<article> <p>বর্তমানে পণ্যের মূল্য বেঁধে দিয়ে জিনিসপত্রের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা চলছে, কিন্তু সবই বৃথা। বাজার অর্থনীতিতে পণ্য ও সেবার দাম নির্ধারিত হয় চাহিদা ও জোগানের মিথস্ক্রিয়ায়; যেখানে ক্রেতা ও বিক্রেতা উভয়ে দর-কষাকষির মাধ্যমে নিজেদের উদ্বৃত্ত সবচেয়ে বেশি করার প্রচেষ্টা নেয়। কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ ছাড়াই একটা মুক্তবাজারে উদ্বৃত্ত ভাগাভাগিতে উভয় পক্ষ তুষ্ট হয়ে বাড়ি ফেরে। তবে মূল্যস্ফীতি ঘটলে, যেমন বর্তমান বাংলাদেশে, বিশেষত যাদের টানাটানির সংসার, তাদের উদ্বৃত্ত হ্রাস পায় এবং উৎপাদকের—বিশেষত দাম কারসাজিতে লিপ্ত সিন্ডিকেট সদস্যদের উদ্বৃত্ত ঊর্ধ্বমুখী হয়। একেই বলে, কারো যায় ঘর পোড়া, কেউ দেয় আলু পোড়া।</p> <p>জানা কথা যে মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির সূত্রে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পায় এবং সেহেতু অর্থনৈতিক অবনতি ঘটে। এমন একটা ব্যাখ্যা নিতান্তই হালকা, সরলরৈখিক এবং বলা যেতে পারে, তা জলের ওপর ওড়াউড়ি কিন্তু জল স্পর্শ করা নয়। মূল্যস্ফীতির অগোচরে থাকা আসল প্রভাবটা আলোতে আসে যখন আমরা গরিবের পুষ্টির কথা ভাবি। বাংলাদেশে বর্তমানে চার সদস্যের একটা পরিবারে সুষম খাদ্য সরবরাহে প্রতি মাসে প্রয়োজন ১৯-২০ হাজার টাকা।</p> <p>একজন দিনমজুর, রিকশাচালক, চর্মকার কিংবা গৃহস্থালির কাজে <img alt="প্রয়োজন প্রতিযোগিতামূলক বাজার" height="269" src="https://cdn.kalerkantho.com/public/news_images/share/photo/shares/1.Print/2024/03.March/29-03-2024/Untitled-1.jpg" style="float:left" width="321" />নিযুক্ত মানুষসহ যেকোনো নিম্ন আয়ের গরিব মানুষ এখন প্রতিদিন যে আয় করছে, তাতে এই পুষ্টি জোগানো প্রায় অসম্ভব। ইদানীং খবরের কাগজে শিরোনাম হয় বিভিন্ন পণ্যের ‘অযৌক্তিক’ ঊর্ধ্বমুখী দাম; যেমন—পেঁয়াজ, চাল, ডিম, মুরগি ইত্যাদি। বলা নেই, কওয়া নেই, হুট করে দাম বেড়ে ভোক্তার মাথায় হাত। যা হোক, আজকের নিবন্ধে আমরা মুরগির বাজারের অস্থিরতা, হরহামেশা সংবাদপত্রের শিরোনাম ইত্যাদি তুলে ধরার প্রয়াস নেব। গরিবের কথা আপাতত বাদ দিলেও মুরগির বাজারের অস্থিরতা যে মধ্যবিত্তের পরিবারে পুষ্টির অভাব ঘটাবে, তাতে সন্দেহ নেই।</p> <p>মুরগি আমাদের খাবারের মেন্যুতে শ্রদ্ধার আসনে বসে আছে সে কথা সবার জানা। সৈয়দ মুজতবা আলী খাবারদাবার নিয়ে অনেক লিখেছেন, বিশেষত গোয়ালন্দ ঘাট থেকে ছাড়া রকেট স্টিমারে রান্না করা সুস্বাদু মুরগির তরকারি তাঁর নজর এড়ায়নি। মুরগির তরকারি বাঙালির খুব প্রিয় খাবার। অসুখ হলে মুরগির স্যুপ, বিয়ে বা মেহমানদারি হলে মুরগির রোস্ট আর এমনিতে প্রোটিনসমৃদ্ধ এই খাবারটির কদর তো আছেই।</p> </article> <article> <p>মুরগিকে খুব বড় প্রাণী হিসেবে কেউ ভাবে না। ভীরু লোককে বলা হয় চিকেন হার্টেড আর নিতান্তই সাদাসিধা বন্ধুদের বলা হয় ‘মুরগি’। সেই রাগে কিনা জানি না, বছরখানেক আগে বাজারে মুরগি খেপে গিয়ে বেশি দাম হাঁকত, তা-ও গেল রমজানের প্রারম্ভে। মাত্র এক-দেড় মাস আগে যে ব্রয়লার মুরগির দাম ছিল ১৫০ টাকা কেজি, একলাফে তা প্রায় দিগুণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল ২৮০ টাকায়। আমার গিন্নির জন্য, যিনি একজন কঠোর কিডনি রোগী, যাঁর ডাক্তার প্রস্তাবিত প্রোটিন মাত্রা খুব কম, বাজারে মুরগির দাম শুনে তাঁর হূত্কম্পন প্রতিফলিত হয় রাগে, ক্ষোভে এবং চেহারায়। এর ওপর গেল রমজান মাসে মুরগির দাম কেজিপ্রতি ৩০০ টাকা পার হতে পারে—এমন প্রক্ষেপণ শুনে তাঁর মাথায় বাজ পড়েছিল বলে অনুমান করি।</p> </article> <article> <p>অন্যদিকে শিশু অথবা অল্পবয়সীরা চিকেন ফ্রাই খেতে ভালোবাসে, কিন্তু মা-বাবা দুর্মূল্যের বাজারে নিজেরাই যে ফ্রায়েড চিকেন! সুতরাং অর্থনীতির ক্লাসে স্যার পড়ান, চিকেন আর বিফ (এমনকি মাটন) পারস্পরিক বিকল্প দ্রব্য—একটির মূল্য বৃদ্ধি পেলে অন্যটির চাহিদা বৃদ্ধি পায়। কিন্তু সব ক্রেতার মুখে এককথা : এমন বেশি দাম আমরা কল্পনাও করিনি। যাঁরা মুরগির মর্যাদা রক্ষা করতে ব্যর্থ, তাঁরা নিরুপায় হয়ে দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাতেন অর্থাৎ ১২০ টাকা কেজিতে মুরগির কলিজা, মাথা, গলা আর পা দুটি বাড়ি নিয়ে ফিরেছিলেন।</p> <p>বাজারে জিনিসের দাম বাড়লে দুটি প্রভাব প্রত্যক্ষ করা যায়—এক. অপেক্ষাকৃত কম গুণসম্পন্ন দ্রব্য কিনে বাড়ি ফেরা, যেমন—একটু আগে উল্লেখিত মুরগির বদলে মাথা, গলা, পা, কলিজা। দুই. কিংবা বিকল্প দ্রব্যে ঝুঁকে পড়া; যেমন—মুরগির মাংসের জায়গায় বিফ বা মাটন চাহিদা করা। যখন ভোক্তা বিকল্পে ঢুকছেন, অতি চালাক বিফ ও মাটন বিক্রেতা অমনি দাম চড়িয়ে দিচ্ছেন। ধরুন, কেজিপ্রতি ৫০ থেকে ৭০ টাকা। যেমন—যে গরুর মাংস মাত্র এক মাস আগে ছিল ৭০০ টাকা, তা বেড়ে ৭৫০ টাকায় ঠেকেছিল। অনেকটা ‘উপায় নেই গোলাম হোসেন’—বড় বড় একান্নবর্তী পরিবারে আটটা মুরগি লাগলে বর্তমানে যে দাম পড়বে, তা দিয়ে পাঁচ কেজি গরুর মাংস কেনা যায় এবং কিনছেনও ক্রেতা। মাটনের দাম আরো বেশি চড়া। তখনকার কৃষিমন্ত্রী আবার এটাও বলেছিলেন, মাংসের দাম আগামী মাসগুলোতেও কমার নয়। তবে পোলট্রি সমিতির সভাপতি বলছেন, সব আনুষঙ্গিক উৎপাদন ও বিতরণ খরচসমেত খুচরা পর্যায়ে এক কেজি ব্রয়লার চিকেনের দাম ২২০ টাকার অধিক হওয়া উচিত নয়। তিনিই আবার সন্দেহ করছেন যে মুরগির বাজার নিয়ন্ত্রণ করা একটা সিন্ডিকেট এই দাম কারসাজির সঙ্গে সম্পৃক্ত। নিন্দুকরা বলছেন, কাবাব মে হাড্ডি!</p> <p>রমজান সামনে রেখে ব্যবসায়ীদের কারসাজি এবং জিনিসপত্রের দামের ঊর্ধ্বগতি একেবারে নতুন কিছু নয়। যেমন নতুন নয় বাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থার চোখের সামনে এদের কাজকারবার। অন্তত এই পবিত্র মাসে মানুষ যাতে প্রোটিনসমৃদ্ধ খাবার মুখে দিতে পারে তার ব্যবস্থা করা জরুরি। এমনিতে মূল্যস্ফীতির মদদে ওষ্ঠাগত প্রাণ!</p> <p>প্রসঙ্গত, গেল বছরের কিছু ঘটনা এবং রটনা না বললেই নয়। একটা বাংলা দৈনিকে প্রকাশিত খবর কিছুটা আশার আলো দেখায়। আর দেখাবে না কেন, কারণ বাংলাদেশে দুর্ঘটনা না হলে নাকি কারো টনক নড়ে না। সামান্য মুরগি, তার এত লম্ফঝম্প! হৈচৈ আর শোরগোলের পর শুরু হয় তোড়জোড় এবং পরবর্তী সময়ে দাম কমল ২০ টাকা। বলা বাহুল্য, পোলট্রি খাতের শীর্ষস্থানীয় চার প্রতিষ্ঠান খামার পর্যায়ে ব্রয়লার মুরগির দাম কেজিপ্রতি ১৯০ থেকে ১৯৫ টাকায় নির্ধারণের পর খুচরা বাজারে দাম কমতে শুরু করেছে।</p> <p>কিন্তু অভিযোগ উঠেছে, এর মধ্যে নাকি গত ৫২ দিনে মুরগি ও বাচ্চার দাম বাড়িয়ে করপোরেট কম্পানিগুলো অতিরিক্ত হাতিয়ে নিয়েছে ৯৩৬ কোটি টাকা। পত্রিকান্তরে প্রকাশ, এই অভিযোগ তুলেছেন স্বয়ং প্রান্তিক খামারিদের সংগঠন বাংলাদেশ পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি। তিনি বলতে চাইছেন, প্রান্তিক খামারিদের উৎপাদন ব্যয় যেখানে কেজিপ্রতি ১৬০ থেকে ১৬৫ টাকা, সেখানে করপোরেট উৎপাদকের খরচ ১৩০ থেকে ১৪০ টাকা এবং করপোরেট থেকে প্রতিদিন দুই হাজার টন বাজারে এসে থাকলে দিনে তাদের অতিরিক্ত মুনাফা দাঁড়ায় ১২ কোটি টাকা কিংবা ১২–৫২= ৬২৪ কোটি টাকা মোট মুনাফা। এর সঙ্গে আছে এক দিনের মুরগির বাচ্চা বিক্রি বাবদ তাদের মোট মুনাফা ৩১২ কোটি টাকা। সংগঠনটির দাবি, দেশে কম্পানিগুলোর প্রতিদিন, প্রতি বাচ্চায় খরচ ২৮ থেকে ৩০ টাকা, মুরগির বাচ্চা উৎপাদন করা হয় ২০ লাখ। প্রতি বাচ্চার দাম ৬২ থেকে ৬৮ টাকা দেওয়ার কথা থাকলেও বিক্রি হচ্ছে ৮০ থেকে ৮৫ টাকায় এবং একটি মুরগির বাচ্চা থেকে অতিরিক্ত মুনাফা এসেছে ৩০ টাকা।</p> <p>পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতির দাবি, ‘সরকারি তদারকি না থাকায় হরিলুট করেছে করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো। ৫২ দিনে তারা মুরগি ও বাচ্চার দাম বাড়িয়ে অতিরিক্ত ৯৩৬ কোটি টাকা তুলে নিয়েছে।</p> <p>মুক্তবাজার অর্থনীতি মানে এই নয় যে বাজারে সরকারি তদারকি থাকবে না। আজ বাজারের করুণ দশার জন্য দায়ী নিয়মিত বাজার পর্যবেক্ষণ ও তদারকির অভাব এবং তার সঙ্গে অপরাধীদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষেত্রে ব্যর্থতা। অন্তত পবিত্র রোজার মাসে ভোক্তার উদ্বৃত্ত যাতে পকেটমার হয়ে উৎপাদকের ঘরে না যায় সেই কামনা সবার। একমাত্র রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতিই পারে সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে সাধারণ মানুষের পাশে থাকতে। করপোরেট সেক্টরের আধিপত্য হ্রাস করে ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক উৎপাদক তথা ভোক্তা শ্রেণির স্বার্থ রক্ষায় সরকারি কঠোর পাহারায় তদারকি, পর্যবেক্ষণ, উপাত্ত এবং দুষ্টের দমনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা হোক। এই দাবি আমাদেরও। একটি প্রতিযোগিতামূলক বাজারই ক্রেতা ও বিক্রেতা উভয়কে খুশি রাখতে পারে।</p> <p><b>লেখক : </b>অর্থনীতিবিদ, সাবেক উপাচার্য</p> <p>জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়</p> </article>