দীর্ঘদিন ধরে ওষুধ শিল্পে প্রভাব বিস্তার করে আসা কম্পানি প্রতিনিধিদের আধিপত্যের অবসান ঘটিয়ে ওষুধসংক্রান্ত বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কমিটি নতুনভাবে গঠন করেছে সরকার। এই প্রথমবারের মতো ওষুধের দাম নির্ধারণ, নতুন ওষুধের নিবন্ধন, কার্যকারিতা ও নিরাপত্তা মূল্যায়ন এবং নিবন্ধন বাতিলের মতো স্পর্শকাতর সিদ্ধান্তে আর থাকছে না কোনো কম্পানির প্রতিনিধি। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এই পরিবর্তনের মাধ্যমে জনস্বার্থে একটি বড় পদক্ষেপ নিয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
সম্প্রতি সরকার এক পরিপত্র জারি করে বেশ কিছু নতুন কমিটি গঠন করেছে।
এর মধ্যে অন্যতম হলো—‘অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের তালিকা প্রণয়ন ও প্রাপ্যতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে করণীয় বিষয়ে সুপারিশ প্রদানে টাস্কফোর্স’, ‘ওষুধ নিয়ন্ত্রণ কমিটি’ এবং ‘ওষুধ নিয়ন্ত্রণ কমিটির টেকনিকেল সাব-কমিটি’।
প্রতিটি কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে বিশেষভাবে খেয়াল রাখা হয়েছে যাতে স্বার্থের সংঘাত না ঘটে। এজন্য নতুন নিয়ম অনুযায়ী, কোনো সদস্যকে কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করার আগে তাকে লিখিতভাবে ঘোষণা দিতে হবে যে, সংশ্লিষ্ট কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তার আর্থিক বা অন্য কোনো স্বার্থের সম্পর্ক নেই।
আরো পড়ুন
দীর্ঘদিনের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ জুলাইয়ের গণ-অভ্যুত্থান : সারজিস
এই প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ বলেন, ‘এতদিন আমরা দেখে এসেছি, ওষুধ কম্পানির প্রতিনিধিরা কমিটিতে থেকে তাদের নিজেদের স্বার্থ রক্ষা করতেন।
সাধারণ জনগণের স্বার্থ সেখানে প্রায়ই উপেক্ষিত হতো। সরকার যদি এখন সত্যিকারের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করে কম্পানির প্রভাবমুক্ত কমিটি গঠন করে থাকে, তাহলে তা নিঃসন্দেহে একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। তবে অবশ্যই এই কমিটিগুলোতে যথাযথ অভিজ্ঞতা ও যোগ্যতাসম্পন্ন সদস্য নিয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। না হলে শুধু নামমাত্র পরিবর্তনে কোনো লাভ হবে না।’
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সূত্রে জানা গেছে, অতীতে ওষুধ কমিটিগুলোর মধ্যে স্বজনপ্রীতি ও গোষ্ঠীগত প্রভাব ছিল ভয়াবহ মাত্রায়। ২০০২ সালের পর থেকে ওষুধ কম্পানির স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা একে একে কমিটিতে প্রবেশ করতে থাকে। ২০০৯ সালের পর সেই প্রভাব চরমে পৌঁছে। তখন থেকে ওষুধের দাম নির্ধারণ থেকে শুরু করে কোন কম্পানি কতটি ওষুধের নিবন্ধন পাবে—সেসব সিদ্ধান্ত নিতেন কম্পানির প্রতিনিধিরাই। শুরুতে তারা প্রতিনিধি হিসেবে থাকলেও, পরে সমালোচনার মুখে তারা নাম পাল্টে ‘পর্যবেক্ষক’ পরিচয়ে কমিটিতে থাকতেন।
অথচ কার্যত তারাই নিয়ন্ত্রণ করতেন পুরো প্রক্রিয়া।
এ অবস্থার পরিবর্তন আনতেই সরকার এবার পুরো কাঠামো নতুনভাবে সাজিয়েছে। ‘অত্যাবশ্যকীয় ওষুধ তালিকা টাস্কফোর্স’-এর সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পেয়েছেন বাংলাদেশ মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএমইউ) উপাচার্য অধ্যাপক ডা. মো. শাহিনুল আলম। এই কমিটিতে রয়েছেন দেশের খ্যাতনামা চিকিৎসক, অধ্যাপক ও ফার্মাকোলজিস্টরা। সদস্য সচিব করা হয়েছে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের যুগ্মসচিব মোজাম্মেল হোসেন খানকে। এই ১৬ সদস্যের দলে কোনো ব্যবসায়ী বা শিল্প মালিক নেই।
আরো পড়ুন
গাজায় পানি সংকট নিরসনে পাইপলাইন স্থাপন করছে সংযুক্ত আরব আমিরাত
ওষুধ নিয়ন্ত্রণ কমিটির সভাপতির দায়িত্ব পালন করবেন স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব এবং সদস্য সচিব হবেন ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক। এই ১৩ সদস্যের কমিটিতেও নেই কোনো কম্পানি প্রতিনিধি। এখানে বাংলাদেশ ফার্মাসিউটিক্যাল সোসাইটি, ফার্মেসি কাউন্সিল, বিএমডিসি, বিএমএ ও বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধিরা রয়েছেন।
তৃতীয় কমিটি ‘ওষুধ নিয়ন্ত্রণ কমিটির টেকনিকেল সাব-কমিটি’র সভাপতি করা হয়েছে ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে। ২২ সদস্যের এই কমিটিতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর, আইইডিসিআর, বিএমইউ, ঢাবি, বিভিন্ন চিকিৎসা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও চিকিৎসক সংগঠনের প্রতিনিধিরা রয়েছেন। এখানেও বাদ রাখা হয়েছে ব্যবসায়ী বা কম্পানির কোনো প্রতিনিধি।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই উদ্যোগ ওষুধ খাতে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও জনস্বার্থ রক্ষায় নতুন দিগন্ত খুলবে। এতে কম্পানির পছন্দমতো সিদ্ধান্ত নয়, বরং জনগণের জন্য প্রয়োজনীয় ওষুধের প্রাপ্যতা, গুণমান ও ন্যায্য দামের বিষয়টি নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ উদ্যোগকে টিকিয়ে রাখতে হলে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত, যোগ্য ও নিরপেক্ষ কমিটি অব্যাহত রাখা জরুরি। নয়তো সব অর্জন আবারও পুরনো ছকে ফিরবে।