আবদুল মান্নান সৈয়দ কবি। ষাটের দশকের অন্যতম কবি। কবিতায় যেমন তিনি আলোচিত, তেমনি ‘সত্যের মতো বদমাশ’ গল্পগ্রন্থ লিখেও আলোচিত হন। লিখেছেন অনেক উপন্যাসও।
গবেষক হিসেবেও অতুলনীয়। সম্পাদনা করেছেন জীবনানন্দসহ অনেক গ্রন্থ। কিছু কিছু হারিয়ে যাওয়া বই তাঁর সম্পাদনার কারণে আমরা নতুন করে পড়তে পেরেছি। এককথায় তিনি কবি, প্রাবন্ধিক, সাহিত্য সমালোচক, গবেষক ও সম্পাদক। তাঁকে বলা হয় সব্যসাচী লেখক। বাংলা সাহিত্যের সব শাখায়ই তাঁর সফল বিচরণ। শুধু কবিতা, গল্প, উপন্যাস নয়, সাহিত্যের সব ক্ষেত্রেই তিনি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতেন। বাংলা কবিতায় যোগ করেছিলেন পরাবাস্তববাদী দিগন্ত। পাশাপাশি বিশ্বসাহিত্য সম্পর্কেও ছিল তাঁর ব্যাপক ধারণা। কবিতায় তিনি
স্বীয় কণ্ঠস্বর উপস্থাপন করেন। সারিয়ালিস্ট বা পরাবাস্তবতার কবি হিসেবে তিনি খ্যাতিমান ছিলেন। নিজের রচনায় নিরন্তর তিনি নিরীক্ষা চালিয়েছেন। নিজেই বলেছেন, ‘কবিতায় আমি ভ্রাম্যমাণ। ফলে বছর পঞ্চাশ ধরে কবিতা যে লিখে গেছি, তার মধ্যে যে রূপান্তর, তাকে আমি বাধা দিইনি। জোর করে কখনো কবিতা লিখিনি। আজও না। কবিতা আমি তখনই লিখি, যখন কবিতা নিজে এসে আমার ওষ্ঠ চুম্বন করে।’ তিনি কবিতা বা কথাসাহিত্যের চেয়েও সাহিত্য সমালোচক হিসেবে অধিকতর খ্যাতিমান ছিলেন। দীর্ঘ পঞ্চাশ বছর ধরে তিনি সাহিত্য সমালোচনা করে বাংলা সমালোচনা সাহিত্যকে একটি দৃঢ় ভিত্তির ওপর দাঁড় করিয়েছেন, যা আজও অক্ষুণ্ন। সাহিত্য সমালোচনায় তিনি ছিলেন বিশুদ্ধ শিল্পলোক-বিচরণে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। শুদ্ধতম কবি, করতলে মহাদেশ, দশ দিগন্তের দ্রষ্টা প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। সম্পাদনা করেছেন বিভিন্ন লেখক-সাহিত্যিকের রচনাসমগ্র। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো জীবনানন্দ দাশের কবিতা, ফররুখ আহমদের শ্রেষ্ঠ কবিতা, ফররুখ রচনাবলী, বাংলাদেশের কবিতা, বাংলাদেশের ছড়া, সমর সেনের নির্বাচিত কবিতা, মোহিতলাল মজুমদারের নির্বাচিত কবিতা, বুদ্ধদেব বসুর সুনির্বাচিত কবিতা প্রভৃতি। কমরেড মুজফ্ফর আহ্মদের পত্রাবলীও তিনি সম্পাদনা করেছেন। মোহাম্মদ জিল্লুর রহমান ও লিলি হক সম্পাদিত ‘সাহিত্য সাধনায় নিবেদিতপ্রাণ আবদুল মান্নান সৈয়দ’ গ্রন্থে বিভিন্ন লেখক তুলে ধরেছেন সাহিত্যে নিবেদিতপ্রাণ এই কবি-সাহিত্যিক-প্রাবন্ধিক-গবেষককে। লিখেছেন অগ্রজ-অনুজ ও সতীর্থ বন্ধুরা।
মোহাম্মদ মাহফুজ উল্লাহ, আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ, রাহাত খান, সৈয়দ শামসুল হক, সেলিনা হোসেন, ড. মাহবুব হাসান, হাসান হাফিজ, মুজিবুল হক কবীর, অসীম সাহা, আবু তাহের মজুমদার, বিশ্বজিৎ ঘোষ, আহমাদ মাযহার, রাজু আলাউদ্দিন, মোহাম্মদ আজম, শাহীন রেজা, ড. রহমান হাবিব, মাহমুদুল বাসার, অনু হোসেন, হুমায়ুন সাদেক চৌধুরী, ফজল মোবারক, শাহাবুদ্দীন নাগরী, শিমুল সালাহউদ্দিন, মোহাম্মদ আসাদ, শেখর ইমতিয়াজ, খালেদ হামিদী, মোহাম্মদ নূরুল হক, আবুল কাসেম হায়দার, পুলক হাসান, চঞ্চল আশরাফ, জুয়েল মোস্তাফিজ, পাবলো শাহি, নাহার আলম, আবু আফজাল মোহা. সালেহ, তাপস মজুমদার, মোহাম্মদ জিল্লুর রহমান প্রমুখ লেখক লিখেছেন তাঁদের প্রিয় লেখক আবদুল মান্নান সৈয়দকে নিয়ে। কেউ স্মৃতিচারণা করেছেন, কেউ মূল্যায়ন করেছেন। ‘সাহিত্য সাধনায় নিবেদিতপ্রাণ আবদুল মান্নান সৈয়দ’ গ্রন্থে তা উঠে এসেছে।
কবি সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক বলেছেন, ‘আবদুল মান্নান সৈয়দ ষাটের দশকের খুব বড়মাপের একজন কবি। তাঁর কবি পরিচয়টাই আমার কাছে প্রধান; যদিও গবেষক, সাহিত্য সম্পাদক, সংকলক হিসেবে তাঁর খ্যাতি শুধু বাংলাদেশে নয়, বাংলা ভাষাভাষী অন্যান্য জায়গাতেও বিস্তৃত। সেদিক থেকে তো তাঁর মূল্য একাডেমিক পর্যায়ে রয়েছে। কিন্তু আমার কাছে বড় পরিচয় এবং যে পরিচয়ে তিনি টিকে থাকবেন বলে বিশ্বাস করি, সেটি হচ্ছে তাঁর কবিতা ও গল্পের জন্য। একটি নতুন ও স্বতন্ত্র কণ্ঠস্বর তিনি আমাদের সাহিত্যে শুনিয়েছেন।’ কালের কণ্ঠের শিলালিপিতে ছাপা হওয়া (৩ সেপ্টেম্বর ২০১০) কবি শিমুল সালাহউদ্দিনের নেওয়া সাক্ষাৎকারটি এই গ্রন্থটিকে করেছে অনন্য। ‘সাহিত্য সাধনায় নিবেদিতপ্রাণ আবদুল মান্নান সৈয়দ’ গ্রন্থটি প্রকাশের জন্য ধন্যবাদ সম্পাদকদ্বয়কে।