‘ইচ্ছা থাকলে উপায় হয়’ এই প্রবাদটি যেন হুবহু মিলে যায় ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার ফারাবাড়ী এলাকার তরুণ রাকিবের জীবনের সঙ্গে। অল্প কিছু চারা নিয়ে শুরু করা মালবেরি চাষ আজ তাঁকে এনে দিয়েছে আর্থিক সচ্ছলতা, সম্মান এবং আত্মবিশ্বাস। এখন তিনি শুধু কৃষকই নন, বরং একজন সফল উদ্যোক্তা হিসেবে এলাকায় বেশ সুনাম কুড়াচ্ছেন।
শুরুটা যেমন ছিল : প্রতিনিয়ত বেকারত্বের সঙ্গে লড়াই করা অনেক তরুণের মতো রাকিবও একসময় দিশাহারা ছিলেন।
জীবনের গতি কোথায় গিয়ে ঠেকবে, তা নিয়েও ছিল অনিশ্চয়তা। কিন্তু কৃষি নিয়ে তাঁর আগ্রহ বরাবরই ছিল প্রবল। বিশেষ করে ফলদ উদ্ভিদের প্রতি। ইউটিউব ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মালবেরি চাষ নিয়ে বিভিন্ন ভিডিও দেখতে গিয়ে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। পরে স্থানীয় কৃষি অফিস ও কিছু চাষির পরামর্শে নিজের বাড়ির পাশে পরীক্ষামূলকভাবে কয়েকটি চারা রোপণ করেন।
প্রথম বছরই আশাতীত ফলন হয়। গাছে ফল ধরেছে, ফলের স্বাদ ভালো এবং সবচেয়ে বড় কথা বাজারে এর চাহিদা রয়েছে ব্যাপক। এ থেকেই অনুপ্রাণিত হয়ে পরের বছর আরো বড় পরিসরে মালবেরি চাষ শুরু করেন।
চাষ ও বাজারজাতকরণ অবস্থা : রাকিবের বাগানে বর্তমানে রয়েছে প্রায় ২৬টি মালবেরি গাছ। এ ছাড়াও বাসায় রয়েছে আরো কয়েকটি গাছ। প্রতিটি গাছই সুস্থ ও ফলনে ভরপুর। গাছে ফল এসেছে ব্যাপক। চারা লাগানোর এক বছর পরেই গাছে ফলন আসা শুরু করে বলে জানিয়েছেন রাকিব।
প্রতিটি গাছে ৫ থেকে ১০ কেজি পর্যন্ত ফল আসে। এই ফল তিনি ঠাকুরগাঁওয়ের স্থানীয় কালীবাজারে ফলের দোকানগুলোতে বিক্রি করেন। রাকিব জানান, চলতি মৌসুমে শুধু ফল বিক্রি করেই প্রায় এক লাখ টাকা আয় করতে পারবেন বলে আশা করছেন। প্রতি কেজি মালবেরি তিনি বর্তমানে বিক্রি করছেন ৪০০ থেকে ৫০০ টাকায়। তবে রমজান মাসে এ দাম বেড়ে ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা পর্যন্ত উঠেছিল।
তবে এখানেই থেমে নেই তাঁর আয়। মালবেরির চারা বিক্রি করেও এ বছর তাঁর আয়ের পরিমাণ দাঁড়াতে পারে আরো এক লাখ টাকায়। কারণ, এলাকার অনেকেই এখন রাকিবের অনুপ্রেরণায় মালবেরি চাষে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন এবং তাঁর কাছ থেকেই চারা সংগ্রহ করছেন।
খরচ কম, লাভ বেশি : মালবেরি চাষে খরচ প্রায় নেই বললেই চলে। গাছগুলোর প্রাথমিক যত্ন নিলেই হয়। কীটনাশক বা অতিরিক্ত সার প্রয়োগের প্রয়োজন পড়ে না। বরং প্রাকৃতিকভাবে বেড়ে ওঠা গাছগুলোই বেশি ফলন দেয় বলে রাকিব জানান। তিনি বলেন, ‘প্রথমে কিছুটা শঙ্কা ছিল। ভাবছিলাম গাছ হবে কি না, ফল আসবে কি না। কিন্তু আল্লাহর রহমতে সব গাছেই ভালো ফলন হয়েছে। খরচ বলতে তেমন কিছুই নেই। শুধু পরিশ্রম করতে হয়।’
আন্তঃফসল চাষে সুবিধা : রাকিবের চাষে অন্যতম ব্যতিক্রমী দিক হচ্ছে, তিনি জমির আইলের মধ্যেই মালবেরি চারা রোপণ করেছেন। এতে জমির মূল ফসলের কোনো ক্ষতি হয়নি, বরং উল্টো উপকার হয়েছে। মালবেরিগাছের পাতা ও ছায়া অন্য ফসলের জন্য পরিবেশবান্ধব পরিবেশ তৈরি করে বলে জানান তিনি। এ ছাড়া বাড়ির পাশেও কয়েকটি গাছে ফল ধরেছে। বাড়ির ব্যবহারকৃত ফাঁকা জায়গাগুলো কাজে লাগিয়েই তিনি এই চাষে সফল হয়েছেন।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা : রাকিব এখন মালবেরি চাষকে ঘিরেই বড় স্বপ্ন দেখছেন। তাঁর ইচ্ছা, ভবিষ্যতে একটি নার্সারি গড়ে তোলা, যেখানে শুধু মালবেরির চারা নয়, আরো বিভিন্ন ফলদ ও ভেষজ উদ্ভিদের চারা উৎপাদন ও বিক্রির ব্যবস্থা থাকবে। এ ছাড়া মালবেরি দিয়ে বিভিন্ন খাদ্যপণ্য তৈরির একটি ক্ষুদ্র শিল্প গড়ে তোলার পরিকল্পনাও রয়েছে।
রাকিবের সাফল্য দেখে এলাকার অনেকেই এখন মালবেরি চাষকে সম্ভাবনার খাত হিসেবে ভাবতে শুরু করেছেন। বিশেষ করে তরুণরা নতুনভাবে উৎসাহ পাচ্ছেন। তাঁর দেখানো পথে চলতে চান অনেকেই।
একজন স্থানীয় প্রবীণ কৃষক মো. সামসুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা তো চিনি, এই ছেলেটা কিভাবে নিজের পরিশ্রমে আজকে এই জায়গায় এসেছে। এ রকম চাষাবাদ আগে দেখিনি। এখন আমরাও শিখছি।’
কৃষি বিভাগ যা বলছে : রাকিবের এই সফলতা নজর কেড়েছে কৃষি কর্মকর্তাদেরও। ঠাকুরগাঁও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত উপপরিচালক আলমগীর হোসেন বলেন, ‘মালবেরি একটি অত্যন্ত পুষ্টিকর ও অর্থকরী ফল। আমাদের দেশে এর চাষ এখনো সীমিত হলেও এর সম্ভাবনা অনেক। রাকিব যেভাবে উদ্যোগ নিয়ে কাজ করছেন, তা সত্যিই প্রশংসনীয়। আমরা তাঁকে প্রয়োজনীয় পরামর্শ ও সহায়তা দিয়ে যাচ্ছি। রাকিবের মতো আরো তরুণরা এগিয়ে এলে মালবেরি চাষের মাধ্যমে গ্রামীণ অর্থনীতি আরো শক্তিশালী হতে পারে।’

উদ্যোক্তা রাকিব মালবেরি চাষ ঘিরেই বড় স্বপ্ন দেখছেন। ছবি : কালের কণ্ঠ