<article> <p style="text-align: justify;">বাংলাদেশ বেশির ভাগ স্বাস্থ্য সম্পর্কিত সূচকে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে, বিশেষ করে মা ও শিশু স্বাস্থ্যে। যেমন—মাতৃমৃত্যুর হার প্রতি লাখে এখন ১৩৬ জন, যেটি ২০১৫ সালেও ছিল ১৮১ জন। ২০১৫ সালে যেখানে প্রতি এক হাজার জনে ৩৬ জন পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশু মারা যেত, এখন সেটি ৩৩ জন। এসডিজির স্বাস্থ্য সম্পর্কিত প্রায় সব সূচকে বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি পরিলক্ষিত হয়েছে।</p> </article> <article> <p style="text-align: justify;">তবে গত কয়েক দশকে আমাদের জনগণের রোগের ধরনের যে পরিবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছে (সংক্রামক রোগের হার কমে অসংক্রামক রোগের হার বৃদ্ধি পাওয়া), তাতে স্বাস্থ্য খাতে বিশেষ নজর দেওয়ার সময় এসেছে।</p> <p style="text-align: justify;">অপ্রতুল স্বাস্থ্যসেবা সুবিধা, অপর্যাপ্ত ডাক্তার-নার্স, হাসপাতালে শয্যাসংকট, নিম্নমানের চিকিৎসা, দক্ষ ল্যাব টেকনিশিয়ানের অভাবসহ নানা কারণে দেশের স্বাস্থ্য খাত বিভিন্ন সময় সমালোচিত হয়েছে। করোনা মহামারিতে স্বাস্থ্য খাতের যে নাজুক অবস্থা আমরা দেখেছি, সেই অবস্থা থেকে স্বাস্থ্য খাত আবার ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। সম্পদের সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও আমাদের স্বাস্থ্যব্যবস্থা যেভাবে দেশের জনগণের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করছে, সেটি সত্যি প্রশংসনীয়।</p> </article> <article> <p style="text-align: justify;"><img alt="https://cdn.kalerkantho.com/public/news_images/share/photo/shares/1.Print/2024/05.May/05-05-2024/2/kalerkantho-ed-1a.jpg" height="239" src="https://cdn.kalerkantho.com/public/news_images/share/photo/shares/1.Print/2024/05.May/05-05-2024/2/kalerkantho-ed-2a.jpg" width="400" />বছর বছর স্বাস্থ্য খাতে বাজেট বৃদ্ধি পাচ্ছে। যেমনটি দেখেছি গত অর্থবছরে স্বাস্থ্য খাতে বাজেট বরাদ্দ ছিল ৩৮ হাজার ৫২ কোটি টাকা, যেটি ২০২২-২৩ অর্থবছরে  ছিল ৩৬ হাজার ৮৬৩ কোটি টাকা। টাকার অঙ্কে স্বাস্থ্য খাতের বাজেট বৃদ্ধি পেলেও জাতীয় বাজেটের শতাংশে এটি বাড়েনি, বরং কমেছে। করোনার সময় স্বাস্থ্য খাতের দুর্বলতা ব্যাপক আকারে পরিলক্ষিত হওয়ার পরও কয়েক বছর ধরে এ খাতে বাজেট বরাদ্দ তুলনামূলক কমে আসছে।</p> </article> <article> <p style="text-align: justify;">গত অর্থবছরে বাজেটের ৫ শতাংশ স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে, যেটি ২০২২-২৩ অর্থবছরে ছিল ৫.৪ শতাংশ; যদিও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মাপকাঠি অনুযায়ী জাতীয় বাজেটের ১৫ শতাংশ স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ দেওয়া প্রয়োজন। এটি জিডিপির হিসাবে ১ শতাংশেরও কম, যা দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে কম। একই সঙ্গে আমরা দেখেছি পরিচালন বা রাজস্ব ব্যয়ের বরাদ্দ বেড়েছে, যদিও উন্নয়ন ব্যয়ের বরাদ্দ কমেছে। স্বাস্থ্য বাজেটের আকার বাড়লেও স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণে জনগণের ব্যক্তিগত ব্যয় বেড়েই চলেছে। বাংলাদেশ ন্যাশনাল হেলথ অ্যাকাউন্ট ১৯৯৭-২০২০-এর তথ্য অনুযায়ী ২০২০ সালে জনগণের ব্যক্তিগত ব্যয় ছিল ৬৮.৫ শতাংশ, যেটি ২০১২ সালে ছিল ৬২ শতাংশ।</p> </article> <article> <p style="text-align: justify;">বাংলাদেশে স্বাস্থ্যসেবা সংক্রান্ত ব্যয় বহন করতে গিয়ে প্রতিবছর প্রায় ৫০ লাখ লোক দরিদ্র হয়। ২০১৫ সাল থেকে পাঁচ বছরের ব্যবধানে ২০২০ সালে স্বাস্থ্যসেবায় সরকারের গড় মাথাপিছু ব্যয় ৬০ শতাংশ বেড়ে হয়েছে ৫৪ ডলার, যদিও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানদণ্ড অনুযায়ী এটি হওয়া উচিত ৮৮ ডলার। এসব পরিসংখ্যান থেকে সহজেই অনুমেয় যে আমাদের দেশের স্বাস্থ্য খাতের বরাদ্দ অপ্রতুল।</p> <p style="text-align: justify;">প্রতিবারই বাজেটের আগে-পরে আলোচনা হয় বাজেট বাড়ানো হলেও সেটির সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করা যাবে কি না। সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের স্বাস্থ্য খাতের বাজেট সম্পর্কিত একটি গবেষণায় উঠে এসেছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে গত এক দশকে গড় বাজেট ব্যবহারের হার মাত্র ৮৭ শতাংশ। এর মানে মোট বাজেট বরাদ্দের একটি বড় অংশ অব্যবহৃত থেকে যাচ্ছে। বাজেট অব্যবহৃত থাকার একটি বড় কারণ হচ্ছে বিভিন্ন লেভেলের স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে প্রয়োজনীয়তার ভিত্তিতে (নিড-বেজড) বাজেট বরাদ্দ না হওয়া। বর্তমানে লাইন আইটেম অনুযায়ী বাজেট বরাদ্দ হয়। যেই আইটেমে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে, এর বাইরে গিয়ে খরচ করার সুযোগ নেই। অপর্যাপ্ত অনুমোদিত পদ, বিপুলসংখ্যক শূন্যপদের কারণেও বাজেট অব্যবহৃত থেকে যাচ্ছে। যেমন ধরুন, একটি হাসপাতাল ১০০ শয্যা থেকে ১৫০ শয্যায় উন্নীত করা হলো। হাসপাতালের শয্যাসংখ্যা বাড়লেও জনবল নিয়োগে একটি জটিল প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। ১৫০ শয্যার জনবল নিয়োগ হতে হতে হয়তো বা হাসপাতালটি ২০০ বা ২৫০ শয্যায় উন্নীত হয়ে যায়। আবার একটি সমস্যা হলো, যেই পদ অনুমোদিত আছে, সেগুলোও শূন্য থেকে যাচ্ছে বছরের পর বছর। বাজেট বরাদ্দ হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু সেই পদে জনবল না থাকায় সেই বাজেট অব্যবহৃত থেকে যাচ্ছে। বাজেট অব্যবহৃত থাকার আরো কিছু কারণের মধ্যে আছে জটিল ও সময়সাপেক্ষ প্রকিউরমেন্ট ও টেন্ডারিং প্রক্রিয়া, অর্থবছরের শেষ তিন মাসের বাজেট ছাড়ে বিলম্ব, আর্থিক ব্যবস্থাপনা বিষয়ে স্বাস্থ্য খাতের ম্যানেজারদের প্রশিক্ষণের অভাব ইত্যাদি।</p> <p style="text-align: justify;">যদি সরকার স্বাস্থ্য খাতে আরো বাজেট বরাদ্দ দেয়, কিন্তু সেই বাজেটের সঠিকভাবে ব্যবহার নিশ্চিত করা না যায়, তাহলে অতিরিক্ত বাজেট বরাদ্দ খুব বেশি উপকারে আসবে না। বাজেটের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিতকরণে প্রয়োজনীয়তার ভিত্তিতে বাজেট বরাদ্দ দিতে হবে এবং আর্থিক ব্যবস্থাপনা বিষয়ে স্বাস্থ্য খাতের ম্যানেজারদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। এ ছাড়া শূন্যপদে নিয়োগ প্রদান এবং প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে নতুন পদ সৃষ্টি; অসংক্রামক রোগের ব্যাপকতা বেড়ে যাওয়ায় প্রতিরোধমূলক সেবা নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে বিভিন্ন লেভেলের স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রের অর্গানোগ্রামের সংশোধন করতে হবে। জটিল ও সময়সাপেক্ষ প্রকিউরমেন্ট ও টেন্ডারিং প্রক্রিয়ার আধুনিকীকরণের মাধ্যমে ত্বরান্বিত করতে হবে। এসব কিছু নিশ্চিত করা গেলে স্বাস্থ্য খাতে বাজেট বরাদ্দ বৃদ্ধি করতে হবে, যেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানদণ্ড নিশ্চিত হয়।</p> <p style="text-align: justify;">তাই আমাদের প্রত্যাশা, স্বাস্থ্য খাতে শুধু বেশি বরাদ্দই নয়, একটি সুন্দর ও সুস্থ স্বাস্থ্য ব্যবস্থা তৈরি করতে প্রয়োজনীয় রূপরেখাও যেন আগামী বাজেটে থাকে, যার মাধ্যমে বরাদ্দকৃত বাজেটের সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত হবে।</p> <p style="text-align: justify;"><strong>লেখক :</strong> প্রভাষক, স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়</p> </article>