<p style="text-align: justify;">গুপ্তযুগের পরাক্রমশালী রাজা চন্দ্রগুপ্তের মহামন্ত্রী চাণক্য বলেছেন, মানুষের জিহ্বার ডগায় মধু কিংবা বিষ যা-ই রাখো না কেন, সে চেখে দেখবেই। তিনি মূলত সরকারি কর্মচারীদের উদ্দেশ করে এ কথা বলেছিলেন। সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে চাকরি করে, সরকারের সম্পদ অর্থ নাড়াচাড়া করে অথচ চেখে দেখবে না, সেটা সম্ভব না। আর এখন যে খবর বের হচ্ছে, সেটা ভয়ানক এক রাহুগ্রাসের মতো।</p> <p style="text-align: justify;">সরকারি সম্পত্তি দেখভালের দায়িত্বে নিয়োজিতদের একটা অংশ চাখাচাখির মধ্যে নেই, পুরোটাই খেয়ে অন্যদিকে হাত বাড়াচ্ছে! কিছুদিন আগে খবর বের হলো, পোস্ট অফিসে জমাকৃত জনগণের টাকা পোস্টমাস্টাররা ভাগযোগ করে নিয়েছেন! ক্ষমতাবানরা ক্ষমতা ও বন্দুকের জোরে দেশটাকে ভাগাড়ে পরিণত করার চেষ্টা করছে। এমন কর্মকর্তা নাকি এ দেশে কয়েক ডজন আছে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী শিক্ষার্থীরা আর কেউ শিক্ষক হতে চায় না। সবাই বিসিএস ক্যাডার হতে চায়।</p> <p style="text-align: justify;">একটু নেতিবাচকভাবে বললে, বড় একটা অংশ প্রভাবশালী আমলা হতে চায়। কারণ তারা জানে, চাখাচাখি না, গিলে খেলেও কিছু হবে না। এটা এখন গবেষণা করে বের হওয়ার সময় হয়েছে, সমাজ-মানসিকতার এই পচন কবে থেকে, কেন শুরু হয়েছে।<br /> বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার সঙ্গে কলেজের শিক্ষার বড় ধরনের একটা পার্থক্য আছে।</p> <p style="text-align: justify;">নতুন জ্ঞান সৃজন ও বিতরণ যেখানে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মূল উদ্দেশ্য, সেখানে কলেজগুলোতে জ্ঞান সৃজনের চেয়ে বিতরণ করাই প্রধান কাজ। দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নতুন জ্ঞান সৃজনের ক্ষেত্রে তেমন কোনো সাফল্য দেখাতে পারছে না, অর্থাৎ তার উদ্দেশ্যের জায়গাটাতে অসফল। আর এ জন্যই এখন কলেজের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পার্থক্য নির্ণয় করা কঠিন হয়ে পড়ছে। প্রশ্ন করা যেতে পারে, এই ব্যর্থতার কারণ কী? এক কথায় এর উত্তর দেওয়া কঠিন। দেশবিভাগ-পরবর্তী সময়ে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের  একটি অংশ সরকারের স্তাবক শ্রেণিতে পরিণত হয়েছিল।</p> <p style="text-align: justify;">সমস্যাটা তখনো প্রকট আকার ধারণ করেনি। দেশ স্বাধীনের পর বিশেষ করে জিয়াউর রহমান, এরশাদ অর্থাৎ সামরিক ছায়াবেষ্টিত সরকার দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে প্রতিপক্ষ মনে করে এগুলো নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার চেষ্টা শুরু করল। দূরদর্শী নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অনেক আগেই ভবিষ্যৎ জানতেন, ফলে চারটি বিশ্ববিদ্যালয়কে ১৯৭৩ সালে আইন ও অধ্যাদেশ জারি করে স্বায়ত্তশাসন দিয়ে যান। কিন্তু তিনি হয়তো জানতেন না, একটা সময় পরে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এই স্বায়ত্তশাসন যথাযথভাবে ধরে না রেখে, জ্ঞান-বিজ্ঞানের উত্তরণ না ঘটিয়ে সরকারের লেজুড়বৃত্তিতে নিয়োজিত হবে। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের একটা অংশ হালুয়া-রুটির লোভে আত্মসম্মান, মর্যাদা বিসর্জন দিয়ে সরকারি হয়ে ওঠার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হলো। নিজেরা নিজেদের উপাচার্য নির্বাচিত করার ক্ষমতা রাখলেও সরকারের দিকে তাকিয়ে থাকত কাকে উপাচার্য হওয়ার বর প্রদান করা হয়। সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে রাতারাতি হল দখলের মতো উপাচার্যের চেয়ার দখলের প্রতিযোগিতায় নিয়োজিত হলো শিক্ষকদের একাংশ। বিগত প্রায় ৫০ বছর ধরে এই চর্চায় এখন বাংলাদেশের ৭৩-এর অধ্যাদেশে পরিচালিত চারটি বিশ্ববিদ্যালয়সহ সবই হয়ে উঠেছে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, সবগুলো পরিচালিত হয় সরকারের ইচ্ছা ও মর্জিমাফিক।</p> <p style="text-align: justify;">এখন ভাইস চ্যান্সেলররা সরকারের ইচ্ছার দাস। আর যেহেতু বিভিন্ন সরকারের প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক দুর্বলতার কারণে আমলাদের ওপর বেশি নির্ভর করতে হয়েছে, সেহেতু দিনে দিনে আমলারাও হয়ে উঠেছে দোর্দণ্ড প্রতাপশালী। তারাও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে তাদের অধীন প্রতিষ্ঠান বানানোর চেষ্টা ছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নানা দুর্বলতা নিয়ে সরকারের কানে নানা মিষ্টি মধুর গীত গায়। যেমন—আমাদের নবীন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা উচ্চশিক্ষার জন্য দেশের বাইরে পড়াশোনা করতে যেতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেটের অনুমোদনই একসময় তাদের জন্য চূড়ান্ত ছিল এবং অনেকে সেই অনুমোদন নিয়ে দেশের বাইরে থেকে পিএইচডি করে দেশে ফেরত এসেছে। এর মধ্যে এক উপাচার্য এসে ঘোষণা দিলেন, সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ছাড়পত্র ছাড়া কোনো শিক্ষক বিদেশে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে যেতে পারবেন না। তিনি মন্ত্রণালয়ের একটা আদেশ এনে হাজির করলেন। আদেশ প্রতিষ্ঠা হয়ে গেল। এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশ যেতে হলে দিনের পর দিন মন্ত্রণালয়ের কেরানির পেছনে ঘুরতে হয়।</p> <p style="text-align: justify;">আমলাদের দীর্ঘদিনের চাওয়াও হয়তো এ রকমটাই ছিল, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা তাদের পেছনে ঘুরুক। এটা প্রতিষ্ঠা হয়ে যাওয়ার পরে তাদের নজর পড়ল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার দিকে। তারা মনে করছে, যেহেতু পলিসি মেকিংয়ের বিভিন্ন পর্যায়ে সরকারের সামনে-পেছনে থেকে আমলারাই ভূমিকা রাখে, কাজেই তাদের কথার বাইরে এ দেশে কিছু হবে না। তারা নিজেদের দেশের মালিকের ভূমিকায় ভাবা শুরু করেছে। আর শিক্ষকদের প্রভাবশালী অংশ সরকারের তাঁবেদারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হলো। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে জ্ঞান-বিজ্ঞান, গবেষণার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল রাজনীতি। বায়ান্ন, ঊনসত্তর, একাত্তর, নব্বই সালের বড় বড় রাজনৈতিক আন্দোলনে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল।</p> <p style="text-align: justify;">দেশের সংকটকালে এই ভূমিকা যথার্থ ও গৌরবের ছিল কোনো সন্দেহ নেই, কিন্তু এসব করতে গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল লক্ষ্য থেকে সরে গিয়ে রাজনীতি মুখ্য বিষয় হিসেবে পরিগণিত হয়েছে। ফলে যেকোনো সরকারের আজ্ঞাবহ হওয়া বা তাঁবেদারি করা শিক্ষকগোষ্ঠী সরকার যেমন পছন্দ করে তেমনি শিক্ষকদের একটা অংশ হালুয়া-রুটির ভাগাভাগিতে একাডেমিক কাজের চেয়েও সরকারের তাঁবেদারি করাটাকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করছে। যেহেতু এখন আর বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পক্ষ থেকে সরকারের ওপর কোনো হুমকি নেই, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও প্রশাসন তাই পুরোপুরি তাদের আজ্ঞাবহ। কাজেই তাদের বেতন-ভাতা ও সুযোগ-সুবিধা আমলারা ইচ্ছামতো তাদের মতো করে ডিজাইন করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ওপর চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। শিক্ষকদের যুক্তি, পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত, শ্রীলঙ্কা এমনকি পাকিস্তানেও শিক্ষকদের বেতন-ভাতা ও অন্যান্য সুযোগ সুবিধা অনেক বেশি। একই সঙ্গে এটাও সত্যি যে সেখানকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষা, গবেষণাও অনেক এগিয়ে।</p> <p style="text-align: justify;">২০১৫ সালের ঘোষিত পে-স্কেল সৃজনের কারিগররা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের বেতন-ভাতা অবনমনের চেষ্টা করেন। শিক্ষকরা তখনো আন্দোলনে নামেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তখন শিক্ষকদের বেশ জোরে ধমক দিয়েছিলেন। ধমক খেয়েও শিক্ষকরা এক নম্বর গ্রেডে যাওয়া পর্যন্ত তাঁদের দাবি আদায় করতে পেরেছিলেন। আবার এখন প্রত্যয় স্কিম নামে সর্বজনীন পেনশনের ঘোষণা দিয়ে সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সংযুক্ত করা হয়েছে। মজার বিষয় হলো, এই স্কিমটাকে সর্বজনীন বলা হলেও আমলারা নিজেরা সেটাতে অন্তর্ভুক্ত হননি। অর্থাৎ, আপনি আচরি ধর্ম পরকে শেখাও নীতিতে তাঁরা বিশ্বাসী নন। অন্তর্ভুক্ত করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের। কারণ তাঁরা খুব ভালোভাবেই জেনে গেছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এখন তল্পিবাহক সম্প্রদায়, তাদের বড় অংশ সরকারি দলের সমর্থনের রাজনীতি করেন। ফলে সরকারের বিরুদ্ধে তাঁরা মাঠে নামবেন না। কিন্তু আমলাদের ধারণাকে ভ্রান্ত প্রমাণিত করে সরকার সমর্থিত শিক্ষক সম্প্রদায় এখন মাঠে! তাদের ক্ষোভ যতটা না সরকারের বিরুদ্ধে, তার চেয়ে বেশি আমলাদের বিরুদ্ধে। রাজনৈতিক চেতনায় উদ্দীপ্ত শিক্ষকদের কথা, সরকারের যেকোনো ক্রাইসিসে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা এগিয়ে আসেন, কিন্তু সুযোগ-সুবিধা নেওয়ার বেলায় আমলারা! আর আমলারা মনে করে, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা সুবিধা পাওয়ার যোগ্য নয়। বিষণ্ন সত্য হলো, উভয় সম্প্রদায়ের কারোই চিন্তায় দেশ নেই! আছে স্বার্থ, আছে ব্যক্তিচিন্তা। এই দৃষ্টিকোণ থেকে ৩০ লাখ শহীদের রক্তে রাঙানো বাংলাদেশ এখন শুধুই মুখের বুলি! আমলাদের কাছে দেশ হচ্ছে গিলে খাওয়ার বস্তু।</p> <p style="text-align: justify;"><em>লেখক : অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ ও ডিন, কলা অনুষদ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর</em></p> <p style="text-align: justify;"><em>Email: shafiqashrafibs@gmail.com</em></p> <p> </p>