চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে নতুন করে শুল্ক নিয়ে উত্তেজনা দেখা দিয়েছে। যার ফলে বিশ্ব বাজারগুলো চলতি সপ্তাহে মন্দার মধ্য দিয়ে শুরু হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক আরোপের ঘোষণার পর চীনের পাল্টা ঘোষণা এ পরিস্থিতিকে আরো গুরুতর করে তুলেছে।
প্রত্যাশার চেয়েও বেশি শুল্ক বৃদ্ধি এবং আলোচনার কোনো লক্ষণ না থাকায় বাজারগুলো এখন বিশ্বব্যাপী মন্দার ঝুঁকিতে।
এর প্রভাব সোনার দামেও পড়েছে। বিপদে পড়লেই মানুষ সোনার দিকে ঝোঁকে—এই কথাটা সাধারণত ঠিক। কিন্তু এবার সোনা বাজারই ঝুঁকির মুখে! বৃহস্পতিবার থেকে এখন পর্যন্ত সোনার দাম (এক্সইউ/ইউএসডি- বৈদেশিক বাজারে ডলারের বিপরীতে প্রতি আউন্স সোনার দাম) ৬ শতাংশের বেশি কমেছে। বাজারের এই আচরণ সোনাকে আর নিরাপদ বিনিয়োগ হিসেবে ভাবতে দিচ্ছে না।
এর সম্ভাব্য কারণ হতে পারে জোরপূর্বক বিক্রি। লোকসানের পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিনিয়োগকারীরা মার্জিন কল মেটাতে বা এক্সপোজার কমাতে সোনার মতো লাভজনক বা তরল সম্পদ বিক্রি করে দিচ্ছেন। এই বিক্রয় অনেকটাই মনস্তাত্ত্বিক এবং কৌশলগত কারণ, মৌলিক কারণে নয়।
ক্যাপিটাল ডট কমের সিনিয়র মার্কেট অ্যানালিস্ট ডেনিয়েলা স্যাবিন হ্যাথোর্ন বলেন, সোনার দাম বৃদ্ধির পেছনে যে মূল কারণগুলো কাজ করেছে তা হলো, ক্রমবর্ধমান ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনা, চলমান বিশ্বব্যাপী প্রবৃদ্ধির উদ্বেগ, কম সুদের হারের প্রত্যাশা এবং স্বর্ণের প্রতি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চাহিদা অব্যাহত থাকা।
স্বল্পমেয়াদি দামের ওঠানামা দেখে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। মাঝারি ও দীর্ঘ মেয়াদে স্বর্ণের সম্ভাবনা এখনো ভালো। কারণ, অস্থিরতা আর অনিশ্চয়তার সময়গুলোয় সাধারণত এই বস্তুটিই নিরাপদ আশ্রয় হিসেবে কাজ করে।
সপ্তাহের শুরুতেই বিশ্ববাজারে সোনার দামে বড় ধাক্কা আসে। সোমবার দুপুর নাগাদ এর দাম ওঠানামা করেছে।
সর্বশেষ জুনে স্বর্ণের দাম প্রতি আউন্সে ৩৮.৫০ ডলার কমে দাঁড়িয়েছে ২৯৯৬.৭০ ডলারে। এদিকে, রুপার দাম কিছুটা বাড়লেও দিনের সর্বোচ্চ দাম থেকে নেমে এসেছে। গত বছরের মে মাসে রুপার দাম ০.৫৫৫ ডলার থেকে বেড়ে ২৯.৭৯ ডলারে দাঁড়ায়।
শেয়ারবাজার এক্সপার্ট জিম ওয়াইকফ কিটকো নিউজে প্রকাশিত এক নিবন্ধে বলেন, নিউইয়র্কে সোনার বাজারে প্রাথমিক অবস্থায় লেনদেন ভালোই ছিল। হঠাৎ গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে, যুক্তরাষ্ট্র ৯০ দিনের জন্য চীনের ওপর আরোপিত শুল্ক স্থগিত করতে যাচ্ছে। এরপরই বাজারে স্বর্ণের বিক্রি বেড়ে যায়। কিন্তু হোয়াইট হাউস যখন চীনের ওপর আরোপিত শুল্কহার বহাল রাখার বিষয়টি নিশ্চিত করে তখনই স্বর্ণ বিক্রিতে ভাটা পড়ে।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প আবারও চীনের ওপর অতিরিক্ত শুল্ক আরোপের হুমকি দেন। এশিয়া ও ইউরোপের শেয়ারবাজারগুলোও রাতের লেনদেন বড় পরিসরে পতনের মুখে পড়ে। যদিও মার্কিন বাজার সূচকগুলো দিনের শুরুতে ১৪ মাসের মধ্যে সর্বনিম্নে নেমে এসেছিল, পরে কিছুটা ঘুরে দাঁড়ায়।
গত সপ্তাহে ফেডারেল রিজার্ভের চেয়ারম্যান জেরোম পাওয়েল বলেছেন, তারা পরিস্থিতি বুঝে পরে সিদ্ধান্ত নেবেন। এই সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্রের মার্চ মাসের মূল্যস্ফীতি (সিপিআই) বিষয়ক তথ্য পাওয়া যাবে। যদি দেখা যায় দাম বাড়ার হার কমেছে, তাহলে সুদের হার কমার সম্ভাবনা বাড়বে—যা সোনার দামে আবার উর্ধ্বগতি আনতে পারে। তবে যদি হঠাৎ দাম বাড়ার ইঙ্গিত আসে, তাহলে ফেড হয়তো সুদের হার কমানো সম্ভব হবে না—যা বাজারকে আরো অস্থির করে তুলবে।
সোমবার সকালে এক্সএইউ/ইউএসডি ৩ হাজারের নিচে নেমে গেলেও বাজার পরিস্থিতি দ্রুত সামলে নেওয়া সম্ভব হয়েছিল এবং তা স্থিতিশীল হতে শুরু করে। সম্প্রতি উচ্চমূল্য কিছুটা কমলেও, প্রতিদিনের দামের চার্ট ইঙ্গিত দিচ্ছে বর্তমান পরিস্থিতিতে বড় ধরনের বিক্রি আর হচ্ছে না।
আরএসআই নামক একটি সূচক বলছে, সোনার দাম এখন অতিরিক্ত বেশি নয়, বরং সঠিক জায়গায় আছে। এতে অনেকেই নতুন করে কম দামে সোনা কিনতে উৎসাহী হতে পারেন।
আশঙ্কার ছায়ায় বাজার
যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের বড় অর্থনীতিগুলো এখন এক ভয়ংকর শুল্কযুদ্ধের অবস্থানে দাঁড়িয়ে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প গত রবিবার বলেছেন, ‘আমরা এখন ওষুধ খাচ্ছি’ অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্র এখন শুল্ক নিয়ে বড় সমস্যার সমাধানে কঠোর অবস্থানে রয়েছে। কিন্তু এতে সাধারণ আমেরিকানদের অবসরভাতা ও শেয়ারবাজারের বিনিয়োগ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এমনকি ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ সমর্থকরাও ভেতরে ভেতরে অস্থির।
সিনেটর টেড ক্রুজ, মিচ ম্যাককনেল এবং ইলন মাস্কও ট্রাম্পের শুল্কনীতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। জেপি মরগ্যান প্রধান জেমি ডিমন হুঁশিয়ারি দিয়েছেন—এই শুল্কনীতি পণ্যের দাম বাড়াবে, আর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কমিয়ে দেবে।
এই বাজার পরিস্থিতিতে বিনিয়োগকারীদের বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত। যেকোনো সময় বড় উত্থান-পতনের সম্ভাবনা রয়েছে।
সূত্র : আইএফএ, কিটকো নিউজ