যারা বেশি ঝুঁকিতে
♦ নিরাপদ যৌন সম্পর্ক ও প্রজনন স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতনতার অভাব যাদের
♦ বাল্যবিবাহ হলে
♦ অল্প বয়সে, লম্বা সময়ের পর অথবা স্বল্প বিরতিতে গর্ভধারণ করলে
♦ বহুগামিতা
♦ দীর্ঘদিন জন্ম নিয়ন্ত্রণের ওষুধ সেবন করলে
♦ ধূমপায়ী
লক্ষণ
প্রাথমিক পর্যায়ে জরায়ুমুখ ক্যান্সারের লক্ষণ প্রকাশ না পেলেও ধীরে ধীরে নিম্নলিখিত উপসর্গগুলো দেখা দেয়—
♦ যোনিপথে অতিরিক্ত সাদা স্রাব
♦ বাদামি বা রক্তমিশ্রিত স্রাবের আধিক্য
♦ অনিয়মিত রক্তস্রাব
♦ সহবাসের পর রক্তক্ষরণ
♦ ঋতুস্রাব স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর আবার রক্তক্ষরণ
♦ তলপেটে বা কোমরে ব্যথা
পরীক্ষা
জরায়ুমুখ ক্যান্সার প্রতিরোধযোগ্য। এ জন্য স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়ে কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করালে ক্যান্সারের পূর্বাবস্থা সহজেই শনাক্ত করা যায়। এর মধ্যে আছে ভিজ্যুয়াল ইন্সপেকশন অব সার্ভিক্স (ভিআইএ) পরীক্ষা, প্যাপ স্মিয়ার টেস্ট, কোলপোস্কোপি, এইচপিভি ডিএনএ পরীক্ষা প্রভৃতি।
সারা বিশ্বে প্যাপস টেস্ট জরায়ুমুখ ক্যান্সার স্ক্রিনিংয়ের জন্য ‘গোল্ড স্ট্যান্ডার্ড’ প্রক্রিয়া বলে বিবেচিত। তবে বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল দেশগুলোতে সহজলভ্য পদ্ধতি হিসেবে ভিআইএর মতো পরীক্ষাকেই জাতীয় পর্যায়ে উৎসাহিত করা হচ্ছে।
ভিআইএ ও প্যাপস পরীক্ষার মাধ্যমে জরায়ুমুখ ক্যান্সারের পূর্বাবস্থা শনাক্ত হওয়ার পর কোলপোস্কোপির সাহায্যে বায়োপসি নিয়ে ক্যান্সারের পূর্বাবস্থা আছে কি না তা নিশ্চিত হওয়া সম্ভব। এরপর সঠিক চিকিৎসা নিলে রোগ শতভাগ নিরাময় সম্ভব। স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞরা যদি পরীক্ষার সময় খালি চোখেই জরায়ুমুখে কোনো বাড়তি অংশ বা ক্ষত দেখতে পান, তখনো বায়োপসি নিয়ে হিস্টোপ্যাথলজি পরীক্ষার মাধ্যমে জরায়ুমুখ ক্যান্সারের ধরন সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়।
কোন বয়সে স্ক্রিনিং
জরায়ুমুখ ক্যান্সার রুখতে হলে ৩০ থেকে ৬০ বছর বয়সী নারীদের তিন বছর পর পর ভিআইএ-এর সাহায্যে জরায়ুমুখ পরীক্ষা করা উচিত। ১৮ বছরের আগে যাঁদের বিয়ে হয়েছে তাঁদের বয়স ২৫ হলেই জরায়ুমুখ পরীক্ষা করানো জরুরি। বিয়ের স্থায়িত্ব ১০ বছরের বেশি হলে এবং নিজের বয়স ৩০ বছরের কম হলেও জরায়ুমুখ পরীক্ষা করানো উচিত।
এ ধরনের পরীক্ষা নির্বাচিত ইউনিয়ন স্বাস্থ্য পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র, নির্বাচিত উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, জেলা সদর হাসপাতাল, সব সরকারি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, জাতীয় ক্যান্সার হাসপাতাল, বাংলাদেশ মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়সহ আপনার আশপাশের বিভিন্ন হাসপাতালে করানো যায় অতিরিক্ত খরচ ছাড়াই।
চিকিৎসা পদ্ধতি
রোগীকে সম্পূর্ণ অজ্ঞান করে শারীরিক পরীক্ষার মাধ্যমে জরায়ুমুখ ক্যান্সারের বিস্তৃতি অনুধাবন করা হয়। পাশাপাশি করা হয় জরায়ুমুখ থেকে বায়োপসি স্যাম্পল নিয়ে হিস্টোপ্যাথলজিক্যাল গ্রেডিং। এরপর ক্যান্সারের পর্যায় অনুযায়ী এর বিভিন্ন মেয়াদি ও ধরনের চিকিৎসা নির্ধারণ করেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক।
ক্যান্সারের বিভিন্ন পর্যায়
পর্যায় ১ : ক্যান্সার শুধু জরায়ুমুখে সীমাবদ্ধ
পর্যায় ২ : জরায়ুমুখের সঙ্গে যোনিপথের ওপরের অংশেও কিছুটা ছড়িয়েছে ক্যান্সার
পর্যায় ৩ : যখন ক্যান্সার জরায়ুমুখের সঙ্গে যোনিপথের নিচের অংশে ও আশপাশে ছড়ায়
পর্যায় ৪ : ক্যান্সার যখন জরায়ুমুখের সঙ্গে মূত্রথলি, মলদ্বার অথবা আরো দূরবর্তী প্রত্যঙ্গ, যেমন—কলিজা, ফুসফুস, এমনকি মস্তিষ্কেও ছড়িয়ে যায়।
জরায়ুমুখ ক্যান্সারের প্রতিটি পর্যায়ের চিকিৎসাই রেডিওথেরাপির মাধ্যমে করা সম্ভব। তবে প্রথম ও দ্বিতীয় পর্যায়ে শনাক্ত হলে অস্ত্রোপোচার করেই রোগ নিরাময় সম্ভব। অ্যাডভান্সড স্টেজে কেমো ও রেডিয়েশনের মাধ্যমে চিকিৎসা করা হয়। জরায়ুমুখ ক্যান্সারের চিকিৎসা সম্পূর্ণ হওয়ার পরও নির্দিষ্ট বিরতিতে রোগীকে সারা জীবন সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে থাকতে হয়।
প্রতিরোধে করণীয়
জরায়ুমুখ ক্যান্সার প্রতিরোধে কিছু বিষয়ে সতর্কতা প্রয়োজন; যেমন—
♦ প্রতিষেধক টিকা গ্রহণ করা : কিশোরী বয়সে জরায়ুমুখ ক্যান্সার প্রতিরোধের ভ্যাকসিন নিলে এবং কিছু নিয়ম-কানুন মেনে চললে এই ক্যান্সার প্রতিরোধ করা সম্ভব।
♦ বাইভ্যালেন্ট ভ্যাকসিন : ২টি ভাইরাসের বিরুদ্ধে কাজ করে এই ভ্যাকসিন।
♦ কোয়াড্রিভ্যালেন্ট ভ্যাকসিন : ৪টি ভাইরাসের বিরুদ্ধে যখন কাজ করে সেটি কোয়াড্রিভ্যালেন্ট ভ্যাকসিন।
♦ নোনাভ্যালেন্ট ভ্যাকসিন : ৯টি ভাইরাসের বিরুদ্ধে যখন কাজ করে সেটি হচ্ছে নোনাভ্যালেন্ট ভ্যাকসিন।
♦ আমাদের দেশে বাজারে পাওয়া যায় বাইভ্যালেন্ট ভ্যাকসিন। সরকারিভাবে যেটা ৯ থেকে ১৫ বছর বয়সের কিশোরীদের বিনামূল্যে দেওয়া হচ্ছে সেটি কোয়াড্রিভ্যালেন্ট ভ্যাকসিন। ৯ থেকে ৪৫ বছরের নারীরা এই প্রতিষেধক টিকা নিতে পারেন। তবে ৯ থেকে ২০ বছর পর্যন্ত (বিবাহ-পূর্ব সময়ে) যৌন সম্পর্ক স্থাপনের আগের সময়টাই টিকা নেওয়ার উপযুক্ত সময়।
♦ ৩০ থেকে ৬০ বছর বয়সী সব নারীর ক্যান্সার স্ক্রিনিং কর্মসূচির আওতায় থেকে তিন বছর পর পর জরায়ুমুখ পরীক্ষা করা।
♦ বাল্যবিবাহ রোধ করে অধিক সন্তান নেওয়া থেকে বিরত থাকা।
♦ নারীদের নিরাপদ যৌন সম্পর্ক ও প্রজনন স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতন থাকা।
♦ সঠিক জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহার।
মূলকথা, সচেতনতা ও সঠিক সময়ে টিকা গ্রহণ করলে জরায়ুমুখ ক্যান্সার থেকে মুক্ত থাকা সম্ভব।
লেখক : বিভাগীয় প্রধান, গাইনি অ্যান্ড অবস, কুয়েত মৈত্রী হাসপাতাল, ঢাকা