হৃদরোগ ও স্ট্রোকের ঝুঁকি কমাতে পারে কফি

ডা. শাহজাদা সেলিম
ডা. শাহজাদা সেলিম
শেয়ার
হৃদরোগ ও স্ট্রোকের ঝুঁকি কমাতে পারে কফি

বিশ্বের অন্যতম জনপ্রিয় পানীয় কফি। ব্যক্তি, জাতি, লিঙ্গ বা সাংস্কৃতিক পটভূমি নির্বিশেষে ব্যাপকভাবে এটি খাওয়া হয়ে থাকে। কেননা মানসিক উদ্দীপনাকারক ও শারীরিক শক্তিকারক হিসেবে এটি সুনাম অর্জন করছে শত শত বছর ধরে। এর সহজলভ্যতা এবং ব্যাপক ব্যবহার স্বাস্থ্যের ওপর এটির সামগ্রিক প্রভাব ফেলেছে।

ইউরোপীয়দের মতো মার্কিনরা প্রতিবছর আনুমানিক ৫.১ কেজি কফি পান করে থাকে। কফির একটি প্রধান উপাদান ক্যাফেইনের পরিমাণ ৩০ মিলিগ্রাম থেকে ১৭৫ মিলিগ্রামের মধ্যে পরিবর্তিত হয় কফির কাপভেদে। ক্যাফেইনের উদ্দীপক প্রভাব অ্যাডেনোসিন রিসেপ্টরগুলোর বিরোধিতা দ্বারা সৃষ্ট হয়, একটি সুপরিচিত প্রতিরোধক নিউরোমোডুলেটর অ্যাডেনোসিনের প্রভাবকে কার্যকরভাবে বাধা দেয়।

কফি খাওয়ার বিষয়ে সাম্প্রতিক (২০০০- ২১) গবেষণার প্রকাশনার পরিপ্রেক্ষিতে কার্ডিওভাসকুলার স্বাস্থ্যের ওপর কফি খাওয়ার প্রভাব পর্যালোচনায় কফি পান এবং কার্ডিওভাসকুলার রোগ সম্পর্কিত মৃত্যুহার ও অসুস্থতার মধ্যে ইতিবাচক সংযোগের ধারণা পাওয়া যায়।

 

কফি পানের উপকারিতা 

অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট বৈশিষ্ট্য : কফি অ্যান্টি-অক্সিডেন্টেসমৃদ্ধ, যা শরীরের অক্সিডেটিভ স্ট্রেস ও প্রদাহের বিরুদ্ধে লড়াই করতে সাহায্য করতে পারে, উভয়ই কার্ডিওভাসকুলার রোগের ঝুঁকির কারণ।

উন্নত এন্ডোথেলিয়াল ফাংশন : কিছু গবেষণা ইঙ্গিত করে যে কফি এন্ডোথেলিয়ামের কার্যকারিতা বাড়াতে পারে, যা রক্তনালির স্বাস্থ্য ও রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

রক্তচাপের ওপর সম্ভাব্য প্রভাব : যদিও ক্যাফেইন সাময়িকভাবে রক্তচাপ বাড়াতে পারে, গবেষণায় দেখা যায় যে নিয়মিত কফি পানকারীদের সহনশীলতা তৈরি হতে পারে, যার ফলে রক্তচাপের ওপর কোনো উল্লেখযোগ্য দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়ে না।

হৃদরোগের ঝুঁকি হ্রাস : পরিমিত কফি খাওয়ার সঙ্গে হৃদরোগের ঝুঁকি হ্রাসের সম্পর্ক রয়েছে।

কিছু গবেষণায় পরামর্শ দেওয়া হয়েছে যে প্রতিদিন তিন থেকে পাঁচ কাপ কফি পান করা হার্টসংক্রান্ত সমস্যাগুলোর ঝুঁকি হ্রাস করতে পারে।

স্ট্রোকের ঝুঁকি হ্রাস : মাঝারি কফি খাওয়ার সঙ্গে স্ট্রোকের ঝুঁকি কম হওয়ার সঙ্গে যুক্ত করা যায়। যদিও স্বাস্থ্যগত কারণ এবং জেনেটিকসের ওপর ভিত্তি করে এটা পরিবর্তিত হতে পারে।

টাইপ ২ ডায়াবেটিস সংযোগ : এমন কিছু প্রমাণ পাওয়া গেছে যে কফি পানকারীদের টাইপ ২ ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকি কম হতে পারে, যা কার্ডিওভাসকুলার রোগের ঝুঁকির কারণ।

মানসিক স্বাস্থ্য ও স্ট্রেস : মেজাজ ও বুদ্ধিবৃত্তিক কর্মকাণ্ডের ওপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে কফি।

স্বাস্থ্যকর জীবনধারা প্রচার করে এবং চাপ কমিয়ে পরোক্ষভাবে হৃদরোগের স্বাস্থ্যকে উপকৃত করে। যদিও মাঝারি কফি পান (প্রতিদিন তিন-চার কাপ) এই সুবিধাগুলো দিতে পারে। তবে কফি পানে কার্ডিয়াক অ্যারিথমিয়াস (অস্বাভাবিক হৃত্স্পন্দন/ বুক ধড়ফড়ানি) হলে এর থেকে বিরত থাকা উচিত।

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক

এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগ

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়

মন্তব্য

সম্পর্কিত খবর

শিশুকে স্মার্টফোন থেকে দূরে রাখুন

অধ্যাপক ডা. গোপেন কুমার কুণ্ডু
অধ্যাপক ডা. গোপেন কুমার কুণ্ডু
শেয়ার
শিশুকে স্মার্টফোন থেকে দূরে রাখুন
শিশুদের হাতে স্মার্টফোন দেওয়া অনুচিত। ছবি : সংগৃহীত

প্রযুক্তির এক বিস্ময়কর সৃষ্টি স্মার্টফোন। আজকাল অনেকেই শিশুর হাতে এ যন্ত্রটি দিয়ে নিজেদের কর্ম সম্পাদন করছেন। শিশুকে খাওয়ানোর সময় এই ডিভাইস ব্যবহার করা হয় বেশি। একসময় শিশুর মধ্যে এমন অভ্যাস তৈরি হয়, এটা ছাড়া শিশুকে খাওয়ানোই সম্ভব হয় না।

এতে কারো কারো স্ক্রিন ডিপেনডেন্সি ডিস-অর্ডারও হতে পারে। এর ফলে দেখা দেয় বেশ কিছু শারীরিক সমস্যা—ঘুমের অসুবিধা, পিঠ ও কোমর ব্যথা, মাথা ব্যথা, চোখের জ্যোতি কমে যাওয়া, ওজন বেড়ে যাওয়া, পুষ্টিহীনতা ইত্যাদি। কারো কারো মধ্যে ইমোশনাল উপসর্গ, যেমন—উদ্বিগ্নতা, অসততা, একাকিত্ব, দোষী বোধ ইত্যাদিও হতে পারে। শিশুর বাইরে যাওয়ার প্রবণতাও কমে যায়।

স্মার্টফোন সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করে দুই থেকে পাঁচ বছর বয়সী শিশুরা। অথচ শিশুর মস্তিষ্কের বিকাশের উপযুক্ত সময় এটি। মস্তিষ্কের স্বাভাবিক বিকাশ হলো শিশুর ক্রমে ক্রমে এক থেকে পাঁচ বছরের মধ্যে কথা বলতে শেখা, হাঁটাচলা শেখা এবং স্বাভাবিক বুদ্ধির বিকাশ হওয়া। আর এই সময় শিশুর একদিকে দীর্ঘ সময়ে মোবাইল গেম খেলা, ইউটিউব দেখা, অন্যদিকে স্বাভাবিক উদ্দীপনামূলক খেলাধুলা না করায় শিশুর স্নায়বিক বিকাশ মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়।

শিশুর মস্তিষ্কের বিকাশ নির্ভর করে পরিবেশ ও অন্যান্য শিশুর সঙ্গে ভাবের আদান-প্রদানের ওপর। বলা হয়, শিশু শেখে দেখতে দেখতে এবং অন্যদের সঙ্গে খেলতে খেলতে।

অধিক সময় শিশু মাল্টিমিডিয়ার সংস্পর্শে থাকায় মা-বাবার সঙ্গে তার সামাজিক যোগাযোগ এবং সমবয়সী শিশুর সঙ্গে খেলাধুলা ও মেলামেশা একেবারেই কমে যায়। শিশুর বিকাশের প্রারম্ভে অত্যধিক মোবাইল ফোনের ব্যবহার শিশুর মস্তিষ্কের গঠন প্রকৃতির ভিন্নতা বদলে দেওয়ার কথাও উল্লেখ করেছেন গবেষকরা।

শিশুদের ইলেকট্রনিক মিডিয়া ব্যবহারের ক্ষেত্রে সর্বসম্মতিক্রমে নিম্নরূপ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে আমেরিকান একাডেমি অব পেডিয়াট্রিকস ও টেলিভিশন কমিটি—

♦ দুই থেকে পাঁচ বছর বয়সের শিশুরা সারা দিনে দু-এক ঘণ্টা স্ক্রিন দেখতে পারবে, কিন্তু মানসম্মত প্রোগ্রাম হতে হবে।

♦ দুই বছরের কম বয়সী শিশুদের হাতে মোবাইল তুলে দিতে একেবারেই নিরুৎসাহিত করা হয়েছে।

♦ শিশুদের বেডরুমে টেলিভিশন না রাখার পরামর্শও দেওয়া হয়েছে।

♦ শিশুর বিকাশের ক্ষেত্রে কিছু উদ্দীপনাকে উৎসাহিত করেছে তারা, যেমন—শিশুর সঙ্গে অভিভাবকের কথা বলা, গল্প করা, ছড়া বলা, গান করা ইত্যাদি।

 

অভিভাবকের করণীয়

♦ মা-বাবার সচেতনতাই শিশুর মোবাইল ফোন ব্যবহার কমাতে পারে।

♦ মোবাইল ফোন বাদ দিয়ে শিশুদের বই পড়ার প্রতি আগ্রহী করে তুলতে হবে।

♦ সৃজনশীল কাজ যেমন—ছবি আঁকা, গল্প করা, গান করা, পাজল খেলা, লুডু খেলা ইত্যাদিতে উদ্বুদ্ধ করতে হবে।

♦ সম্ভব হলে এসব খেলায় মা-বাবার অংশগ্রহণও শিশুর মোবাইল ফোন ব্যবহার কমাতে পারে।

লেখক : সাবেক চেয়ারম্যান

শিশু নিউরোলজি বিভাগ, বিএসএমএমইউ

 

 

মন্তব্য

ডেন্টাল ইমপ্লান্টের যত্ন

    ডেন্টাল ইমপ্লান্ট যাতে দীর্ঘ মেয়াদেও কার্যকর থাকে, সে জন্য প্রয়োজন যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ। কিছু প্রয়োজনীয় টিপস দিয়েছেন ডা. অনুপম পোদ্দার
শেয়ার
ডেন্টাল ইমপ্লান্টের যত্ন

দন্তক্ষয়, মাড়ির রোগ, দাঁতে সরাসরি আঘাত, অথবা অন্য কোনো রোগের চিকিৎসায় দাঁত প্রতিস্থাপনের প্রয়োজন হতে পারে। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, দাঁত প্রতিস্থাপনের বিভিন্ন পদ্ধতির মধ্যে ডেন্টাল ইমপ্লান্টের সাফল্যের হার সবচেয়ে বেশি, টেকসইও বটে। তাই এর জনপ্রিয়তা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। ডেন্টাল ইমপ্লান্ট যাতে দীর্ঘ মেয়াদেও কার্যকর থাকে, সে জন্য প্রয়োজন যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ ও যত্ন।

এ জন্য কিছু প্রয়োজনীয় টিপস আলোচনা করা হলো। নির্দেশনাগুলো মেনে চললে রোগীর পাশাপাশি উপকৃত হবেন জেনারেল ডেন্টাল ফিজিশিয়ানরাও।

 

নিয়মিত ব্রাশ ও ফ্লস করুন

মুখগহ্বরের স্বাস্থ্য ও ইমপ্লান্টের দীর্ঘায়ু নিশ্চিত করার জন্য প্রতিদিন সকালে ও রাতে দাঁত ব্রাশ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পাশাপাশি রাতে ফ্লস করাও জরুরি।

নরম ব্রিসলযুক্ত টুথব্রাশ এবং ফ্লোরাইডযুক্ত  টুথপেস্ট ব্যবহার করে দিনে দুইবার দাঁত ও ইমপ্লান্ট ব্রাশ করুন। প্রতিবার ব্রাশ করতে হবে কমপক্ষে দুই মিনিট। এর পরও ইমপ্লান্টের আশপাশে জমে থাকতে পারে অল্পবিস্তর খাদ্যকণা বা ডেন্টাল প্লাক। এটি অপসারণ করতে রাতে একবার ডেন্টাল ফ্লস বা ইন্টারডেন্টাল ব্রাশ ব্যবহার করুন।
ইমপ্লান্টের সুস্থতায় ফ্লসটি হওয়া উচিত নন-ওয়াক্স অর্থাৎ মোমহীন।

 

ধূমপান ও অ্যালকোহল এড়িয়ে চলুন

দাঁতের স্বাস্থ্যের জন্য ধূমপান ও অ্যালকোহল গ্রহণ অত্যন্ত ক্ষতিকর। সময়ের সঙ্গে এটি হতে পারে ইমপ্লান্ট নষ্টের কারণ। তামাকের নিকোটিন এবং অন্যান্য রাসায়নিক মাড়িতে রক্তপ্রবাহ কমায়, ফলে অক্সিজেন সরবরাহে ঘাটতি হতে পারে। এতে ইমপ্লান্ট সার্জারির পর নিরাময়প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়।

ইমপ্লান্টের ও আশপাশের দাঁতেও ধূমপানের ফলে দাগ পড়তে পারে।

 

খান স্বাস্থ্যকর খাবার

স্বাস্থ্যকর ও সুষম খাদ্য গ্রহণ ইমপ্লান্ট এবং মুখের সামগ্রিক স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী। চিকিৎসকের নিষেধ না থাকলে প্রতিদিনের খাবার তালিকায় প্রোটিন, ক্যালসিয়াম ও ভিটামিনসমৃদ্ধ খাবার অন্তর্ভুক্ত করুন; যেমন—দুগ্ধজাত দ্রব্য, মাছ, সবুজ শাক-সবজি, বাদাম ও রসালো ফলমূল। দৈনিক ৮-১০ গ্লাস পানি পান করুন। চিনিযুক্ত ও অ্যাসিডিক পানীয়, মিষ্টি ফলমূল, যেমন—খেজুর ও কিশমিশ এড়িয়ে চলুন। এতে দাঁতের এনামেল ক্ষয়ের পাশাপাশি ইমপ্লান্টেরও ক্ষতি হতে পারে।

 

বছরে অন্তত দুইবার ডেন্টিস্টের পরামর্শ নিন

ইমপ্লান্টের স্বাস্থ্য ও স্থিতিশীলতা নিরীক্ষণের জন্য নিয়মিত দেখভাল অপরিহার্য। চেকআপের সময় খালি চোখে দেখার পাশাপাশি এক্স-রে করেও ইমপ্লান্ট পরীক্ষা করবেন দন্ত চিকিৎসক। দাঁত পরিষ্কার, অর্থাৎ স্কেলিং ও রুট প্লানিংও প্রয়োজন, যাতে কোনো টারটার বা দন্তপাথরি তৈরি না হয়। যদি কোনো সমস্যা শনাক্ত করা হয়, দাঁতের ডাক্তার তাড়াতাড়ি পদক্ষেপ নেবেন এবং যাতে ইমপ্লান্টের আরো ক্ষতি না হয় সে জন্য সময়মতো প্রয়োজনীয়  চিকিৎসা দেবেন।

 

খেলাধুলার জন্য মাউথগার্ড ব্যবহার করুন

যাঁরা খেলাধুলা করেন বা এমন কোনো শারীরিক কার্যকলাপে লিপ্ত হন, যাতে মুখে আঘাত আসতে পারে, তাহলে মাউথগার্ড পরতে হবে। এতে ইমপ্লান্ট ও আশপাশের দাঁত থাকবে সুরক্ষিত, ইমপ্লান্ট নষ্ট হওয়ার ও দাঁতের ক্ষতির ঝুঁকি অনেকটাই কমবে।

 

ইমপ্লান্টে কোনো পরিবর্তন বা ব্যবহারে অস্বস্তি অনুভূত হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন

যদি আপনার ইমপ্লান্টের চারপাশে কোনো পরিবর্তন বা অস্বস্তি বোধ হয়, যেমন—ফুলে যাওয়া, ব্যথা বা রক্তপাত, তাহলে অনতিবিলম্বে দাঁতের ডাক্তারের সঙ্গে যোগাযোগ করুন। এই লক্ষণগুলো সংক্রমণ, প্রদাহ বা অন্যান্য সমস্যা নির্দেশ করতে পারে। সঠিক চিকিৎসার মাধ্যমে তাই সময়মতো হস্তক্ষেপ জরুরি। সমস্যাগুলো উপেক্ষা করলে ইমপ্লান্ট নষ্ট হওয়ার পাশাপাশি মুখের স্বাস্থ্যেও জটিলতা দেখা দিতে পারে।

ডেন্টাল ইমপ্লান্টের দীর্ঘমেয়াদি সাফল্যের জন্য সঠিক রক্ষণাবেক্ষণ ও যত্ন গুরুত্বপূর্ণ। এই টিপসগুলো অনুসরণ করে সুস্থ ও কার্যকর ইমপ্লান্ট দীর্ঘদিন কার্যকর রাখা যাবে।

লেখক : অধ্যক্ষ

খুলনা ডেন্টাল কলেজ

 

মন্তব্য

জরায়ুমুখ ক্যান্সার : লজ্জা নয়, চাই প্রতিরোধ

    ৩৫ থেকে ৫৫ বছর বয়সী নারীদের মধ্যে বেশি দেখা যায় জরায়ুমুখ ক্যান্সার। বিশ্বব্যাপী এই রোগে মোট মৃত্যুর ৯০ শতাংশই ঘটে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল, মধ্যম আয় ও অনুন্নত দেশগুলোতে। রোগটির প্রতিরোধ ও চিকিৎসায় করণীয় জানাচ্ছেন ডা. নাদিরা হক
শেয়ার
জরায়ুমুখ ক্যান্সার : লজ্জা নয়, চাই প্রতিরোধ
ক্যান্সার চিকিৎসায় ব্যবহৃত রেডিওথেরাপি মেশিন। ছবি : সংগৃহীত

নারীদের অকালমৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ সার্ভাইক্যাল বা জরায়ুমুখ ক্যান্সার। বিশ্বব্যাপী নারীদের ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়া ও মৃত্যুহারের দিক থেকে চতুর্থ অবস্থানে আছে জরায়ুমুখ ক্যান্সার। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) ক্যান্সার গবেষণা বিষয়ক আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান আইএআরসির সর্বশেষ ২০২০ সালের গ্লোবোক্যান প্রতিবেদন অনুসারে, জরায়ুমুখ ক্যান্সারে আক্রান্তের দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান পঞ্চম।

বছরে নতুন করে আক্রান্ত হয় আট হাজার ২৬৮ জন এবং মারা যায় চার হাজার ৯৭১ জন।

এই হিসাবে দেশে ক্যান্সারে আক্রান্ত নারীদের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ মৃত্যুর কারণ এই রোগ।

 

যেভাবে হয় এই ক্যান্সার

জরায়ুমুখের কোষগুলোর অস্বাভাবিক বৃদ্ধির ফলে সৃষ্টি হয় ক্যান্সার। সুস্থ কোষ বিভিন্ন কারণেই পরিবর্তিত হয়ে ক্যান্সার কোষে

রূপান্তরিত হতে পারে। এটি বেশ সময়সাপেক্ষ প্রক্রিয়া, বেশ কিছু বছর পার হয়ে যায় রোগের উপসর্গ ছাড়াই।

জরায়ুমুখে অনেক দিন ধরে থাকতে পারে ক্যান্সারপূর্ব অবস্থা। জরায়ুমুখ সরাসরি দেখার উপায় নেই, তাই ক্যান্সারপূর্ব অবস্থা সহজেই নজর এড়িয়ে যায়।

 

কারণ

৩৫ বছর এবং ৫০ থেকে ৫৫ বছর বয়সী নারীদের মধ্যে রোগটি বেশি দেখা দেয়। এর সুনির্দিষ্ট একক কোনো কারণ অবশ্য এখন পর্যন্ত জানা যায়নি।

তবে হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাসকে (এইচপিভি) জরায়ুমুখ ক্যান্সারের জন্য দায়ী করা হয়। শুধু অনিরাপদ শারীরিক সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমেই এটি ছড়ায়। জরায়ুমুখের সুস্থ কোষে প্রবেশ করে সৃষ্টি করে ক্যান্সার। এইচপিভি ভাইরাসের ১৩০টি ধরন এ পর্যন্ত শনাক্ত করা হয়েছে। এইচপিভি ১৬, এইচপিভি ১৮ প্রজাতিই ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ জরায়ুমুখ ক্যান্সারের জন্য দায়ী।

 

যারা বেশি ঝুঁকিতে

♦ নিরাপদ যৌন সম্পর্ক ও প্রজনন স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতনতার অভাব যাদের

♦ বাল্যবিবাহ হলে

♦ অল্প বয়সে, লম্বা সময়ের পর অথবা স্বল্প বিরতিতে গর্ভধারণ করলে

♦ বহুগামিতা

♦ দীর্ঘদিন জন্ম নিয়ন্ত্রণের ওষুধ সেবন করলে

♦ ধূমপায়ী

 

লক্ষণ

প্রাথমিক পর্যায়ে জরায়ুমুখ ক্যান্সারের লক্ষণ প্রকাশ না পেলেও ধীরে ধীরে নিম্নলিখিত উপসর্গগুলো দেখা দেয়—

♦ যোনিপথে অতিরিক্ত সাদা স্রাব

♦ বাদামি বা রক্তমিশ্রিত স্রাবের আধিক্য

♦ অনিয়মিত রক্তস্রাব

♦ সহবাসের পর রক্তক্ষরণ

♦ ঋতুস্রাব স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর আবার রক্তক্ষরণ

♦ তলপেটে বা কোমরে ব্যথা

 

পরীক্ষা

জরায়ুমুখ ক্যান্সার প্রতিরোধযোগ্য। এ জন্য স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়ে কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করালে ক্যান্সারের পূর্বাবস্থা সহজেই শনাক্ত করা যায়। এর মধ্যে আছে ভিজ্যুয়াল ইন্সপেকশন অব সার্ভিক্স (ভিআইএ) পরীক্ষা, প্যাপ স্মিয়ার টেস্ট, কোলপোস্কোপি, এইচপিভি ডিএনএ পরীক্ষা প্রভৃতি।

সারা বিশ্বে প্যাপস টেস্ট জরায়ুমুখ ক্যান্সার স্ক্রিনিংয়ের জন্য ‘গোল্ড স্ট্যান্ডার্ড’ প্রক্রিয়া বলে বিবেচিত। তবে বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল দেশগুলোতে সহজলভ্য পদ্ধতি হিসেবে ভিআইএর মতো পরীক্ষাকেই জাতীয় পর্যায়ে উৎসাহিত করা হচ্ছে।

ভিআইএ ও প্যাপস পরীক্ষার মাধ্যমে জরায়ুমুখ ক্যান্সারের পূর্বাবস্থা শনাক্ত হওয়ার পর কোলপোস্কোপির সাহায্যে বায়োপসি নিয়ে ক্যান্সারের পূর্বাবস্থা আছে কি না তা নিশ্চিত হওয়া সম্ভব। এরপর সঠিক চিকিৎসা নিলে রোগ শতভাগ নিরাময় সম্ভব। স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞরা যদি পরীক্ষার সময় খালি চোখেই জরায়ুমুখে কোনো বাড়তি অংশ বা ক্ষত দেখতে পান, তখনো বায়োপসি নিয়ে হিস্টোপ্যাথলজি পরীক্ষার মাধ্যমে জরায়ুমুখ ক্যান্সারের ধরন সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়।

 

কোন বয়সে স্ক্রিনিং

জরায়ুমুখ ক্যান্সার রুখতে হলে ৩০ থেকে ৬০ বছর বয়সী নারীদের তিন বছর পর পর ভিআইএ-এর সাহায্যে জরায়ুমুখ পরীক্ষা করা উচিত। ১৮ বছরের আগে যাঁদের বিয়ে হয়েছে তাঁদের বয়স ২৫ হলেই জরায়ুমুখ পরীক্ষা করানো জরুরি। বিয়ের স্থায়িত্ব ১০ বছরের বেশি হলে এবং নিজের বয়স ৩০ বছরের কম হলেও জরায়ুমুখ পরীক্ষা করানো উচিত।

এ ধরনের পরীক্ষা নির্বাচিত ইউনিয়ন স্বাস্থ্য পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র, নির্বাচিত উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, জেলা সদর হাসপাতাল, সব সরকারি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, জাতীয় ক্যান্সার হাসপাতাল, বাংলাদেশ মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়সহ আপনার আশপাশের বিভিন্ন হাসপাতালে করানো যায় অতিরিক্ত খরচ ছাড়াই।

 

চিকিৎসা পদ্ধতি

রোগীকে সম্পূর্ণ অজ্ঞান করে শারীরিক পরীক্ষার মাধ্যমে জরায়ুমুখ ক্যান্সারের বিস্তৃতি অনুধাবন করা হয়। পাশাপাশি করা হয় জরায়ুমুখ থেকে বায়োপসি স্যাম্পল নিয়ে হিস্টোপ্যাথলজিক্যাল গ্রেডিং। এরপর ক্যান্সারের পর্যায় অনুযায়ী এর বিভিন্ন মেয়াদি ও ধরনের চিকিৎসা নির্ধারণ করেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক।

ক্যান্সারের বিভিন্ন পর্যায়

পর্যায় ১ : ক্যান্সার শুধু জরায়ুমুখে সীমাবদ্ধ

পর্যায় ২ : জরায়ুমুখের সঙ্গে যোনিপথের ওপরের অংশেও কিছুটা ছড়িয়েছে ক্যান্সার

পর্যায় ৩ : যখন ক্যান্সার জরায়ুমুখের সঙ্গে যোনিপথের নিচের অংশে ও আশপাশে ছড়ায়

পর্যায় ৪ : ক্যান্সার যখন জরায়ুমুখের সঙ্গে মূত্রথলি, মলদ্বার অথবা আরো দূরবর্তী প্রত্যঙ্গ, যেমন—কলিজা, ফুসফুস, এমনকি মস্তিষ্কেও ছড়িয়ে যায়।

জরায়ুমুখ ক্যান্সারের প্রতিটি পর্যায়ের চিকিৎসাই রেডিওথেরাপির মাধ্যমে করা সম্ভব। তবে প্রথম ও দ্বিতীয় পর্যায়ে শনাক্ত হলে অস্ত্রোপোচার করেই রোগ নিরাময় সম্ভব। অ্যাডভান্সড স্টেজে কেমো ও রেডিয়েশনের মাধ্যমে চিকিৎসা করা হয়। জরায়ুমুখ ক্যান্সারের চিকিৎসা সম্পূর্ণ হওয়ার পরও নির্দিষ্ট বিরতিতে রোগীকে সারা জীবন সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে থাকতে হয়।

 

প্রতিরোধে করণীয়

জরায়ুমুখ ক্যান্সার প্রতিরোধে কিছু বিষয়ে সতর্কতা প্রয়োজন; যেমন—

♦ প্রতিষেধক টিকা গ্রহণ করা : কিশোরী বয়সে জরায়ুমুখ ক্যান্সার প্রতিরোধের ভ্যাকসিন নিলে এবং কিছু নিয়ম-কানুন মেনে চললে এই ক্যান্সার প্রতিরোধ করা সম্ভব।

♦ বাইভ্যালেন্ট ভ্যাকসিন : ২টি ভাইরাসের বিরুদ্ধে কাজ করে এই ভ্যাকসিন।

♦ কোয়াড্রিভ্যালেন্ট ভ্যাকসিন : ৪টি ভাইরাসের বিরুদ্ধে যখন কাজ করে সেটি কোয়াড্রিভ্যালেন্ট ভ্যাকসিন।

♦ নোনাভ্যালেন্ট ভ্যাকসিন : ৯টি ভাইরাসের বিরুদ্ধে যখন কাজ করে সেটি হচ্ছে নোনাভ্যালেন্ট ভ্যাকসিন।

♦ আমাদের দেশে বাজারে পাওয়া যায় বাইভ্যালেন্ট ভ্যাকসিন। সরকারিভাবে যেটা ৯ থেকে ১৫ বছর বয়সের কিশোরীদের বিনামূল্যে দেওয়া হচ্ছে সেটি কোয়াড্রিভ্যালেন্ট ভ্যাকসিন। ৯ থেকে ৪৫ বছরের নারীরা এই প্রতিষেধক টিকা নিতে পারেন। তবে ৯ থেকে ২০ বছর পর্যন্ত (বিবাহ-পূর্ব সময়ে) যৌন সম্পর্ক স্থাপনের আগের সময়টাই টিকা নেওয়ার উপযুক্ত সময়।

♦ ৩০ থেকে ৬০ বছর বয়সী সব নারীর ক্যান্সার স্ক্রিনিং কর্মসূচির আওতায় থেকে তিন বছর পর পর জরায়ুমুখ পরীক্ষা করা।

♦ বাল্যবিবাহ রোধ করে অধিক সন্তান নেওয়া থেকে বিরত থাকা।

♦ নারীদের নিরাপদ যৌন সম্পর্ক ও প্রজনন স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতন থাকা।

♦ সঠিক জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহার।

 

মূলকথা, সচেতনতা ও সঠিক সময়ে টিকা গ্রহণ করলে জরায়ুমুখ ক্যান্সার থেকে মুক্ত থাকা সম্ভব।

 

 

লেখক : বিভাগীয় প্রধান, গাইনি অ্যান্ড অবস, কুয়েত মৈত্রী হাসপাতাল, ঢাকা

মন্তব্য

চশমা পরিষ্কারের সঠিক উপায়

শেয়ার

সর্বশেষ সংবাদ