<article> <p style="text-align: justify;">আমাদের দেশে ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে আলোচনার শেষ নেই। এই ক্ষুদ্রঋণের কারণে বাংলাদেশ যেমন বিশ্বে একটি ভালো পরিচিতি পেয়েছে, তেমনি অনেক ব্যক্তিও পরিচিত হয়েছেন। ক্ষুদ্রঋণের সুনাম-সুখ্যাতি যেমন আছে, তেমনি আছে অনেক আলোচনা-সমালোচনা। এই আলোচনা-সমালোচনার মাত্রা তখনই বেড়ে যায়, যখন ক্ষুদ্রঋণকে কেন্দ্র করে কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটে।</p> </article> <article> <p style="text-align: justify;">কয়েক দিন আগে তেমনি একটি ঘটনা ঘটেছে মুন্সীগঞ্জের সিরাজদিখান উপজেলার একটি গ্রামে, যেখানে এক গৃহবধূ ক্ষুদ্রঋণের দায়ে জর্জরিত হয়ে এবং সেই ঋণ পরিশোধের ক্রমাগত চাপ সহ্য করতে না পেরে তার দুই নাবালক সন্তানকে হত্যা করে নিজে আত্মহত্যা করেন। ক্ষুদ্রঋণের দায়ের পরিমাণ এবং এই ঋণ আদায়ের চাপ কোন পর্যায় গেলে একজন গৃহবধূ দুই সন্তানকে হত্যা করে নিজে আত্মহত্যা করার মতো চরম সিদ্ধান্ত নিতে পারেন? ক্ষুদ্রঋণকে কেন্দ্র করে এমন দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা এবারই প্রথম ঘটেছে তেমন নয়। ক্ষুদ্রঋণের দায় শোধ করতে গিয়ে আত্মহত্যা, ভিটামাটি হারানো, সহায়সম্বলহীন হওয়ার অনেক ঘটনাই প্রতিনিয়ত ঘটে চলেছে।</p> <p style="text-align: justify;">এসব ঘটনার জন্য মূলত ক্ষুদ্রঋণ বিতরণপদ্ধতি এবং ব্যবস্থাপনা দায়ী।</p> </article> <article> <p style="text-align: justify;">আমাদের দেশে ক্ষুদ্রঋণের শুরু এবং বিস্তার ব্র্যাক, গ্রামীণ ব্যাংক ও আশার মতো ভালো ভালো প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে হলেও সেটি আর ভালো প্রতিষ্ঠানের হাতে থাকেনি। দরিদ্র মানুষের অর্থের চাহিদাকে পুঁজি করে গ্রামে-গঞ্জে গড়ে উঠেছে ভুঁইফোড় সব এনজিও বা ক্ষুদ্রঋণ দানকারী সংস্থা, যারা ইচ্ছামাফিক ঋণ বিতরণ করে এবং জোরপূর্বক আদায় করে থাকে। এসব ভুঁইফোড় প্রতিষ্ঠানের পেছনে থাকে স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তি, যাঁদের ভয়ে অসহায় ক্ষুদ্রঋণ গ্রহণকারীকে সব সময় তটস্থ থাকতে হয়। এসব ক্ষুদ্রঋণ দানকারী সংস্থার উদ্দেশ্য হচ্ছে গরিব মানুষের অর্থের চাহিদাকে কাজে লাগিয়ে তাদের ভিটামাটি বা সহায়সম্বল হাতিয়ে নেওয়া।</p> </article> <article> <p style="text-align: justify;">আমাদের দেশে ক্ষুদ্রঋণের ইতিহাস দীর্ঘদিনের হলেও এই খাতকে একটি সুশৃঙ্খল অবস্থার ওপর দাঁড় করানোর চেষ্টা হয়নি। উল্টো এখানে এক চরম বিশৃঙ্খল অবস্থা বিরাজ করছে।</p> <p style="text-align: justify;">ক্ষুদ্রঋণের দায়ে যে অনেকেই সর্বস্বান্ত হচ্ছে তার অন্যতম কারণ হচ্ছে ক্ষুদ্রঋণ অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ বিনিয়োগ হওয়া সত্ত্বেও এই ঋণের অনাদায়ি অংশ তাত্ক্ষণিক অবলোপনের ব্যবস্থা নেই। কেননা এ জন্য প্রয়োজনীয় প্রভিশন না রেখেই অর্জিত সুদ উপার্জন হিসেবে নিয়ে নেওয়া হয়। এ ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট গবেষণা আছে কি না আমার জানা নেই, তবে ক্ষুদ্রঋণ অধিক ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় মোট বিতরণের ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ ঋণ অনাদায়ি হয়ে থাকে।</p> </article> <article> <p style="text-align: justify;">সর্বাধিক ৩০ শতাংশ ক্ষুদ্রঋণ অনাদায়ি থাকবে, সেটি বিবেচনায় নিয়েই এই ক্ষুদ্রঋণ বিতরণের সিদ্ধান্ত নিতে হবে এবং এই অনাদায়ি ঋণ সঠিকভাবে অবলোপনের মাধ্যমে এই খাতের বিরাজমান বিশৃঙ্খল অবস্থার অবসান করতে হবে। বিষয়টি বেশ জটিল বিধায় একটি আনুমানিক উদাহরণের মাধ্যমে পরিষ্কার করা যেতে পারে।              </p> <p style="text-align: justify;">ধরা যাক, একটি ক্ষুদ্রঋণদান প্রতিষ্ঠান গড়ে জনপ্রতি এক লাখ টাকা করে মোট পাঁচ লাখ ক্ষুদ্রঋণগ্রহীতাকে ঋণ বিতরণ করেছে। আলোচ্য ক্ষেত্রে মোট বিতরণ করা ক্ষুদ্রঋণের পরিমাণ দাঁড়াবে পাঁচ হাজার কোটি টাকা। এই বিতরণকৃত পাঁচ হাজার কোটি টাকার ৩০ শতাংশ ঋণ অর্থাত্ প্রায় এক হাজার ৫০০ কোটি টাকা খেলাপি হবে এবং আদায় হবে না। এই পরিমাণ অনাদায়ি ক্ষুদ্রঋণ যে এক বছর পরেই হবে তেমন নয়। তবে তিন থেকে পাঁচ বছরের মধ্যে যে এমনটি হবে, সেটি বিবেচনায় রেখে এই পাঁচ বছরের মধ্যে এই পরিমাণ অর্থ প্রাপ্ত সুদ থেকে সরিয়ে প্রভিশন হিসেবে রেখে দিতে হবে, যাতে অনাদায়ি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অবলোপন বা রাইট-অফ করা যায়। যদি ক্ষুদ্রঋণের ওপর ১৫ শতাংশ হারে সুদ ধার্য হয়, তাহলে পাঁচ বছরে এই পাঁচ হাজার কোটি টাকার ওপর সুদ বাবদ আদায় হবে তিন হাজার ৭৫০ কোটি টাকা। উল্লেখ্য, ক্ষুদ্রঋণে অনাদায়ির হার অপেক্ষাকৃত বেশি হওয়ায় সুদের হার বেশি হয়ে থাকে। এই সুদ থেকে প্রভিশন বাবদ এক হাজার ৫০০ কোটি টাকা সরিয়ে রেখে অবশিষ্ট দুই হাজার ২৫০ কোটি টাকা সংগৃহীত তহবিলের সুদ, পরিচালনা ব্যয় এবং মুনাফা হিসেবে বরাদ্দ করা হবে। যদি পাঁচ হাজার কোটি টাকা তহবিলের সুদের হার হয় ৭ শতাংশ, তাহলে সুদ বাবদ মোট বরাদ্দ হবে এক হাজার ৭৫০ কোটি টাকা। অবশিষ্ট ৫০০ কোটি টাকার মধ্যে ক্ষুদ্রঋণ দানকারী প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা ব্যয় এবং মুনাফার পরিমাণ নির্ধারণ করতে হবে।</p> <p style="text-align: justify;">এই ব্যবস্থা শুধু ক্ষুদ্রঋণের ক্ষেত্রে যে প্রযোজ্য তেমন নয়, অন্য যেকোনো ঋণ ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রেও সমানভাবে প্রযোজ্য, তা সে ক্রেডিট কার্ড, বৃহত্ অঙ্কের বাণিজ্যিক বা করপোরেট ঋণ হোক। এই কাজটি করতে হবে সম্পূর্ণ প্রযুক্তিনির্ভর ক্ষুদ্রঋণ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে, যেখানে শর্তগুলো এমনভাবে আগে থেকেই ঠিক করা থাকবে, যাতে প্রাপ্ত সুদের নির্দিষ্ট অংশ স্বয়ংক্রিয়ভাবেই প্রভিশন হিসেবে চলে যায় এবং এখানে কোনো রকম ম্যানিপুলেশনের সুযোগ না থাকে। আমাদের দেশে সবচেয়ে বেশি খেলাপি ঋণ থাকা সত্ত্বেও প্রদত্ত ঋণের একটি অংশ যে অনিবার্যভাবেই অনাদায়ি হতে পারে সেই বিবেচনা রাখা হয় না। ফলে নামমাত্র বিধিবদ্ধ প্রভিশন বাদ দিয়ে ঋণের ওপর অর্জিত সমুদয় সুদ উপার্জন হিসেবে নিয়ে নেওয়া হয়। আর এখানেই ঘটে সব বিপত্তি। এই বিপত্তির কারণেই আজ ক্ষুদ্রঋণের দায়ে অনেক মানুষ সর্বস্বান্ত হচ্ছে এবং দেশের ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ মারাত্মক সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে।</p> <p style="text-align: justify;">এখন প্রশ্ন উঠতে পারে যে ক্ষুদ্রঋণ দানকারী প্রতিষ্ঠান এত অল্প সুদে তহবিল সংগ্রহ করবে কিভাবে। এটি একটি কঠিন প্রশ্ন। কেননা আমাদের দেশের আর্থিক খাত বা মুদ্রাবাজার সেভাবে গড়ে ওঠেনি যে খুব সহজেই স্বল্প সুদের হারে তহবিল সংগ্রহ করতে পারবে। তবে বাস্তবতা হচ্ছে যে অল্প সুদের হারে তহবিল সংগ্রহের ব্যবস্থা না থাকলে ক্ষুদ্রঋণের মতো ঝুঁকিপূর্ণ বিনিয়োগে যাওয়ার কোনো রকম সুযোগ নেই। এ জন্য দেশে প্রয়োজন কার্যকর বন্ড মার্কেট। যেসব বৃহত্ প্রতিষ্ঠান এই ক্ষুদ্রঋণ বিতরণের কাজে ব্যাপক হারে নিয়োজিত; যেমন—ব্র্যাক, গ্রামীণ ব্যাংক, আশা, প্রশিকা, তারা নিজেরাই বন্ড মার্কেট থেকে স্বল্প সুদে তহবিল সংগ্রহ করতে পারবে। আর যেসব প্রতিষ্ঠানের সেই সুযোগ বা সক্ষমতা নেই, তাদের জন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় স্বল্প সুদে বন্ড বিক্রি করে তহবিল সংগ্রহ করে নামমাত্র কমিশনে তাদের সরবরাহ করতে পারে। এখানেও প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক যে এই ক্ষুদ্রঋণের ক্ষেত্রেও কেন সরকারকে জড়িত হতে হবে। অবশ্যই হতে হবে। কেননা ক্ষুদ্রঋণ শুধু গরিব মানুষের ঋণ নয়। এই ঋণের সঙ্গে জড়িত আছে বেকারত্ব লাঘবের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যা অর্থনৈতিক উন্নতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বাংলাদেশের মতো জনসংখ্যা অধ্যুষিত দেশে শুধু চাকরি দেওয়ার মতো কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে বেকারত্ব কমানো সম্ভব নয়। এ জন্য প্রয়োজন ব্যাপক আত্মকর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা। এটি তখনই সম্ভব হবে, যখন ক্ষুদ্রঋণের সুযোগ থাকবে। দেশে প্রায় দুই থেকে তিন কোটি নাগরিককে ক্ষুদ্রঋণ প্রদানের মাধ্যমে আত্মকর্মসংস্থানে নিয়োজিত করতে হবে। ক্ষুদ্রঋণ যেহেতু সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ বিনিয়োগ, তাই এই খাতে স্বল্প সুদে তহবিল সরবরাহে সরকারের ভূমিকা রাখতেই হবে। উন্নত বিশ্বে আমাদের দেশের মতো ক্ষুদ্রঋণ না থাকলেও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ঋণ আছে, যা আত্মকর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধির স্বার্থে সরকারি উদ্দীপনা এবং প্রণোদনার মাধ্যমে ব্যাপকভাবে উত্সাহিত করা হয়।</p> <p style="text-align: justify;">সবার আগে দেশে ক্ষুদ্রঋণ ব্যবস্থাপনায় ব্যাপক সংস্কার করে এখানে শৃঙ্খলা আনার উদ্যোগ নিতে হবে এবং এ জন্য যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে—১. ক্ষুদ্রঋণের সংজ্ঞা পরিবর্তন করে একে আত্মকর্মসংস্থান ঋণ করতে হবে। ক্ষুদ্রঋণের নামে যেকোনো প্রয়োজনে ঋণদানের সুযোগ বন্ধ করতে হবে। এখন যেভাবে ছেলেমেয়ের বিয়ে, লেখাপড়া, চিকিত্সা খরচ, ঘরবাড়ি তৈরি, এমনকি বেড়ানোর জন্য ক্ষুদ্রঋণ দেওয়া হয়, তা অনতিবিলম্বে বন্ধ করতে হবে। ২. একটি শক্তিশালী আত্মকর্মসংস্থান ঋণ নিয়ন্ত্রক সংস্থা প্রতিষ্ঠা করতে হবে এবং তাদের সব ক্ষুদ্রঋণ দানকারী প্রতিষ্ঠান নিবন্ধন এবং তদারকির দায়িত্ব দিতে হবে। ৩. ক্ষুদ্রঋণ বিতরণে নিয়োজিত সব সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানকে নিবন্ধন করে তাদের বিতরণকৃত ঋণের বিস্তারিত বিবরণ দিয়ে সব কিছু নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে অবহিত করতে হবে। ৪. ক্ষুদ্রঋণগ্রহীতাদের এই ঋণ ব্যবহার, পরিশোধ, বিশেষ করে ঋণ পরিশোধের পাশাপাশি একটি নিজস্ব তহবিল গড়ে তোলার ব্যাপারে পরামর্শ এবং উত্সাহ দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। ৫. ক্ষুদ্রঋণ বা আত্মকর্মসংস্থান ঋণ আইন প্রণয়ন করতে হবে। ৬. এই জাতীয় ঋণ ব্যবস্থাপনার জন্য একটি কম্প্রিহেনসিভ সফটওয়্যার তৈরি করতে হবে। সব শেষে ক্ষুদ্রঋণ পরিশোধে যারা ব্যর্থ হবে বা যাদের ক্ষুদ্রঋণ অবলোপন করা হবে, তাদের পরবর্তী তিন থেকে পাঁচ বছর ঋণ গ্রহণের সুযোগ থেকে প্রযুক্তির মাধ্যমে দূরে রাখার ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। এর বাইরে শুধু ক্ষুদ্রঋণ নয়, সার্বিকভাবে দেশের ব্যাংকিং, মুদ্রাবাজার এবং অর্থনীতির বৃহত্তর স্বার্থে দেশে একটি কার্যকর সেকেন্ডারি বন্ড মার্কেট গড়ে তোলা প্রয়োজন। </p> <p style="text-align: justify;">দেশের অর্থনীতিকে এগিয়ে নেওয়ার যে লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে অর্থাত্ ২০৩১ সাল নাগাদ মধ্যম আয়ের দেশ, ২০৩৫ সালের মধ্যে ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতি এবং ২০৪১ সাল নাগাদ দেশকে উন্নত বিশ্বের কাতারে পৌঁছে দেওয়া, তা অর্জন করতে হলে দেশ থেকে বেকারত্ব দূর করতে হবে। একমাত্র আত্মকর্মসংস্থানের মাধ্যমে এই বেকারত্ব দূর করা সম্ভব, অন্য কোনোভাবে নয়। আর এটি করতে হলে ক্ষুদ্রঋণের গুরুত্ব বাড়বে ছাড়া কমবে না। এ কারণেই দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির লক্ষ্য বিবেচনায় রেখে এই খাতকে নিয়ন্ত্রণের মধ্য্যে এনে এখানে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করা অপরিহার্য।</p> <p style="text-align: justify;">লেখক : সার্টিফায়েড অ্যান্টি মানি লন্ডারিং স্পেশালিস্ট ও ব্যাংকার, টরন্টো, কানাডা</p> <p style="text-align: justify;"><a href="mailto:nironjankumar_roy@yahoo.com">nironjankumar_roy@yahoo.com</a></p> </article>