<p>বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের জুলাই-সেপ্টেম্বরে মোট বেকারের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২৪ লাখ ৩০ হাজার, যা অতীতের চেয়ে কমেছে। যদিও কেউ কেউ এ বিষয় নিয়ে সমালোচনা করেছেন। বেকারের সংখ্যা কমা দেশের অর্থনীতির জন্য ইতিবাচক। তার পরও শিল্পসহ বিভিন্ন খাতে বিদেশ থেকে দক্ষ কর্মী আনতে হয়।</p> <p>দুই লাখেরও বেশি বিদেশি কর্মী বাংলাদেশের বিভিন্ন শিল্প-কারখানায় কর্মরত। দেশে নিযুক্ত এসব বিদেশি কর্মীর বার্ষিক বেতন বাবদ ৬ বিলিয়ন ডলার বা তার বেশি উত্তোলন করে থাকেন, যা আমাদের মতো দেশের জন্য কোনোভাবেই কাম্য নয়। বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ ২০২১-২২ অর্থবছরে ১৫ হাজার ১২৮ বিদেশির ওয়ার্ক পারমিট অনুমোদন দেয়। এটি আগের বছরের তুলনায় ৮৭.৩২ শতাংশ বেশি।</p> <p>এ জন্য দেশে গুণগত এবং দক্ষ জনশক্তির অভাবকে দায়ী করা হয়। তাই তরুণ শিক্ষিত সমাজকে অবশ্যই দেশি-বিদেশি শিল্প প্রতিষ্ঠানে কর্মক্ষম এবং অধিক যোগ্যতাসম্পন্ন হিসেবে গড়ে তুলতে আমাদের নানামুখী পদক্ষেপ নেওয়া খুবই জরুরি, যা আমাদের কর্মীদের বিশ্ববাজারে চাহিদা বাড়বে। এক গবেষণায় দেখা গেছে, রপ্তানিমুখী পোশাকশিল্পে অনেক বিদেশি লোক কাজ করে যাচ্ছে। বিদেশিরা সাধারণত পোশাকশিল্পে মার্চেন্ডাইজার, টেকনিশিয়ান, গবেষণা এবং উন্নয়ন, নমুনা উন্নয়ন, উৎপাদন স্তর, মান নিয়ন্ত্রণ, রক্ষণাবেক্ষণ ক্ষেত্রে কাজ করছে।</p> <p>কর্মরত বিদেশিদের মধ্যে ভারতীয়রাই শীর্ষে। তারপর শ্রীলঙ্কা, চীন, থাইল্যান্ড। যদি স্থানীয় লোকের প্রয়োজনীয় অভিজ্ঞতা যেমন-সফট স্কিল থাকত, তাহলে হয়তো এত বিদেশি কর্মী নিয়োগ পেত না। পোশাক মালিকদের বিকল্প নেই বলে বিদেশি লোক নিয়োগ দিয়ে থাকেন। এ ছাড়া পোশাকশিল্পে কেমন দক্ষতা বা কোন বিষয়ে পারদর্শী লোক দরকার, সেই অনুসারে আমাদের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কোর্স কারিকুলাম তৈরি করা হয় কি না এটা প্রশ্নের বিষয়।</p> <p>তাই আমাদের শিক্ষার্থীদের অবশ্যই পোশাকশিল্প বা অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের চাহিদা অনুযায়ী ডিগ্রি দেওয়া দরকার। এ জন্য ইন্ডাস্ট্রি-একাডেমিয়া সংযোগ দরকার। মাঝেমধ্যে করপোরেট  প্রতিষ্ঠান থেকে কিছু উচ্চ পর্যায়ের প্রফেশনাল লোকদের ক্লাস নেওয়ার সুযোগ করে দেওয়া উচিত, যাতে শিক্ষার্থীরা বাস্তব জব মার্কেটের চাহিদা অনুসারে জ্ঞান অর্জন করতে পারে। শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন সারা দেশে যেসব প্রশিক্ষণকেন্দ্র আছে সেখানে চাহিদাভিত্তিক প্রশিক্ষণ ও দক্ষতা অর্জনের ব্যবস্থা বাড়াতে হবে।</p> <p>বিশ্লেষকরা অনেকেই মনে করে থাকেন বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থাও কর্মমুখী নয়। কারণ বিশ্ববিদ্যালয় ও শিল্প প্রতিষ্ঠানে যৌথ গবেষণা নেই বললেই চলে। বর্তমান দেশে শিক্ষা কার্যক্রম চালুকৃত সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ৫৪টি। এর মধ্যে ১০টি বা তার বেশি বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয়। এমনকি বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয় সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো সব ধরনের কোর্স চালু করে থাকে। শিল্প প্রতিষ্ঠানের চাহিদা অনুযায়ী আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের কোর্স কারিকুলাম ডিজাইন করা উচিত। কারণ শিল্প প্রতিষ্ঠান অনেক ক্ষেত্রে দক্ষ জনশক্তি পাচ্ছে না। তাই বিদেশ থেকে দক্ষ কর্মী নিয়োগ দিতে হয়। আবার বেকারের সংখ্যা কম নয়। দুই পক্ষের মধ্যে গ্যাপ রয়েছে। তাই বিশ্ববিদ্যালয়কে উদ্যোগ নিতে হবে। ইন্ডাস্ট্রির চাহিদা অনুসারে জনশক্তি তৈরি করা সময়ের দাবি। এ জন্য স্মার্ট বাংলাদেশ নির্মাণে শিল্পের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংযোগ খুবই জরুরি। আমাদের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অনেকের গ্র্যাজুয়েটসের কারিগরি দক্ষতার সফট স্কিলের ঘাটতি রয়েছে। ফলে অনেক গ্র্যাজুয়েট বেকার থেকে যায়। ভিশন ২০৪১, টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্য অর্জন এবং চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় বিশ্ববিদ্যালয়-শিল্প প্রতিষ্ঠানে সংযোগ প্রয়োজন। তাই বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিয়ে খুবই দ্রুত দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। এ জন্যই কারিগরি শিক্ষার ক্ষেত্রে বয়সের বাধ্যবাধকতা তুলে দেওয়ার বিষয়ে সরকারের সিদ্ধান্তটি সঠিক বলে মনে করছি। উন্নত ও প্রযুক্তিগত গবেষণার গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র হলো বিশ্ববিদ্যালয়।</p> <p>কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর দক্ষতা উন্নয়ন ও বেকার সমস্যা নিরসনে বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়মিত কোর্সের পাশাপাশি বিভিন্ন শর্ট কোর্স ও প্রফেশনাল কোর্স পরিচালনা করা যেতে পারে বলে মতামত দিয়েছেন বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সদস্য, যা খুবই ইতিবাচক সিদ্ধান্ত হবে, যদি এটা কার্যকরীভাবে বাস্তবায়ন হয়। বাণিজ্যিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক অগ্রগতির কলাকৌশল প্রণয়নের কেন্দ্রবিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়। গবেষণার মাধ্যমে জ্ঞান সৃষ্টি, উদ্ভাবনী চিন্তা-চেতনার বিকাশ মূলত বিশ্ববিদ্যালয়ের মাধ্যমে হয়ে থাকে। বিশ্ববিদ্যালয় বিভিন্ন গবেষণা এবং দক্ষ শিক্ষকদের একটি নির্দিষ্ট কাঠামোতে সমন্বিত করে যেভাবে উদ্ভাবন ও উন্নয়নে অবদান রাখতে পারে, শিল্প প্রতিষ্ঠানের পক্ষে এককভাবে তা সম্ভব নয়। ইউরোপে শিল্প বিপ্লবের সময় থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ে গবেষণা শুরু হয়। ইন্ডাস্ট্রি বিশ্ববিদ্যালয় সংযোগের অনেক সুবিধা রয়েছে, যেমন-বিশ্ববিদ্যালয়-শিল্প প্রতিষ্ঠানের যৌথ গবেষণা থেকে উদ্ভাবনী পণ্য এবং প্রযুক্তির মাধ্যমে সমাজ উপকৃত হয়ে থাকে। এই যৌথ গবেষণার মাধ্যমে নতুন উন্নত মেডিক্যাল ডিভাইস, কৌশল, দক্ষ শক্তি উন্নয়ন এবং উদ্ভাবনী বৈদ্যুতিক প্রযুক্তি যেমন কম্পিউটার এবং আধুনিক যন্ত্রপাতি তৈরি করা সম্ভব। পরোক্ষভাবে বিশ্ববিদ্যালয়-শিল্প প্রতিষ্ঠান সংযোগ যে নতুন পণ্য তৈরি করতে পারে, তা দিয়ে শিল্প প্রতিষ্ঠান প্রতিযোগিতামূলক বিশ্ববাজারে টিকে থাকা সহজ হয় এবং দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ল্যাবগুলোতে যেসব বৈজ্ঞানিক সরঞ্জামগুলো থাকে না, তা শিক্ষকরা ইন্ডাস্ট্রি-একাডেমিয়া সংযোগের মাধ্যমে সহজেই ব্যবহার করতে পারে। এই সরঞ্জামগুলো শিক্ষকদের গবেষণার অতিরিক্ত সুযোগ সৃষ্টি করে, যা শেষ পর্যন্ত গবেষকদের উৎপাদনশীলতায় অবদান রাখে। বিশ্ববিদ্যালয় এই সংযোগের মাধ্যমে স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থীদের জন্য ভবিষ্যতের কর্মসংস্থানের ক্ষেত্র বৃদ্ধি করতে পারে। করপোরেট অংশীদারের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয় আরো রিসোর্স পেয়ে থাকে, যা গবেষণা করতে সহায়ক এবং তারা তাদের গবেষণার ক্ষেত্রগুলোকে বৈচিত্র্যময় করতে সক্ষম হয়।</p> <p>ইন্ডাস্ট্রি-একাডেমিয়া লিংকেজ সহযোগিতা কম্পানির অভ্যন্তরীণ গবেষণা এবং উন্নয়ন কর্মসূচিকে উদ্দীপিত করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা শিল্পবিজ্ঞানীদের বর্তমান গবেষণার দুর্বলতা শনাক্ত করতে পারে, যা উদ্ভাবনী প্রক্রিয়া এবং সম্ভাব্য পণ্যগুলোর নকশা এবং বিকাশের জন্য কার্যকর হতে পারে। যা সম্ভাব্য পণ্যকে পরীক্ষাগার থেকে বাজারে নিয়ে যাওয়ার সময় কমায় এবং আন্তর্জাতিক বাজারে অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতার গতিশীলতা জোরদার করে থাকে। অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নত এবং আধুনিক গবেষণা ল্যাব সুবিধা রয়েছে, যাতে শিল্প প্রতিষ্ঠান গবেষণা পরিচালনা করতে পারে। পরিশেষে ইন্ডাস্ট্রি-একাডেমিয়া সংযোগ উভয় পক্ষের গবেষণা ও উন্নয়নকে অধিকতর শক্তিশালী করতে খুবই জরুরি। বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা শিল্প প্রতিষ্ঠান বিজ্ঞানীদের নকশা এবং প্রযুক্তিগত সমস্যা সমাধানে সহায়তা করে থাকে। এ ছাড়া শিল্প প্রতিষ্ঠান বা কম্পানির কর্মীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মাধ্যমে নতুন গবেষণা কৌশল শেখার সুযোগ পায়। যৌথ গবেষণা থেকে বিকশিত উদ্ভাবনী পণ্যগুলো বেশি লাভজনক হতে পারে, যা পরবর্তী সময়ে গবেষণা ও উন্নয়নকে ইতিবাচকভাবে প্রভাবিত করে।</p> <p><strong> লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, হিসাববিজ্ঞান ও তথ্য পদ্ধতি বিভাগ, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ</strong></p>