<p style="text-align:justify">দেশের ব্যবসাবাণিজ্য ও উৎপাদনশীল খাতের একাধিক কোম্পানি নিয়ে গড়ে ওঠে গ্রুপ অব কোম্পানিজ বা বড় বড় শিল্প গ্রুপ। কোম্পানিগুলোয় থাকেন একাধিক পরিচালক। তবে কোনো কোম্পানি পরিচালক অনিচ্ছাকৃতভাবে ঋণখেলাপি হলে বিপদে পড়ে পুরো গ্রুপ অব কোম্পানি। এভাবে কোম্পানি পরিচালকের ক্রেডিট তথ্য ব্যুরো বা সিআইবি রিপোর্ট বিভিন্ন নিয়মের বেড়াজালে গ্রুপ অব কোম্পানির ব্যবসাবাণিজ্যে মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। এতে ভয়াবহ বিপদে পড়ার কথা জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। </p> <p style="text-align:justify">তাদের অভিযোগ, ক্রেডিট কার্ডেও তুচ্ছ খেলাপিতেও যন্ত্রণা বাড়ছে। দেশে ৮০ টাকার মার্কিন ডলার ১২০ টাকায় হওয়ায় ঋণখেলাপি হয়েছেন অনেক ব্যবসায়ী। অর্থ ঋণ আদালতে মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি না হওয়ায় অনেকে খেলাপি হয়েছেন। এমন পরিস্থিতিতে শিল্পকারখানার সুরক্ষায় সরকারের উদার হওয়া উচিত।</p> <p style="text-align:justify">এ প্রসঙ্গে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশন- এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন বলেন, ‘বৈশ্বিক যুদ্ধ আর করোনা মহামারির পর পুরো বিশ্বে সৃষ্ট অর্থনৈতিক সমস্যায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন ব্যবসায়ীরা। আর বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে প্রকৃত ব্যবসায়ীরা সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়েছেন। কারণ একটি কোম্পানি খারাপ হলে পুরো গ্রুপের সিআইবি রিপোর্ট খারাপ দেখানো হচ্ছে। এর মানে করোনাকালের চেয়েও খারাপ পরিস্থিতি মোকাবিলা করছেন দেশের ব্যবসায়ীরা।’</p> <p style="text-align:justify">দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্পপ্রতিষ্ঠান বেঙ্গল গ্রুব অব কোম্পানির এই ভাইস চেয়ারম্যান আরও বলেন, ‘বিশ্ববাজারে যেভাবে আমদানি পণ্যের দাম বাড়ছে, সেভাবে দেশি বাজারে মূল্য সমন্বয় হচ্ছে না। ফলে অনেক ব্যবসায়ী অনিচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি হয়েছেন। তাই বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে খেলাপি ঘোষণা এক বছরের জন্য পিছিয়ে দিতে হবে। আর কোনো শিল্প গ্রুপের একটি ইউনিট খারাপ হলে, পুরো গ্রুপের সব ইউনিট খারাপ চিহ্নিত করা যাবে না।’ এ বিষয়টি সরকারকে উদারভাবে দেখা উচিত বলে মনে করেন এই শীর্ষ ব্যবসায়ী নেতা।</p> <p style="text-align:justify">বাংলাদেশ তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতি-বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, ‘একটি গ্রুপ অব কোম্পানির একাধিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে কোনো একটি ঋণখেলাপি হলে বাকিগুলোর ব্যাংক সুবিধা বন্ধ করে দেওয়া হয়, খেলাপি হিসেবে গণ্য করা হয়। এ প্রথা বাতিল করতে হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে, দেশের অধিকাংশ ঋণ নেয় বড় বড় কোম্পানি, ব্যবসায়ী গ্রুপ ও করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো। ব্যক্তিগত পর্যায়ে ঋণ বাংলাদেশে অনেক কম।’</p> <p style="text-align:justify">অংশীজনেরা বলছেন, বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি বেসরকারি খাত। ব্যবসায়ীদের হাত ধরে বাংলাদেশ বর্তমান উন্নয়নশীল দেশের কাতারে উন্নীত হয়েছে। মধ্যম আয়ের দেশের কাতারে উন্নীত হওয়ার দ্বারপ্রান্তে এসে পৌঁছেছে। প্রতি বছর সরকারি পর্যায়ে যে পরিমাণ কর্মসংস্থান হয়, তার চেয়ে কয়েক গুণ বেশি হয় বেসরকারি খাতে। এক একটি গ্রুপ অব কোম্পানিতে রয়েছে অনেক প্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠান জাতীয় অর্থনীতিতে বড় ধরনের ভূমিকা রাখছে। কিন্তু বিগত বছরগুলোয় বাংলাদেশসহ সমগ্র বিশ্বে বিভিন্ন ধরনের বিপর্যয় নেমে আসে। </p> <p style="text-align:justify">এর মধ্যে কভিড মহামরি, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, বাংলাদেশে বৈদেশিক মুদ্রার সঙ্গে টাকার বড় ধরনের অবমূল্যায়ন, শিল্পের কাঁচামালের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির কারণে পরবর্তীতে গ্রুপ অব কোম্পানিগুলোর কিছু ইউনিট ভালো থাকলেও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দু-একটি ইউনিট। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের সিআইবির বিভিন্ন ধরনের নিয়মের বেড়াজালে ক্ষতিগ্রস্ত ইউনিটগুলোর কারণে ভালো ইউনিটগুলো তাদের ব্যবসায়িক কার্যক্রম কোনোভাবেই অব্যাহত রাখতে পারছে না। অর্থাৎ একই গ্রুপ অব কোম্পানির পাঁচটি ইউনিটের মধ্যে একটি খারাপ হলে সে ইউনিটের সিআইবি যদি খেলাপি হয়, তাহলে ওই গ্রুপের বাকি চারটি ইউনিট শিডিউল ব্যাংকগুলোয় ফ্যাক্টরির কাঁচামালসহ অন্যান্য পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে বাধার সম্মুখীন হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে খারাপ ইউনিটের জন্য ভালো ইউনিটগুলো বন্ধ হওয়ার উপক্রম। ফলে গ্রুপ অব কোম্পানিজের ভালো-খারাপ সব ইউনিট একসঙ্গে বন্ধ হয়ে গেলে লাখ লাখ লোক বেকার হওয়ার উপক্রম হয়। এর সঙ্গে ব্যাংকগুলোর ঋণ আদায়ও ঝুঁকির মধ্যে পড়বে বলে মনে করেন অংশীজনেরা।</p> <p style="text-align:justify">এ প্রসঙ্গে কোম্পানি আইন বিশেষজ্ঞদের মত হলো, ১৯৯১ সালের ব্যাংক কোম্পানি আইনের ধারা ৫(গগ) অনুযায়ী, কোনো কোম্পানির পরিচালক বা শেয়ারহোল্ডার ঋণখেলাপি হলে কোম্পানি আইনের চোখে খেলাপি হিসেবে বিবেচনা করার সুযোগ নেই। সেহেতু একই গ্রুপের একটি খারাপ ইউনিটের জন্য অন্য ভালো ইউনিটগুলোকে প্রভাবিত করা আইনের ব্যত্যয়। কিন্তু বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো ও বাংলাদেশ ব্যাংক এ বিষয়টি আইনের আলোকে যথাযথভাবে বিবেচনায় না নেওয়ায় দেশের অর্থনীতির ওপর অযথা নেতিবাচক এবং বিরূপ প্রতিক্রিয়া হচ্ছে।</p> <p style="text-align:justify">এমন পরিস্থিতিতে সংশ্লিষ্টরা আশঙ্কা করে বলছেন, বাংলাদেশ ব্যাংকসহ সংশ্লিষ্ট ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান গ্রুপ অব কোম্পানির ক্ষেত্রে যদি সিআইবি রিপোর্ট স্বস্তিদায়ক না করে, তাহলে অচিরে বড় বড় গ্রুপগুলোর সব ইউনিট একসঙ্গে বন্ধ হওয়ার ব্যাপক আশঙ্কা রয়েছে। আর যদি খারাপ ইউনিটের সাময়িক সিআইবি রিপোর্ট খারাপ সত্ত্বেও এ গ্রুপের ভালো ইউনিটের ব্যাংকিং কার্যক্রম চালু রাখার সুযোগ প্রদান করা হয়, সে ক্ষেত্রে ভালো ইউনিটের আয় দিয়ে খারাপ ইউনিটগুলো ধীরে ধীরে ভালো করা সম্ভব। এ বিষয়টি এ মুহূর্তে গুরুত্বের সঙ্গে সরকারের বিবেচনা করা উচিত। অন্যথায় খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি পেয়ে ব্যাংকিং খাত মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে পড়বে।</p> <p style="text-align:justify">বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য বলছে, চলতি বছরের জুন শেষে খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ১১ হাজার ৩৯১ কোটি টাকা; যা বিতরণ করা ঋণের ১৬ লাখ ৮৩ হাজার ৩৯৬ কোটি টাকার ১২ দশমিক ৫৬ শতাংশ। শুধু তাই নয়, গত ১৬ বছরের মধ্যে বিতরণ করা ঋণ ও খেলাপি ঋণের সর্বোচ্চ অনুপাত এটি। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, গত বছরের জুন পর্যন্ত খেলাপি ঋণ ছিল ১ লাখ ৫৬ হাজার ৩৯ কোটি টাকা। গত তিন মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২৯ হাজার ৯৬ কোটি টাকা, যা ৩০ মার্চ পর্যন্ত ছিল ১ লাখ ৮২ হাজার ২৯৫ কোটি টাকা।</p> <p style="text-align:justify"><strong>সূত্র:</strong> বাংলাদেশ প্রতিদিন</p>