গত বছরের ৫ আগস্টের পর থেকে নারায়ণগঞ্জের পোশাক কারখানাগুলোতে অস্থিরতা বৃদ্ধি পেয়েছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে গ্যাস সংকট এবং গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধি। গ্যাস সংকটের কারণে কারখানাগুলোতে ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ উৎপাদন কমে যাওয়ায় উৎপাদন ব্যয় বেড়ে গেছে। এতে করে পোশাক শিল্পে সংকট বাড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।
ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বর্তমান রাজনৈতিক অস্থিরতা, ব্যাংক ঋণের উচ্চ সুদহার, উৎপাদন অপ্রতুলতায় নারায়ণগঞ্জের বেশ কয়েকটি পোশাক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। এছাড়া পোশাক শ্রমিকদের কেউ কেউ উসকানি দেওয়ার চেষ্টা করছে। প্রায় সময় বিভিন্ন অযৌক্তিক দাবি নিয়ে শ্রমিকদের আন্দোলনের কারণে কারখানায় কাজের ব্যাঘাত ঘটছে। এর ফলে সময়মতো অর্ডার সরবরাহ করতে পারছেন না অনেক কারখানার মালিকরা।
জেলা শিল্পাঞ্চল পুলিশ কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, বতর্মানে নারায়ণগঞ্জে ছোট বড় মিলিয়ে সর্বমোট ৪৪২টি পোশাক কারখানা সচল রয়েছে। আর বিভিন্ন কারণে গত বছরের ৫ আগস্টের পর থেকে এ পর্যন্ত ১৯টি পোশাক কারখানা স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে গেছে। এতে চাকরি হারিয়েছেন ১ হাজার ৫৭৩ জন। এর মধ্যে পুরুষ শ্রমিকের সংখ্যা ৭৮৯ জন।
এদিকে কারখানাগুলো স্থায়ীভাবে বন্ধ হওয়ার কারণ পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ১৯টি পোশাক কারখানার মধ্যে সিংহভাগ কারখানাই বন্ধ হয়েছে আর্থিক সংকট এবং পর্যাপ্ত কাজের অভাবের কারণে।
পোশাক কারখানা বন্ধের বিষয়ে শিল্পাঞ্চল পুলিশ-৪, নারায়ণগঞ্জ জোনের পরিদর্শক (গোয়েন্দা) সেলিম বাদশা বলেন, এই সমস্যা দীর্ঘদিন ধরেই রয়েছে। বন্ধ হওয়ার পাশাপাশি অনেক কারখানা নতুন করে উৎপাদনে গেছে। কারখানাগুলোতে গ্যাস সংকটের সমস্যা আছে। কোনো কোনো কারখানায় কাজের চাপ কম রয়েছে।
এগুলোর রেকর্ড আমরা রাখি না। এসব বিষয়ে কারখানার মালিকরা ভালো বলতে পারবেন। কারখানাগুলো সচল হওয়ার পাশাপাশি শ্রমিকরা ঠিকমতো বেতন পাচ্ছে কিনা তা আমরা নিয়মিত তদারকি করে থাকি। শ্রমিকদের যদি কোনো অভিযোগ থাকে তখন তা নিয়ে আমরা কাজ করি।
বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) সহসভাপতি মোর্শেদ সারোয়ার সোহেল বলেন, বিভিন্ন সমস্যা মিলিয়ে আমরা কঠিন সংকটে রয়েছি। কারখানা পরিচালনা করতে আমাদের অনেকটাই হিমশিম খেতে হচ্ছে। আমাদের যখন টিকে থাকাই দায়, তখন গ্যাসের দাম ৩৩ শতাংশ বাড়ানোর ঘোষণা আমাদের ওপর বাড়তি চাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
শিল্পখাত ও ক্যাপটিভে গ্যাসের দাম ৩৩ শতাংশ বৃদ্ধির সিদ্ধান্তকে শিল্পখাতের জন্য আত্মঘাতী হবে মন্তব্য করে নারায়ণগঞ্জ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি মোস্তাফিজুর রহমান ভুঁইয়া দিপু বলেন, শিল্পখাতে ও ক্যাপটিভে গ্যাসের দাম ৩৩ শতাংশ বৃদ্ধির যে সিদ্ধান্ত এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন-পেট্রো বাংলাসহ ৬টি গ্যাস বিতরণ কম্পানির মাধ্যমে নিচ্ছে, এটা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক এবং অবাস্তব। এ সিদ্ধান্ত আমাদের শিল্পখাতের জন্য আত্মঘাতী হবে।
তিনি বলেন, দাম বৃদ্ধির ফলে শ্রমজীবী মানুষের ভোগান্তি ব্যাপক বাড়বে। অন্যদিকে, ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট প্রশ্রয় পাবে। এ সিদ্ধান্তে ক্ষুদ্র শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো নতুন সংকটে পড়বে এবং নতুন শিল্প উদ্যোক্তাদের শিল্প কারখানা স্থাপনে অনুৎসাহী করবে।
তিনি আরো বলেন, বর্তমানে গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধির কোনো প্রয়োজন আমরা মনে করছি না। আমদানিকৃত এলএনজি গ্যাসের বিবেচনা করে কিছুটা মূল্য বৃদ্ধি হতে পারে, তবে সেটা অবশ্যই যৌক্তিক হওয়া চাই এবং আন্তর্জাতিক বাজারে দর কমানোর সঙ্গে সঙ্গে আমাদের দেশেও সেটা সমন্বয় করতে হবে।
পোশাক কারখানা বন্ধের কারণ হিসেবে মোস্তাফিজুর রহমান ভুঁইয়া দিপু বলেন, বায়ার না পাওয়া, আর্থিক সংকট ও বিভিন্ন সিন্ডিকেটের কারণে শিল্পকারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। এর মধ্যে কিছু মালিক পতিত সরকারের ঘনিষ্ঠ ছিলেন, তারাও আত্মগোপনে চলে গেছেন। আর এসব সমস্যার কারণে গত কয়েক মাসে শিল্পাঞ্চল গাজীপুর, সাভার ও নারায়ণগঞ্জে ৯৫টি শিল্পকারখানায় উৎপাদন বন্ধ হয়ে গেছে। এছাড়া গ্যাস সংকটে উৎপাদনের গতি কিছুটা কমেছে। একজন শ্রমিকের পরিবারের সদস্যরাও সমস্যার মুখে পড়েছে। সরকারের উচিত, বাইরে থেকে যে শক্তিগুলো কাজ করে এই শিল্প-কলকারখানা বন্ধ করে দেশকে অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু করে দেওয়ার জন্য, তাদের বিরুদ্ধে আরো কঠোর অবস্থানে যাওয়া।
বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, গ্যাস সংকট, গ্যাসের দামবৃদ্ধিসহ বিভিন্ন কারণে পোশাক কারখানাগুলোতে উৎপাদন মারাত্মক ব্যাহত হচ্ছে। গ্যাসের দাম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে যদি সে অনুযায়ী আমরা নিয়মিত গ্যাস সরবরাহ পেতাম তাহলেও আমরা এতো ক্ষতির সম্মুখীন হতাম না।
তিনি বলেন, কোনো কারখানা কর্তৃপক্ষ দুই মাসের বেশি গ্যাস বিল বকেয়া রাখলেই ওই কারখানা থেকে গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হচ্ছে। এর ফলে আমরা মারাত্মক সমস্যার মধ্যে পড়েছি। এছাড়া গ্যাস সংকটের কারণে আমাদের উৎপাদন প্রায় ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ কমে গেছে। পাশাপাশি গত কয়েকমাসে আমাদের বেশ কয়েকটি পোশাক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে।