<p>মহান মে দিবস পৃথিবীর শ্রমিক শ্রেণির আন্তর্জাতিক সংহতি ও অধিকার আদায়ে ঐক্যবদ্ধ থাকার অঙ্গীকার প্রকাশের দিন। শ্রমিকদের অধিকার ও মর্যাদা রক্ষার আন্দোলনে প্রেরণার এই দিনটি সারা বিশ্বের শ্রমজীবী মানুষের কাছে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ একটি দিন। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে শ্রমিকরা তাঁদের অর্জিত অধিকারকে আরো সংহত করার আওয়াজ তোলেন এই দিনে। আর আমাদের দেশের মতো দেশগুলোতে এই দিবসটি এখনো শ্রমিকদের অস্তিত্ব রক্ষার দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে।</p> <p>আবহমান কাল থেকে বাংলাদেশসহ বিশ্বের সর্বত্র সব সৃজন বা উৎপাদনের নির্মাতা হলেন শ্রমিক-কর্মচারী মেহনতি মানুষ। মহান মুক্তিযুদ্ধসহ আমাদের দেশের সব গণতান্ত্রিক সংগ্রাম ও উন্নয়নে শ্রমিক-কর্মচারী মেহনতি মানুষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে এসেছেন। গার্মেন্ট, নির্মাণ, প্রবাসী, পাট, চা, চামড়া, পরিবহন, হোটেল, রেস্টুরেন্ট, রাবার, স্টিল, রি-রোলিং, শিপ ব্রেকিং, চাতাল, সুতা, ওষুধ, সিরামিক, প্লাস্টিক, স্বাস্থ্য খাত, রিকশা, গৃহশ্রমিকসহ প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কর্মরত শ্রমিক-কর্মচারীরা হলেন আমাদের দেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি। তাঁদের হাড়ভাঙা পরিশ্রমে প্রতিনিয়ত বর্ধিত হচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রার ভাণ্ডার। তাঁদের শ্রম ও ঘামের ফসল হিসেবে প্রতিবছর দেশের জিডিপি বাড়ছে, বাজেট বাড়ছে, সম্পদ বাড়ছে, মানুষের গড় আয়ু বাড়ছে, দেশের সম্মান বাড়ছে। শ্রমজীবী মেহনতি মানুষের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ এবং ৩০ লাখ মানুষের জীবনদানের বিনিময়ে দীর্ঘ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে অর্জিত স্বাধীনতার ৫৩ বছরে দেশ রাজনীতি, অর্থনীতি, শিক্ষা, চিকিৎসা, কর্মসংস্থান, নারীর ক্ষমতায়নসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে উন্নতি করেছে। অনুন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হতে যাচ্ছে।</p> <p>কিন্তু সে অনুযায়ী শ্রমিক-কর্মচারীদের জীবনমানের উন্নয়ন ঘটেনি। তাঁরা এখনো পরিবার-পরিজনসহ জীবনধারণ উপযোগী মজুরি ও অবাধ ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার থেকে বঞ্চিত। কর্মস্থলে তাঁদের চাকরির নিরাপত্তা ও সামাজিক মর্যাদাও প্রতিষ্ঠিত হয়নি এখনো। দেশের শ্রমিক সংগঠনগুলো দীর্ঘদিন ব্যক্তিমালিকানা-নির্বিশেষে জাতীয় ন্যূনতম মজুরি ঘোষণার দাবি জানিয়ে এলেও এখনো এ বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। অথচ সমতাভিত্তিক ন্যায্য মজুরি ও শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য এটি সর্বস্তরের শ্রমিক-কর্মচারীদের অন্যতম মৌলিক দাবি। বিভিন্ন দেশে জাতীয় ন্যূনতম মজুরির বিধান রয়েছে। আমাদের দেশে বিগত সময়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি সরকার একবার জাতীয় ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ করেছিল। কিন্তু অদৃশ্য কারণে সেটা আর বাস্তবায়িত হয়নি। আমাদের দেশে স্বাধীনতা-পূর্ববর্তী সময়ে মহার্ঘ ভাতা চালু ছিল। কিন্তু এখন মহার্ঘ ভাতা প্রদান করা হচ্ছে না। প্রতিবছর জীবনধারণের জন্য নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রীর মূল্য যে হারে বৃদ্ধি পায় তার সঙ্গে সংগতি রেখে প্রতিবছর মহার্ঘ ভাতা চালু করা উচিত।</p> <p><img alt="শ্রমিক-কর্মচারীদের অধিকার ও মর্যাদা দিতে হবে" height="300" src="https://cdn.kalerkantho.com/public/news_images/share/photo/shares/1.Print/2024/05.May/01-05-2024/4_kaler-kantho--1-5-2024.jpg" style="float:left" width="500" />বর্তমানে বাংলাদেশ খুবই অর্থনৈতিক সংকটে নিমজ্জিত। কভিড মহামারি এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের অর্থনীতি নাজুক অবস্থায় রয়েছে। দেশের সাত কোটি ৩৬ লাখ শ্রমজীবী মানুষ উৎপাদন ও অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি। অথচ আইএলওর প্রতিবেদন অনুযায়ী এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশই একমাত্র দেশ যেখানে ন্যূনতম মজুরি দারিদ্র্যসীমার নিচে। অব্যাহত মুদ্রাস্ফীতির সঙ্গে সংগতিপূর্ণভাবে মজুরি বৃদ্ধি না পাওয়ায় বাংলাদেশের শ্রমিকদের প্রকৃত মজুরি এই অঞ্চলের মধ্যে সর্বনিম্ন স্তরে। আইএলও কনভেনশন ৮৭ ও ৯৮ অনুযায়ী অবাধ ট্রেড ইউনিয়ন ও দর-কষাকষির অধিকার ভোগ করার কথা থাকলেও উল্টো ট্রেড ইউনিয়ন করতে গেলে আমাদের দেশে গড়ে ওঠা নব্য ধনিক শ্রেণির রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষমতায়নের দাপটে শ্রমিক-কর্মচারীদের ওপর নির্যাতনের খড়গ নেমে আসে।</p> <p>বাংলাদেশের মোট শ্রমশক্তির ৮৫ শতাংশের বেশি অপ্রাতিষ্ঠানিক সেক্টরে কাজ করছেন। এই অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের অনেক কারখানা বা প্রতিষ্ঠানে শ্রমিকদের নামমাত্র মজুরি দিয়ে কাজ করানো হয়, নিয়োগপত্র দেওয়া হয় না, নির্দিষ্ট কর্মঘণ্টার অতিরিক্ত সময় কাজ করতে বাধ্য করা হয়। ছুটি বা অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা সেভাবে নেই। নারী শ্রমিকদের বিভিন্নভাবে হয়রানি ও নির্যাতন করা হয়। কর্মস্থলে পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা উপেক্ষিত। কর্মস্থলে দুর্ঘটনায় আহত ও নিহত শ্রমিকদের জন্য আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ও বাংলাদেশের শ্রমিক সংগঠনগুলোর দীর্ঘদিনের দাবি ‘লস অব ইয়ার আর্নিং’ অনুযায়ী ক্ষতিপূরণ প্রদান করা হয় না। একই কাজের জন্যও তাঁদের সমান মজুরি দেওয়া হয় না। অথচ মহান মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকার ছিল সাধারণ মানুষসহ শ্রমজীবী মানুষদের শোষণের হাত থেকে মুক্ত করে একটি বৈষম্যহীন সমতাভিত্তিক সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা কায়েম করা।</p> <p>শ্রমআইন অনুযায়ী প্রতি পাঁচ বছর পর পর নিম্নতম মজুরি বোর্ডের আওতাধীন ৪৪টি শিল্পপ্রতিষ্ঠানের শ্রমিকদের মজুরি পুনর্নির্ধারণ এবং বৃদ্ধি করার কথা থাকলেও এমন অনেক প্রতিষ্ঠান আছে যেগুলোর মজুরি গত ১৫ বছরেও পুনর্নির্ধারণ হয়নি বা বাড়েনি। অতীতের সরকারগুলোর মতো বর্তমান সরকারও মুখে নিজেদের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি এবং শ্রমিকবান্ধব সরকার বললেও আমরা স্পষ্ট লক্ষ্য করছি, সরকার শ্রমিকদের কথা বিবেচনা না করে মালিকদের স্বার্থকেই প্রাধান্য দিচ্ছে।</p> <p>সরকার, মালিক ও শ্রমিক পক্ষের প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত ত্রিপক্ষীয় পরামর্শক পরিষদ (টিসিসি)-কে পাশ কাটিয়ে এবং শ্রম আইন সংশোধনী সাবকমিটির মধ্যে আলোচনা শেষ না করে তড়িঘড়ি করে শ্রম আইনের সংশোধনী পাস করানো হয়েছে। শ্রম আইন সংশোধনী পাসের এই প্রক্রিয়া অগণতান্ত্রিক, শ্রম আইন ও আইএলও কনভেনশন পরিপন্থী। সরকারের এই আচরণ শ্রমিকদের কাছে নেতিবাচক বার্তা দেবে, যা দেশের শিল্প ও শ্রম সেক্টরে মঙ্গল বয়ে আনবে না। সরকার আইএলও, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ দেশি-বিদেশি বিভিন্ন মহলে দেখানোর জন্য শ্রম আইনের কিছু সংশোধনী আপাতদৃষ্টিতে শ্রমিকদের পক্ষে করেছে মনে হলেও প্রকারান্তরে এসব সংশোধনী শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন কার্যক্রমকে আরো জটিল করে দেবে। এতে শ্রমিকদের আরো হয়রানির শিকার হতে হবে। আইনগতভাবে যেটুকু অধিকার শ্রমিকদের রয়েছে বাস্তবে মালিকদের একচেটিয়া ক্ষমতার দাপটের ফলে এই অধিকারটুকুও শ্রমিকরা ভোগ করতে পারেন না। এ ছাড়া মালিকদের প্রতি সরকারের নতজানু পক্ষ অবলম্বন শ্রমিকদের তাঁদের ন্যায্য অধিকার থেকে আরো বঞ্চিত করছে। মুক্ত বাজার অর্থনীতির দাপট এবং মুনাফাখোর ফড়িয়া ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট কারসাজিতে দ্রব্যমূল্যের ক্রমবর্ধমান ঊর্ধ্বগতি বর্তমানে এমন অবস্থায় এসে পৌঁছেছে যে শ্রমিক-কর্মচারী ও সাধারণ মানুষ অসহায় ও মানবেতর জীবনযাপন করতে বাধ্য হচ্ছে।</p> <p>দুর্ভাগ্যজনকভাবে শ্রমজীবী মানুষ নির্মাতা হিসেবে বিভিন্ন সৃজন-উৎপাদনে যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন তা আমাদের দেশের মালিক গোষ্ঠী কোনোভাবেই বুঝতে চায় না। শিল্প-কারখানায় কর্মরত শ্রমিকদের স্বাস্থ্য ভালো ও নিরাপদ কর্মপরিবেশ থাকলে তাঁদের উৎপাদন ক্ষমতা অনেক বৃদ্ধি পায়। এতে মালিকরা উপকৃত হবেন এই বিষয়টি উপলব্ধি করে পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তার জন্য শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মালিকদের নির্দিষ্ট পরিমাণ বরাদ্দ রাখতে হবে। এটা বিশ্বজনীন স্বীকৃত সত্য যে, শিল্পে কর্মরত শ্রমিক সুস্থ ও নিরাপদ থাকলে শিল্পের উৎপাদন ক্ষমতা বাড়বে। পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা ব্যয় কোনো খরচ নয় বরং বিনিয়োগ, এই উপলব্ধি বাংলাদেশের শিল্প মালিকদের মধ্যে এখনো গড়ে ওঠেনি। অথচ ইতিহাস বলে শ্রমজীবী মানুষের অবদানের জন্যই শিল্প ও কৃষি বিপ্লব হয়েছে। তাই শ্রমিকদের অনাস্থায় নিয়ে নয়, আস্থায় নিয়েই শিল্পের উন্নয়ন ও বিকাশ সম্ভব। আমাদের দেশের সাধারণ শ্রমিকরা কাজে দক্ষ এবং মেধার ক্ষেত্রে অতুলনীয়। শ্রমিকরা জানেন শিল্প-কারখানার সঙ্গে মানুষের রুটি-রুজির সম্পর্ক এক ও অভিন্ন। তাই শিল্প-কারখানার ক্ষতি কোনোভাবেই শ্রমিকরা চান না।</p> <p>জাতির প্রত্যাশা, একজন দেশপ্রেমিক শিল্প উদ্যোক্তা অবশ্যই শিল্প, শ্রমিক ও দেশের স্বার্থ দেখবেন। কিন্তু আমাদের দেশের মালিকরা এসব ভাবেন না। তাঁরা ভাবেন কিভাবে সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলবেন। তাই দেশে শিল্প বিকাশের পরিবর্তে গড়ে উঠেছে বিদেশি পণ্যের বাজার। এ জন্য মালিকদের বৈরী দৃষ্টিভঙ্গির পাশাপাশি সরকারের নীতিও দায়ী, যা কোনোভাবেই কাম্য নয়।</p> <p>দ্রব্যমূল্যের ক্রমবর্ধমান ঊর্ধ্বগতিসহ বিভিন্ন কারণে বর্তমানে দেশের মানুষ এক অসহায় অবস্থায় দিন যাপন করছে। উদ্ভূত পরিস্থিতি উত্তরণে স্থায়ী মজুরি কমিশন গঠন করে সব সেক্টরের শ্রমিকদের মজুরি নির্ধারণের জন্য মজুরি কমিশনের অধীনে প্রয়োজনীয় সংখ্যক মজুরি বোর্ড গঠন করে জীবনধারণ উপযোগী মজুরি ঘোষণা এবং সর্বজনীন রেশনিং প্রথা চালু করে গার্মেন্ট, ট্যানারি, নির্মাণ, পরিবহন, হকার্সসহ গ্রাম-শহরের সব শ্রমজীবী মানুষকে সস্তা ও বাঁধা দরে চাল, ডাল, তেল, আটা, শিশু খাদ্যসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি প্রদান সংবিধান, আইএলও কনভেনশন ও শ্রমনীতি অনুসারে অবাধ ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার নিশ্চিত করাসহ শ্রম আইন সংশোধন ও কার্যকর করা প্রয়োজন। একই সঙ্গে দুর্নীতি ও অপচয় রোধ করে রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল, চিনিকল, সুতাকল ও বস্ত্রকল অধুনিকায়ন করে রাষ্ট্রীয় মালিকানায় চালু, নারী-পুরুষের বৈষম্য দূর করা এবং সমকাজে সমমজুরি, সামাজিক মর্যাদা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা প্রয়োজন।</p> <p>আমাদের দেশের অর্থনীতি, জাতীয় শিল্প এবং শ্রমশক্তিকে বাঁচাতে হলে প্রয়োজন দেশপ্রেম। দেশে যে জনশক্তি ও সম্পদ রয়েছে, সেটা পরিকল্পিতভাবে কাজে লাগিয়ে সার্বিক উন্নয়ন সম্ভব। যে উন্নয়নে শ্রমজীবী মানুষের স্বার্থরক্ষা, সেই কাজে শ্রমজীবী মানুষ তাঁদের সর্বস্ব দিয়ে কাজ করতে প্রস্তুত। বিনিময়ে শ্রমিকরা চান ন্যায্য মজুরি, সামাজিক মর্যাদা ও নিরাপদ কর্মপরিবেশ, যার মাধ্যমে একজন শ্রমিক তাঁর পরিবার-পরিজন নিয়ে মৌলিক চাহিদা মেটাতে পারেন।</p> <p>শ্রমিকরা তাঁদের মৌলিক অধিকারের স্বীকৃতি চান। বিশ্ব ইতিহাসের শিক্ষা এটা যে শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার প্রদানের মাধ্যমে তাঁদের আস্থায় নিয়ে শিল্প বিকাশ এবং উৎপাদন বৃদ্ধি করা সম্ভব। এর মাধ্যমেই জাতীয় অর্থনীতি সুদৃঢ় হবে। তবেই শিল্প, শ্রমিক, দেশ ও জাতি সমৃদ্ধ হবে।</p> <p>লেখক : সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র (টিইউসি)</p> <p> </p>