বিশ্ব ধরিত্রী দিবস আজ। প্রকৃতি, পরিবেশ ও প্রতিবেশ রক্ষার মাধ্যমে ধরিত্রীকে টিকিয়ে রাখার লক্ষ্যে এবং এ সম্পর্কে জনসচেতনতা বাড়াতে প্রতিবছর ২২ এপ্রিল বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দিবসটি পালিত হয়।
এ বছরের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে — ‘আমাদের শক্তি, আমাদের পৃথিবী’। পরিবেশ রক্ষা, জলবায়ু পরিবর্তন রোধ এবং প্রাকৃতিক ভারসাম্য বজায় রাখার অঙ্গীকারে বিশ্বের নানা প্রান্তে পালিত হচ্ছে এ বিশেষ দিনটি।
বিশ্ব এখন জলবায়ু পরিবর্তন, জীববৈচিত্র্যের ক্ষয়, বন উজাড়, প্লাস্টিক দূষণ ও অতিরিক্ত কার্বন নির্গমনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছে। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে প্লাস্টিক দূষণে বছরে প্রায় ১ লাখ সামুদ্রিক প্রাণীর মৃত্যু হচ্ছে।
বড় প্লাস্টিক চোখে দেখা যায়। এ কারণে পরিবেশ ও স্বাস্থ্যগত বিপদ কেমন হতে পারে– সে ধারণা কম-বেশি সবারই জানা।
তবে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র প্লাস্টিক কণা প্রাণ-প্রকৃতিতে নীরবে বিষ ঢাললেও এর ভয়াবহতা থেকে যাচ্ছে আড়ালেই। বিভিন্ন গবেষণায় প্রমাণ মিলেছে– লবণ, আটা, চিনি, মাছ, মাটি, বাতাস, নদী, সমুদ্র এমনকি খাবার পানিতেও রয়েছে মাইক্রোপ্লাস্টিকের অস্তিত্ব।
বাংলাদেশও এর বাইরে নয়। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, ঘন ঘন প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং গ্রীষ্মকালীন তাপমাত্রার অতিরিক্ত বৃদ্ধি আমাদের ভবিষ্যতের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বিপজ্জনক মাইক্রোপ্লাস্টিক ঠেকানোর উদ্যোগ হিসেবে বিশ্বের প্রথম দেশ বাংলাদেশ ২০০২ সালে পলিথিন ব্যাগ নিষিদ্ধ করেছিল। উপকূলীয় অঞ্চলে একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিকেও লাগাম টানা হয়েছে। পলিথিন আর প্লাস্টিকের বিরুদ্ধে সাম্প্রতিক সময়ে দেশজুড়ে চলছে অভিযান। তবু থামছে না এর ব্যবহার। সরকার এ ব্যাপারে নানামুখী উদ্যোগ নিলেও মানুষকে এখনও সচেতন করা যায়নি।
ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ডলাইফ ফান্ডের তথ্য অনুসারে, প্লাস্টিক দূষণের কারণে প্রতিবছর ১ লাখ সামুদ্রিক প্রাণী মারা যাচ্ছে। ২০৫০ সালে সাগরে যত মাছ থাকবে, তার চেয়ে বেশি থাকবে প্লাস্টিক। প্রতিদিন প্রায় ৭৩ হাজার টন প্লাস্টিক বর্জ্য বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে সমুদ্রে গিয়ে পড়ছে। পরিমাণের দিক থেকে এটি বিশ্বে পঞ্চম।
ময়মনসিংহের পুরোনো ব্রহ্মপুত্র নদের পানি, মাটি এবং মাছের পেটে মাইক্রোপ্লাস্টিকের উপস্থিতি পেয়েছে আন্তঃরাষ্ট্রীয় এক গবেষক দল। গত ১৯ এপ্রিল প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, ওই নদের প্রতি বর্গকিলোমিটার পানিতে ২৫ লক্ষাধিক ভাসমান কণা এবং তলদেশে প্রতি কেজি মাটিতে সাড়ে ৪০০ কণা মাইক্রোপ্লাস্টিকের অস্তিত্ব মিলেছে। মাছের পেটেও পাওয়া গেছে মাত্রাতিরিক্ত ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র প্লাস্টিক।
গত ২৫ মার্চ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় এবং বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের অর্থায়নে হবিগঞ্জ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় রিসার্চ সিস্টেম পরিচালিত গবেষণায় সেখানকার সুতাং নদের পানিতে মাইক্রোপ্লাস্টিকের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া গেছে। এমনকি হাওরের ধানেও মাইক্রোপ্লাস্টিক থাকার কথা বলছেন গবেষকরা।
গত বছরের এপ্রিলে যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (যবিপ্রবি) গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের বিভাগীয় শহরে প্রতি গ্রাম ধুলায় ৫২টি, ঢাকায় প্রতি গ্রাম ধুলায় ১০৬টি মাইক্রোপ্লাস্টিক উড়ছে।
গবেষণায় অনুমান করা হয়েছে, গঙ্গা নদী এবং এর উপনদীগুলোর মাধ্যমে প্রতিদিন ১০০ থেকে ৩০০ কোটি মাইক্রোপ্লাস্টিকের কণা বঙ্গোপসাগরে যাচ্ছে। মাইক্রোপ্লাস্টিকের উপাদানের মধ্যে সবচেয়ে বেশি পাওয়া গেছে রেয়ন।
২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের ৭৩ শতাংশ মাছে রয়েছে প্লাস্টিকের ক্ষুদ্র কণা। বাজারে পাওয়া যায় এমন দেশি মাছের ওপর গবেষণা করে জানা যায়, ১৫ প্রজাতির মাছে মাইক্রোপ্লাস্টিকের উপস্থিতি রয়েছে।
ঢাকার ১৩টি এলাকা, গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জের বাতাসে জরিপ করে অতি ক্ষুদ্র বিষাক্ত প্লাস্টিক কণা পাওয়ার তথ্য উঠে আসে ২০২৩ ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত এক গবেষণায়।
সাম্প্রতিক বিভিন্ন গবেষণায় পশুর ও বুড়িগঙ্গা নদীর পানি, মাটি ও মাছে মাইক্রোপ্লাস্টিকের উপস্থিতি নিশ্চিত করা হয়েছে, যা জনস্বাস্থ্যের ওপর গুরুতর হুমকির ইঙ্গিত দেয়। এ ছাড়া এ বছর গবেষকরা বাণিজ্যিক খাদ্য আটার মধ্যেও মাইক্রোপ্লাস্টিকের অস্তিত্বের প্রমাণ পান, যা মানুষের খাদ্যচক্রে এ ক্ষতিকর উপাদান প্রবেশের একটি উদাহরণ।
এ বিষয়ে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় এবং পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান গণমাধ্যমকে বলেন, সরকার চেষ্টা করছে, একবার ব্যবহার্য প্লাস্টিকের ক্রমবর্ধমান ব্যবহার থেকে মানুষকে সরিয়ে আনতে। পলিথিন শপিং ব্যাগ বন্ধে কাজ করছি। এখন পর্যন্ত সুপারশপে সফল হলেও অন্য জায়গায় আরও কাজ করতে হবে। কারণ পলিথিনের নেতিবাচক দিকগুলো মানুষ জানে না। সেক্ষেত্রে সচেতনতা সৃষ্টি এবং আইন প্রয়োগের মাধ্যমে পলিথিন ব্যাগসহ একবার ব্যবহার্য প্লাস্টিক বন্ধ করার চেষ্টা করব।
আরো পড়ুন
কাপাসিয়ায় ওষুধ কাণ্ডে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি
বিশ্ব ধরিত্রী দিবস প্রথম উদযাপিত হয় ১৯৭০ সালের ২২ এপ্রিল। যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটর গে লর্ড নেলসন এই দিবসের প্রবর্তন করেন পরিবেশ দূষণ ও প্রাকৃতিক সম্পদের অব্যবস্থাপনার বিরুদ্ধে জনমত গঠনের লক্ষ্যে। সেই থেকে প্রতিবছর এ দিনটিকে ঘিরে বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন সচেতনতামূলক কর্মসূচি পালন করা হয়। বর্তমানে ১৯৩টিরও বেশি দেশে পালিত হয় ধরিত্রী দিবস।