ইন্টারনেট ও অ্যালগরিদম
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, ভিডিও শেয়ারিং প্ল্যাটফরম অথবা রেডিটের মতো লিংক শেয়ার ও পোস্ট করার ফোরাম—প্রতিটি সেবাই ব্যবহারকারীদের প্রাসঙ্গিক পোস্ট দেখাতে নিজস্ব অ্যালগরিদম ব্যবহার করে। অন্যরা কোন কনটেন্ট বা পোস্ট বেশি দেখছে ও শেয়ার করছে—তার ওপর ভিত্তি করে সেটিকে নিজস্ব স্কোর দেয় এসব অ্যালগরিদম। এই স্কোর নির্ধারণ করে, পোস্টটি কোন ব্যবহারকারীদের কাছে পৌঁছে যাবে।
সার্চ ইঞ্জিন, যেমন গুগল বা ডাকডাকগো, নিজস্ব অ্যালগরিদম ব্যবহার করে ওয়েবসাইট স্কোরিং বা র্যাংকিং করে থাকে।
নইলে পাঠক বা দর্শক টানা একপ্রকার অসম্ভব।
তাই এত দিন পর্যন্ত অনলাইনে কনটেন্ট নিয়ে কাজ করার মূল মন্ত্র ছিল ট্রেন্ড ধরে সে অনুযায়ী কনটেন্ট তৈরি করা। এর পরও জনপ্রিয়তা পাওয়া ছিল অনেকটা ভাগ্যের ব্যাপার। ভাইরাল হয়ে বাজিমাত করার সুযোগ পেতেন খুব কম নির্মাতা।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার আগমন
লিখিত কনটেন্ট বা মাল্টিমিডিয়া—দুটিই তৈরিতে বেশ অনেকটা সময়ের প্রয়োজন। বিষয় নির্ধারণ, তথ্য সংগ্রহ, লেখার ধরন বা স্ক্রিপ্ট ঠিক করা এবং চূড়ান্ত সম্পাদনা—সবটা মিলিয়ে দিন থেকে মাসও পার হয়ে যেতে পারে। তত দিনে ট্রেন্ড হয়তো শেষও হয়ে যেতে পারে। শর্ট ভিডিও বানাতে অবশ্য এতটা সময় ব্যয় হয় না, তাই টিকটক বা ইউটিউব শর্টস নিয়ে যাঁরা কাজ করেন তাঁরা দ্রুতই ট্রেন্ড ধরে দর্শক টানতে পারেন।
লেখার জন্য এআইয়ের ব্যবহার দৃশ্যপট বদলে দিয়েছে। বিষয়বস্তু বুঝিয়ে দিলেই হাজার শব্দের আর্টিকল কয়েক মিনিটেই লিখে দিচ্ছে এআই, এসইও এবং কি-ওয়ার্ড অপটিমাইজেশন করার কাজেও এআই পারদর্শী। ভিডিও তৈরির বিভিন্ন সেবা, যেমন—ওপেন এআইয়ের সোরা (ঝড়ত্ধ) সেবা কাজে লাগিয়ে শর্ট ভিডিও তৈরিতে এখন আর ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় লাগে না।
কনটেন্ট তৈরির পাশাপাশি সেগুলো ছড়িয়ে দিতেও এআই কাজে লাগাচ্ছেন নির্মাতারা। একাধিক বট অ্যাকাউন্ট তৈরি করে একই কনটেন্ট প্রতিটি প্ল্যাটফরমে ছড়িয়ে দিচ্ছেন, সেগুলো শেয়ার করছেন, ভাইরাল হওয়ার পথে অনেকটা এগিয়ে দিচ্ছেন নিজের কনটেন্ট। কয়েক বছর আগেও এ ধরনের কাজের জন্য তৃতীয় বিশ্বের কনটেন্ট ফার্ম ব্যবহৃত হতো, এখন একটি কম্পিউটার আর কয়েকটি এআই সেবাই যথেষ্ট।
ব্রুট ফোর্সের যুগ
ব্রুট ফোর্স শব্দের অর্থ সঠিক উপায় না মেনে গায়ের জোরে সমস্যা সমাধান করা। একটি মানসম্মত ভিডিও তৈরি করে এক লাখ ভিউ পাওয়ার চেয়ে এক হাজার মানহীন কিন্তু ভাইরাল ভিডিও তৈরি করে প্রতিটিতে ১০ হাজার ভিউ পাওয়াটাকে বলা হচ্ছে অ্যালগরিদমকে ব্রুট ফোর্স করা।
কনটেন্ট তৈরি সহজ হয়ে যাওয়ায়, মানের চেয়ে পরিমাণের দিকেই নজর দিচ্ছে প্রতিটি নির্মাতা। প্রতিদিন কয়েক শ আর্টিকল আর ভিডিও পোস্ট করতে পারলে অন্তত একটি তো ভাইরাল হবেই। ড্যানিয়েল বিটন প্রতিদিন কয়েক শ ভিডিও তৈরি করে ইউটিউব, মেটা এবং টিকটকে আপলোড করেন। ফলে মাত্র ১৭ বছর বয়সেই তিনি হয়েছেন মিলিয়নেয়ার। প্রতি মাসে শুধু ইউটিউব শর্টস থেকেই তাঁর আয় বাংলাদেশি মুদ্রায় ২০ লাখ টাকার ওপরে। এ ছাড়াও মেটা এবং টিকটক থেকে প্রায় সমপরিমাণ আয় হয় তাঁর। এখন তিনি নতুন নির্মাতাদের আয় করার সহজ তরিকাও বাতলে দিচ্ছেন। তাঁর মার্কেটিং ই-মেইলে তিনি দর্শকদের সরাসরি সিরিয়াল কিলারদের সঙ্গে তুলনা করে বলেন, “সিরিয়াল কিলারদের যেমন আছে নিজস্ব উদ্ভট চিন্তাধারা, যা দেখে তাদের সহজেই ধরা যায়, তেমনি শর্ট ভিডিওতে আসক্ত দর্শকদেরও চিন্তা-ভাবনার নির্দিষ্ট ধরন আছে। এআই কাজে লাগিয়ে সহজেই বের করা যায় কোন ধরনের ভিডিও এখন ভাইরাল হবে, প্রয়োজন শুধু এআই দিয়ে তা তৈরি করার। এভাবে আমরা প্রতিনিয়ত নতুন নতুন ভাইরাল ভিডিও তৈরি করেই যাব, প্ল্যাটফরমগুলোও আমাদের থামাবে না।”
বিটনের সহকর্মী মুসা মোস্তফাও একই কথা বলেছেন। তাঁর মতে, ইউটিউব বা টিকটকে সুপারস্টার হওয়ার জন্য যত সময় ও বিনিয়োগ প্রয়োজন, তা নতুনদের পক্ষে একেবারেই অসম্ভব। অনেক নতুন নির্মাতা সময় নিয়ে চমৎকার স্ক্রিপ্ট তৈরি করেন, চড়ামূল্যের ক্যামেরা কিনে সেট তৈরি করে বানান ভিডিও, অথচ ভিডিও দেখে হয়তো বেশি হলে এক-দেড় লাখ দর্শক। বেশির ভাগ চ্যানেলের দর্শকসংখ্যা হাজারেই আটকে থাকে। অথচ মানহীন হলেও যারা প্রতিদিন কয়েক শ ভিডিও পোস্ট করছে, দিনশেষে তাদের আয় মানসম্মত চ্যানেলের চেয়ে অনেক বেশি।
কেন এই চাহিদা
মানহীন কনটেন্ট কেন ভাইরাল হচ্ছে? এ প্রশ্ন প্রায় সবার। একে ফাস্টফুডের সঙ্গে তুলনা করেছেন বেশ কিছু কনটেন্ট নির্মাতা। খিদে পেলেই যেমন সব সময় পাঁচতারা রেস্টুরেন্টের সেরা খাবার খেতে হবে এমন কোনো কথা নেই, তেমনি কনটেন্ট স্ক্রল করার জন্য সেরা মানের ভিডিওরও নেই প্রয়োজন। শর্টস বা টিকটক দেখাকে সিগারেট ফুঁকার সঙ্গে তুলনা করেছে অনেকে, একঘেয়ে কাজের ফাঁকে কয়েক মিনিট বিরতির জন্য লাখ টাকা বাজেটের শৈল্পিকতার চেয়ে রঙচঙে চটকদার ভিডিওই বেশি কাজের।
লিখিত কনটেন্টের ক্ষেত্রে বিষয়টি একটু আলাদা। পাঠকের দৃষ্টিভঙ্গিকে সমর্থন করে এবং উসকে দেয়—এমন লেখাই দ্রুত ভাইরাল হয়। সে ক্ষেত্রে লেখাটি বস্তুনিষ্ঠ কি না—সেটাও পরীক্ষা করে না পাঠক। এআই কাজে লাগিয়ে এমন পোস্ট তৈরি করা কয়েক সেকেন্ডের ব্যাপার। তবে লিখিত কনটেন্টের জনপ্রিয়তা প্রতিনিয়নত কমছে, তাই সবার লক্ষ্য ভিডিও তৈরি। কয়েক বছর আগেও প্রতিটি প্ল্যাটফরমের চেষ্টা ছিল মানসম্মত কনটেন্ট তুলে ধরার। ব্যবহারকারীদের চাহিদা বদলে যাওয়ায় প্ল্যাটফরমের অ্যালগরিদমও বদলে গেছে। যত বেশি ভিউ তত বেশি আয়, এই মর্মেই কাজ করছে অ্যালগরিদম। ফলে বিজ্ঞাপনদাতাদের ওপরও চাপ কমেছে অনেকটা। এআই কনটেন্টের মাধ্যমে তারা দ্রুত ট্রেন্ড অনুযায়ী পণ্য ও সেবার প্রচারণা চালাচ্ছে। এ বছর আমাদের দেশেও এআইয়ে তৈরি বিজ্ঞাপনচিত্রের ব্যবহার দেখা গেছে।
ভবিষ্যৎ
মেটা, টিকটক এবং গুগল—প্রতিটি প্রতিষ্ঠান নিজেরাই এআই কনটেন্ট তৈরির সেবা নিয়ে কাজ করছে। বিজ্ঞাপনদাতাদের কাজ শুধু কেমন বিজ্ঞাপন চাই সেটা বলা, বাকি কাজ করবে এআই। ব্যবহারকারীরা এআইয়ের তৈরি কনটেন্ট দেখবে, শেয়ার করবে, সেটা নিয়ে এআই বটদের সঙ্গে বিতর্কে মেতে উঠবে—অন্তত মেটার প্রতিটি প্ল্যাটফরম নিয়ে মার্ক জাকারবার্গের চাওয়া এমনটাই। মেটার চলমান এআই ইনফ্লুয়েন্সার এবং বট প্রোফাইল তৈরির প্রজেক্টগুলো অন্তত এমনটাই নির্দেশ করছে। শর্ট ভিডিওর প্রতি আসক্ত ব্যবহারকারীদের অসীম চাহিদা মেটাতে এআই কনটেন্টের জনপ্রিয়তা ভবিষ্যতে আরো বাড়বে সন্দেহ নেই। এআইয়ের সাইবার দুনিয়ায় মানুষের স্থান আসলেই আছে কি না সেটাই এখন দেখার বিষয়।