‘বিশ্ব বই দিবস’র মূল উদ্দেশ্য হলো—বই পড়া, বই প্রকাশ, বইয়ের ব্যবহার বৃদ্ধি, বইয়ের কপিরাইট সংরক্ষণ করা, ইত্যাদি বিষয়ে ব্যাপক আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে জনসচেতনতা সৃষ্টি করা। ‘বিশ্ব বই দিবস ২০২৫' উপলক্ষে ইউনেস্কোর মহাপরিচালিক ড. উড্রে আজুল্যে বিশ্ববাসীর উদ্দেশ্যে বাণী প্রদান করেছেন।
১৯৯৫ সালে প্রথমবার ‘বিশ্ব বই দিবস’ পালিত হলেও ২০০১ সালে, বই বিক্রেতা, প্রকাশক এবং বিশ্বের বিভিন্ন দেশের গ্রন্থাগার ও গ্রন্থাগার সমিতির অনুরোধে ‘বই দিবস’ -এর সঙ্গে ‘গ্রস্থস্বত্ব’ শব্দটি জুড়ে দেয় ইউনেস্কো। সেইসঙ্গে ঠিক হয় প্রতিবছর ‘বই রাজধানী’ হিসাবে বেছে নেওয়া হবে বিশ্বের একটি করে শহরকে।
ঘটনাচক্রে আজকের তারিখেই প্রয়াত হয়েছিলেন ভারতের সুখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক সত্যজিৎ রায়ও। এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কো স্পেনের এক প্রস্তাব অনুযায়ী ২৩ এপ্রিলকে’ বিশ্ব বই দিবস’ হিসেবে বেছে নেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।
দেশের সকল স্তরের মানুষকে বিশেষ করে ছাত্র, শিক্ষক ও গবেষকদের অধিকতর গ্রন্থাগারমুখী করে তোলা, জাতিগঠনে গ্রন্থাগারের অবদান ও প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা করা, দেশে বিদ্যমান গ্রন্থাগারগুলোতে জ্ঞানবিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার উপর সর্বশেষ প্রকাশিত বই ও সাময়িকীর তথ্যাদি সংগ্রহ, পাঠাভ্যাস বৃদ্ধির কলাকৌশল সম্পর্কে আলোচনা ও মতবিনিময়, মননশীল সমাজ গঠনে স্থানীয় পর্যায়ে গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠা, পাঠসামগ্রী সংগ্রহ, সংরক্ষণ, বিতরণ এবং পাঠক তৈরির মাধ্যমে একটি জ্ঞানভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এবং গ্রন্থাগারকর্মী ও পেশাজীবী, লেখক, প্রকাশক, পাঠক বিশেষ করে বাংলাদেশ গ্রন্থাগার সমিতির দাবীর পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৭ সালের ৩০ অক্টোবর তারিখে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিপরিষদের সভায় ৫ ফেব্রুয়ারিকে ‘জাতীয় গ্রন্থাগার দিবস’ ঘোষনা করা হয়েছিল।
আমরা মনে করি, একই উদ্দেশ্য (ইউনেস্কো কতৃক নিরূপিত) সামনে রেখে বহির্বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সরকার ‘বিশ্ব বই দিবস’ পালনের উদ্যোগ নিতে পারেন। আমরা আরো মনে করি, ‘জাতীয় গ্রন্থাগার দিবস’ এবং ‘বিশ্ব বই দিবস’ যথাযথভাবে পালনের মাধ্যমে জাতিকে বইমুখী করার বিকল্প নেই। জ্ঞানভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ডিজিটাল ডিভাইস ব্যাহারের পাশাপাশি মুদ্রিত বই পাঠেও ছাত্র শিক্ষক গবেষকসহ সকল শ্রেণির নাগরিককে উদ্বুদ্ধ করেত হবে। ‘বিশ্ব বই দিবস’ পালনের গুরুত্ব ও তাৎপর্য এখানেই।
সংশ্লিষ্ট সবাই বিশ্বাস করেন যে, ‘বিশ্ব বই দিবস’ পালনের মাধ্যমে সকল স্তরের জনগণ, ছাত্র-শিক্ষক, গবেষক সবাই বই পড়ার গুরুত্ব অনুধাবন এবং নিজেদের পাঠাভ্যাস বৃদ্ধি করে স্ব স্ব ক্ষেত্রে উন্নততর ফলাফল অর্জন করবেন এবং সার্বিকভাবে জীবন মানের উন্নতি ঘটাবেন। বলা দরকার যে, ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে চতুর্থ শিল্পবিপ্লব বাস্তবায়নের এজেন্ডা মাথায় রেখে আমরা যদি অগ্রসর হতে চাই তাহলে গ্রন্থাগার স্থাপন এবং পাঠাভ্যাস বৃদ্ধির আর কোনো বিকল্প নেই।
এ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে আজ ‘একত্রিংশতিতম ‘বিশ্ব বই দিবসে’ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের সকল পর্যায়ের গ্রন্থাগার ও শিক্ষার মান পর্যালোচনার সময় এসেছে। আমরা জানি, যে জাতির গ্রন্থাগার যত সম্মৃদ্ধ, সে জাতি তত উন্নত। আমরা এও জানি যে, বর্তমান যুগে কোনো জাতির উন্নয়নের ব্যারোমিটার বা পরিমাপক যন্ত্র হচ্ছে গ্রন্থাগার ও তথ্য ব্যবহারের পরিমান অর্থাৎ যে জাতি যত বেশি পরিমানে গ্রন্থাগার ও তথ্য ব্যবহার করে সে জাতি তত বেশি উন্নত।
প্রযুক্তির কারণেই হোক অথবা অন্য যে কোনো কারণেই হোক আমাদের সমাজে বই পড়ার অভ্যাসটা কমেছে দারুণভাবে। এখন সবার চোখ বই-এর স্থলে থাকে মোবাইলের স্ক্রিনে। গবেষণায় দেখা গিয়েছে, তরুণরা গড়ে দৈনিক ৪-৫ ঘণ্টা সময় এ সকল ডিজিটাল ডিভাইসে ব্যয় করে। অতিরিক্ত মোবাইল আসক্তির কারণে সাইবার নিপীড়ন, হতাশা, উদ্বেগ এবং আত্মহত্যার ঘটনা বাড়ছে। ‘হ্যাভ স্মার্টফোনস ডেস্ট্রয়েড আ জেনারেশন’ শিরোনামের ওই প্রতিবেদনে বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত ব্যবহার করে ‘আইজেন’ প্রজন্মের খুঁটিনাটি তুলে ধরেছেন যুক্তরাষ্ট্রের সান ডিয়েগো বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিদ্যার অধ্যাপক জিন টুয়েঙ্গে।
স্ক্রিন আসক্তির বাস্তব যে কুফল তা আমাদের ‘আইজেন’দের লেখাপড়ার বর্তমান অবস্থা ও পরীক্ষার ফলাফল দেখলেই পরিষ্কার বোঝা যায়। চলতি বছরসহ গত কয়েক বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার ফলাফল পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করা ছেলেমেয়েদের মধ্যে শতকরা ৯০% অকৃতকার্য হচ্ছে। এই ফলাফল পরিষ্কার বলে দিচ্ছে, আমাদের ছেলেমেয়েদের বই এর সাথে কোনো সম্পর্ক নেই। সুতরাং এই অবস্থার আশু পরিবর্তন প্রয়োজন। আর এর একমাত্র পথ হচ্ছে – তরূন-তরূণীদের সামনে মোবাইল স্ক্রিনের বিকল্প মুদ্রিত পাঠসামগ্রী উপস্থাপন।
গবেষণা থেকে দেখা গেছে, বই পড়ার অভ্যাসের ফলে মস্তিষ্কের ওপর ইতিবাচক প্রভাব দেখা দেয়। মানসিকভাবে সবসময় উদ্দীপ্ত থাকার ফলে ডিমেনশিয়া ও আলঝেইমারকে প্রতিরোধ করা সম্ভব হয়। কারণ, মস্তিষ্ক সব সময় অ্যাকটিভ থাকার ফলে, তার কর্মক্ষমতা হারানোর সম্ভবনা কমে যায়। এ ছাড়া বই পড়া মানসিক চাপ কমায়, স্মৃতিশক্তি প্রখর করে, বৃদ্ধি পায় কল্পনাশক্তি, যৌক্তিক চিন্তায় দক্ষ হওয়া যায়, মনোযোগ বৃদ্ধি করে, রাতে দ্রুত ঘুমাতে সাহায্য করে, কোন বিষয়ে অনুপ্রাণিত হওয়া যায়, অন্যের প্রতি সহমর্মিতা সৃষ্টি হয়, বৃদ্ধি পায় সৃজনশীলতা। মহাগ্রন্থ আল কোরআনের প্রথম বাণীই হচ্ছে, পড়’।
বাংলাদেশকে ‘বিশ্ব জ্ঞান সূচকে ঈপ্সিত স্থানে নিয়ে যেতে হলে (২০২৪ সালে বিশ্ব জ্ঞান সূচকে বাংলাদেশ’র স্থান বিশ্বের ১৪১টি দেশের মধ্যে ১১২তম) শিক্ষার সর্বস্তরে পড়াশুনার মান আমাদের বাড়াতেই হবে সেই সাথে প্রযুক্তির ব্যবহার। পড়াশুনার মান তখনই বৃদ্ধি পাবে যখন ছাত্রছাত্রীরা নির্দিষ্ট পাঠ্য পুস্তকের পাশাপাশি গ্রন্থাগারে গিয়ে বিষয়সংশ্লিষ্ট পুস্তকের অতিরিক্ত রেফারেন্স বই পড়ে নিজেদের জ্ঞানের পরিধি বৃদ্ধির প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখবে। সেই সাথে অনলাইনে শিক্ষক প্রদত্ত ওয়েবসাইট (একাধিক হতে পারে) ঘাটাঘাটি করে নিজের জ্ঞানস্তরকে সমৃদ্ধ করবে।
অপ্রিয় হলেও আমাদের মাথায় রাখতে হবে যে আমাদের ছেলেমেয়েরা মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক স্তরে উচ্চ জিপিএ অর্জন করার পরও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের ভর্তি পরীক্ষায় একই পাঠক্রমের উপর করা প্রশ্নপত্রের উত্তরে খারাপ ফলাফল করছেন। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে – আমাদের ছাত্রছাত্রীরা গ্রন্থাগারে পড়াশুনা, রেফেরেন্স বই পড়া, ওয়েবসাইট সার্চ করে পড়াশুনা তো দূরের কথা – নিজেদের পাঠ্যপুস্তকও সঠিকভাবে পড়ে আয়ত্ত করেন নাই। তারা গাইড বা নোট পড়ে পাশ করেছেন।
এ অবস্থায় ‘বিশ্ব বই দিবসে’ আমাদের পরামর্শ হচ্ছে – ছাত্রছাত্রীদের পাঠ্যপুস্তক ও গ্রন্থাগারভিত্তিক পড়াশুনায় মনোনিবেশ করানো – শিক্ষক ও ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে পড়াশুনার সম্পর্ক দৃঢ়তর করা এবং স্মার্টফোন কে অর্থবহ কাজে লাগানো। প্রতিটি স্কুল কলেজ ও মাদ্রাসায় যথানিয়মে গ্রন্থাগার পরিচালনা এবং এর যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করা। এ ছাড়া সরকার নির্দেশিত লক্ষ্যভিত্তিক শিক্ষা (ওবিই) বাস্তবায়নের জন্যে ছাত্রছাত্রীদের গ্রন্থাগারের প্রতি উৎসাহিত করার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণকে অগ্রাধিকার দিতে হবে।
লেখকঃ উপদেষ্টা, গ্রন্থাগার ও তথ্যবিজ্ঞান বিভাগ ও প্রক্টর, এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ, আশুলিয়া, সাভার, ঢাকা, প্রাক্তন পরিচালক, বাংলাদেশ লোক-প্রশাসন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র (বিপিএটিসি), সাভার।
amatin@aub.ac.bd