রাজনীতিতে উত্থান যেভাবে
মাহবুব তালুকদার ১৯৯০ সালে কলাপাড়া উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্ধীতা করে হেরে যান। কিন্তু ২০০১ সালের অষ্টম সংসদ নির্বাচনে তিনি দলের মনোনয়ন পেয়ে প্রথমবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। পরের নির্বাচনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে পানি সম্পদ প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব নেন। ২০১৪ সালেও তিনি কথিত ‘বিনা ভোটে’র নির্বাচনে টানা তৃতীয়বার সংসদ সদস্য হয়েছেন।
কিন্তু দুর্নীতির অভিযোগের কারণে প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পাননি। একই কারণে ২০১৮ সালের একাদশ সংসদ নির্বাচনে তাঁকে মনোনয়ন দেওয়া হয়নি। তাঁর আপন ফুপাত ভাই মো. মহিববুর রহমান দলীয় মনোনয়ন পান। তাকেও প্রতিন্ত্রীর দায়িত্ব দেওয়া হয়। গেল দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও মাহবুব স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করে দলীয় মনোনীত প্রার্থী মো. মহিববুর রহমানের কাছে হেরে যান।
গত ৫ আগষ্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর পরিবারসহ মাহবুব আত্মগোপনে চলে যান। এই সময়ের মধ্যে তার বিরুদ্ধে হত্যা, বিস্ফোরক আইনে একাধিক মামলা দায়ের হয়। একইসঙ্গে জমি দখল করে তার গড়ে তোলা তালুকদারি বেদখল হতে শুরু করে। এতে মানষিকভাবে তিনি বিচলিত হয়ে পড়েন। ঢাকার একটি হাসপাতালে প্রায় এক মাস ধরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় গতবছরের ২২ সেপ্টেম্বর তিনি মারা যান।
‘তালুকদারি’ উদ্ধারের নামে দখলবাজি
কলাপাড়া পৌর শহরের কুমারপট্রি এলাকায় সাবেক প্রতিমন্ত্রী মাহবুব তালুকদারের দ্বিতল ভবন। লাগোয়া পশ্চিম পাশের সাড়ে ৪ শতাংশ জমি ১৯৭৭ সালের ১৪ জুন ইসমাইল তালুকদার বিক্রি করেন। জমি নিয়ে সেখানেই মো. খলিলুর রহমান ওরফে চুন্নু মিয়ার বসবাস করছিলেন। তিনি এক সময় উপজেলা বিএনপির দপ্তর সম্পাদক ছিলেন।
২০০৮ সালের নির্বাচনের পর মাহবুব তালুকদার পানি সম্পদ প্রতিমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন। ২০০৯ সালের ২ সেপ্টেম্বর কতিপয় সন্ত্রাসীরা মাহবুব তালুকদারের নির্দেশে অস্ত্রের মুখে চুন্নু মিয়ার বসতবাড়ি দখল করে। দখলের ৮ দিন পর ১০ সেপ্টেম্বর রাতে ওই জমি মাহবুব জোরপূর্বক লিখে নেন। এই ঘটনার প্রায় ১৬ বছর পর মাহবুব তালুকদার, তাঁর ছোট ভাই ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব:) মো. হাবিবুর রহমানসহ ২৭ জনের নামে চুন্নু মিয়া গতবছরের ১৫ সেপ্টেম্বর আদালতে মামলা করেছেন।
চুন্নু মিয়া বলেন, আমার বসত ভিটা থেকে নামিয়ে দেওয়ার পর শোকে-কষ্টে আমার স্ত্রী মাজেদা বেগম ২০১৭ সালের ২১ জুলাই মৃত্যুবরণ করেন। কলাপাড়া উপজেলা সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট কোর্টে বিচারক থানার ওসিকে তদন্ত করে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দিয়েছে। মামলার এক আসামি গ্রেপ্তার হলেও ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব:) মো. হাবিবুর রহমানসহ অপর আসামি পলাতক রয়েছেন।
মাহবুব তালুকদারের আরেক প্রতিবেশী জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. কামরুজ্জামান। মাহবুরের বাবার কাছ থেকে সোয়া ৬ শতাংশ জমি তারা কিনেন। সেখানে টিন-কাঠের তৈরি বড় ঘর ছিল। জমির পিছনের অংশে আরেকটি ঘর ছিল। দেখাশোনার সেখানে একজন কেয়ারটেকার থাকতেন। প্রতিমন্ত্রী থাকাকালীন মাহবুব পুরো জমিটি জোড়পূর্বক দখল করেন। সীমানা প্রাচীর দিয়ে নিজের জমির সঙ্গে যুক্ত করেছেন।
অধ্যাপক ড. মো. কামরুজ্জামান বলেন, 'সাবেক প্রতিন্ত্রীর আমার বাড়িসহ পাশের আরেকটি বাড়ি দখল করেন। পরবর্তীতে তিনি দখলকৃত জমির দলিল সম্পাদন করে দেওয়ার জন্য চাপ প্রয়োগ করেন। কিন্তু আমি জমির দলিল দেয়নি। দখল হওয়া জমি ফিরে পেতে আইনী প্রক্রিয়া শুরু করেছি।'
খেপুপাড়া কো-অপারেটিভ সাপ্লাই এন্ড সেল সোসাইটি লিমিটেডের সভাপতি বিশ্বাস শফিকুর রহমান টুলু বলেন, 'মাহবুব তালুকদারের ভবনের পাশেই শতবর্ষী সোসাইটির অয়েল মিল ছিল। সেই মিলের অন্তত ৫ শতাংশ জমি তিনি প্রচীর দিয়ে দখল করেছেন। সেই ঘটনায় থানায় সাধারন ডায়েরি করা হয়েছিল। কিন্তু প্রতিমন্ত্রীর বিরুদ্ধে পুলিশ কোনো ব্যবস্থা গ্রহন করেনি। সেই জমি উদ্ধারের জন্য সম্প্রতি সোসাইটি আইনী প্রক্রিয়া শুরু করেছে।'
মাদ্রাসার জমি দখল
কলাপাড়া উপজেলার টিয়াখালী ইউনিয়নের ইটবাড়িয়া মৌজায় ১৪ একর ২ শতাংশ জমি জাল জালিয়াতি করে দখলে রেখেছেন মাহবুব তালুকদার। পটুয়াখালীর দুমকি উপজেলার জলিশা-জাটরা হাসানিয়া সিনিয়র মাদ্রাসা এ জমির মালিক ছিল। ১৯৬৩ সালে এই জমি মাদ্রাসার নামে কবলা করে দেন কলাপাড়া পৌর শহরের বাসিন্দা মোজাম্মেল হক মুন্সীর পরিবার।
প্রায় ৪৭ বছর পর ২০০৯ সালে এ জমির দখল হারায় মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ। প্রতিমন্ত্রী থাকাকালীন মাদ্রাসার ৮ একর জমি মাহবুব নিজের নামে লিখে নেন। ২০০৯ সালের ১০ জুলাই এই দলিল সম্পাদিত হয়। মাহবুবের ভাগনি জামাই আবু সালেহ, কলাপাড়া ভূমি অফিসের তৎকালীন নাজির রফিকুল ইসলাম এবং টিয়াখালী এলাকার গাজী আব্বাস উদ্দিন বাচ্চু বাকি জমি তাঁদের নামে ভুয়া দলিল দিয়ে দখল করেন।
কলাপাড়া পৌর বিএনপির সাধারন সম্পাদক মুসা তাওহীদ নাননু মুন্সী বলেন, মাদ্রাসায় দানকৃত জমির প্রায় ৬ একর পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষ অধিগ্রহন করে। তার বিপরীতে মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষকে সাড়ে ৩ কোটি টাকা দিয়েছিল। কিন্তু উচ্চ আদালতে মামলার কারনে সেই টাকা উত্তোলন করা সম্ভব হয়নি। তবে অপর জমি সম্প্রতি মাদ্রাসা দখলে নিয়েছে।
মাহবুব পরিবার যা বলছেন
মাহবুব তালুকদারের ছোটবোন সুরাইয়া বেগম কালের কণ্ঠকে মুঠোফোনে বলেন, তার ভাইয়ের বেশকিছু জমি ৫ আগষ্টের পর দখল হয়েছে। আরো কিছু জমি দখলের চেষ্টা করা হচ্ছে। তবে জমিজমার বিষয়টি তার ভাই ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অবঃ) মো. হাবিবুর রহমান ভালো বলতে পারবেন। তার সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করিয়ে দেওয়ার কথা বলে তিনি আর ফোন ধরছেন না।
মো.হাবিবুর রহমানের মুঠোফোনে যোগাযোগ করে তাকে পাওয়া যায়নি। এমনকি তাকে খুর্তে বার্তা পাঠালেও তিনি তাতে সাড়া দেননি। মাহবুব তালুকদারের স্ত্রী প্রীতি রহমানের সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি। তারা সবাই ঢাকায় অবস্থান করছেন বলে সুরাইয়া বেগম কালের কণ্ঠকে নিশ্চিত করেছেন।