<p><span style="font-size:10pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">অধ্যাপক গোলাম মুরশিদ গত ২২ আগস্ট ৮৫ বছর বয়সে লন্ডনের কুইন্স হাসপাতালে মারা যান। ২৬ আগস্ট ২০২৪ তারিখে ইলফোর্ডের গার্ডেনস অব পিস কবরস্থানে তাঁকে সমাহিত করা হয়। তিনি জন্মেছিলেন ১৯৩৯ সালের ৮ এপ্রিল বরিশালের ধামুড়া গ্রামে। লেখাপড়া করেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। চাকরি করেছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে এবং লন্ডনের বিবিসি বাংলা বিভাগে। বাংলাদেশের ভাষা, সাহিত্য, সমাজ, সংস্কৃতি ও ইতিহাস নিয়ে তাঁর প্রায় অর্ধশত বই রয়েছে। এসব বইয়ে বঙ্গবিদ্যা সম্পর্কিত বহু ধারণা প্রথমবারের মতো বর্ণিত ও প্রকাশিত। ২০১৯ সালে ঢাকার একটি সভায় এ জন্য তাঁকে </span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">‘</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">বঙ্গবিদ্যাবিশারদ</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">’</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"> নামে আখ্যায়িত করা হয়। শিক্ষক হিসেবেও ছিলেন অতুলনীয়। এই লেখা শুধু </span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">‘</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">শিক্ষক গোলাম মুরশিদকে</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">’</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"> নিয়ে।</span></span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:10pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের এমএ ক্লাসের শ্রেণিকক্ষে গোলাম মুরশিদের সঙ্গে প্রথম দেখা ১৯৮২ সালে। পড়াতেন ভাষাতত্ত্ব ও ভাষার ইতিহাস। গৌড়ী প্রাকৃত থেকে গৌড়ী অপভ্রংশ হয়ে বাংলা ভাষার জন্ম হয়েছে কমপক্ষে সাত শতকে</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">—</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">মুহম্মদ শহীদুল্লাহর এই তত্ত্ব মুখস্থ করে আমরা অনার্স পাস করেছি; ভালো নম্বর পেয়েছি। কিন্তু একদিন ক্লাসে এসে তিনি বললেন, এই তত্ত্বের অন্তত দুটি অসংগতি আছে: এক. কালগত, আর  দুই. উদাহরণগত। কালগত এ জন্য যে মধ্যভারতীয় আর্যভাষাগুলো সাত শতক নাগাদ প্রাকৃতের খোলস থেকে বেরিয়ে অপ্রভ্রংশ হতে শুরু করেছে। এই অঞ্চলের অপভ্রংশকে বড়জোর প্রত্নবাংলা বলা যায়, বাংলা বলা যায় না। তা ছাড়া হিন্দি, মারাঠি প্রভৃতি নব্যভারতীয় আর্যভাষা যেমন দশম শতকের পরে আবির্ভূত হয়েছে, বাংলার পক্ষেও তেমনটা হওয়া স্বাভাবিক। উদাহরণগত যুক্তি দেখাতে গিয়ে তিনি বলেন, মাগধী প্রাকৃতকে বাংলা ভাষার পূর্বসূরি বিবেচনা করা হয় বিশেষ এই কারণে যে, মাগধী প্রাকৃতের প্রচুর লিখিত নিদর্শন আছে এবং সেগুলো বাংলা ভাষার ব্যাকরণ ও শব্দরূপের কাছাকাছি। কিন্তু গৌড়ী প্রাকৃতের কোনো লিখিত নিদর্শন নেই। তাই সেখান থেকে কোনো কিছুর সৃষ্টি হওয়াটাকে কষ্টকল্পনা না বলে উপায় থাকে না। এভাবে ব্যাখ্যার পর তিনি বলেন, মুহম্মদ শহীদুল্লাহ আমাদের কাছে নিঃসন্দেহে পরম শ্রদ্ধেয় মনীষী। কিন্তু যৌক্তিক বিবেচনায় তাঁর এই তত্ত্ব অগ্রহণযোগ্য। মনে রাখা দরকার, সত্যের সঙ্গে ভক্তির যোগ জরুরি নয়, যুক্তির যোগ জরুরি। গোলাম মুরশিদ এভাবে কথা বলতেন। পরীক্ষার খাতায় আমরা শেষ পর্যন্ত কী লিখেছিলাম, মনে নেই। তবে একজন শ্রেণিশিক্ষকের এমন যুক্তিবাদী ও ভিন্নমতী বক্তৃতা দেওয়ার সাহস দেখে তাঁর প্রতি অন্য রকম একটা শ্রদ্ধাবোধ তৈরি হয়ে গিয়েছিল।</span></span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:10pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">গোলাম মুরশিদের প্রতি আকৃষ্ট হওয়ার আরেকটি কারণ ছিল তাঁর টিউটরিয়াল ক্লাস নেওয়ার ধরন থেকে। এর কিছুকাল আগে তিনি মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পোস্ট-ডক্টরাল গবেষণা করে ফিরেছিলেন। সেই বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর শ্রেণির শিক্ষার্থীরা কিভাবে লেখাপড়া করে, তা তিনি দেখে থাকবেন। হয়তো সেই পদ্ধতিই তিনি আমাদের ওপর প্রয়োগ করার চেষ্টা করেছিলেন। ভাগ্যক্রমে আমি তাঁর টিউটরিয়াল গ্রুপে জায়গা পাই। আমাদের গ্রুপে অন্তত ১৫-১৬ জন শিক্ষার্থী ছিলাম। প্রত্যেককে আলাদা আলাদা শিরোনামে প্রবন্ধ লিখতে বলতেন। প্রবন্ধ লেখা হয়ে গেলে পাঠচক্রের মতো করে সবাইকে তা পাঠ করতে হতো। পাঠ করার পর সবাইকে বলতেন প্রবন্ধের দোষ-গুণ নিয়ে কথা বলতে। সব শেষে কথা বলতেন গোলাম মুরশিদ। তাঁর এবং অন্যদের সমালোচনার ভিত্তিতে প্রবন্ধটিকে পুনরায় লিখে জমা দিতে বলতেন। বাংলা বিভাগের জন্য তখন এই ধরনের ক্লাস নেওয়ার বিশেষ কোনো কক্ষ বা ব্যবস্থা ছিল না। কয়েকটি ক্লাস মুরশিদ স্যার তাঁর বসার ঘরে নেন, কিন্তু সেখানে বসার জায়গা পর্যাপ্ত না হওয়ায় বেশির ভাগ টিউটরিয়াল ক্লাস হয়েছে শহীদুল্লাহ কলাভবনের সামনের গাছতলায়। বসার জায়গা সংকুলান না হওয়ার আরেকটি কারণ অন্য টিউটরিয়াল গ্রুপের শিক্ষার্থীরাও এসে আমাদের সঙ্গে বসতে শুরু করেছিল। এমনই একজন আমাদের সময়কার ফার্স্ট বয় আবুল হাসান চৌধুরী। এসব ক্লাসে আমরা শিখেছিলাম কিভাবে একটা প্রবন্ধ লিখতে হয়, ভূমিকাটা কিভাবে লেখা উচিত, একটা লেখার ভেতরটা কিভাবে সাজাতে হয়, আবার উপসংহারেই বা কী কী কথা কিভাবে লিখতে হয়। এমন হাতে-কলমে লেখাপড়া শেখানোর মতো শিক্ষক আমি এর আগে কোনো দিন পাইনি, শুনিওনি, দেখিওনি। তাই এমন একজন শিক্ষকের ভক্ত না হয়ে কোনো উপায় ছিল না।</span></span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:10pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">তখনকার দিনে এমএ ক্লাসের গুটিকয়েক ছাত্র থিসিস গ্রুপে নাম লেখাত। সাধারণত ওপরের দিকের ছাত্ররাই এই সুযোগ পেত। সেই সুবাদে আমিও এই তালিকায় নাম লেখাই। এক পর্যায়ে গোলাম মুরশিদ আমার থিসিসের সুপারভাইজার হয়েছিলেন। তাতে আমি তাঁর আরো কাছে আসার সুযোগ পাই। সংযোগটা অবশ্য খুব সহজভাবে হয়নি। বাংলা বিভাগে আমরা যারা পড়তাম, তারা সবাই মুরশিদ স্যারকে খুব সমীহ করতাম। নিজেদের অপরিসীম অজ্ঞতা আর গোলাম মুরশিদের অপরিসীম জ্ঞানই সম্ভবত এমন পরিস্থিতি ও পরিবেশ তৈরি করত। আমি প্রথমে আবদুল খালেক স্যারকে গিয়ে অনুরোধ করি আমার সুপারভাইজার হওয়ার জন্য। তিনি খুবই মিশুক এবং স্নেহপ্রবণ। মতুয়া সংগীত নিয়ে কাজ করতে আগ্রহী বলায় তিনি সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে যান। কিন্তু কয়েক দিন লাইব্রেরিতে পড়াশোনা করতে গিয়ে হঠাৎ রবীন্দ্রনাথের গীতাঞ্জলি ও পুনশ্চ কাব্যের কয়েকটি কবিতা এবং কালান্তর বইয়ের কয়েকটি প্রবন্ধ আমাকে বিশেষভাবে ভাবায়। বুঝতে পারি, রবীন্দ্রনাথের সময়ে কিছু মানুষ সমাজের বেশির ভাগ মানুষকে সামাজিকভাবে স্পর্শের অযোগ্য মনে করত, যা রবীন্দ্রনাথ পছন্দ করতেন না। মনে হলো, এই বিষয়টা নিয়ে তো কাজ করা যায়। একদিন সাহস করে গোলাম মুরশিদের ঘরে গেলাম। সংকোচের সঙ্গে বললাম, </span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">‘</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">স্যার, ফোকলোর আমার পছন্দ, তবে রবীন্দ্রনাথের এই বিষয়টাও আমাকে টানে। আমি কি এ নিয়ে গবেষণা করতে পারি?</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">’</span></span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:10pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">আমার কথা শোনার পর গোলাম মুরশিদ বললেন, </span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">‘</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">তুমি যা বললে, তা এক পৃষ্ঠায় লিখে নিয়ে আগামীকাল আমাকে দেখাও।</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">’</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"> আমার চিন্তাগুলো যথাসম্ভব গুছিয়ে লিখে পরের দিন নির্ধারিত সময়ে দেখালাম। লেখাটা পড়ে আমাকে খুব উৎসাহ দিলেন। বললেন, তিনিও বিষয়টা নিয়ে গতকাল ভেবেছেন। বললেন, </span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">‘</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">তুমি যদি এ নিয়ে গবেষণা করতে পারো, তাহলে ভবিষ্যতে নাম করতে পারবে। আমি তোমার জন্য শ-খানেক কার্ড কিনে নিয়ে এসেছি। এখন থেকে প্রাসঙ্গিক যত তথ্য তুমি যেখানেই পাবে, সঙ্গে সঙ্গে তা কার্ডে টুকে রাখবে। দেখবে, থিসিস লেখার সময়ে তোমার কত সুবিধা হয়।</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">’</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"> মুরশিদ স্যারের এই উৎসাহ থেকে একদিকে যেমন আমার আনন্দ হচ্ছিল, অন্যদিকে আবদুল খালেক স্যারের সঙ্গে আমার আগাম কথা বলার বিষয়টা নিয়ে উদ্বিগ্ন হচ্ছিলাম। হঠাৎ মুরশিদ স্যার নিজেই সেই উদ্বেগের অবসান ঘটিয়ে বললেন, </span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">‘</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">এই ধরনের কাজ তত্ত্বাবধানের মতো শিক্ষক এখানে আমি ছাড়া আর কেউ নেই। তাই আমিই হব তোমার সুপারভাইজার। খালেক ভাইকে আমি বলে নেব। তোমাকে চিন্তা করতে হবে না।</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">’</span></span> </span></span></span></p> <p><span style="font-size:10pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">এক বছর মাত্র তাঁর সরাসরি তত্ত্বাবধানে কাজ করতে পেরেছিলাম। ১৯৮৩ সালে তিনি যখন বিবিসি বাংলা বিভাগের চাকরি নিয়ে লন্ডনে চলে যান, তখন আমাদের পরীক্ষা হয়েছে বটে, কিন্তু রেজাল্ট হয়নি। আমার গবেষণাপত্রের পরীক্ষক হিসেবে তিনি নম্বর দিয়ে যেতে পারেননি। গবেষণাপত্রটিতে আমি ১০০ নম্বরের মধ্যে মাত্র ৪৮ পেয়েছিলাম জেনে খুব কষ্ট পান। পরে অবশ্য তাঁর এ দুঃখ ঘুচেছে। কারণ একই গবেষণাপত্রের জন্য ২০০৫ সালে আমি বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন অ্যাওয়ার্ড লাভ করি। গবেষণাপত্রটি তখন </span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">‘</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">অস্পৃশ্যতা বিষয়ে রবীন্দ্রনাথ</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">’</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"> নামে প্রকাশিত হয়েছিল। খবরটা জেনে মুরশিদ স্যার খুব উচ্ছ্বসিত হয়ে লিখেছিলেন, </span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">‘</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">দেরিতে হলেও বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় তোমার গবেষণাপত্রের মূল্য বুঝেছে।</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">’</span></span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:10pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">রবীন্দ্রনাথ বিষয়ক এই গবেষণার কাজটি সহজ ছিল না। গবেষণার পদ্ধতি সম্পর্কে এর আগে আমি কিছুই জানতাম না। কিভাবে তথ্যনির্দেশ করতে হয় বা গ্রন্থপঞ্জি রচনা করতে হয়, তা-ও জানতাম না। সবচেয়ে প্রকট ছিল প্রাথমিক ও সহায়ক উপকরণের অভাব। সব ব্যাপারেই মুরশিদ স্যার আমাকে সহায়তা করেছিলেন। গবেষণার মূল লক্ষ্য নতুন কোনো ধারণা তৈরি করা, এ কথা তাঁর কাছ থেকে শিখেছি। তিনি শিখিয়েছেন কিভাবে মনের মধ্যে জিজ্ঞাসা তৈরি করতে হয়, কিভাবে সেসব জিজ্ঞাসাকে গবেষণার লক্ষ্যে পরিণত করতে হয়, কিভাবে লক্ষ্য অনুযায়ী তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে জবাব উপস্থাপন করতে হয়। আমার ওই গবেষণার প্রাথমিক উপকরণ ছিল রবীন্দ্রনাথের যাবতীয় রচনা এবং সহায়ক উপকরণ ছিল রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে লেখা যাবতীয় গবেষণাধর্মী রচনা। এসব রচনার একটা বিশাল সংগ্রহ ছিল গোলাম মুরশিদের বাসায়। তিনি একদিন বলেছিলেন, </span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">‘</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">এমন সংগ্রহ তুমি আর কোথাও পাবে না। এখান থেকেই গবেষণার জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করো।</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">’</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"> আমি তাঁর বাসা থেকে বই নিয়ে আসতাম, আবার যথাস্থানে রেখে আসতাম। </span></span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:10pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">১৯৮৩ সাল থেকে ২০২৪ সাল, এই দীর্ঘ চল্লিশ বছর তিনি আমার সরাসরি শ্রেণিশিক্ষক ছিলেন না বটে, কিন্তু আমার কখনোই মনে হয়নি যে, তিনি আমার শিক্ষক নন। যখনই কোনো বিষয়ে জানার আগ্রহ তৈরি হয়েছে, যখনই কোনো প্রবন্ধ বা বই লেখার কাজে হাত দিয়েছি, তাঁকে জানানো মাত্রই পথনির্দেশ করতে এগিয়ে এসেছেন। আমিও চেষ্টা করেছি তাঁকে অনুসরণ করতে। যেমন</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">—</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">১৯৮৭ সালে পিএইচডি করার সুযোগ পেয়েই আমার মনে হয়েছে গোলাম মুরশিদের মতো কোনো একটা কাজ বেছে নেব। গোলাম মুরশিদ পিএইচডি করেছিলেন হিন্দু সমাজ সংস্কার আন্দোলন নিয়ে, তাই আমারও মনে হলো আমি কাজ করব মুসলমান সমাজের সংস্কার প্রচেষ্টা নিয়ে। জীবনী লেখক হিসেবে তিনি কিংবদন্তিতুল্য। আমিও কয়েকজন সাহিত্যিক ও সংস্কৃতি সাধকের জীবনী রচনার চেষ্টা করেছি। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তিনি লিখেছিলেন, আমিও মুক্তিযুদ্ধের আঞ্চলিক ইতিহাস নিয়ে বই লিখেছি। তিনি একটি ইংরেজি-বাংলা অভিধান সম্পাদনা করেছিলেন, আমিও যুক্ত হয়েছি অনেক অভিধানের সংকলন ও সম্পাদনার কাজে। দুজনের কাজের ঐক্যের একটা মহাসুযোগ এসেছিল একটি অভিধানের কাজ করতে গিয়ে। ২০১০ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত আমরা এই অভিধানের কাজ করেছিলাম। অভিধানটির নাম </span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">‘</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">বিবর্তনমূলক বাংলা অভিধান</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">’</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">। তিন খণ্ডের এই অভিধান বাংলা একাডেমি প্রকাশ করে। এই অভিধানে কাজ করার সময়েও তিনি ছিলেন আমার শিক্ষক, আর আমি ছাত্র। সব সময়ে মনে হয়েছে, যেন ৩০ বছর আগের মতোই তাঁর নির্দেশ অনুসারে কাজ করছি।</span></span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:10pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">উপমহাদেশীয় সংস্কারের মধ্যে গুরুদক্ষিণা বলে একটা কথা আছে। কিন্তু গোলাম মুরশিদ সেই ধারণার সম্পূর্ণ বিরোধী ছিলেন। তাই আমি কোনো দিনই তাঁকে কোনো উপহার দিতে পারিনি। একবার একটা জামা কিনেছিলাম তাঁকে দেব বলে, তিনি তা না নিয়ে আমাকে হতাশ করেছিলেন। আমার পিএইচডি থিসিসটি বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত হওয়ার পর তাঁকে তা উৎসর্গ করেছিলাম, না জানিয়ে। এতে অবশ্য তিনি অখুশি হয়েছিলেন বলে মনে হয়নি। </span></span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:10pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">মাস তিনেক আগে হঠাৎ পড়ে গিয়ে গোলাম মুরশিদের মাথায় রক্তক্ষরণ হয়েছিল। এ ছাড়া ডান হাতের গোড়ায় ঘাড়ের দিকে খানিকটা ফ্রাকশন হয়। এসবের ফলে পারকিনসন্সের পাশাপাশি তাঁর ডিমেনশিয়া দেখা দেয়। মাঝে মাঝে কিছু অসংলগ্ন কথা বলেন। ল্যাপটপ খুলতে পারেন না। পাসওয়ার্ড মনে থাকে না। ই-মেইল করতে বা পড়তে ব্যর্থ জন। কোথায় আছেন জিজ্ঞাসা করলে একদিন বলেছিলেন, সম্ভবত আব্বাস উদ্দিনের বাসায়। একবার বলেছিলেন, এখন তো বাজারে, বাজার থেকে ফিরে রাজশাহীর টিকিট কাটব। এমন শারীরিক ও মানসিক অবস্থার মধ্যেও তিনি কিন্তু আমাকে উপদেশ দিতে ভোলেননি। বলেছিলেন, </span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">‘</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">স্বরোচিষ, দেশের অবস্থা ভালো না, সাবধানে থেকো।</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">’</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"> নিজের বিপন্ন অবস্থার মধ্যেও ছাত্রের কল্যাণচিন্তার এই উদাহরণ আর কোনো সম্পর্কের মধ্যে খুঁজে পাওয়া যাবে কি না জানি না। বাগেরহাটের মতুয়া-কবি অশ্বিনী সরকারের গানের কলি দিয়ে হয়তো এই গুরুতর্পণ শেষ করা যায়</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">—‘</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">কী ধনে তুষিব গুরু দিবানিশি ভাবি হৃদয়ে।</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">’</span></span></span></span></span></p> <p style="text-align:left"> </p>