ঋণ পরিশোধ নিয়ে ইসলামের নির্দেশনা

ড. ইকবাল কবীর মোহন
ড. ইকবাল কবীর মোহন
শেয়ার
ঋণ পরিশোধ নিয়ে ইসলামের নির্দেশনা

হিসাববিজ্ঞানের ভাষায়, আর্থিক লেনদেন বলতে এমন একটি ব্যাবসায়িক ঘটনাকে বোঝায়, যেটিকে অবশ্যই অর্থের মাপকাঠিতে পরিমাপ করা সম্ভব। এই লেনদেন কর্মকাণ্ড ব্যবসা বা কারবারের কর্মকাণ্ড ও আর্থিক অবস্থার ওপর প্রভাব ফেলে। মূলত অর্থের সঙ্গে সম্পর্ক আছে—এমন লেনদেনকেই আর্থিক লেনদেন বলা হয়। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে আর্থিক লেনদেন একটি অপরিহার্য বিষয়।

সারা দিন আমরা কোনো না কোনোভাবে আর্থিক লেনদেনের সঙ্গে জড়িত আছি। জীবন পরিচালনার জন্য নানা জিনিস ও পণ্য আমাদের সংগ্রহ করতে হয় অথবা কোনো না কোনো সেবা আমাদের গ্রহণ করতে হয়। 

আর এসবের সঙ্গে অর্থের সম্পর্ক রয়েছে। অর্থের বিনিময়ে আমরা কোনো না কোনো জিনিস ক্রয় করি।

যেমন—খাবারদাবার, পোশাক, ওষুধ ইত্যাদি। আবার অনেক সময় নানা রকম সেবাও গ্রহণ করি। যেমন ঘরের লাইট নষ্ট হয়েছে বা পানির কল খারাপ হয়েছে তা ঠিক করার জন্য মিস্ত্রির সহায়তা নেই। তাকে পারিশ্রমিক দিই।
এখানে সেবার বিনিময়ে অর্থের লেনদেন হয়। আর এসবই আর্থিক লেনদেনের অন্তর্ভুক্ত।

আর্থিক লেনদেন ও মুমিনের পরিচয়

সামাজিক জীব হিসেবে আমাদের একে অন্যের সাহায্য-সহযোগিতা নিয়েই বেঁচে থাকতে হয়। ফলে মানুষের সঙ্গে আমাদের প্রায়ই অনেক ধরনের আর্থিক লেনদেন হয়ে থাকে। সাধারণভাবে এই লেনদেনের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা, আমানতদারিতা ও সততা হলো অন্যতম একটি মাপকাঠি।

যার লেনদেন স্বচ্ছ তিনিই সমাজে সৎ ও সততার অধিকারী। ইসলামেও লেনদেনকে ধার্মিকতা মাপকাঠি ধরা হয়েছে। একজন মুমিনকে অবশ্যই লেনদেনে সৎ ও স্বচ্ছ থাকতে হবে। সময়মতো লেনদেন সম্পন্ন করতে হবে। এ ক্ষেত্রে ওয়াদা ঠিক রাখতে হবে। একজন মুমিনের সত্যবাদিতার পরিচয় হচ্ছে তার লেনদেন। একবার এক ব্যক্তি উমর (রা)-এর কাছে একজনের প্রশংসা করে বলল, ‘ওই ব্যক্তি খুব সত্যবাদী।’ তখন উমর (রা.) বললেন, ‘আচ্ছা তুমি কী তার সঙ্গে সফর করেছ? লোকটি জবাবে না বলল। উমর (রা.) আবার বললেন, তুমি কী তার সঙ্গে কোনো লেনদেন করেছ? এবারও লোকটি বলল,  না। এরপর উমর (রা.) জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কী তার কাছে কোনো আমানত রেখেছ? সে এবারও বলল, না।’ তখন উমর (রা.) বললেন, ‘তাহলে ওই লোকটির ব্যাপারে তোমার কোনো ধারণা নেই। মনে হয়, তুমি তাকে মসজিদে রুকু-সিজদা করতে দেখেছ অর্থাৎ শুধু মসজিদের গণ্ডিতে দেখেই যে তাকে ধার্মিক ও সত্যবাদী মনে করেছ এবং তার গুণের প্রশংসা করেছ, এটা ঠিক নয়। প্রকৃত পরিচয় তো জানবে লেনদেনের পর।’ (কানজুল উম্মাল, হাদিস : ২৫৫৭০)

আমরা জীবনের প্রতিটি পরতে পরতে লেনদেন বা মুয়ামালাতের সঙ্গে সম্পৃক্ত। লেনদেনের মাধ্যমে জীবন যাপন করা কারো পক্ষেই সম্ভব নয়। আর লেনদেন ছাড়া কারো পক্ষে সঠিকভাবে ইবাদত-বন্দেগি করাও অসম্ভব। দ্বিনের ইবাদত-বন্দেগি আমাদের জন্য সীমিত। কিন্তু মুয়ামালাত বা লেনদেনের পরিধি বা সীমা ব্যাপক বিস্তৃত। তাই ইসলামে মুয়ামালাত বা লেনদেনের গুরুত্ব অনেক বেশি। 

ইবাদত দুই ধরনের 

আমরা যেসব ইবাদত করি বা অধিকার বা দায়দায়িত্ব বিষয়ের মোকাবেলা করি, তা দুই ধরনের। এক. আল্লাহর হক, দুই. বান্দার হক। আল্লাহর হক সঠিকভাবে পালনে ব্যর্থ হলে তাঁর কাছে মার্জনা চেয়ে ক্ষমা পেতে পারি। কিন্তু বান্দার  হক বা বান্দার সঙ্গে লেনদেনে ব্যর্থ হলে এই ত্রুটি বা গুনাহ আল্লাহ মাফ করবেন না।

তাই বান্দার হক সঠিকভাবে আদায় করা বা লেনদেন ও কায়কারবারে স্বচ্ছ থাকার ব্যাপারে আল্লাহর রাসুল (সা.) সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছেন। তিনি বলেন, ‘যে ব্যক্তি তার কোনো ভাইয়ের সম্মানহানির মাধ্যমে বা অন্য কোনো প্রকারে তার ওপর জুলুম করেছে, সে যেন আজই তার সঙ্গে লেনাদেনা সাফ করে নেয়। ওই দিন আসার পূর্বেই, যেদিন তার কাছে কোনো দিনার-দিরহাম (মানে টাকা-পয়সা) থাকবে না। সেদিন যদি তার কাছে কোনো নেক আমল থাকে তবে তার জুলুম পরিমাণ সেখান থেকে নিয়ে নেওয়া হবে এবং পাওনাদারকে আদায় করে দেওয়া হবে।  আর যদি কোনো নেক আমল না থাকে তাহলে যার ওপর জুলুম করা হয়েছে তার পাপের বোঝা জুলুম অনুযায়ী তার ঘাড়ে চাপানো হবে।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ২৪৪৯)

আর্থিক লেনদেনে মুমিনের দায়িত্ব

আর্থিক লেনদেনের বেলায় একজন মুমিনের দায়িত্ব হচ্ছে সে সময়মতো আর্থিক লেনদেন সম্পন্ন করবে। লেনদেনের সময় ঠিক রাখবে, মানে ওয়াদা রক্ষা করবে, ব্যবসায় করলে ওজনে কম দেবে না, বিক্রির সময় মিথ্যা শপথ কাটবে না, পণ্যের সঠিক গুণ প্রকাশ করবে, প্রতারণা ও ধোঁকাবাজি করবে না, মজুদদারি করবে না ইত্যাদি সব ক্ষেত্রে সততা, স্বচ্ছতা ও আমানতদারিতা রক্ষা করে চলবে। যে ব্যবসায়ী ওজনে কম দেয় তার সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, ‘দুর্ভোগ তাদের জন্য যারা ওজনে কম দেয়।’ (সুরা : মুতাফফিফিন, আয়াত : ১)

যারা অন্যায়ভাবে বা প্রতারণামূলকভাবে মানুষের সম্পদ গ্রাস করে তাদের সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা একে অন্যের সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস করবে না।’ (সুরা : নিসা, আয়াত : ২৯)

লেনদেন সঠিকভাবে না হলে বা তাতে অস্বচ্ছতা থাকলে মানুষের ইবাদতও কবুল হয় না। আমরা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য ইবাদত-বন্দেগি করি, নামাজ পড়ি, রোজা রাখি এবং অন্যান্য ভালো আমল করি। তবে যে ব্যক্তি অন্যায়ভাবে বা অবৈধ পথে সম্পদ উপার্জন করে বা অস্বচ্ছ আর্থিক লেনদেন করে, আল্লাহ তার ইবাদত-বন্দেগি ও দোয়া কবুল করেন না। আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেন, ‘হে আমার রব, হে আমার রব! অথচ তার খাদ্য-পানীয় হারাম, পোশাক-পরিচ্ছদ হারাম, তাহলে কিভাবে তার দোয়া কবুল হবে?’ (তিরমিজি, হাদিস : ২৯৮৯)

ঋণ পরিশোধে গড়িমসি করার পরিণাম

আর্থিক লেনদেন বা ঋণের বেলায় আমাদের অনেকে ঋণ না দেওয়ার প্রবণতা লক্ষ করি। অনেক সময় তা পরিশোধে গড়িমসি করতে দেখা যায়। অনেকের মধ্যে আর্থিক সংগতি থাকা সত্ত্বেও তার মধ্যে গড়িমসি বা টালবাহানার দোষ পরিলক্ষিত হয়। এই গড়িমসি বা টালবাহানা সম্পর্কে ইসলাম সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছে। মহানবী (সা.) বলেন, ‘সচ্ছল ব্যক্তির ঋণ পরিশোধে টালবাহানা বা গড়িমসি করা অন্যায় বা জুলুম।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ২৪০০)

তিনি অন্যত্র বলেন, ‘যে সচ্ছল ব্যক্তি ঋণ পরিশোধে গড়িমসি করে, তাকে অপমান ও শাস্তি উভয়টিই দেওয়া আমার কাছে হালাল।’ (আবু দাউদ, হাদিস : ৩৬২৮)

মহানবী (সা.) আরো বলেন, ‘কোনো ব্যক্তি তার হাত দিয়ে যা গ্রহণ করেছে, তা পরিশোধ না করা পর্যন্ত সে দায়ী থাকবে।’ (তিরমিজি, হাদিস : ১২৬৬)

সঠিক সময়ে ঋণ পরিশোধের বিষয়টি এতটাই গুরুত্বপূর্ণ যে তার বিলম্বে ঋণগ্রহীতা ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং কিয়ামতের দিন সে ক্ষতির সম্মুখীন হয়। আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেন, ‘ঋণগ্রস্ত ব্যক্তির আত্মা লটকে থাকে, যতক্ষণ না তার পক্ষ থেকে কেউ সেই ঋণ পরিশোধ করে দেয়।’ (ইবনে মাজাহ, হাদিস : ২৪১৩)

রাসুল (সা.) অন্যত্র বলেন, ‘যে ব্যক্তি একটি দিনার অথবা দিরহাম ঋণ রেখে মারা যাবে, কিয়ামতের দিন তাকে তার নেকি থেকে সেই ঋণ পরিশোধ করতে হবে। কারণ সেখানে কোনো দিনার বা দিরহাম নেই।’ (ইবসে মাজাহ, হাদিস : ৫৫১৯)

শহীদের বেলায়ও ঋণের ব্যাপারে কোনো মাফ নেই। যেখানে বলা হয়েছে শহীদের সব গুনাহ মাফ করা হবে এবং তারা বিনা বিচারে জান্নাত লাভ করবেন। তার পরও শুধু ঋণের বিষয়টির মাফ নেই। তাই রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘ঋণ পরিশোধের পাপ ছাড়া শহীদদের সব পাপ মাফ করে দেওয়া হবে।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ২৯১২)

ঋণের অর্থ পরিশোধ করার সময় খুশি হয়ে বেশি ফেরত দেওয়ার বিধানও ইসলামে রয়েছে। সাহাবি জাবের (রা.) বলেন, ‘রাসুল (সা.) আমার কাছ থেকে কিছু ঋণ নিয়েছিলেন। পরে যখন তা আমাকে ফেরত দেন, তখন আমার পাওনার চেয়েও বাড়িয়ে দিলেন।’ (আবু দাউদ, হাদিস : ৩৩৪৯)

আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আমাদের সবাইকে লেনদেনের গুরুত্ব এবং তার সঠিক বিধান সম্পর্কে অবহিত হওয়ার তৌফিক দান করুন।

মন্তব্য

সম্পর্কিত খবর

রমজানের রোজা যেভাবে ফরজ হয়েছে

ড. আবুু সালেহ মুহাম্মদ তোহা
ড. আবুু সালেহ মুহাম্মদ তোহা
শেয়ার
রমজানের রোজা যেভাবে ফরজ হয়েছে

আরবি সাওম ও সিয়াম শব্দের অনুবাদ হিসেবে রোজা ব্যবহার হয়ে থাকে। রোজা ফারসি থেকে বাংলায় এসেছে। পবিত্র কোরআনে সাওম শব্দটি এক জায়গায় (সুরা : মারইয়াম, আয়াত : ২৬) আর সিয়াম শব্দটি ৯ জায়গায় [সুরা : বাকারাহ, আয়াত : ১৮৩, ১৮৭ (দুইবার), ১৯৬ (দুইবার); সুরা : নিসা, আয়াত : ৯২; সুরা : মায়িদা, আয়াত : ৮৯, ৯৫; সুরা : মুজাদালা, আয়াত : ৪] ব্যবহার হয়েছে। বিভিন্ন হাদিসে শব্দ দুটির প্রচুর ব্যবহার রয়েছে।

সাওম ও সিয়ামের মূল অক্ষর একই। ইসলামী পরিভাষায় সাওম বা সিয়াম হলো, সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য পানাহার ও যৌনাচার থেকে বিরত থাকা। যুগে যুগে রোজার বিধান ছিল এবং ইসলামেও এ বিধান প্রবর্তন হয়েছে।    

ইসলাম-পূর্ব যুগে রোজা : ইসলাম-পূর্ব সব যুগেই রোজার বিধান ছিল।

আলী (রা.) ও হাসান বসরি (রহ.) থেকে বর্ণিত আছে যে আদম (আ.)-এর যুগ থেকে শুরু করে সব উম্মতের ওপরই রোজা ফরজ ছিল। (ইজুহুল মিশকাত, দ্বিতীয়-খণ্ড,  পৃষ্ঠা-৬৫৬)

মুুসা (আ.)-এর রোজা প্রসঙ্গে কোরআন মজিদে বর্ণিত হয়েছে। আল্লাহ বলেন, ‘স্মরণ করো, মুসার জন্য আমি ৩০ রাত নির্ধারিত করি এবং আরো ১০ দ্বারা তা পূর্ণ করি, এভাবে তার প্রতিপালকের  নির্ধারিত সময় ৪০ রাতে পূর্ণ হয়।’ (সুরা : আরাফ, আয়াত : ১৪২)

মুুসা (আ.) তাওরাতপ্রাপ্তির জন্য প্রথমে ৩০ দিন, পরে আরো ১০ দিন বাড়িয়ে মোট ৪০ দিন রোজাসহ ইতিকাফ অবস্থায় ধ্যানমগ্ন থেকে ছিলেন।

ইহুদিদের আশুরার রোজা প্রসঙ্গে হাদিসে বর্ণিত হয়েছে। ইবন আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) মদিনায় আগমন করে দেখলেন যে ইহুদিরা আশুরার দিন রোজা পালন করে। তিনি তাদের এদিনের রোজার ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করলেন। তারা বলল, এদিনে মুসা (আ.) ফেরাউনের ওপর বিজয় লাভ করেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, তোমরা (মুসলমানরা) মুসা (আ.)-এর অধিক নিকটবর্তী।
কাজেই তোমরাও রোজা পালন করো। (সুনান আদ-দারিমি, হাদিস : ১৭৫৯)

দাউদ (আ.)-এর রোজা সম্পর্কে হাদিস বর্ণিত হয়েছে। আবদুল্লাহ ইবন আমর ইবন আল-আস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) আমাকে বলেন, তুমি কি সব সময় রোজা রাখো আর রাতভর নামাজ আদায় করে থাকো? আমি বললাম, হ্যাঁ। তিনি বলেন, এরূপ করলে তোমার চোখ বসে যাবে এবং শরীর দুর্বল হয়ে যাবে। যে বছরজুড়ে রোজা রাখল সে যেন রোজাই রাখল না। আর তুমি প্রতি মাসে তিন দিন করে রোজা রাখো, তাই বছরজুড়ে রোজা রাখা বা বছরজুড়ে রোজা রাখার মতো। তিনি বলেন, আমি এর চেয়ে বেশি সামর্থ্য রাখি। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, তাহলে তুমি দাউদ (আ.)-এর রোজা রাখো। তিনি এক দিন রোজা রাখতেন আর এক দিন রোজা ছেড়ে দিতেন। তিনি শত্রুর সম্মুখীন হলে পালায়ন করতেন না। (বুখারি, হাদিস : ১৮৭৮)

ইসলাম-পূর্ব যুগের সামগ্রিক রোজা বিষয়ে আল্লাহ বলেন, ‘হে মুমিনরা! তোমাদের জন্য রোজার বিধান দেওয়া হলো, যেমন বিধান তোমাদের পূর্ববর্তীদের দেওয়া হয়েছিল, যাতে তোমরা মুত্তাকি হতে পারো।’ (সুরা : বাকারাহ, আয়াত : ১৮৩)

ইসলামে রোজার প্রবর্তন : ইসলাম-পূর্ব সব যুগে রোজার বিধান থাকলেও সেসব শর্ত, প্রকৃতি ও ধারাবাহিকতায় ইসলামে রোজা ফরজ হয়নি; বরং ইসলামে রোজা স্বমহিমায় উদ্ভাসিত। আত্মিক, নৈতিক ও চারিত্রিক কল্যাণের আধার। রহমত, বরকত ও মাগফিরাত দ্বারা সমৃদ্ধ। স্বাতন্ত্র্য বৈশিষ্ট্যে ভরপুর মাসব্যাপী এই রোজা দ্বিতীয় হিজরিতে ফরজ করা হয়। রাসুল (সা.) মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করার দ্বিতীয় বছরে শাবান মাসের শেষ দশকে রমজানের রোজা আদায়ের নির্দেশনা সংবলিত সুরা বাকারার ১৮৩-১৮৫ আয়াত অবতীর্ণ হয়। অবশ্য রমজানের রোজা ফরজ হওয়ার আগে আশুরার রোজা (১০ মহররম) এবং আইয়ামে বিজ তথা চান্দ্রমাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখের রোজা ফরজ ছিল। 

রমজানের রোজা ফরজ হওয়ার পর সেসব রোজার বিধান নফলে পরিণত হয়েছে। মুয়াজ ইবন জাবাল (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নামাজ তিন ধাপে পরিবর্তিত হয়েছে এবং রোজাও তিন ধাপে পরিবর্তিত হয়েছে। রোজার তিন ধাপের তিনি ব্যাখ্যা দিয়েছেন।

প্রথম ধাপ : রাসুলুল্লাহ (সা.) প্রতি মাসে তিন দিন (আইয়ামে বিজ তথা চান্দ্রমাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখের রোজা) এবং আশুরার রোজা (১০ মহররম) পালন করতেন।

দ্বিতীয় ধাপ : এরপর অবতীর্ণ হয়—(হে মুমিনরা! তোমাদের জন্য রোজার বিধান দেওয়া হলো, যেমন বিধান তোমাদের পূর্ববর্তীদের দেওয়া হয়েছিল, যাতে তোমরা মুত্তাকি হতে পারো। রোজা নির্দিষ্ট কয়েক দিনের। তোমাদের মধ্যে কেউ অসুস্থ হলে বা সফরে থাকলে অন্য সময় এই সংখ্যা পুরো করে নিতে হবে। তা যাদের অতিশয় কষ্ট দেয় তাদের কর্তব্য, এর পরিবর্তে ফিদয়া—একজন অভাবগ্রস্তকে খাদ্য দান করা। যদি কেউ স্বতঃস্ফূর্তভাবে সত্ কাজ করে তবে তা তার পক্ষে অধিক কল্যাণকর। আর রোজা পালন করাই তোমাদের জন্য অধিকতর কল্যাণপ্রসূ যদি তোমরা জানতে)। (সুরা : বাকারাহ, আয়াত : ১৮৩-১৮৪)

তখন যে চায় রোজা রাখে আর যে চায় রোজা না রেখে এর পরিবর্তে ফিদয়া—একজন অভাবগ্রস্তকে খাদ্য দান করে। এভাবে এক বছর যায়।

তৃতীয় ধাপ : এর পর অবতীর্ণ হয়, ‘রমজান মাস, এতে মানুষের দিশারি এবং সৎ পথের স্পষ্ট নিদর্শন ও সত্যাসত্যের পার্থক্যকারী রূপে কোরআন অবতীর্ণ হয়েছে। সুতরাং তোমাদের মধ্যে যারা এই মাস পাবে তারা যেন এই মাসে রোজা পালন করে। আর কেউ অসুস্থ হলে বা সফরে থাকলে অন্য সময় এই সংখ্যা পুরো করবে। আল্লাহ তোমাদের জন্য যা সহজ তা চান এবং যা তোমাদের জন্য ক্লেশকর তা চান না। এ জন্য যে তোমরা সংখ্যা পূর্ণ করবে এবং তোমাদের সত্ পথে পরিচালিত করার কারণে তোমরা আল্লাহর মহিমা ঘোষণা করবে এবং যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে পারো।’ (সুরা : বাকারাহ, আয়াত : ১৮৫)

তার পর থেকে রমজান মাস উপস্থিত হলে রোজার আবশ্যকতা প্রমাণিত হয়। আর মুসাফিরদের জন্য কাজা আদায় এবং রোজা আদায়ের সামর্থ্য নেই—এমন বৃদ্ধদের জন্য ফিদয়া প্রদানের সুযোগ অব্যাহত থাকে। (আবু দাউদ,  হাদিস : ৫০৭)

মন্তব্য
প্রতিদিনের আমল

কঠিন পরিস্থিতিতে ইউনুস (আ.)-এর দোয়া

ইসলামী জীবন ডেস্ক
ইসলামী জীবন ডেস্ক
শেয়ার
কঠিন পরিস্থিতিতে ইউনুস (আ.)-এর দোয়া

দুনিয়ার বিভিন্ন পরিস্থিতিতে মহান আল্লাহর কাছে নবী-রাসুলরা বিনীতভাবে দোয়া করেছেন। পবিত্র কোরআনে অনেক দোয়া বর্ণিত হয়েছে। ইউনুস (আ.) মাছের পেটে থাকায় অবস্থায় একটি দোয়া পড়েছিলেন। দীর্ঘ ৪০ দিন পর তিনি এই পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পান।

দোয়াটি ছিল-

لا إِلَهَ إِلَّا انْتَ سُبْحَنَكَ إِنِّي كُنْتُ مِنَ الظَّلِمِينَ

অর্থ : আপনি ছাড়া কোনো উপাস্য নেই। আপনার পবিত্রতা ঘোষণা করছি, নিশ্চয়ই আমি অপরাধীদের অন্তর্ভুক্ত। (সুরা মুমিনুন, আয়াত : ৮৭)

হাদিস শরিফে এসেছে, সাআদ বিন আবু ওয়াক্কাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বর্ণনা করেছেন, ইউনুস (আ.) মাছের পেটে উল্লিখিত দোয়া করেছিলেন। কারণ মুসলিম ব্যক্তি যখন কোনো পরিস্থিতির মুখোমুখি হয় তখন এই দোয়া পড়লে মহান আল্লাহ তার ডাকে সাড়া দেবেন।

(মুসলিম, হাদিস : ৩৫০৫)
 

মন্তব্য
হাদিসের বাণী

রাসুল (সা.) রমজানে বাতাসের গতিতে দান করতেন

ইসলামী জীবন ডেস্ক
ইসলামী জীবন ডেস্ক
শেয়ার
রাসুল (সা.) রমজানে বাতাসের গতিতে দান করতেন

রাসুল (সা.) বেশি বেশি দান-খয়রাত করতেন। আর পবিত্র রমজান মাসে এ দানের পরিমাণ আরো বেড়ে যেত। এমনকি প্রবহমান বাতাসের গতিতে তিনি দান-সদকা করতেন। হাদিস শরিফে এসেছে,

عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ، قَالَ‏:‏ كَانَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم، أَجْوَدَ النَّاسِ بِالْخَيْرِ، وَكَانَ أَجْوَدَ مَا يَكُونُ فِي شَهْرِ رَمَضَانَ، حَتَّى يَنْسَلِخَ، فَيَأْتِيهِ جِبْرِيلُ، فَيَعْرِضُ عَلَيْهِ الْقُرْآنَ، فَإِذَا لَقِيَهُ جِبْرِيلُ كَانَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم، أَجْوَدَ بِالْخَيْرِ مِنَ الرِّيحِ الْمُرْسَلَةِ‏.‏

ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী করিম (সা.) মানুষের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দানশীল ছিলেন।

রমজানে তিনি আরো বেশি দান করতেন। রমজান শেষ না হওয়া পর্যন্ত প্রতি রাতেই জিবরাইল (আ.) তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আসতেন। আর নবী করিম (সা.) তাঁকে কোরআন শোনাতেন। জিবরাইল (আ.) যখন তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতেন তখন তিনি প্রবাহমান বাতাসের চেয়ে বেশি দান করতেন।
(সহিহ বুখারি, হাদিস : ৬)

মন্তব্য

ফিতরার পরিমাণ কিভাবে নির্ধারণ হয়? টাকা ছাড়া দেওয়া যায় পণ্য

অনলাইন ডেস্ক
অনলাইন ডেস্ক
শেয়ার
ফিতরার পরিমাণ কিভাবে নির্ধারণ হয়? টাকা ছাড়া দেওয়া যায় পণ্য
ফাইল ছবি

পাঁচটি পণ্যের ওপর ভিত্তি করে ফিতরার পরিমাণ নির্ধারণ করা হয়। সেগুলোর কথা ইসলামের নবী হাদিসে উল্লেখ করেছেন। এগুলো হচ্ছে আটা, যব, কিশমিশ, খেজুর ও পনির। এসব পণ্যের যেকোনো একটি দ্বারা ফিতরা প্রদান করা যাবে।

দেশের প্রতিটি বিভাগ থেকে এই পাঁচটি পণ্যের বাজারমূল্য সংগ্রহ করে ইসলামিক ফাউন্ডেশন। এরপর এসব মূল্যের ওপর ভিত্তি করে ফিতরা নির্ধারণ করা হয়।

রমজানে এ বছর বাংলাদেশে ফিতরার হার জনপ্রতি সর্বনিম্ন ১১০ টাকা ও সর্বোচ্চ ২৮০৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। আজ মঙ্গলবার রাজধানীর বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের সভাকক্ষে কমিটির সভায় ১৪৪৬ হিজরি সনের ফিতরার হার নির্ধারণ করা হয়।

আরো পড়ুন
ফিতরার সর্বনিম্ন ও সর্বোচ্চ হার নির্ধারণ

ফিতরার সর্বনিম্ন ও সর্বোচ্চ হার নির্ধারণ

 

ফিতরা নির্ণয়ের কিছু নিয়ম নির্ধারিত আছে ইসলাম ধর্মে। একজন ব্যক্তি তার দুই হাতের তালু একত্রিত করে ধরার পর সেখানে যে পরিমাণ খাদ্য রাখা যাবে সেটি ফিতরা হিসেবে দিতে হবে। এই পরিমাণকে আর্থিক মূল্যে নির্ণয় বা পরিমাপ করা যাবে।

পরিমাপ করার জন্য ‘অর্ধ সা’ এবং ‘এক সা’ মানদণ্ড নির্ধারণ করা হয়েছে।

একমাত্র গম ও চালের ক্ষেত্রে ‘অর্ধ সা’ এবং বাকি চারটি পণ্যের ক্ষেত্রে ‘এক সা’ নির্ধারণ করা হয়েছে। এগুলো ছিল প্রাচীন আরব পরিমাপের একক। পরবর্তীতে এটিকে কেজি ও গ্রামে রূপান্তর করা হয়েছে। ‘অর্ধ সা’ বলতে ১ কেজি ৬৫০ গ্রাম এবং ‘এক সা’ বলতে ৩ কেজি ৩০০ গ্রাম বোঝানো হয়।

ইসলামিক ফাউন্ডেশন বলছে, মুসলমানগণ নিজ নিজ আর্থিক সামর্থ্য অনুযায়ী এসব পণ্যের যেকোনো একটি পণ্য বা এর বাজারমূল্য দ্বারা ফিতরা দিতে পারবেন।

ইসলামের বিধান মতে, প্রতিটি সচ্ছল মুসলিম ব্যক্তি, যার প্রয়োজনের অতিরিক্ত খাদ্য আছে সেটির ওপর ভিত্তি করে ফিতরা প্রদান বাধ্যতামূলক। এটি নিজের জন্য দেওয়ার পাশাপাশি তার ওপর কেউ যদি নির্ভরশীল থাকে তাদের জন্যও দিতে হবে। যেমন–মা, বাবা, স্ত্রী, সন্তান। একটি পরিবারের কর্তা বা অভিভাবক তাদের নিজের জন্য এবং তার ওপর নির্ভরশীল পরিবারের অন্য সদস্যদের জন্য ফিতরা দেবেন। এটি ইসলামে বিধান।

মন্তব্য

সর্বশেষ সংবাদ