বলকান উপদ্বীপের ছোট্ট দেশ কসোভো। ইউরোপে ইসলামের স্মারক বুকে নিয়ে টিকে আছে দেশটি। ইসলামের প্রথম শতাব্দীতেই কসোভোর মাটিতে ইসলামের দ্যুতি পৌঁছে যায়। আর ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠিত হয় ৭৯৭ হিজরিতে।
এরপর বহু ত্যাগ ও সংগ্রামের বিনিময়ে হলেও কসোভোর মানুষ তাদের ঈমান ও ইসলাম টিকিয়ে রেখেছে।
বহুবার ইউরোপের ইসলামবিদ্বেষী শক্তিগুলোর আক্রমণের শিকার হয়েছে অত্র অঞ্চলের মুসলিম জনগণ। সর্বশেষ নব্বইয়ের দশকে হানাদার সার্ব বাহিনীর হাতে লাখ লাখ মুসলিম প্রাণ হারায় এবং গৃহহারা হয় অসংখ্য মানুষ। অবশেষে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে এখন কসোভো একটি মুসলিম রাষ্ট্র।
কসোভোর জনগণের প্রায় ৯৫ শতাংশই মুসলিম। প্রায় প্রতিটি জেলায় রয়েছে একটি ইসলামিক সেন্টার ও পাঁচটি ধর্মীয় স্কুল। যেখানে শিক্ষার্থীদের ইসলাম ও আরবি ভাষা-সাহিত্য শেখানো হয়।
যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের পুনর্গঠনে মনোযোগ দিয়েছে তারা।
সার্বদের হাতে ধ্বংস হওয়া ইসলামী সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনা এবং ধর্মীয় অবকাঠামোর পুনর্নির্মাণের কাজ শুরু করেছে। কসোভোর দুই শতাধিক মসজিদ ধ্বংস করে সার্ব বাহিনী। কসোভোর ধর্মবিদ্বেষী কমিউনিস্ট শাসকরা ৭০ বছর ইসলামী শিক্ষা, সংস্কৃতি ও সর্বপ্রকার ধর্মীয় কার্যক্রম নিষিদ্ধ করে রাখে। তারা অসংখ্য মসজিদ, মাদরাসা ও ধর্মকেন্দ্র বন্ধ করে দেয়। কসোভোর মুসলিমরা চেষ্টা করছে ইসলামের হারানো ঐতিহ্য ও আবহ ফিরিয়ে আনতে।
তারা নতুন করে মাদরাসা মসজিদ ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলছে। বর্তমানে মাদরাসায়ে আলাউদ্দিন নামে একটি প্রাচীন ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আবার শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করেছে এবং একটি বিশেষায়িত ইসলামিক কলেজ চালু হয়েছে।
কসোভোর পুনর্গঠনে সে দেশের জনগণ ধনী মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর সাহায্য প্রত্যাশা করে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, তুরস্ক ও মালয়েশিয়ার বাইরে উল্লেখযোগ্য কোনো মুসলিম দেশ এগিয়ে আসেনি।
তবে বিভিন্ন দেশের কিছু বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সাহায্যের হাত বাড়িয়েছে। এ ক্ষেত্রে মধ্যপ্রাচ্যের কিছু দানশীল মানুষের উদ্যোগে গঠিত ‘আল মাশিখাতুল ইসলামিয়া’ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। তারা সেখানে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান নির্মাণ ও ইসলামী শিক্ষার বিস্তারে ব্যাপক কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এরই মধ্যে তারা ২৪টি ইসলামী শিক্ষা ও প্রচার কেন্দ্র এবং ৫৫০টি মসজিদ নির্মাণ করেছে। তাদের অধীনে ৫০০ আলেম ও মুবাল্লিগ কসোভোতে ইসলাম প্রচারের কাজ করছেন।
রমজানের চাঁদের ব্যাপারে কসোভোর মুসলিমরা জ্যোতির্বিজ্ঞানের অনুসরণ করে। সঙ্গে সঙ্গে তুরস্ক ও ইউরোপীয় ফতোয়া ও গবেষণা বোর্ডের পরামর্শ গ্রহণ করে। রমজানের আগমনে কসোভোর মুসলিমরা আনন্দে মেতে ওঠে এবং রঙিন ফানুস নিয়ে রাস্তায় নেমে পড়ে। ছোট-বড় সবাই পরস্পরকে অভিনন্দন জানায়। রমজানের কয়েক দিন আগে থেকে তারা মসজিদগুলোকে মুসল্লিদের জন্য প্রস্তুত করে। স্বাধীনতার পর থেকে কসোভোর মুসলিমরা রমজান মাসে দেশ, জাতি ও মুসলিম উম্মাহর কল্যাণে সম্মিলিত দোয়ার আয়োজন করে। প্রতিটি মসজিদে বিতর ও ফজরের নামাজে ‘কুনুতে নাজেলা’ পড়া হয়।
রমজানে কসোভোর মুসলিমরা কোরআন তিলাওয়াত, তাহাজ্জুদ, অধিক পরিমাণে সালাতুত তাসবিহ ও ধর্মীয় জ্ঞান আহরণ করে কাটাতে পছন্দ করে। জোহরের পর মসজিদে মসজিদে ইসলামী বিশ্বাস ও বিধি-বিধানের পাঠ দান করা হয়। আসর থেকে মাগরিব পর্যন্ত হয় কোরআন তিলাওয়াত ও দোয়ার অনুষ্ঠান। সাধারণ মুসলিমরা এতে উপস্থিত থাকার চেষ্টা করে।
কসোভোর মুসলিমরা রমজান মাসটি পারিবারের সঙ্গে কাটাতে পছন্দ করে। ইফতার ও সাহরি অবশ্যই পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে করে। এশার নামাজের পর পরিবারের সব সদস্য একত্র হয়ে খোশগল্পে মেতে ওঠে। এ সময় পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠ সদস্যরা তাঁদের পরিবারের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংগ্রামের কথা নতুন প্রজন্মের সামনে তুলে ধরেন।
পারিবারিক ওই বৈঠকে হরেক রকম ফলের জুস পরিবেশন করা হয়। সবচেয়ে বেশি পরিবেশন করা হয় আপেলের জুস। কখনো কখনো এ আড্ডা সাহরি পর্যন্তও দীর্ঘায়িত হয়। ইফতারের সময় হলে তারা ফলের জুস বা পানীয় ও খেজুর দ্বারা ইফতার করে। তারপর মসজিদে মাগরিবের নামাজ আদায় করার পর ঘরে ফিরে ইফতার করে। ইফতারে কসোভোবাসীর সবচেয়ে জনপ্রিয় খাবার হলো ‘বুরিক’। গরুর মাংসের কিমা দিয়ে তৈরি বিশেষ খাবার।
সূত্র : ইসলাম ওয়েব ডটনেট