<article> <p style="text-align: justify;">ধোঁয়ার গন্ধ টের পাচ্ছিলাম রোহিঙ্গা শিবিরের সরু রাস্তা ধরে যেতে যেতে। এ বছরের শুরুতে এক বিশাল অগ্নিকাণ্ড পুড়িয়ে দিয়েছে প্রায় ৯০০ ঘর। আরেকটু এগোতেই বোঝা যায় কোথায় আগুন লেগেছিল। হঠাৎ এক জায়গায় দেখা যায় কোনো গাছ নেই, মাটি পুড়ে কালো হয়ে আছে। কয়েক দিন আগেও সবুজে ঢাকা পাহাড়গুলোতে এখন আছে শুধু পোড়া গাছ।</p> </article> <article> <p style="text-align: justify;"><img alt="ছাই থেকে নতুন জীবনের সূচনা" height="160" src="https://cdn.kalerkantho.com/public/news_images/share/photo/shares/1.Print/2024/February/04-02-2024/mk/kk-6-2024-02-04-02a.jpg" width="321" />সব হারানো হাজার হাজার রোহিঙ্গা ৭ জানুয়ারি রাতে এখানে আবারও নিঃস্ব হয়েছে। ত্রিপল আর বাঁশের তৈরি ঘরগুলোতে গত কয়েক বছরের রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবিরের জীবনে সংগ্রহ করা সামান্য জিনিসপত্রই ছিল। সেগুলোও পুড়ে গেল, যখন আগুন থেকে বাঁচতে সবাই মরিয়া হয়ে পালাচ্ছিল।</p> </article> <article> <p style="text-align: justify;">তবে সেসব মানুষ ফিরেও এসেছে দ্রুত। অস্থায়ী ঝুপড়িতে বসে তাদের অধীর অপেক্ষা আগের জায়গায় নতুন করে ঘর তোলার জন্য। মানবিক সংস্থাগুলোর তৈরি ইমার্জেন্সি শেল্টারগুলো হয়তো উষ্ণ আর শক্ত, কিন্তু তাদের অনেকেই চায় পরিচিত জায়গায় থাকতে। একজন রোহিঙ্গা যেমন বলছিলেন, ‘এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যেতে যেতে আমরা ক্লান্ত। আপাতত এখানেই আমাদের ঘর।’</p> </article> <article> <p style="text-align: justify;">এই প্রান্তরে এখন শোনা যায় নির্মাণের শব্দ আর নতুন ঘর তুলতে পুরোদমে ব্যস্ত রোহিঙ্গাদের কণ্ঠ। রোহিঙ্গারা একেক দুর্যোগের পর নতুন করে আবার সব কিছু দাঁড় করায় আর পরিষ্কার প্রমাণ দেয় তাদের দৃঢ় প্রত্যয়ের।</p> <p style="text-align: justify;">আমাদের গর্ব হয় প্রতিটি দুর্যোগে রোহিঙ্গা স্বেচ্ছাসেবক ও সাধারণ রোহিঙ্গাদের স্থির সংকল্প আর দক্ষতা দেখে। এবারের আগুনে একজনও মারা যায়নি বা গুরুতর আহত হয়নি।</p> </article> <article> <p style="text-align: justify;">রাত ১টার সামান্য একটু পর যখন সাইরেন বেজেছে, শত শত স্বেচ্ছাসেবক এগিয়ে এসেছে। তারা শিশু, বয়োবৃদ্ধ ও প্রতিবন্ধীসহ প্রায় পাঁচ হাজার মানুষকে নিরাপদে সরিয়ে নিয়েছে আর এর সঙ্গে আগুনও নিভিয়েছে।</p> <p style="text-align: justify;">অন্য ক্যাম্প থেকে রোহিঙ্গা স্বেচ্ছাসেবকরাও এসে যোগ দেয় দ্রুত ছড়িয়ে পড়া লেলিহান শিখা নেভাতে। তারা খুব ভালো করেই জানত শীতের শুষ্ক মৌসুমের জোরালো বাতাসে আগুন কত দ্রুত ছড়াতে পারে। সময়মতো নেভাতে না পারলে এরপর তাদের ঘরেও আগুন লাগতে পারত। ফায়ার সার্ভিসের প্রতিও আমরা গভীরভাবে কৃতজ্ঞ, তারা ঘটনাস্থলে এসেছিল আর প্রায় তিন ঘণ্টার সম্মিলিত চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে।</p> <p style="text-align: justify;">রোহিঙ্গাদের সাহসিকতা ও তৎপরতায় আমি বিস্মিত। উদ্ধারকাজে নিয়োজিত রোহিঙ্গা স্বেচ্ছাসেবকরা বয়স্ক প্রতিবেশীদের, যাঁরা হাঁটতে পারেন না, তাঁদের কাঁধে করে সরিয়ে নিয়ে গেছে। আরেক দল ‘ফায়ার-ব্রেক’ তৈরি করছিল কিছু শেল্টার ভেঙে দেওয়ার মাধ্যমে, যেন আগুনের ছড়িয়ে পড়া বন্ধ করা যায়। আগুন মোকাবেলায় তাদের প্রত্যেকেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।</p> <p style="text-align: justify;">তারা সবাই একটা ব্যাপারে একমত যে ক্যাম্পে ঢোকার রাস্তা ভালো থাকলে অনেক মূল্যবান সময় বাঁচানো যেত।</p> <p style="text-align: justify;">রোহিঙ্গাদের আগমনের পর ২০১৭ সালের শেষের দিকে যখন এই পাহাড়ি এলাকায় রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবির গড়ে ওঠে, সবুজে ঢাকা এই জায়গা রূপ নেয় জনবহুল লোকালয়ে। সান ফ্রান্সিসকো বা আমস্টারডাম শহরের জনসংখ্যার সমানসংখ্যক মানুষের বাসস্থান নির্মাণে বাংলাদেশি ও আন্তর্জাতিক মানবিক সংস্থার কর্মীরা একসঙ্গে কাজ করেছিলেন কয়েক মাস ধরে।</p> <p style="text-align: justify;">পরবর্তী বছরগুলোতে যখন ক্যাম্পজুড়ে রাস্তাগুলো তৈরি হলো, পাহাড়ের ধারে তত দিনে গড়ে উঠেছে রোহিঙ্গাদের শেল্টার। এই এলাকাকে বড় রাস্তার সঙ্গে যুক্ত করতে হলে সেই শেল্টারগুলো ভাঙতে হতো আর সেসব মানুষকে আবার অন্য কোথাও সরিয়ে নিতে হতো। তাই শেল্টারগুলো আর ভাঙা হয়নি, সংযোগ সড়ক নির্মিত হয়নি। সে জন্যই ৭ জানুয়ারির রাতের আগুনের স্পটে যাওয়ার উপায় ছিল সরু রাস্তা আর সিঁড়ি। বাঁশ দিয়ে মজবুত করা সরু রাস্তায় ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি সহজে যেতে পারছিল না।</p> <p style="text-align: justify;">২০১৭ সাল থেকে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের অনেক উন্নতি হয়েছে। স্বাস্থ্যবিধি, শিক্ষা ও চিকিৎসাকেন্দ্র জীবনমান উন্নয়নে সাহায্য করেছে। বনায়নের জোরালো প্রচেষ্টায় বাদামি এলাকাটি সবুজে ভরিয়ে তোলা হয়েছে। দক্ষতা উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে রোহিঙ্গারা পেয়েছে নতুন কাঠামো ও কিছু সামগ্রী; যদিও প্রায় সবাই আমাদের বলে, নিরাপদ হলে তারা নিজ দেশ মিয়ানমারে ফিরে যেতে চায়; তবু তারা যারপরনাই চেষ্টা করছে দৈনন্দিন কাজের মাধ্যমে রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবিরের জীবনে স্বাভাবিক থাকতে।</p> <p style="text-align: justify;">বাংলাদেশি মানবিক সংস্থা, জাতিসংঘের সংস্থা ও এনজিওর সঙ্গে মিলে ইউএনএইচসিআর ক্ষতিগ্রস্ত ক্যাম্পটি পুনর্নির্মাণ করছে আর লক্ষ রাখছে কিভাবে আরেকটু ভালোভাবে এটিকে গড়ে তোলা যায়। সুষ্ঠুভাবে পরিকল্পিত ক্যাম্পে দুর্যোগের ঝুঁকি কম থাকে, যদিও রোহিঙ্গাদের ঘর নির্মাণে এখনো অস্থায়ী উপকরণই ব্যবহৃত হচ্ছে; তার পরও আমরা সাইট প্ল্যানিং, রাস্তার প্রশস্ততা, পানি ও পয়োনিষ্কাশন কেন্দ্র, স্ট্রিট ল্যাম্প এবং শেল্টারের সার্বিক নকশায় গুরুত্বপূর্ণ উন্নতি করছি।</p> <p style="text-align: justify;">ক্যাম্পের বিধ্বংসী আগুন আমাদের আবারও তীব্রভাবে মনে করিয়ে দেয়, রোহিঙ্গাদের মনোবল যত দৃঢ়ই হোক না কেন, আশ্রয়শিবিরে দুর্যোগ আঘাত হানলে তা খুবই করুণ অভিজ্ঞতা নিয়ে আসে। সে জন্য ঘূর্ণিঝড়, ভারি মৌসুমি বৃষ্টি, আগুন বা ভূমিধসে টিকে থাকার মতো মজবুত বাসস্থান ও ভালো সংযোগ সড়ক নির্মাণে আমাদের সম্মিলিতভাবে কাজ করা খুবই জরুরি। শত শত ঘর, রাস্তা আর বিভিন্ন স্থাপনা পুনর্নির্মাণের মাধ্যমে তাদের জীবন নতুন করে শুরু হচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ নতুন ঘরে থাকতে পারবে, যেখানে আমরা আশা করি তারা আরেকটু নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারবে এটা জেনে যে বিপদে তাদের কাছে সাহায্য পৌঁছাবে আরেকটু দ্রুত।</p> <p style="text-align: justify;"><b>লেখক : </b>বাংলাদেশে জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআরের রিপ্রেজেন্টেটিভ হিসেবে কর্মরত</p> </article>