<p>বিপুল সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছেন সাভারের দুই ভাই। বড় ভাই মঞ্জুরুল আলম রাজীব সাভার উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও সাভার উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। ছোট ভাই ফখরুল আলম সমর সাভার উপজেলাধীন তেঁতুলঝোড়া ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান ও সাভার উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। দুজনই জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হয়েছেন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়।</p> <p>অভিযোগ রয়েছে, জনপ্রতিনিধি হওয়ার পর এলাকায় নিজেদের প্রভাব কাজে লাগিয়ে অবৈধভাবে অঢেল সম্পদের মালিক হয়েছেন রাজীব ও সমর। তাঁদের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি, দখলবাজি, পদ বাণিজ্য, সন্ত্রাসবাদ, টেন্ডারবাজি, ঝুট ব্যবসার আধিপত্য নিয়ে বিরোধ, হত্যা, অপহরণ, মাদক বেচাকেনা, অস্ত্র ও হত্যাচেষ্টার অভিযোগ রয়েছে। এসব অভিযোগে বেশ কয়েকটি মামলাও আছে। </p> <p>রাজীব ও সমর সাভারের হেমায়েতপুর ইউনিয়নের ওয়াসিল উদ্দিনের ছেলে।</p> <p>চার ভাইয়ের মধ্যে রাজীব সেজো এবং সমর সবার ছোট। এবার উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান নির্বাচনেও প্রার্থী হয়েছেন রাজীব। একজন স্বতন্ত্র প্রার্থী তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী। এলাকায় গুঞ্জন, ভয়ে অনেকে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী হননি।</p> <p>অভিযোগ রয়েছে, বন্ধ হয়ে যাওয়া সাভারের হলমার্কের বিভিন্ন কারখানার যন্ত্রপাতি (মেশিনারিজ) বিক্রি করে প্রায় ৫০০ কোটি টাকার মালিক হন রাজীব ও তাঁর ভাই সমর। শুধু তাঁরাই নন, তাঁদের স্বজন ও অনুসারী বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতাকর্মী রাতারাতি বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছেন।</p> <p>সাভার মডেল থানা সূত্রে জানা যায়, আশির দশকে ছাত্রদল নেতা চঞ্চল হত্যার মামলায় রাজীবকে আসামি করা হয়। ১৯৯৬ সালে সাভার সাবরেজিস্ট্রার অফিসের সামনে যুবদল নেতা মজনুকে প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। এ মামলারও অন্যতম আসামি রাজীব।</p> <p>১৯৯৮ সালে চাঁদা দিতে রাজি না হওয়ায় সাভারের ব্যাংক কলোনি এলাকায় হত্যা করা হয় তেল ব্যবসায়ী সাইদুর রহমানকে। এ হত্যাকাণ্ডে রাজীবের জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। ২০০২ সালে সাভারের ঘোষপাড়া এলাকায় হানিফ হত্যা এবং পৌরসভার আড়াপাড়া মহল্লায় ছাত্রদলের কর্মী বাবুকে হত্যার অভিযোগ আছে রাজীবের বিরুদ্ধে।</p> <p>২০১১ সালে হেমায়েতপুরে কুয়েতপ্রবাসী এখলাসকে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করা হয়। এই ঘটনায় রাজীব ও সমরের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে। স্থানীয় অনেকের মতে, আরো অনেক অপরাধমূলক ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তরা রাজীব ও সমরের বিরুদ্ধে মামলা করার সাহস পাননি। দু-একজন মামলা করলেও রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে এসব মামলা থেকে খালাস পেয়ে যান রাজীব, সমর ও তাঁদের সহযোগীরা। ২০১১ সালে সরকারি কাজে বাধা দেওয়ার অভিযোগে দুই ভাইয়ের বিরুদ্ধে সাভার থানায় মামলা করে পুলিশ।</p> <p>খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রাজীব উপজেলা চেয়ারম্যান হওয়ার পর সম্পদে ফুলেফেঁপে ওঠেন তাঁর স্ত্রী শ্রাবণী আক্তারের বড় ভাই মাজহারুল ইসলাম রুবেল। দখলবাজি, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি ও ঝুট ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে অল্পদিনে তিনি বিপুল পরিমাণ অর্থ-সম্পদের মালিক হয়েছেন। রুবেল এখন সাভার সদর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে নতুন এমপি সাইফুল ইসলামের শক্ত অবস্থানের কারণে রুবেল এখন খানিকটা চাপে রয়েছেন বলে জানা গেছে।</p> <p>সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য ও এলাকার লোকজনের ভাষ্য অনুযায়ী, স্থানীয় আরো বেশ কয়েকজন নেতাকর্মী রাজীব ও সমরের ছত্রচ্ছায়ায় প্রভাব বিস্তার করছেন। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন রাজীব ও সমরের মামা সাভার পৌরসভার ২ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর নজরুল ইসলাম মানিক মোল্লা, সাভার উপজেলা ছাত্রলীগের সভপাতি আতিকুল রহমান আতিক, সাভার পৌর ছাত্রলীগের সভাপতি মাসুম, সাভার পৌর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক পাভেল, সদর ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সভাপতি সোহেল রানা, যুবলীগ নেতা বাবু, তেঁতুলঝোড়া ইউপি ছাত্রলীগ সভাপতি লুত্ফর রহমান পাভেল, সাধারণ সম্পাদক ইমতিয়াজ সুমন এবং সাভার কলেজ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সাইফ আহমেদ নাসিম।</p> <p>নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সাভারের হেমায়েতপুরের এক ব্যবসায়ী বলেন, তাঁদের বিরুদ্ধে কথা বলার মতো এই এলাকায় কেউ নেই। প্রকাশ্যে তো দূরের কথা, গোপনে কিছু বললেও রক্ষা নেই। কোনোভাবে কানে গেলে তাঁদের রোষানলে পড়তে হয়। মারধর ও মামলার আসামি হতে হয়, এমন উদাহরণ রয়েছে।</p> <p>২০২২ সালের মে মাসে সাভারের তিন সাংবাদিককে হত্যার হুমকি দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে রাজীবের বিরুদ্ধে। এ ছাড়া উপজেলা পরিষদে বসে প্রকাশ্যে যুগান্তরের সাংবাদিককে হাতুড়িপেটা করার হুমকি দেন রাজীব।</p> <p>২০২৩ সালের জানুয়ারিতে একাত্তর টেলিভিশনের সাভার প্রতিনিধি আশরাফের ওপর হামলা এবং তাঁকে অপহরণের চেষ্টার অভিযোগ ওঠে রাজীবের বিরুদ্ধে।</p> <p>বিভিন্ন তথ্য সূত্র বলছে, বিপুল সম্পদের মালিক বনে যাওয়া রাজীব ২০১৯ সালে নির্বাচনী হলফনামায় উল্লেখ করেন তাঁর ব্যক্তিগত গাড়ি নেই। কিন্তু নির্বাচনের পর পাঁচ বছরে তিনি বিভিন্ন ব্র্যান্ডের অন্তত ছয়টি দামি গাড়ি কিনেছেন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।</p> <p>এ বিষয়ে কথা বলার জন্য রাজীব ও সমরের মোবাইল ফোন নম্বরে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তাঁরা কেউ ফোন রিসিভ করেননি।</p> <p>রাজীব ও সমরের অবৈধভাবে অর্জিত বিপুল পরিমাণ সম্পদ ও বাড়ি-গাড়ি নিয়ে গত ফেব্রুয়ারি মাসে দুটি পত্রিকায় প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। ওই প্রতিবেদনে দুই ভাইয়ের প্রায় দুই হাজার কোটি টাকার সম্পদ অর্জনের নানা তথ্য দেওয়া হয়। এ ছাড়া সরকারের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত হওয়া হলমার্ক গ্রুপের বিপুল পরিমাণ সম্পদ বিক্রি করে দেওয়ার তথ্য প্রকাশ করা হয়। চেয়ারম্যান হওয়ার পর সাভারে ১৩টি হত্যায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে দুই ভাইয়ের জড়িত থাকার তথ্য তুলে ধরা হয়। পরে ওই প্রতিবেদন সংযুক্ত করে সাভারের সজিব হোসেন নামের এক ব্যক্তি দুদক, ঢাকার জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপার বরাবর তদন্ত চেয়ে লিখিত অভিযোগ করেন। তারা ব্যবস্থা না নেওয়ায় সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের নিষ্ক্রিয়তা চ্যালেঞ্জ করে তিনি হাইকোর্টে রিট আবেদন করেন।</p> <p>সর্বশেষ আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গত সোমবার বিচারপতি নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি কাজী ইবাদত হোসাইনের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগটি স্বেচ্ছাধীন আইনগতভাবে নিষ্পত্তি করে ব্যবস্থা নিতে দুদককে নির্দেশ দিয়েছেন।</p>