’ (সুরা : ফাতির, আয়াত : ২৭)
প্রখ্যাত মুফাসসির শায়খ আবদুর রহমান আস-সাদি (রহ.) বলেন, আল্লাহ তাআলা যেভাবে পৃথিবীকে স্থিতিশীল রাখার জন্য পর্বতমালা সৃষ্টি করেছেন, সেভাবেই তিনি সেই পর্বতগুলোকেও রূপ দিয়েছেন বৈচিত্র্যময় রঙের, সৌন্দর্য ও মাধুর্যের এক বিস্ময়কর আবরণে।
আয়াতে ব্যবহৃত ‘জুদাদ’ শব্দটির অর্থ পর্বতের বুকে আঁকা রেখা বা শিরা। তিনি বলেন, একটি পর্বতের মধ্যেই দেখা যায় সাদা শিরা, লালচে বা পিঙ্গল রেখা এবং গভীর কালো রেখা—যাকে বলা হয়েছে ‘গারাবিবু সুদ’, যার অর্থ অত্যন্ত গাঢ় কালো, যেন কাকের পালকের মতো নিখাদ কালো। (তাফসিরে সাদি, খণ্ড-১, পৃষ্ঠা-৬৮৮)
এই আয়াতটি চীনের রংধনু পাহাড়কে স্মরণ করিয়ে দেয়। এখানে বলা হয়েছে—‘নানা রঙের রেখাযুক্ত পাহাড়’, যা সুনির্দিষ্টভাবে Danxia-এর বর্ণনা মনে করায়। প্রকৃতির এই রঙিন বিন্যাস কেবল চাক্ষুষ আনন্দের বিষয় নয়, এটি আল্লাহর কুদরতের প্রতীক।
রংধনু পাহাড় ও ‘তাফসিরুল আয়াত’
কোরআনে একটি শব্দ বারবার ব্যবহৃত হয়েছে—তাফসিরুল আয়াত অর্থাৎ নিদর্শনের বহুমাত্রিক ব্যাখ্যা ও পুনরাবৃত্তি। এটি প্রকৃতির ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। যখন আমরা রংধনু পাহাড়ের মতো সৌন্দর্য দেখি, তখন তা আমাদের চিন্তা-ভাবনায় নতুন মাত্রা যোগ করে। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন : ‘তিনিই সেই সত্তা, যিনি পৃথিবীতে নানা রঙের বস্তু সৃষ্টি করেছেন। এতে আছে নিদর্শন চিন্তাশীল জাতির জন্য।’ (সুরা : আন-নাহল, আয়াত : ১৩)
চীনের রংধনু পাহাড় যেন এই আয়াতের জীবন্ত ব্যাখ্যা। এখানে রঙের যে বৈচিত্র্য দেখা যায়, তা মানুষের দৃষ্টি ও হৃদয়—উভয়কে আকৃষ্ট করে এবং বিশ্বাসী হৃদয়ে জাগিয়ে তোলে স্রষ্টার প্রশংসা।
চিত্রশৈলী ও কোরআনের অলংকার
কোরআনের ভাষা অলংকারপূর্ণ, চিত্রাত্মক ও ভাবনাবোধক। যখন আমরা পাহাড়ের রঙিন রূপ দেখি, তখন মনে পড়ে কোরআনের সেই উপমা যেখানে মেঘ, পাহাড়, আলো-আঁধারির সমন্বয়ে সৃষ্টিশীলতা ফুটে ওঠে; কোরআনে বলা হয়েছে : ‘আল্লাহর সৃষ্টিকে দেখো! কিভাবে তিনি বিভিন্ন রঙের সৃষ্টি করেছেন!’ (সুরা : আন-নাহল, আয়াত : ১৬)
Zhangye Danxia যেন এই আয়াতের চিত্ররূপ। যেমনভাবে কোরআন একটি চিত্রকল্প সৃষ্টি করে, তেমনি এই পাহাড় তার রং ও রেখায় আমাদের সামনে একটি জীবন্ত আলোকচিত্র তুলে ধরে।
রংধনু পাহাড় ও মানুষের হৃদয়ের সংলাপ
প্রাকৃতিক সৌন্দর্য শুধু বাহ্যিক দর্শনের বিষয় নয়, এটি মানুষের হৃদয়ের গভীরে স্পর্শ করে। কোরআনে বলা হয়েছে : ‘নিশ্চয়ই আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর সৃষ্টি এবং রাত ও দিনের পরিবর্তনে বোধশক্তিসম্পন্নদের জন্য নিদর্শন আছে।’ (সুরা : আলে ইমরান, আয়াত : ১৯০)
যিনি রংধনু পাহাড়ের মতো নিখুঁত নকশা সৃষ্টি করতে পারেন, তিনি নিঃসন্দেহে একজন সুবিশাল পরিকল্পনাকারী। এখানে কেবল শৈল্পিকতা নয়, বরং রয়েছে গণিত, রসায়ন ও সময়ের নিখুঁত সমন্বয়। এটি কেবল সৌন্দর্য নয়, এটি একটি মহাজাগতিক সিম্ফনি।
প্রকৃতির রং ও আত্মার জাগরণ
রং মানুষের মনোজগতে বিশেষ প্রভাব ফেলে। রংধনু পাহাড়ের প্রতিটি শিলা যেন একটি বার্তা বহন করে। কোরআনে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আল্লাহ রং দিয়েছেন, যেমন রং তিনিই দিতে পারেন।’ (সুরা : আল-বাকারাহ, আয়াত : ১৩৮)
এই আয়াতে সিবগাতুল্লাহ বা ‘আল্লাহর রং’ কথাটি এসেছে। চীনের এই পাহাড় সেই রঙেরই এক নিদর্শন, যা শুধু চাক্ষুষ রূপ নয়, আধ্যাত্মিক উপলব্ধির একটি উৎস।
রঙিন পাহাড়, রঙিন জীবন ও ঈমানের প্রতিচ্ছবি
চীনের রংধনু পাহাড় প্রকৃতির এক বিস্ময়, কিন্তু একজন মুমিনের জন্য এটি তার ঈমানের শক্তি পুনর্জাগরণের উপলক্ষ। এটি প্রমাণ করে যে পৃথিবীতে এমন কোনো কিছুর সৃষ্টি হয়নি, যা উদ্দেশ্যহীন। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন : ‘আমি আকাশ ও পৃথিবী এবং তাদের মধ্যে যা কিছু আছে তা ক্রীড়াচ্ছলে সৃষ্টি করিনি।’ (সুরা : আদ-দুখান, আয়াত : ৩৮)
এখানে এই পাহাড় যেন চিৎকার করে বলে—‘আমার পেছনে এক মহান পরিকল্পক আছেন।’ এবং সেই পরিকল্পকের প্রতি আমাদের ঈমান আরো গভীর হয়, যখন আমরা কোরআনের আয়াত এবং পাহাড়ের রংকে মিলিয়ে দেখি।
আল্লাহর নিপুণ শিল্পকর্মের বহিঃপ্রকাশ
রেইনবো মাউন্টেন—এ এক চিত্রকরের তুলির ছোঁয়া নয়, বরং আল্লাহ তাআলার ইচ্ছায় গঠিত প্রাকৃতিক শিল্পকর্ম। যুগে যুগে এই বৈচিত্র্য নজরে এসেছে ভূবিজ্ঞানীদের, পর্যটকদের, এমনকি সাধারণ পথিকেরও। কিন্তু আল্লাহ তাআলা পবিত্র কোরআনে এই বৈশিষ্ট্যের ইঙ্গিত দিয়েছেন হাজার বছর আগেই, যখন মানুষের জ্ঞান এই প্রাকৃতিক রহস্যের কেবল প্রান্ত স্পর্শ করত।
উপরোক্ত আয়াত আমাদের দৃষ্টি দেয় প্রকৃতির গভীরে এবং নির্দেশ করে এক মহান শিল্পীর দিকে, যিনি তাঁর সৃষ্টিকে শুধু প্রয়োজনের জন্যই গড়েননি, বরং দিয়েছেন সৌন্দর্য, শৈল্পিকতা ও ভাবগম্ভীরতা। প্রতিটি পাহাড় যেন এক একটি মৌন কবিতা—সাদা রেখা তার পবিত্রতা, লাল তার আবেগ, আর গাঢ় কালো তার গভীরতা ও গাম্ভীর্য প্রকাশ করে।
এই রঙিন পর্বতগুলো শুধু প্রাকৃতিক দৃশ্য নয়, বরং তারা আল্লাহর কুদরত ও জ্ঞানের সাক্ষ্য বহন করে। তারা নীরবে ঘোষণা করে : ‘তোমাদের স্রষ্টা কেবল ক্ষমতাবানই নন, তিনি অপার সৌন্দর্যেরও অধিকারী।’
অতএব, উপরোক্ত আয়াত কেবল ভৌগোলিক সত্যের বর্ণনা নয়, এটি এক আত্মিক আহবান—মানুষ যেন প্রকৃতির দিকে তাকিয়ে আল্লাহর অস্তিত্ব, জ্ঞান, শক্তি ও সৌন্দর্য অনুধাবন করে। সত্যিই সৃষ্টির মধ্যে ছড়িয়ে আছে স্রষ্টার নিপুণতা। চোখের সামনে দৃশ্যমান প্রতিটি পাহাড়ের বুকে আঁকা রঙিন রেখাগুলো যেন তাঁর মহানত্বের মৌন সাক্ষী।
তথ্যঋণ
The Holy Qur’an, translated by Sahih International.
Geological studies on Zhangye Danxia Landform– Chinese Academy of Sciences.
NASA Earth Observatory reports on multicolored landforms.
Signs in the Universe–Dr. Zaghloul El-Naggar.
Tafsir al-Jalalayn, Tafsir ibn Kathir- interpretations on Surah Fatir and Surah Nahl.
Colours in the Qur’an : Szmbolism and Science – Islamic Research Institute.