<article> <p style="text-align: justify;">নির্বাচন আসে, নির্বাচন যায়। ভারতের মতো এত বড় একটা দেশে প্রায় সারা বছর ধরেই কোনো না কোনো নির্বাচন হয়। আর সব নির্বাচনের মধ্যে ২০২৪-এর লোকসভা ভোট হলো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভোট। ভোট তো চলছে, কিন্তু প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে ভারতের পররাষ্ট্রনীতি, পারস্পরিক সম্পর্ক যখন ধাক্কা খায়, নির্বাচনের জন্য অভ্যন্তরীণ স্বার্থে যখন শীর্ষ শাসক নেতৃত্বকে চিৎকার করে আবহ তৈরি করতে হয়, তখন অনেক সময় তার খেসারত দিতে হয় পররাষ্ট্রনীতিতে।</p> </article> <article> <p style="text-align: justify;">এমনটাই এই মুহূর্তে হচ্ছে ভারতের সঙ্গে শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ, এমনকি বাংলাদেশের মতো বন্ধু রাষ্ট্রের ক্ষেত্রেও। আর চীনের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের টানাপড়েন তো কিছুতেই বিলুপ্ত হচ্ছে না। বরং যুক্তরাষ্ট্র, না চীন—কার ওপর বেশি ভরসা করবে, তা নিয়ে ভারতের দোদুল্যমানতা বাড়ছে বৈ কমছে না।</p> <p style="text-align: justify;">প্রথমে চীনের প্রসঙ্গে আসা যাক।</p> </article> <article> <p style="text-align: justify;">সম্প্রতি চীন সীমান্তবর্তী বহু এলাকার নতুন নামকরণ শুরু করেছে। চীনের সার্বভৌম ক্ষেত্রে নামকরণ করলে কারো কিছু বলার নেই। কিন্তু যখন নামকরণ করতে করতে চীন অরুণাচল প্রদেশের মধ্যে ঢুকে পড়ে, তখনই শুরু হয়ে যায় বিতর্ক। কেননা ভারত কিছুতেই অরুণাচল প্রদেশকে চীনের এখতিয়ার বলে মানতে রাজি নয়।</p> </article> <article> <p style="text-align: justify;">আর চীনও কিন্তু অরুণাচল প্রদেশের ক্ষেত্রে বিভিন্ন নতুন নামকরণ করে বোঝাতে চাইছে যে এখনো চীন মনে করে, অরুণাচল প্রদেশের অধিকার তাদেরই।</p> <p style="text-align: justify;">সীমান্তবর্তী রাজ্যের প্রায় ৩০টি স্থানে চীন নতুন নামকরণ করেছে। অরুণাচল প্রদেশে জাং নাম, যেটা তিব্বতের দক্ষিণ প্রান্তের সঙ্গে যুক্ত। আর এই এলাকা নিয়ে চলছে চূড়ান্ত বিতর্ক। ভারত যদি ‘ওয়ান চায়না’ বা ‘এক চীন’ নীতিকে মেনে নেয়, তাহলে তিব্বতের ওপর চীনের অধিকারকেও মানতে হয়।</p> </article> <article> <p style="text-align: justify;">আর সে ক্ষেত্রে যদি তিব্বতের কোনো এলাকায় চীন নামকরণ করে, আর ভারত মনে করে যে সেই এলাকা কি ভারতের মধ্যে পড়ছে, তাহলে কিন্তু বিতর্ক আরো বেড়ে যায়। প্রশ্নটা তিব্বতকে নিয়ে নয়। প্রশ্নটি হচ্ছে অরুণাচল প্রদেশ ভারতের অধীনে বলে ভারত সরকার মনে করে এবং সেখানে কোনোভাবেই আপস করতে ভারত রাজি নয়। চীনের প্রসঙ্গটি যখন এলো, তার হাত ধরে এলো এই প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে ভূখণ্ড দিয়ে দেওয়ার আপসের নীতি। সম্প্রতি তামিলনাড়ুতে গিয়ে সোচ্চার হয়েছেন নরেন্দ্র মোদি।</p> <p style="text-align: justify;">নেহরু শ্রীলঙ্কাকে একটি ভূখণ্ড দিয়ে দিয়েছিলেন নীতিগতভাবে এবং বলেছিলেন, এত ছোট একটি দ্বীপ, সেটি নিয়ে ভারতের অধিকার ফলানোর কোনো মানে হয় না। তবে নেহরু কাজটি করে উঠতে পারেননি নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েও। কিন্তু ইন্দিরা গান্ধী ওই দ্বীপটি দিয়ে দিয়েছিলেন শ্রীলঙ্কাকে। আর এই দেওয়া নিয়ে তামিলনাড়ুতে শুধু ডিএমকে নয়, সব দ্রাবিড়িয়ান দল একমত যে এটি কংগ্রেস অন্যায় করেছিল। আজ যখন ডিএমকে আর কংগ্রেস একজোট হয়ে গেছে, স্ট্যালিন আর রাহুল গান্ধী খুব বন্ধু হয়ে গেছেন, যখন ‘ইন্ডিয়া’ জোটে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও কেজরিওয়াল পুরোপুরি না থাকলেও ডিএমকের স্ট্যালিন সবচেয়ে বেশি আছেন, তখন কংগ্রেসের বিরুদ্ধে শ্রীলঙ্কাকে জমি দেওয়ার পুরনো ইস্যু তুলে নরেন্দ্র মোদি একটি মোক্ষম চাল চেলেছেন।</p> <p style="text-align: justify;">১৯৭৪ সালে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এই দ্বীপের দাবি ছেড়ে দিয়ে তা শ্রীলঙ্কাকে দিয়ে দিয়েছিলেন বলে এক জনসভায় অভিযোগ করেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। ওদিকে পাল্টা যুক্তি দিয়ে বিরোধী দল কংগ্রেস বলেছে, ভোট আসছে, তাই ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) কাচ্চাতিভু নিয়ে সরব হয়েছে।</p> <p style="text-align: justify;">কাচ্চাতিভুর অবস্থান শ্রীলঙ্কার জাফনা নগরীর দক্ষিণ-পশ্চিমে। এই দ্বীপের আয়তন প্রায় ১.৯ বর্গকিলোমিটার। দ্বীপটিতে একটি গির্জা আছে। ভারত ও শ্রীলঙ্কা—দুই দেশের পুণ্যার্থীরা সেখানে বার্ষিক ধর্মীয় উৎসব পালন করে থাকে। ১৯২১ সাল থেকে ভারত ও শ্রীলঙ্কা (তখন নাম ছিল সিলন) দুই দেশের জেলেরাই দ্বীপটিতে মাছ ধরার অধিকার দাবি করে আসছিল। পরে ১৯৭৪ সালে ভারত দ্বীপটির ওপর দাবি ছেড়ে দিলে বিরোধ নিষ্পত্তি হয়। দুই বছর পর একটি চুক্তির মধ্য দিয়ে দুই দেশের জেলেদের মাছ ধরা বন্ধ হয়। এতে ক্ষোভ বাড়ে ভারতীয় মৎস্যজীবীদের।</p> <p style="text-align: justify;">গত সপ্তাহে মোদি টাইমস অব ইন্ডিয়ার একটি নিবন্ধ এক্সে (সাবেক টুইটার) শেয়ার করে লেখেন, ‘চোখ খুলে দেওয়া আর চমকে ওঠার মতো বিষয়। নতুন যে তথ্য উঠে এসেছে, তাতে ফাঁস হয়ে গেছে যে কতটা উদাসীনভাবে কংগ্রেস কাচ্চাতিভু দিয়ে দিয়েছিল।’</p> <p style="text-align: justify;">কাচ্চাতিভু নিয়ে বিতর্ক দীর্ঘদিন ধরেই চলে আসছে। সম্প্রতি তামিলনাড়ুর বিজেপিপ্রধান কে আন্নামালাই তথ্যের অধিকার বা আরটিআই আইনের অধীনে কাচ্চাতিভু সম্পর্কে সব তথ্য প্রকাশ্যে আনার আবেদন করেছিলেন। সেই তথ্যের ভিত্তিতেই লেখা হয় ওই নিবন্ধ। আর তাতেই উঠে এসেছে দ্বীপটি নিয়ে সেই সময়কার বিস্তারিত খুঁটিনাটি। ফলে নতুন করে শুরু হয়েছে বিতর্ক।</p> <p style="text-align: justify;">সমস্যার এখানেই শেষ নয়। এরপর শ্রীলঙ্কাকে জমি দেওয়ার বিষয়টির কাউন্টার করার জন্য ভারতেরই ভেতর কংগ্রেস দলের পক্ষ থেকে কেউ কেউ ছিটমহল হস্তান্তর নরেন্দ্র মোদি কেন করলেন—সেসব নিয়ে প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছেন। এতে অহেতুক জটিলতা বেড়েছে। এত দিন পর হঠাৎ ছিটমহল নিয়ে প্রশ্ন উঠছে এবং সেটিও লোকসভা নির্বাচনের সময়। আর যখন নাগরিকত্ব বিল নিয়ে অনুপ্রবেশকারীদের বিরুদ্ধে বিজেপি চিৎকার করছে, সেই সময় ছিটমহল হস্তান্তর নিয়ে বাংলাদেশ সরকার সম্পর্কে কেন নরম মনোভাব নেওয়া হয়েছে—কংগ্রেস এই প্রশ্ন তোলায় পরিস্থিতি আরো জটিল হয়ে উঠছে।</p> <p style="text-align: justify;">বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের ছিটমহল বিনিময় সম্পন্ন হয়েছে ২০১৫ সালের ৩১ জুলাই আর পয়লা আগস্টের মধ্যবর্তী রাতে। এর প্রায় ৯ বছর পর লোকসভা নির্বাচনের আগে ভারতের জাতীয় কংগ্রেস সেই প্রসঙ্গ তুলে এনেছে।</p> <p style="text-align: justify;">প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির একটি ভাষণের জবাব দিতে গিয়ে কংগ্রেস তাঁরই পুরনো একটি বিবৃতি তুলে ধরে বলেছে, ২০১৫ সালে বাস্তবায়িত ‘স্থলসীমান্ত চুক্তি শুধু ভূমি পুনর্বিন্যাস ছিল না, সেটি ছিল হূদয় মিলেমিশে যাওয়ার মতো ঘটনা’।</p> <p style="text-align: justify;">কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়গে আসলে নরেন্দ্র মোদির তোলা একটি গুরুতর অভিযোগের জবাব দিতে গিয়ে ভারত-বাংলাদেশের স্থলসীমান্ত চুক্তির প্রসঙ্গ টেনে এনেছেন।</p> <p style="text-align: justify;">সব মিলিয়ে ভোটের জন্য ভারতের সঙ্গে প্রতিবেশী রাষ্ট্র, বিশেষত বাংলাদেশের সম্পর্কে কোনো কালো ছায়া পড়ুক, সেটি আর যা-ই হোক, শুভবুদ্ধিসম্পন্ন ভারতীয় নাগরিকরাও চান না। তাই বলব, সাধু সাবধান! ভোট বড় বালাই।</p> <p style="text-align: justify;"><strong>লেখক : </strong>নয়াদিল্লিতে কালের কণ্ঠ’র বিশেষ প্রতিনিধি</p> </article>