত এটা দিয়ে তারা ইরানের হামলার পাল্টা জবাব দেওয়ার সক্ষমতা অর্জন করতে পারছে না। অন্যদিকে নিরাপত্তা পরিষদে কিছুদিন আগে সর্বসম্মতিক্রমে যে যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব পাস হয়েছে, সে মোতাবেক গাজায় যদি তারা তাদের হামলা অব্যাহত রাখে, তাহলে তাদের নিজেদের আত্মরক্ষার বৈধতা প্রশ্নের মুখে পড়তে থাকবে। আবার তাদের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন ধরে রাখাও কঠিন হয়ে উঠবে। এরই মধ্যে গাজা ইস্যু নিয়ে পশ্চিমাদের মধ্যে ব্যাপক মতপার্থক্য দেখা দিয়েছে। গাজায় ইসরায়েলের নির্বিচার গণহত্যার কারণে মধ্যপ্রাচ্যে একটি স্থায়ী শান্তির প্রচেষ্টা এবং দ্বিরাষ্ট্রিক সমাধানের অংশ হিসেবে ইউরোপীয় ইউনিয়নের চারটি দেশ মাল্টা, স্লোভাকিয়া, স্পেন ও আয়ারল্যান্ড আগামী জুন মাস নাগাদ ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার পরিকল্পনা করেছে। সুতরাং এর মধ্যেই ইসরায়েল যদি গাজা ইস্যুতে নিজেকে নিবৃত্ত না করে কিংবা যুক্তরাষ্ট্র বা জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের পক্ষ থেকে ফিলিস্তিনের নিরাপত্তার প্রশ্নে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া না হয়, তাহলে গোটা মধ্যপ্রাচ্যের পরিস্থিতি কেবল ইসরায়েলেরই নয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থের বিপক্ষে চলে যেতে পারে। ইরানের এই হামলা যদিও তাদের সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে জবাব দেওয়া বলে উল্লেখ করা হয়েছে, চলমান হামাস-ইসরায়েল যুদ্ধের ক্ষেত্রেও এর ব্যাপক তাৎপর্য রয়েছে।</p> <p>লেখক : অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ</p> <p>চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়</p> <p>mfulka@yahoo.com     </p>