এআই কনটেন্টের হতশ্রী চিত্র নেপথ্যে কী?

  • ছবি, ভিডিও ও লেখা তৈরির এআই সেবা আমূলে বদলে দিয়েছে ইন্টারনেটকে। মেধা ও শ্রম খাটিয়ে মানসম্মত কনটেন্ট নয়, এসব নির্মাতারা বেছে নিচ্ছেন ব্রুট ফোর্স সিস্টেম। এআই কাজে লাগিয়ে প্রতিনিয়ত এমন সব মানহীন কনটেন্ট তৈরি হচ্ছে, যেগুলো ভাইরাল হয়ই। এতে নির্মাতাদের আয় হচ্ছে ঠিকই, তবে বঞ্চিত হচ্ছে দর্শক ও পাঠক। এআই কনটেন্টের বর্তমান হতশ্রী চিত্র তুলে ধরেছেন এস এম তাহমিদ
শেয়ার
এআই কনটেন্টের হতশ্রী চিত্র নেপথ্যে কী?

ইন্টারনেট ও অ্যালগরিদম

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, ভিডিও শেয়ারিং প্ল্যাটফরম অথবা রেডিটের মতো লিংক শেয়ার ও পোস্ট করার ফোরামপ্রতিটি সেবাই ব্যবহারকারীদের প্রাসঙ্গিক পোস্ট দেখাতে নিজস্ব অ্যালগরিদম ব্যবহার করে। অন্যরা কোন কনটেন্ট বা পোস্ট বেশি দেখছে ও শেয়ার করছেতার ওপর ভিত্তি করে সেটিকে নিজস্ব স্কোর দেয় এসব অ্যালগরিদম। এই স্কোর নির্ধারণ করে, পোস্টটি কোন ব্যবহারকারীদের কাছে পৌঁছে যাবে।

সার্চ ইঞ্জিন, যেমন গুগল বা ডাকডাকগো, নিজস্ব অ্যালগরিদম ব্যবহার করে ওয়েবসাইট স্কোরিং বা র‌্যাংকিং করে থাকে।

ব্যবহারকারীরা কিছু সার্চ করলে সেটার কি-ওয়ার্ড মিলিয়ে ওয়েবসাইট বের করে দেয় সার্চ ইঞ্জিন। কিন্তু ফলাফল তালিকার শীর্ষে থাকবে কোন ওয়েবসাইট, সেটা নির্ধারিত হয় কি-ওয়ার্ডের পাশাপাশি অন্যান্য আরো কিছু জিনিস বিবেচনা করে দেওয়া স্কোরের ওপর ভিত্তি করে।

অ্যালগরিদমের স্কোরিং সিস্টেম বেশ জটিল, কি-ওয়ার্ড বা প্রাসঙ্গিকতার বাইরে আরো অনেক ক্ষেত্রের ওপরই নির্ভর করে পোস্ট বা ওয়েবসাইটের র‌্যাংকিং। এ প্রক্রিয়া কিভাবে কাজ করে তা সরাসরি জানার উপায় নেই।

পাশাপাশি প্রতিনিয়ত এসব অ্যালগরিদমে পরিবর্তন করা হয়। এতে করে অ্যালগরিদম ফাঁকি দিয়ে ভাইরাল হওয়ার সুযোগ থাকে না।

ওয়েবসাইট ও কনটেন্ট নির্মাতারা সার্চ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশন (এসইও) আর কনটেন্টের ট্রেন্ডের ওপর রীতিমতো গবেষণা চালান। এসইও, কি-ওয়ার্ড এবং ট্রেন্ড বিশেষজ্ঞরা কাজ করেন প্রতিটি মিডিয়া প্রতিষ্ঠানে।

সফল কনটেন্ট ক্রিয়েটর হতে চাইলে অ্যালগরিদমের হালচাল বোঝা খুব জরুরি। এতকিছুর পরও একটা সময়ে গিয়ে অনেক নির্মাতা আর ট্রেন্ড ধরতে পারেন না, ফলে শেষ হয়ে যায় তাঁর ক্যারিয়ার।

অন্যদিকে অতি সূক্ষ্মভাবে প্রত্যেক পাঠক ও দর্শকের মনোভাব বদলে দেয় অ্যালগরিদম। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একই মতাদর্শের পোস্ট এবং কমেন্ট ব্যবহারকারীদের সামনে তুলে ধরে, সার্চ ইঞ্জিন ভিন্ন মতাদর্শী ওয়েবসাইট ও সংবাদমাধ্যমের পোস্ট র‌্যাংকিংয়ে নিচে নামিয়ে দেয়। নতুন ওয়েবসাইট বা কনটেন্ট চ্যানেল তৈরি করার সময় তাই নির্মাতাদের চেষ্টা করতে হয় র‌্যাংকিংয়ে ওপরের দিকে থাকা সাইট বা চ্যানেলের আদলে নিজেদেরটাও সাজাতে।

নইলে পাঠক বা দর্শক টানা একপ্রকার অসম্ভব।

তাই এত দিন পর্যন্ত অনলাইনে কনটেন্ট নিয়ে কাজ করার মূল মন্ত্র ছিল ট্রেন্ড ধরে সে অনুযায়ী কনটেন্ট তৈরি করা। এর পরও জনপ্রিয়তা পাওয়া ছিল অনেকটা ভাগ্যের ব্যাপার। ভাইরাল হয়ে বাজিমাত করার সুযোগ পেতেন খুব কম নির্মাতা।

 

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার আগমন

লিখিত কনটেন্ট বা মাল্টিমিডিয়াদুটিই তৈরিতে বেশ অনেকটা সময়ের প্রয়োজন। বিষয় নির্ধারণ, তথ্য সংগ্রহ, লেখার ধরন বা স্ক্রিপ্ট ঠিক করা এবং চূড়ান্ত সম্পাদনাসবটা মিলিয়ে দিন থেকে মাসও পার হয়ে যেতে পারে। তত দিনে ট্রেন্ড হয়তো শেষও হয়ে যেতে পারে। শর্ট ভিডিও বানাতে অবশ্য এতটা সময় ব্যয় হয় না, তাই টিকটক বা ইউটিউব শর্টস নিয়ে যাঁরা কাজ করেন তাঁরা দ্রুতই ট্রেন্ড ধরে দর্শক টানতে পারেন।

লেখার জন্য এআইয়ের ব্যবহার দৃশ্যপট বদলে দিয়েছে। বিষয়বস্তু বুঝিয়ে দিলেই হাজার শব্দের আর্টিকল কয়েক মিনিটেই লিখে দিচ্ছে এআই, এসইও এবং কি-ওয়ার্ড অপটিমাইজেশন করার কাজেও এআই পারদর্শী। ভিডিও তৈরির বিভিন্ন সেবা, যেমনওপেন এআইয়ের সোরা (ঝড়ত্ধ) সেবা কাজে লাগিয়ে শর্ট ভিডিও তৈরিতে এখন আর ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় লাগে না।

কনটেন্ট তৈরির পাশাপাশি সেগুলো ছড়িয়ে দিতেও এআই কাজে লাগাচ্ছেন নির্মাতারা। একাধিক বট অ্যাকাউন্ট তৈরি করে একই কনটেন্ট প্রতিটি প্ল্যাটফরমে ছড়িয়ে দিচ্ছেন, সেগুলো শেয়ার করছেন, ভাইরাল হওয়ার পথে অনেকটা এগিয়ে দিচ্ছেন নিজের কনটেন্ট। কয়েক বছর আগেও এ ধরনের কাজের জন্য তৃতীয় বিশ্বের কনটেন্ট ফার্ম ব্যবহৃত হতো, এখন একটি কম্পিউটার আর কয়েকটি এআই সেবাই যথেষ্ট।

ব্রুট ফোর্সের যুগ

ব্রুট ফোর্স শব্দের অর্থ সঠিক উপায় না মেনে গায়ের জোরে সমস্যা সমাধান করা। একটি মানসম্মত ভিডিও তৈরি করে এক লাখ ভিউ পাওয়ার চেয়ে এক হাজার মানহীন কিন্তু ভাইরাল ভিডিও তৈরি করে প্রতিটিতে ১০ হাজার ভিউ পাওয়াটাকে বলা হচ্ছে অ্যালগরিদমকে ব্রুট ফোর্স করা।

কনটেন্ট তৈরি সহজ হয়ে যাওয়ায়, মানের চেয়ে পরিমাণের দিকেই নজর দিচ্ছে প্রতিটি নির্মাতা। প্রতিদিন কয়েক শ আর্টিকল আর ভিডিও পোস্ট করতে পারলে অন্তত একটি তো ভাইরাল হবেই। ড্যানিয়েল বিটন প্রতিদিন কয়েক শ ভিডিও তৈরি করে ইউটিউব, মেটা এবং টিকটকে আপলোড করেন। ফলে মাত্র ১৭ বছর বয়সেই তিনি হয়েছেন মিলিয়নেয়ার। প্রতি মাসে শুধু ইউটিউব শর্টস থেকেই তাঁর আয় বাংলাদেশি মুদ্রায় ২০ লাখ টাকার ওপরে। এ ছাড়াও মেটা এবং টিকটক থেকে প্রায় সমপরিমাণ আয় হয় তাঁর। এখন তিনি নতুন নির্মাতাদের আয় করার সহজ তরিকাও বাতলে দিচ্ছেন। তাঁর মার্কেটিং ই-মেইলে তিনি দর্শকদের সরাসরি সিরিয়াল কিলারদের সঙ্গে তুলনা করে বলেন, সিরিয়াল কিলারদের যেমন আছে নিজস্ব উদ্ভট চিন্তাধারা, যা দেখে তাদের সহজেই ধরা যায়, তেমনি শর্ট ভিডিওতে আসক্ত দর্শকদেরও চিন্তা-ভাবনার নির্দিষ্ট ধরন আছে। এআই কাজে লাগিয়ে সহজেই বের করা যায় কোন ধরনের ভিডিও এখন ভাইরাল হবে, প্রয়োজন শুধু এআই দিয়ে তা তৈরি করার। এভাবে আমরা প্রতিনিয়ত নতুন নতুন ভাইরাল ভিডিও তৈরি করেই যাব, প্ল্যাটফরমগুলোও আমাদের থামাবে না।

বিটনের সহকর্মী মুসা মোস্তফাও একই কথা বলেছেন। তাঁর মতে, ইউটিউব বা টিকটকে সুপারস্টার হওয়ার জন্য যত সময় ও বিনিয়োগ প্রয়োজন, তা নতুনদের পক্ষে একেবারেই অসম্ভব। অনেক নতুন নির্মাতা সময় নিয়ে চমৎকার স্ক্রিপ্ট তৈরি করেন, চড়ামূল্যের ক্যামেরা কিনে সেট তৈরি করে বানান ভিডিও, অথচ ভিডিও দেখে হয়তো বেশি হলে এক-দেড় লাখ দর্শক। বেশির ভাগ চ্যানেলের দর্শকসংখ্যা হাজারেই আটকে থাকে। অথচ মানহীন হলেও যারা প্রতিদিন কয়েক শ ভিডিও পোস্ট করছে, দিনশেষে তাদের আয় মানসম্মত চ্যানেলের চেয়ে অনেক বেশি।

 

কেন এই চাহিদা

মানহীন কনটেন্ট কেন ভাইরাল হচ্ছে? এ প্রশ্ন প্রায় সবার। একে ফাস্টফুডের সঙ্গে তুলনা করেছেন বেশ কিছু কনটেন্ট নির্মাতা। খিদে পেলেই যেমন সব সময় পাঁচতারা রেস্টুরেন্টের সেরা খাবার খেতে হবে এমন কোনো কথা নেই, তেমনি কনটেন্ট স্ক্রল করার জন্য সেরা মানের ভিডিওরও নেই প্রয়োজন। শর্টস বা টিকটক দেখাকে সিগারেট ফুঁকার সঙ্গে তুলনা করেছে অনেকে, একঘেয়ে কাজের ফাঁকে কয়েক মিনিট বিরতির জন্য লাখ টাকা বাজেটের শৈল্পিকতার চেয়ে রঙচঙে চটকদার ভিডিওই বেশি কাজের।

লিখিত কনটেন্টের ক্ষেত্রে বিষয়টি একটু আলাদা। পাঠকের দৃষ্টিভঙ্গিকে সমর্থন করে এবং উসকে দেয়এমন লেখাই দ্রুত ভাইরাল হয়। সে ক্ষেত্রে লেখাটি বস্তুনিষ্ঠ কি নাসেটাও পরীক্ষা করে না পাঠক। এআই কাজে লাগিয়ে এমন পোস্ট তৈরি করা কয়েক সেকেন্ডের ব্যাপার। তবে লিখিত কনটেন্টের জনপ্রিয়তা প্রতিনিয়নত কমছে, তাই সবার লক্ষ্য ভিডিও তৈরি। কয়েক বছর আগেও প্রতিটি প্ল্যাটফরমের চেষ্টা ছিল মানসম্মত কনটেন্ট তুলে ধরার। ব্যবহারকারীদের চাহিদা বদলে যাওয়ায় প্ল্যাটফরমের অ্যালগরিদমও বদলে গেছে। যত বেশি ভিউ তত বেশি আয়, এই মর্মেই কাজ করছে অ্যালগরিদম। ফলে বিজ্ঞাপনদাতাদের ওপরও চাপ কমেছে অনেকটা। এআই কনটেন্টের মাধ্যমে তারা দ্রুত ট্রেন্ড অনুযায়ী পণ্য ও সেবার প্রচারণা চালাচ্ছে। এ বছর আমাদের দেশেও এআইয়ে তৈরি বিজ্ঞাপনচিত্রের ব্যবহার দেখা গেছে।

 

ভবিষ্যৎ

মেটা, টিকটক এবং গুগলপ্রতিটি প্রতিষ্ঠান নিজেরাই এআই কনটেন্ট তৈরির সেবা নিয়ে কাজ করছে। বিজ্ঞাপনদাতাদের কাজ শুধু কেমন বিজ্ঞাপন চাই সেটা বলা, বাকি কাজ করবে এআই। ব্যবহারকারীরা এআইয়ের তৈরি কনটেন্ট দেখবে, শেয়ার করবে, সেটা নিয়ে এআই বটদের সঙ্গে বিতর্কে মেতে উঠবেঅন্তত মেটার প্রতিটি প্ল্যাটফরম নিয়ে মার্ক জাকারবার্গের চাওয়া এমনটাই। মেটার চলমান এআই ইনফ্লুয়েন্সার এবং বট প্রোফাইল তৈরির প্রজেক্টগুলো অন্তত এমনটাই নির্দেশ করছে। শর্ট ভিডিওর প্রতি আসক্ত ব্যবহারকারীদের অসীম চাহিদা মেটাতে এআই কনটেন্টের জনপ্রিয়তা ভবিষ্যতে আরো বাড়বে সন্দেহ নেই। এআইয়ের সাইবার দুনিয়ায় মানুষের স্থান আসলেই আছে কি না সেটাই এখন দেখার বিষয়।

মন্তব্য

সম্পর্কিত খবর

কুখ্যাত ফোরচানের অবসান

    ফোরচানকে বলা যায় ইন্টারনেটের অন্ধকূপ। এহেন কোনো বিদ্বেষ ও সহিংসতা ছড়ানো উগ্রপন্থী দল নেই যারা ফোরচানে পোস্ট করে না। ২২ বছর পর সাইবার হামলায় অবশেষে সাইটটি বিদায় নিয়েছে ইন্টারনেট থেকে। বিস্তারিত জানাচ্ছেন টি এইচ মাহির
শেয়ার
কুখ্যাত ফোরচানের অবসান

আলোচিত-সমালোচিত ওয়েবফোরাম ফোরচান দখলে নিয়েছে হ্যাকাররা। ১৫ এপ্রিল মঙ্গলবার দুপুরে কুখ্যাত এই ফোরামে হামলা চালানো শুরু করে তারা। ব্যবহারকারীরা প্রবেশ করতে পারছিল, তবে কোনো পেজ লোড হচ্ছিল না। শুধু স্ট্যাটিক এইচটিএমএল এরর মেসেজ দেখাচ্ছিল হোম পেজে।

ধারণা করা হচ্ছে, হামলাকারীরা প্রায় এক বছর ধরে ফোরচানের সঙ্গে যুক্ত থেকে সাইটটির দুর্বলতা খুঁজে বের করেছে। পাশাপাশি ব্যবহারকারীদের ব্যক্তিগত সব তথ্য হাতিয়ে নেওয়ার দাবি করেছে হ্যাকাররা।  প্রতিদ্বন্দ্বী ওয়েবফোরাম সোয়জাক পার্টি এই ডাটা চুরির দায় স্বীকার করেছে। ফোরচানের বিভিন্ন নথি ও ব্যবহারকারীর তালিকা নিজেদের ফোরামে ফাঁস করেছে তারা।
এর মধ্যে আছে ফোরচান ওয়েবসাইটের অ্যাডমিন, মডারেটর ও ব্যবহারকারীদের নামের পাশাপাশি আইডি ও পাসওয়ার্ড। ফোরচান কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ওয়েবসাইট হ্যাকের বিষয়টি স্বীকার করেছে।

ফোরচান হচ্ছে কোনো প্রকার সেন্সরশিপ ছাড়া স্বাধীনভাবে পোস্ট করার ফোরাম। এটি ইমেজবোর্ড ঘরানার, অর্থাৎ ছবি পোস্ট করে ক্যাপশন হিসেবে লেখা যায়।

ব্যবহারকারীরা নিজেদের পরিচয় গোপন রেখে ভিডিও গেম থেকে শুরু করে সাহিত্য, অস্ত্র, রান্না, প্রযুক্তিসহ নানা বিষয়ে পোস্ট করে। এখন রাজনীতি এবং সহিংসতামূলক পোস্টের জন্য ফোরচান কুখ্যাত। এর একটি সংস্করণ ডার্ক ওয়েবেও চালু আছে। ফলে বহুবার একে নিয়ন্ত্রণহীন ও বিপজ্জনক বলে চিহ্নিত করেছে বিভিন্ন নিরাপত্তা সংস্থা। ২০০৩ সালে চালু হওয়া ওয়েবসাইটটি সহিংসতা ও উগ্রবাদী মতবাদ প্রচারে বিভিন্ন সময়ে ব্যবহৃত হয়েছে।
তখনই শুরু হয়েছে এর কুখ্যাতি। বিভিন্ন ধরনের সাইবার আক্রমণ, আমেরিকায় সহিংসতার হুমকি, বর্ণবাদ, উগ্র রাজনীতি নিয়েই এখন সবচেয়ে সরগরম এই ফোরাম। এ ছাড়াও বিভিন্ন রকমের গোপনীয় বা অবৈধ তথ্যও শেয়ার হয় এই ওয়েবসাইটে।

ইন্টারনেট ব্যবহারকারী কিশোর তরুণদের একটি বিরাট অংশ এই ফোরাম ব্যবহার করে। ১৮ থেকে ২৫ বছর বয়সী ব্যবহারকারীর সংখ্যাই ফোরচানে বেশি। ফলে এই ফোরামে অনেক মিমও শেয়ার হয়। যদিও এর পোস্ট বা কনটেন্টগুলো কারোর জন্যই উপযুক্ত নয়। ওয়েবসাইটে প্রবেশ করতে প্রাপ্তবয়স্ক হতে হবে শর্ত থাকলেও, যেহেতু ব্যবহারকারীদের কোনো প্রোফাইল খুলতে হয় না, তাই সবাই ইচ্ছামতো প্রবেশ করে পোস্ট করতে পারে। ওয়েবসাইটটি শুধু ব্যবহারকারীদের আইপি ঠিকানা সংগ্রহ করে থাকে।

বারবার উসকানি, সহিংস এবং গণহত্যা সৃষ্টিকারী ঘৃণ্য বক্তব্য প্রচারের পরও ২২ বছর টিকে ছিল ফোরচান। আক্রমণের শিকার হয়ে অবশেষে তার হয়েছে অবসান। হ্যাকাররা সাইটের ব্যাকএন্ডে প্রবেশ করার ফলে এর সোর্স কোড, মডারেটর-অ্যাডমিনদের পরিচয় ফাঁস হয়ে গেছে, উদ্ধারের আর উপায় নেই। যুক্তরাষ্ট্রের ইউসি রিভারসাইড বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক এমিলিয়ানো ডি ক্রিস্টোফারোর মতে কিছু অতি পরিচিত মডারেটরের পরিচয় ফাঁস হতে পারে। যাদের স্বয়ং ফোরচান ব্যবহারকারীরাই ঘৃণা করে। তাঁর ভাষ্য মতে, ওয়েবসাইটটি বেশ পুরনো, করা হয়নি নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ। তাই হয়তো হ্যাকারদের জন্য হামলা করা হয়েছে সহজ। তবে সফটওয়্যার বা সিস্টেমের ত্রুটিও থাকতে পারে বলে তিনি ধারণা করছেন।

বেশ কিছু বছর ধরে ফোরচানের ওপর মার্কিন নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের নজরদারি চলছিল। এটি টিকে ছিল শুধু একটি জাপানি কম্পানির বিনিয়োগের কারণে। অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও এ সাইটের বিষাক্ত ও বিদ্বেষপূর্ণ পোস্টগুলো ছড়িয়ে পড়ার প্রবণতা বাড়ছে। পেপে দ্য ফ্রগ, রেজ কমিকস এবং ওজাকসের মতো মিমগুলো ফেসবুক ও এক্সে ভাইরাল, যার উৎপত্তি ফোরচান থেকেই। এ চরিত্রগুলো ঘৃণ্য বক্তব্য এবং বর্ণবাদী মিম প্রচারের জন্যই তৈরি। যুক্তরাষ্ট্রের বেশ কিছু অতি উগ্রপন্থী বেশ কয়েকটি ডানপন্থী দলেরও শুরুটা এই ওয়েবসাইটেই। ২০১৯ সালে নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চে দুটি মসজিদে ৫১ জনকে হত্যা করা বন্দুকধারী সন্ত্রাসীও কিশোর বয়স থেকেই নিয়মিত ফোরচান ব্যবহার করত। নিউইয়র্কের বাফেলোতে একটি মুদি দোকানে ১৮ বছর বয়সী এক যুবক ১০ জন কৃষ্ণাঙ্গ ব্যক্তিকে হত্যা করেছিলেন ২০২২ সালে। তিনিও ছিলেন ফোরচানের উগ্র বর্ণবাদী ফোরামের নিয়মিত ব্যবহারকারী। অতএব বলা যায়, ফোরচানের অবসানে ইন্টারনেটের ক্ষতি নয় বরং লাভ হয়েছে।

মন্তব্য

জাকারবার্গ সাম্রাজ্যে ফাটল

    সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বাজারে মেটা একচেটিয়া আধিপত্য বিস্তার করেছে—যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্টের এমনটাই অভিযোগ, ১৪ এপ্রিল শুরু হয়েছে মামলার শুনানি। প্রধান নির্বাহী মার্ক জাকারবার্গের বক্তব্য এবং আদালতে উত্থাপিত নথিপত্র থেকে বেরিয়ে আসছে একের পর এক চাঞ্চল্যকর তথ্য। মামলাটিকে বলা হচ্ছে তথ্য-প্রযুক্তিক্ষেত্রে অনিয়মের বিরুদ্ধে ট্রাম্প প্রশাসনের প্রথম বড় লড়াই। বিস্তারিত জানাচ্ছেন শাহরিয়ার মোস্তফা
শেয়ার
জাকারবার্গ সাম্রাজ্যে ফাটল
সুপ্রিম কোর্টে সাক্ষ্য দিচ্ছেন মার্ক জাকারবার্গ ছবি : সংগৃহীত

মামলার বিষয়বস্তু

প্রায় দেড় যুগ আগে, ২০১২ সালে ছবি শেয়ারিং ভিত্তিক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ইনস্টাগ্রামকে এক বিলিয়ন ডলারে কিনে নেয় ফেসবুক। তখনো প্রতিষ্ঠানটি নাম বদলে মেটাতে পরিণত হয়নি। এরপর ২০১৪ সালে ১৯ বিলিয়ন ডলারে হোয়াটসঅ্যাপও কিনে নেয় এই প্রতিষ্ঠান। রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীদের দাবি, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বাজারে নিজেদের একচ্ছত্র মনোপলি তৈরির জন্যই ফেসবুক এ দুটি প্রতিষ্ঠানকে কিনে নিয়েছিল।

১৪ এপ্রিল মামলার শুনানি শুরু হওয়ার পরপরই যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল ট্রেড কমিশনের আইনজীবী ড্যানিয়েল ম্যাথেসন বলেছেন, নিজেদের সেবার মান ও ফিচার বাড়িয়ে প্রতিযোগিতায় এগিয়ে যাওয়ার বদলে মেটা সহজ রাস্তা হিসেবে অন্য প্রতিযোগীদের কিনে নেওয়ার সহজ রাস্তা বেছে নিয়েছে।

মেটার আইনজীবী মার্ক হ্যানসেনের বক্তব্য, ফেসবুকের পাশাপাশি বাড়তি সেবা হিসেবে ইনস্টাগ্রাম ও হোয়াটসঅ্যাপ কেনা হয়েছিল, প্রতিযোগিতা নষ্টের লক্ষ্যে নয়। মেটা আরো দাবি করেছে, টিকটক ও ইউটিউবের মতো জনপ্রিয় সেবা বর্তমানে মেটার সঙ্গে বাজার দখলে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। তাই মনোপলির অভিযোগ ভিত্তিহীন।

পাশাপাশি মেটা এও উল্লেখ করেছে যে ইনস্টাগ্রাম ও হোয়াটসঅ্যাপ কেনার সময় স্বয়ং এফটিসি ছাড়পত্র দিয়েছিল, এখন সেই সিদ্ধান্ত বদল সরাসরি আইনের পরিপন্থী।

 

জাকারবার্গের বক্তব্য

প্রতিযোগীদের কিনে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল সেবাগুলোর মান এবং পরিধি আরো বাড়ানোর জন্য, মনোপলির জন্য নয়, বলেছেন মার্ক জাকারবার্গ। তাঁর দাবি, ওই সময় ইনস্টাগ্রামের ক্যামেরা অ্যাপ ফিচারের দিক থেকে এগিয়ে থাকায় ফেসবুকের নিজস্ব অ্যাপ তৈরির ঝামেলায় না গিয়ে ইনস্টাগ্রাম কিনে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তবে ফেসবুকের অভ্যন্তরীণ নথিপত্র বলছে ভিন্ন কথা।

জাকারবার্গ ২০১২ সালে এক ই-মেইলে লিখেছিলেন, ইনস্টাগ্রাম যেভাবে জনপ্রিয় হচ্ছে, না কিনে উপায় ছিল না। বর্তমানে জেনারেশন জেড-এর মধ্যে ফেসবুকের চেয়ে ইনস্টাগ্রাম বেশি জনপ্রিয়, যদিও টিকটকই এখন তাদের মধ্যে জনপ্রিয়তার শীর্ষে। সেই হিসেবে বলাই যায়, যে বাজার ফেসবুক ধরতে পারত না, সেটা ইনস্টাগ্রাম কেনার মাধ্যমে মেটা ধরেছে। প্রতিযোগিতা করে টিকতে হয়নি।

হোয়াটসঅ্যাপের বিষয়টিও ছিল প্রায় একই।

ফেসবুকের অন্য নির্বাহীদের আশঙ্কা ছিল, মেসেঞ্জার অ্যাপগুলো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বিকল্প হয়ে উঠতে পারে। ফেসবুক মেসেঞ্জার তখনো তেমন জনপ্রিয়তা পাচ্ছিল না, অন্যদিকে বিশেষ করে এশিয়ায় হোয়াটসঅ্যাপ প্রতিনিয়ত জনপ্রিয় হয়ে উঠছিল। এই বিশাল বাজার ধরার জন্যই হোয়াটসঅ্যাপ কেনা। পাবলিক ফোরাম যেমন ফেসবুক নিউজফিড বা তৎকালীন টুইটারের পাশাপাশি গন চ্যাটরুম জনপ্রিয় হয়ে উঠছিল ওই সময়। জাকারবার্গ ধারণা করেছিলেন, শিগগিরই মেসেঞ্জারভিত্তিক সামাজিক যোগাযোগের জনপ্রিয়তা ফোরামকে ছাড়িয়ে যাবে। তাঁর ধারণা সঠিক হলেও, হোয়াটসঅ্যাপ নয়, এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে জনপ্রিয় প্ল্যাটফরম ডিসকর্ড, সেটা তিনি বুঝতে পারেননি।

ডিসকর্ডের মতো জনপ্রিয় না হলেও, হোয়াটসঅ্যাপ ব্যবহার করে প্রায় তিন বিলিয়ন ব্যক্তি, যা থেকে মেটা বছরে ১০ বিলিয়ন ডলারের ওপর আয় করে থাকে। ফেসবুক মেসেঞ্জার, ইনস্টাগ্রাম এবং হোয়াটসঅ্যাপ মিলিয়ে মেটা এই বাজারেও শক্ত অবস্থান তৈরি করেছে, যা সুপ্রিম কোর্টের চোখে সুস্পষ্ট মনোপলির লক্ষণ।

অদ্ভুত সব কৌশল

ফেসবুকের জনপ্রিয়তা কমা ঠেকাতে অদ্ভুত বেশ কিছু পদক্ষেপের কথা ভেবেছিলেন জাকারবার্গ। এর মধ্যে আছে ২০১২ সালে ছয় বিলিয়ন ডলারে স্ন্যাপচ্যাট কিনে নেওয়ার চেষ্টা। জাকারবার্গ বলেছেন, স্ন্যাপচ্যাট যদি মেটার অংশ হতো, এত দিনে ব্যবহারকারীর সংখ্যা থাকত ১০ গুণ বেশি। একসময় লিংকডইনের সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার জন্য ফেসবুক ফর ওয়ার্ক চালু করেছিল মেটা, জাকারবার্গ চেয়েছিলেন লিংকডইনের বেশির ভাগ ফিচারই ফেসবুকে যোগ করে আলাদা নিউজফিড ও প্রোফাইল সিস্টেম চালু করতে। এতে প্রতিটি মেটা ব্যবহারকারীর থাকত দুটি পৃথক প্রোফাইল। একসময় জাকারবার্গ এও বলেছিলেন, প্রতিবছর ব্যবহারকারীদের বন্ধু তালিকা মুছে দেওয়া উচিত। এতে নতুন করে বন্ধুদের খুঁজে বের করতে ফেসবুকে তারা আরো বেশি সময় ব্যয় করবে। ফেসবুক চিরকাল বিনা মূল্যে ব্যবহার করা যাবে, প্রোফাইল তৈরির সময় এমনটাই লেখা থাকলেও প্রিমিয়াম ফেসবুক চালু নিয়েও মেটা কাজ করেছে একসময়। যেসব ব্যবহারকারী চায় না মেটা তাদের ব্যক্তিগত তথ্য ব্যাবসায়িক কাজে ব্যবহার করুক, তাদের জন্য বার্ষিক ফি চালু করার কথা ভেবেছিল মেটা। শুধু বিজ্ঞাপনের জন্য আলাদা ফিড তৈরির কথাও তারা ভেবেছিল।

 

কী হতে পারে

মামলাটির শুনানি ও অন্যান্য কার্যক্রম চলবে আরো অনেকটা সময়। যদি শেষ পর্যন্ত মেটা হেরে যায়, তাহলে ইনস্টাগ্রাম ও হোয়াটসঅ্যাপ বিক্রি করতে হতে পারে মেটার। মনোপলি মামলায় কিছুদিন আগে গুগলও হেরেছে, ক্রোম ব্রাউজারের পাশাপাশি অ্যাডসেন্স সেবাও আলাদা প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিক্রির আদেশ দিয়েছেন আদালত। মেটার ক্ষেত্রেও এমনটাই হওয়ার সম্ভাবনা খুবই বেশি।

 

 

 

মন্তব্য
একনজরে

প্লে স্টেশনের দাম বাড়ল

টেকবিশ্ব ডেস্ক
টেকবিশ্ব ডেস্ক
শেয়ার
প্লে স্টেশনের দাম বাড়ল
প্লে স্টেশন ৫ এর দাম ১৫ শতাংশ বেড়েছে।

গেমারদের ঘাড়ে বসতে চলেছে ট্রাম্প ট্যারিফের বোঝা। যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড এবং গোটা ইউরোপেই প্লে স্টেশন ৫ কনসোলের দাম বাড়াচ্ছে সনি। আগামী সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারেও নতুন মূল্য নির্ধারিত হবে। আনুষ্ঠানিক বক্তব্যে সনি মূল্যবৃদ্ধির দায় উচ্চ মূল্যস্ফীতি এবং মুদ্রা বিনিময় হারে অস্থিরতার ওপর চাপিয়েছে।

যদিও বাজার বিশ্লেষক ও ক্রেতাদের ধারণা ভিন্ন।

সনির চীনা কারখানায় তৈরি হয় প্রায় সব প্লে স্টেশন ৫ কনসোল। তাই সব বাজার বিশ্লেষক একমত, চীনে তৈরি পণ্যের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্পের বসানো ১৪৫ শতাংশ ট্যারিফই এ জন্য দায়ী। কম্পিউটার ও স্মার্টফোনের ওপর বাড়তি শুল্ক আপাতত স্থগিত করা হলেও গেমিং কনসোলের ওপর সেটি বলবৎ আছে।

প্লে স্টেশন ৫ এর ডিস্কড্রাইভবিহীন ডিজিটাল সংস্করণের মূল্যই বেশি বাড়ানো হয়েছে, প্রায় ১৫ শতাংশ। ডিস্কড্রাইভসহ সংস্করণের দামও ৫ শতাংশ থেকে ১০ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। তবে প্লে স্টেশন ৫ প্রো মডেলের দাম থাকছে অপরিবর্তিত। ডিজিটাল সংস্করণের সঙ্গে ব্যবহার্য ডিস্কড্রাইভ অ্যাকসেসরির দাম উল্টো কমানো হয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের ট্যারিফের দায় নিতে হচ্ছে বিশ্বের প্রতিটি প্লে স্টেশন গেমারের। প্রতিটি ফোরামে এ বিষয়ে বিরক্তি ও ক্ষোভ প্রকাশ করে পোস্ট করছে হাজারো গেমার। পাশাপাশি তারা এ-ও আশঙ্কা করছে, হয়তো সনির দেখাদেখি অন্যান্য প্রযুক্তি নির্মাতা প্রতিষ্ঠানও যুক্তরাষ্ট্রের বাজারের ক্ষতি অন্যান্য দেশের ক্রেতাদের ওপর চাপানোর চেষ্টা করবে।

 

নিষিদ্ধ হতে পারে ডিপসিক

ট্রাম্প প্রশাসন চীনা এআই ল্যাব ডিপসিকের ওপর নতুন নিষেধাজ্ঞা আরোপ করার কথা বিবেচনা করছে। এতে প্রতিষ্ঠানটি আর এনভিডিয়ার এআই চিপ অবাধে কিনতে পারবে না।

পাশাপাশি আমেরিকায় এআই পরিষেবা পরিচালনায়ও বিধি-নিষেধ আরোপ হবে।

এআই বাজারে চীনের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় এগিয়ে থাকতেই ট্রাম্প প্রশাসন এ নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার কথা ভাবছে। আর১ মডেলটি প্রকাশের মাধ্যমে গত ডিসেম্বর সিলিকন ভ্যালি এবং ওয়াল স্ট্রিট উভয়কেই চমকে দিয়েছিল ডিপসিক। মার্কিন এআই সেবাগুলোর তুলনায় অর্ধেকেরও কম খরচে প্রায় একই সেবা দিতে সক্ষম ডিপসিক, তাই বাজার হারানোর আশঙ্কায় রয়েছে এসব প্রতিষ্ঠান। ডিপসিকের জনপ্রিয়তা বেড়ে যাওয়ায় মার্কিন প্রতিষ্ঠানগুলোও কম মূল্যে এআই সেবা দিতে চাপ অনুভব করছে।

বিশ্বের প্রতিটি এআই সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান এনভিডিয়ার তৈরি চিপের ওপর নির্ভরশীল। চাহিদার তুলনায় চিপের সরবরাহও অপ্রতুল। বাজারের বেশির ভাগ এআই চিপ কেনার কথা ভাবছে ডিপসিক। এতে মার্কিন প্রতিষ্ঠানগুলো যথেষ্ট হার্ডওয়্যার না পেয়ে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ার জোরালো সম্ভাবনা আছে। তাই এনভিডিয়া কত চিপ ডিপসিকের কাছে বিক্রি করতে পারবে, সেটি বেঁধে দেবে মার্কিন সরকার। 

তবে কিছু মডেল তৈরি করতে আইপি চুরি করেছে কি না ডিপসিক, এ নিয়ে প্রশ্ন রয়েই গেছে। ওপেনএআই অভিযোগ করেছে যে চীনা প্রতিষ্ঠানটি তাদের মডেলগুলো ডিস্টিল করেছে, যা ওপেনএআইয়ের ব্যবহারের শর্তাবলি লঙ্ঘন করে।

 

 

 

 

মন্তব্য

ড্রোন যখন শিল্পচর্চার মাধ্যম

    সমরাস্ত্র, উড়ন্ত ফটোগ্রাফির পর এখন বিভিন্ন প্রদর্শনীর অংশ হয়ে উঠেছে ড্রোন। পহেলা বৈশাখ উদযাপনের অংশ হিসেবে এবার রাজধানীতে আয়োজিত ড্রোন শো রীতিমতো হৈচৈ ফেলে দিয়েছে। ড্রোন শোয়ের ইতিহাস ও প্রযুক্তি নিয়ে বিস্তারিত জানাচ্ছেন এস এম তাহমিদ
শেয়ার
ড্রোন যখন শিল্পচর্চার মাধ্যম
ড্রোনে লেখা বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যকার বন্ধুত্বের শুভেচ্ছাবার্তা। ছবি : টিবিএস

যুদ্ধের সমরাস্ত্র থেকে শিল্পকলার মাধ্যম

দূর থেকে নিয়ন্ত্রণযোগ্য উড়ন্ত যান বা ড্রোন তৈরি শুরু হয়েছিল যুদ্ধে ব্যবহারের জন্য। ক্ষুদ্র ড্রোন ব্যবহার করে শত্রুদের অবস্থান পর্যবেক্ষণ করা যায়, এমনকি বড় ড্রোনের মাধ্যমে শত্রু দমনও করা যায়। ২০১০-১৫ পর্যন্ত এসবের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল ড্রোনের ব্যবহার। ২০১৫ সালে প্রথমবার ড্রোন কাজে লাগিয়ে কোরিওগ্রাফি করে বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিল আর্স টেকনিকা ও ইন্টেলের যৌথ প্রযোজনা।

সে বছরের ৪ নভেম্বর জার্মানির হামবুর্গ শহরের রাতের আকাশে নেচেছিল ১০০টি ড্রোন। উড়ন্ত যন্ত্রগুলোর আলোকচ্ছটায় সেদিনই পরিষ্কার হয়ে যায় ড্রোন আর কেবলই সমরাস্ত্র নয়, এখন থেকে এটি সাধারণ জীবনের অংশ এবং শিল্পকলারও মাধ্যম।

ঐতিহাসিক সেই প্রদর্শনীর পর প্রতিনিয়ত এগিয়েছে ড্রোন শো প্রযুক্তি। এরপর ২০১৬ সালে ভিভিড সিডনি ফেস্টিভালে আবারও ইন্টেলের ড্রোনগুলো অংশ নেয়।

২০১৮ সালে উইন্টার অলিম্পিক গেমসের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানেরও বড় চমক ছিল ড্রোন শো। এই দুটি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে প্রযুক্তি প্রদর্শনীর গণ্ডি কাটিয়ে ড্রোন শো হয়ে ওঠে সর্বজনীন উৎসবের অংশ। রাতের আকাশকে ক্যানভাস হিসেবে ব্যবহৃত হওয়ায় ড্রোন শো-কে বলা হচ্ছে একবিংশ শতাব্দীর নতুন টেকনোলজির আতশবাজি। মনোরঞ্জনের জন্য বিপজ্জনক বাজি ফুটানোর চেয়ে ড্রোন ব্যবহার শুধু নিরাপদই নয়, এর মাধ্যমে আতশবাজির চেয়ে আরো চমৎকার প্রদর্শনী আয়োজন করা সম্ভব।

 

ড্রোন শো নয় লাইট শো

ড্রোন শো নয়, একে বরং বলা উচিত লাইট শো। ড্রোন শুধু আলোর বাহক। প্রতিটি ড্রোনে থাকে বেশ কিছু উজ্জ্বল এলইডি লাইট। লাইটগুলোর রং, ঔজ্জ্বল্য এবং জ্বলা-নেভার গতি প্রয়োজন অনুযায়ী নিখুঁতভাবে প্রোগ্রাম করা যায়। প্রতিটি লাইটকে ধরা হয় ড্রোন আর্টের একটি পিক্সেল।

অর্থাৎ সব কটি ড্রোন মিলিয়ে তৈরি হয় একটি ডিসপ্লে। লাইটগুলো সঠিক অবস্থানে পৌঁছতে ব্যবহৃত হয় কোয়াডকপ্টার মডেলের ড্রোন। চারটি মটর-প্রপেলারযুক্ত এই বাহনগুলো সুনিপুণভাবে নিয়্ন্ত্রণ করা যায়, প্রয়োজনে আধা ইঞ্চি এদিক-সেদিক করাও সম্ভব। বাণিজ্যিকভাবে যেসব ড্রোন বাজারে বিক্রি হয়, তার সঙ্গে শো-এ ব্যবহৃত ড্রোনের বেশ কিছু পার্থক্য আছে। এসব ড্রোনে নেই কোনো বডি, সরাসরি ফ্রেমের ওপরেই লাইট এবং ব্যাটারি বসানো হয়। ক্যামেরা বা অন্যান্য হার্ডওয়্যার ব্যবহৃত হয় না। এ ধরনের ড্রোন তৈরির মূল মন্ত্র হচ্ছে যতটা সম্ভব ওজন কমানো। পাশপাশি এতে ব্যবহার করা জিপিএস এবং নেভিগেশন সিস্টেম বাণিজ্যিক ড্রোনের চেয়ে অনেক বেশি নিখুঁত, কেননা শো করার সময় ড্রোনের অবস্থান কয়েক ইঞ্চি এদিক-সেদিক হলেই কোরিওগ্রাফি একেবারে নষ্ট হয়ে যাবে।

থ্রিডি মডেলিংয়ের সঙ্গে ড্রোন শোয়ের মিল আছে। কী ডিজাইন আকাশের বুকে তুলে ধরা হবে, সে অনুযায়ী প্রতিটি ড্রোনের অবস্থান বিশেষ সফটওয়্যারের মাধ্যমে ম্যাপ করা হয়। এরপর সেটি পায় ওড়ার নির্দেশিকা। প্রতিটি ড্রোন নিজস্ব পথে উড়লেও সব কটি মিলেই তৈরি হয় অবাক করে দেওয়ার মতো চমৎকার দৃশ্য। জিপিএসের পাশাপাশি রিয়েল টাইম কাইনেম্যাটিক (আরটিকে) প্রযুক্তিও এতে ব্যবহৃত হয়, যাতে খুব কাছ দিয়ে উড়লেও ড্রোনগুলোর মধ্যে সংঘর্ষ না হয়।

ড্রোনগুলোর নিয়ন্ত্রণে থাকে একটি কেন্দ্রীয় কম্পিউটার, রিমোট কন্ট্রোল ব্যবহার করে ড্রোন পাইলটরা এতটা সমন্বিতভাবে কোরিওগ্রাফি করতে পারেন না। যদি কোনো ড্রোনে ত্রুটি দেখা দেয়, সেটি নিজ থেকেই মাটিতে ফিরে আসতে পারে। কিছু ক্ষেত্রে ড্রোনের মধ্যে স্বয়ংক্রিয় সিস্টেম দেওয়া হয়, যাতে কোনো বাধায় পড়লে সেটি নিজে থেকেই অতিক্রম করতে পারে।

ড্রোন যখন শিল্পচর্চার মাধ্যম

প্রদর্শনীতে ব্যবহৃত এমকে-ইউডি১১৬৬ মডেলের ড্রোন

 

কী প্রয়োজন

মাঝারি আকৃতির ড্রোন শো করার জন্য কয়েক শ পর্যন্ত ড্রোন লাগে, বড় আয়োজনে সংখ্যাটি কয়েক হাজার পর্যন্ত হতে পারে। সেসব নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজনীয় হার্ডওয়্যার, সফটওয়্যার এবং প্রোগ্রামিংয়ের জন্য চাই ১০ থেকে ২০ জন পর্যন্ত লোকবল। আবহাওয়া, দর্শনার্থীদের অবস্থান, শোয়ের স্থানে সমস্যা সৃষ্টি করতে পারেএমন কোনো স্থাপনা আছে কি না সেসব বিবেচনা করে তবেই পরিকল্পনা করা হয়। শুধু ড্রোন বাধাপ্রাপ্ত হতে পারেএমন স্থাপনাই সমস্যার কারণ হতে পারে তা নয়। অতিরিক্ত ওয়াইফাই বা মোবাইল নেটওয়ার্ক টাওয়ার থাকলে, বা কাছাকাছি  নো-ফ্লাই জোন থাকলেসেটাও শোয়ের জন্য সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে।

ড্রোন শোয়ের অন্যতম বড় অংশ এর সঙ্গে ব্যবহৃত আবহ সংগীত। মানসম্মত স্পিকার সিস্টেম এবং ড্রোনের সঙ্গে সাউন্ডের সমন্বয় করাও এ প্রদর্শনীর অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ। বড় প্রদর্শনীর ক্ষেত্রে অনেক সময় কয়েক মাস শুধু প্রস্তুতিতেই ব্যয় হতে পারে। প্রদর্শনী চলার সময় ড্রোন নষ্ট হতে পারে, সে জন্য চাই বাড়তি ড্রোন, যাতে চট করে বদলে নেওয়া যায়। তবে সব কিছুর আগে চাই অনুমতি, প্রদর্শনী চলাকালে সেই এলাকায় যাতে যাত্রী ও পণ্যবাহী বা সামরিক উড়োজাহাজ ঢুকে না পড়ে সে জন্য আগে থেকেই যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে নিতে হয় অনুমতিপত্র।

 

বাংলাদেশে ড্রোন শো

বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো ড্রোন শো আয়োজিত হয়েছিল ২০২২ সালের ৩১ মার্চ। স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তির অংশ হিসেবে রাজধানীর হাতিরঝিলে আয়োজিত হয়েছিল এটি। তবে এর পরিসর ছিল বেশ ছোট, ব্যবহৃত হয়েছিল মাত্র ৫০০ ড্রোন। এ বছর বাংলা বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের অংশ হিসেবে বেশ বড় পরিসরে ড্রোন শো আয়োজিত হয়। রাজধানীর মানিক মিয়া এভিনিউতে সন্ধ্যার পর আকাশে উড়তে শুরু করে দুই হাজার ৬০০ ড্রোন। পুরো আয়োজনটির দায়িত্বে ছিল চীনা দূতাবাসের সৌজন্যে এবং বাংলাদেশের সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়।

প্রদর্শনীটি পরিচালনায় ৬ সদস্যের চীনা বিশেষজ্ঞ দল গত ফেব্রুয়ারি মাসে কাজ শুরু করে। ড্রোন শোটি পরিচালনা করেছেন ১৩ জন চীনা পাইলট বা ড্রোন চালনাকারী বিশেষজ্ঞ। রাতের আকাশে একে একে প্রদর্শিত হয় ছাত্র-জনতার আন্দোলনে অস্ত্রের মুখেও বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা শহীদ আবু সাঈদ ২৪-এর বীর মোটিফ, খাঁচা ভেঙে স্বাধীনতা পাওয়া পায়রা, পানির বোতল হাতে মীর মুগ্ধের প্রতীকী মোটিফ এবং ফিলিস্তিনের মুক্তি কামনা করে প্রার্থনা। বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যকার বন্ধুত্বের শুভেচ্ছাবার্তাও ছিল এর অংশ।

 

ভবিষ্যৎ

আতশবাজি শুধু পরিবেশের জন্যই ক্ষতিকর তা নয়, এর আওয়াজে জনমানুষ ও পাখপাখালির ক্ষতি হয়। পরিবেশদূষণের মাত্রাও নেহাত কম নয়। প্রতিবার বাজি ফোটানোর পর আবারও নতুন করে সেসব তৈরি করতে হয়। সব মিলিয়ে বাজির বদলে ড্রোন শোয়ের জনপ্রিয়তা প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাবে ধরে নেওয়াই যায়।

 

 

 

মন্তব্য

সর্বশেষ সংবাদ