<p>চাকমা, মারমা, ত্রিপুরাসহ বাংলাদেশে বহু ভাষাভাষী মানুষের বাস। শুধু পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলায় বাস করে ১১টি নৃগোষ্ঠীর মানুষ। প্রত্যেকের আছে আলাদা ভাষা ও সংস্কৃতি। কিন্তু এসব ভাষায় চলচ্চিত্র নির্মাণের ইতিহাস খুব কম। এর আগে চাকমা ও মারমা ভাষায় চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছিল। এবার দেশে প্রথমবারের মতো প্রদর্শিত হবে ম্রো ভাষায় নির্মিত চলচ্চিত্র ‘ক্লোবং ম্লা’। বাংলা নাম ‘গিরিকুসুম’। নির্মাতা প্রদীপ ঘোষ।</p> <p>২৩ ফেব্রুয়ারি ঢাকার ধানমণ্ডিতে ‘মাতৃভাষা চলচ্চিত্র উৎসব ২০২৫’-এ প্রদর্শিত হবে ছবিটি, জানিয়েছেন পরিচালক। বান্দরবানের প্রবীণ চিকিৎসক মং উষা থোয়াই। তিনি দীর্ঘদিন ধরেই চেষ্টা করে যাচ্ছেন পাহাড়ের বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর ভাষায় চলচ্চিত্র নির্মাণের। এর আগে মারমা ভাষায় প্রথম চলচ্চিত্র ‘গিরিকন্যা’ প্রযোজনা করেছেন তিনি।</p> <p>ম্রো ভাষার প্রথম চলচ্চিত্রটিরও প্রযোজক ডা. মং উষা থোয়াই। তিনি বলেন, ‘পার্বত্য এলাকায় ১১টি জাতিগোষ্ঠীর মানুষ আছে। প্রত্যেকের নিজস্ব ভাষা ও বর্ণমালা আছে। সেসব সিনেমার মাধ্যমে তুলে ধরতে চাই আমি।’</p> <p>‘ক্লোবং ম্লা’র কাহিনি লিখেছেন ম্রো ভাষার লেখক ও গবেষক ইয়াংঙান ম্রো। ম্রো সমাজের মানুষ ইয়াংঙানকে চেনে নিজেদের কণ্ঠস্বর হিসেবে। পাহাড়ের অন্য নৃগোষ্ঠীর তুলনায় ম্রোরা খুবই অনগ্রসর। বেশির ভাগই লিখতে ও পড়তে পারে না। সেই পিছিয়ে থাকা সমাজে জ্ঞানের সৌরভ ছড়িয়ে যাচ্ছেন ৪০ বছর বয়সী এই গবেষক। ম্রোদের অনেক প্রথমের সঙ্গে জড়িয়ে আছে ইয়াংঙান ম্রোর নাম। ম্রো ভাষার প্রথম অভিধান লিখেছেন তিনি। লিখেছেন নিজ ভাষার প্রথম ব্যাকরণও। ম্রো ভাষায় প্রকাশিত প্রথম বইটিও তাঁর লেখা। এবার নিজেদের প্রথম চলচ্চিত্রের সঙ্গে জড়াল তাঁর নাম। ইয়াংঙান ম্রো বলেন, “ম্রো জাতিগোষ্ঠীর ইতিহাস অনেক প্রচীন। শুধু বান্দরবান জেলার সর্বত্রই নয়, পার্শ্ববর্তী দেশ মায়ানমারের রাখাইন এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গেও ম্রো জাতিগোষ্ঠীর বসবাস। ম্রোদের মুরং নামেও ডাকা হয়। মুরং শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে ম্রো থেকে, ম্রো অর্থ মানুষ। মুরং অর্থ মানবসমাজ। ম্রোদের ইতিহাস-ঐতিহ্য নিয়ে খুব একটা কাজ হয়নি। আমরা ধীরে ধীরে চেষ্টা করছি। তারই ধারাবাহিকতায় এই চলচ্চিত্র। ‘ক্লোবং ম্লা’র প্রযোজক, পরিচালকসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে ধন্যবাদ।”</p> <p>ম্রো সমাজে খুবই জনপ্রিয় প্রচলিত গল্প ‘ক্লোবং ম্লা’। ক্লোবং নামের এক কন্যাশিশুকে কেন্দ্র করে আবর্তিত গল্পটি। শৈশবে কলেরায় আক্রান্ত হয়ে মারা যায় ক্লোবংয়ের মা-বাবা। একমাত্র বড় ভাই ক্লোবংকে আদর-স্নেহে বড় করে তোলে। ভাইটি জুম কাজে সারাক্ষণ ব্যস্ত থাকত আর ক্লোবং ঘরের যাবতীয় কাজ করত। একসময় তার ভাই বিয়ে করে। কিন্তু আদর-স্নেহ দূরে থাক, ক্লোবংকে অত্যাচার করতে থাকে তার বৌদি। প্রিয় বোনের প্রতি এমন অত্যাচার মেনে নিতে পারেনি বড় ভাই। নানা ঘাত-প্রতিঘাতে সমাপ্তির দিকে যায় কাহিনি।</p> <p>১৮ মিনিট ব্যাপ্তির চলচ্চিত্রটিতে মূলত ম্রোদের পারিবারিক জীবন ও সংগ্রাম চিত্রায়িত হয়েছে। অভিনয় করেছেন ইয়াংঙান ম্রোসহ বান্দরবানের ম্রো সম্প্রদায়ের ১৫ জন। সবার জীবনে অভিনয়ের হাতেখড়ি হয়েছে এই সিনেমা দিয়েই।</p> <p>চিম্বুক, রামরিপাড়াসহ বান্দরবানের বিভিন্ন জায়গায় হয়েছে স্বল্পদৈর্ঘ্য ছবিটির শুটিং। এ প্রসঙ্গে পরিচালক প্রদীপ ঘোষ বলেন, ‘ইয়াংঙান ম্রোকে ছাড়া এই সিনেমা নির্মাণ অসম্ভব ছিল। আমরা যখন দুর্গম পাহাড়ে শুটিং পরিচালনা করি, তখন ইয়াংঙান ম্রো তাঁর জনগোষ্ঠীর মানুষকে উৎসাহিত করেছেন। আমরা বাংলায় বলেছি। ইয়াংঙান সেটা ম্রো ভাষায় অনুবাদ করে ছবির কলাকুশলীদের বুঝিয়ে দিয়েছেন।’</p> <p>পরে ছবি সম্পাদনার সময়ও ইয়াংঙান ম্রোর সহায়তা নিয়েছেন প্রদীপ ঘোষ। এখন চলছে প্রদর্শনীর প্রস্তুতি। ছবিতে ম্রো ভাষার পাশাপাশি থাকছে বাংলা ও ইংরেজি সাবটাইটেল। এর আগে মারমা ছবি নির্মাণ করেছেন প্রদীপ ঘোষ, এখন নির্মাণ করছেন বম ভাষার ছবি। দেশে বসবাসরত সব নৃগোষ্ঠী নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ করার ইচ্ছা এই পরিচালকের।</p> <p>উল্লেখ্য, এর আগে ম্রো জনগোষ্ঠীকে নিয়ে ছবি ‘ম্রো’ নির্মাণ শুরু করেছিলেন অং রাখাইন। তার আগেই এই ভাষায় ছবি বানিয়ে দর্শকের সামনে হাজির হচ্ছেন প্রদীপ ঘোষ। ‘ম্রো’ ছবির কাজ কয়েক বছর আগে শুরু করলেও নানা জটিলতায় এখনো সম্পন্ন করতে পারেননি। এর আগে চাকমা ভাষার প্রথম ছবি ‘মর ঠেংগারি’ বানিয়ে প্রশংসিত হয়েছেন অং। গতকাল কালের কণ্ঠকে অং বলেন, ‘এখনো ছবির কাজ সম্পন্ন করতে পারিনি। কিছু জটিলতা আছে। বিস্তারিত কিছু বলতেও পারছি না। আমি কয়েক দিন ধরে অসুস্থ। তবে এটুকু বলতে পারি, ছবিটা ২০২৬ সাল নাগাদ মুক্তি দেব।’</p>