<article> <p style="text-align: justify;">কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলার সীমান্তবর্তী পাহাড়ি এলাকায় অপহরণের ঘটনা ব্যাপক বেড়েছে। গত এক বছরে ওই পাহাড়ি এলাকায় ১১৭ জনকে অপহরণ করে মুক্তিপণ চাওয়া হয় বলে পুলিশ ও গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর কিছু লোক ও স্থানীয় দুর্বৃত্তরা এসব অপহরণে জড়িত বলে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর তদন্তে উঠে এসেছে।</p> <p style="text-align: justify;">অপহরণকারীরা এতই বেপরোয়া যে মাত্র এক সপ্তাহে ১৭ জন স্থানীয় নিরীহ ব্যক্তি অপহৃত  হওয়ার পর মুক্তিপণের বিনিময়ে ফিরে এসেছে। অপহরণকারীদের গ্রেপ্তারে পুলিশ ও র‌্যাব তৎপর থাকলেও এখনো নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি।</p> </article> <article> <p style="text-align: justify;">এ ব্যাপারে গতকাল বৃহস্পতিবার টেকনাফ থানার ওসি মুহাম্মদ ওসমান গনি বিকেলে কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সশস্ত্র রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা স্থানীয় দুর্বৃত্তদের দলে ভিড়িয়ে একের পর এক অপহরণের ঘটনা ঘটিয়ে যাচ্ছে। ভুক্তভোগীরা ভয়ে কেউ মুখ তো খুলছেই না, মামলা করতেও ইচ্ছুক নয়।’ এর পরও পুলিশ স্থানীয় লোকজনের সহযোগিতায় টেকনাফের পাহাড়কেন্দ্রিক অপহরণকারীচক্র দমনে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বলে জানান তিনি।</p> </article> <p style="text-align: justify;">ওসি জানান, সম্প্রতি অপহরণের বেশ কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে গত সোমবার টেকনাফের হ্নীলা ইউনিয়নের পশ্চিম পানখালী গ্রামের কৃষক আবদুর রহিম (৫১) থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে একটি মামলা করেন। মামলায় তিনি তাঁর কিশোর পুত্রকে অপহরণের অভিযোগ করেন।</p> <article> <p style="text-align: justify;">এজাহারে বাদী অভিযোগ করেন, তাঁর ছেলে মোহাম্মদ নূর (১৫) গত ২১ মার্চ রাতে বাড়ির পাশে পাহাড়ি এলাকার ক্ষেতের রবিশস্য পাহারা দিচ্ছিল। পাহাড় থেকে ২০ থেকে ২৫ জন সশস্ত্র দুর্বৃত্ত এসে নূরসহ পাঁচজনকে অপহরণ করে নিয়ে যায়। পরে অপহরণকারীরা মোবাইল ফোনে নূরের মায়ের কাছে ছেলের জন্য ১৫ লাখ টাকাসহ পাঁচজনের মুক্তিপণে ৩০ লাখ টাকা দাবি করে। পরে গত রবিবার টেকনাফ থানা পুলিশ অভিযান চালিয়ে নূরকে উদ্ধার করে। </p> </article> <article> <p style="text-align: justify;">এ ঘটনায় বাদী রহিম মামলায় ১০ জনের নাম-পরিচয়সহ ২৫ জনকে আসামি করেছেন। এজাহারে নাম উল্লেখ করা এসব আসামির মধ্যে টেকনাফের নয়াপাড়া মোচনী নিবন্ধিত ক্যাম্পের দুজন রোহিঙ্গা রয়েছেন। তাঁরা হলেন সাদ্দাম হোসেন (২১) ও মোহাম্মদ শফি প্রকাশ শফিক (২৩)।</p> </article> <article> <p style="text-align: justify;">নাম উল্লেখ করা অপর আটজন স্থানীয়। তাঁরা হলেন জামাল হোসেন (৪৬), মো. আলমগীর (২৪), রিয়াজ উদ্দিন (২০), নুরুল আবছার (৩০), আমরি হোছন (৪০), নুর হাছান (২২), মোহাম্মদ উল্লাহ (২৫) ও ছৈয়দ হোছন (২২)। তাঁরা সবাই টেকনাফের হ্নীলা ইউনিয়নের বাসিন্দা।</p> <p style="text-align: justify;">ওসি জানান, অপহরণের ঘটনায় এক রোহিঙ্গাসহ দুজনকে গ্রেপ্তার করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। অপহূত সর্বশেষ ১০ জন ফিরে আসেন গত বুধবার রাতে। টেকনাফের হোয়াইক্যং রৈক্ষ্যং ২২ নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্পের পার্শ্ববর্তী পাহাড় থেকে তাদের ফেরত দেওয়া হয়েছে।</p> <p style="text-align: justify;">এ ব্যাপারে বাহারছড়া ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আমজাদ হোসেন খোকন কালের কণ্ঠকে বলেন, টেকনাফ থানা পুলিশের সঙ্গে কয়েক হাজার গ্রামবাসী পাহাড়ে অভিযান চালানোর প্রস্তুতি নিলে মুক্তিপণের টাকা যা আদায় করতে পেরেছিল, তা নিয়েই অপহূতদের ছেড়ে দেওয়া হয়। তবে টেকনাফ থানার ওসি জানান, মুক্তিপণ আদায়ের বিষয়টি তার জানা নেই।</p> <p style="text-align: justify;">এলাকার লোকজন বলছে, মিয়ানমারের সংঘাতময় ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে টেকনাফের পাহাড়কেন্দ্রিক অপহরণের ঘটনা বেড়েছে।</p> <p style="text-align: justify;">খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এ পর্যন্ত যেসব লোক অপহরণের শিকার হয়েছে, তাদের কাউকেই মুক্তিপণ আদায় ছাড়া ছেড়ে দেওয়া হয়নি। নাম প্রকাশ না করার শর্তে অপহূত ব্যক্তিরা বলেন, ‘অপহরণকারীরা প্রথমেই শর্ত দেয় যে ঘটনাটি গোপন রেখে লেনদেনের মাধ্যমে সমাধান করতে হবে। অন্যথায় বড় ধরনের বিপদ হবে।’</p> <p style="text-align: justify;">স্থানীয় লোকজন ও পুলিশের তথ্য মতে, টেকনাফের পাহাড়ে থাকা রোহিঙ্গা সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের সঙ্গে অপহরণে স্থানীয়রা জড়িয়ে পড়ায় গ্রামীণ লোকজন সবচেয়ে বেশি বেকায়দায় পড়েছে। পাহাড়ের নিচে জমিতে ক্ষেত-খামার করে তারা জীবিকা চালিয়ে আসছে। বন্য পশুপাখি থেকে ফসল রক্ষায় রাতে ক্ষেত পাহারা দিতে গিয়ে তারা অপহূত হচ্ছে। পাহাড়ে অবস্থানকারী অপহরণকারীরা নিজেদের রক্ষায় ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা পর্যন্ত ব্যবহার করে থাকে। পাহাড়ে ওঠানামার পথে সিসি ক্যামেরা বসিয়ে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করে। আসন্ন ঈদ উপলক্ষে অপহরণ করে মুক্তিপণ দাবির ঘটনা বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছে স্থানীয়রা।</p> <p style="text-align: justify;">টেকনাফের প্রায় ৩৫ কিলোমিটার দীর্ঘ পাহাড়ের সঙ্গে লাগোয়া তিনটি ইউনিয়ন যথাক্রমে হ্নীলা, হোয়াইক্যং ও বাহারছড়ার লোকজন সবচেয়ে বেশি অপহরণের শিকার হচ্ছে। স্থানীয় একাধিক জনপ্রতিনিধির বিরুদ্ধে মুক্তিপণ লেনদেনের মাধ্যমে অপহূত উদ্ধারে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে।</p> <p style="text-align: justify;">এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাহারছড়া ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আমজাদ হোসেন খোকন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা যদি এমন ভয়াল ঘটনায় জড়িত থেকে থাকি, তাহলে আমাদের আইনের আওতায় আনা হোক।’</p> <p style="text-align: justify;">ইউপি চেয়ারম্যান জানান, তাঁর ইউনিয়নে তিন-চারটি দলে বিভক্ত ৩০ থেকে ৩৫ জন স্থানীয় দুর্বৃত্ত পাহাড়ি রোহিঙ্গা অপহরণকারীচক্রের সঙ্গে জড়িত। তাদের মধ্যে বাহারছড়ার ৩ নম্বর ওয়ার্ডের জসিম সরকার ও হেলাল নামের দুই ভাইয়ের একটি বড় সিন্ডিকেট রয়েছে। মারিশবুনিয়া এলাকায়ও রয়েছে অপহরণকারীদের অন্য একটি সিন্ডিকেট।</p> <p style="text-align: justify;">গত বুধবার টেকনাফ থানার পুলিশ জসিম সরকার ও হেলালসহ সন্দেহে থাকা অন্যদের বাড়িতে তল্লাশি চালায়। অভিযোগ রয়েছে, অপহরণকারীরা তাদের চাহিদা মতো মুক্তিপণের টাকা না পেলে অপহূতদের নৌকায় করে মিয়ানমার পাঠিয়ে দেয়। এভাবে মিয়ানমার পাঠিয়ে দেওয়া হ্নীলার একজন মাদরাসা ছাত্রসহ দুজনকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চলছে।</p> <p style="text-align: justify;">পুলিশ জানায়, গত বছর সেপ্টেম্বরে কক্সবাজারের পুলিশ সাতজন ও চট্টগ্রামের বাকলিয়া থানার পুলিশ আটজন অপহূতকে মিয়ানমারের বন্দিশালা থেকে ফিরিয়ে আনে। এসব বিষয়ে টেকনাফের হ্নীলা ইউপি চেয়ারম্যান রাশেদ মাহমুদ আলী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘পাহাড়ের রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা স্থানীয় কিছু সন্ত্রাসীর সঙ্গে হাত মিলিয়ে আমাদের এলাকাটিকে এখন অস্থির করে তুলেছে। পুলিশ বেশ কয়েকজন স্থানীয় দুর্বৃত্তকে  গ্রেপ্তার করে আদালতে পাঠালেও জামিনে বেরিয়ে আবার তারা একই অপরাধে জড়াচ্ছে।’</p> <p style="text-align: justify;">হোয়াইক্যং ইউপি চেয়ারম্যান মওলানা নূর আহমদ আনোয়ারী বলেন, পাহাড়ি এলাকায় ক্ষেত-খামার করা কৃষকরা এখন বড় অসহায়। তাঁরা অপহরণের ভয়ে ক্ষেত রক্ষা করতে পারছেন না।</p> <p style="text-align: justify;">এ প্রসঙ্গে কক্সবাজারের পুলিশ সুপার মো. মাহফুজুল ইসলাম বলেন, টেকনাফকেন্দ্রিক অপহরণে জড়িত রোহিঙ্গা ও স্থানীয়দের গ্রেপ্তারে কাজ করছে পুলিশ। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সহযোগিতায় অপহরণকারীদের বিরুদ্ধে সাঁড়াশি অভিযানের প্রস্তুতি চলছে।</p> <p style="text-align: justify;">কক্সবাজারের র‌্যাব-১৫-এর অধিনায়ক লে. কর্নেল এইচ এম সাজ্জাদ হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সবচেয়ে বড় অসুবিধায় পড়েছি, এ বিষয়ে সঠিক তথ্য পাচ্ছি না। ভুক্তভোগীরা ভয়ে একেবারে মুখই খুলতে রাজি হয় না। তবু র‌্যাবের দুটি দল কয়েক দিন ধরে টেকনাফের পাহাড়কেন্দ্রিক অপহরণকারীদের গ্রেপ্তারে কাজ করছে।</p> </article>