<p>কোয়ান্টাম বলবিদ্যায় অনিশ্চয়তাতত্ত্ব শূন্য থেকে শক্তির উদ্ভবের কথা বলে, এটা কি আদৌ সম্ভব, নাকি শুধুই তত্ত্ব আর তথ্যের চটকদার বিজ্ঞাপন। বিজ্ঞানের শুধু তথ্য থাকলে চলে না, যতক্ষণ না সেটা প্রমাণ হচ্ছে ততক্ষণ হাইপোথিসিসের বাইরে এসে সত্যিকারের বিজ্ঞান হয়ে ওঠার সম্ভাবনা শূন্য। </p> <p>কোয়ান্টাম ফ্ল্যাকচুয়েশন বা শূন্য স্থানের শক্তির প্রমাণ কোথায়? প্রমাণ আছে, কৃষ্ণগহ্বরে, ঘটনা দিগন্তের চারপাশে। ঠিক ঘটনা দিগন্তরেখা যেখানে শুরু, সেখানেও প্রতিমুহূর্তে ঘটে চলেছে ভার্চুয়াল কণাদের ভাঙাগড়ার খেলা। বিখ্যাত তাত্ত্বিক পদার্থবিদ, কৃষ্ণগহ্বর বা ব্ল্যাকহোলের হকিং রেডিয়েশনের তত্ত্ব দিয়ে সারা পৃথিবীতে যেন ঝড় তুলেছিলেন, সেই হুইলচেয়ারের বিজ্ঞানী হকিং মেনেছেন শূন্যস্থানের শক্তির কথা। বলেছেন, ঘটনা দিগন্তরেখার কিনারা ঘেঁষে যখন ভার্চুয়াল একজোড়া কণার জন্ম হয়, সেগুলো কোয়ান্টাম ফ্ল্যাকচুয়েশনের রীতি মেনে আবার পরস্পর সংঘর্ষ ঘটার আগেই যেকোনো একটা কণা পড়ে যেতে পারে ঘটনা দিগন্তের ভেতরে। তখন অন্য কণারাও হয়তো পড়ে যেতে পারে ঘটনা দিগন্তের ভেতরে, হারিয়ে যেতে পারে ব্ল্যাকহোলের গভীরে। কিন্তু হকিং বলছেন, সব সময় এমনটা না-ও ঘটতে পারে, একটা কণা হয়তো পড়ে যেতে পারে ব্ল্যাকহোলের ভেতরে। শূন্যস্থান থেকে যখন দুটি কণা তৈরি হয়, তখন দুটি কণা আর শক্তি থাকে দুই রকম। কোনোটার গতিশক্তি যদি ধনাত্মক  হয়, অন্যটার শক্তি হবে ঋণাত্মক। অর্থাৎ এই দুই কণা আবার যখন পরস্পরের সংঘর্ষে লিপ্ত হচ্ছে তখন ধনাত্মক-ঋণাত্মক শক্তি পরস্পরের সাথে যুক্ত হয়ে আবার শক্তিশূন্য হয়ে যাবে। একটা কণা যদি ব্ল্যাকহোলের ভেতরে পড়ে যায় তাহলে সংঘর্ষের আশঙ্কা আর থাকছে না। বাইরে যেকোনো একটা বেরিয়ে আসছে, তার শক্তি ধনাত্মক অথবা ঋণাত্মক হতে পারে। সেই কণাটা ধনাত্মক অথবা ঋণাত্মক শক্তি নিয়ে ছুটে কৃষ্ণগহ্বরের বাইরে বেরিয়ে আসে। একছুটে বেরিয়ে আসার সময় তাদের শক্তি এতটাই বেশি থাকে, সেই কণাগুলো বিকিরণ নির্গত করে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। তখন কৃষ্ণগহ্বরের চারপাশে ওনাদের একটা বলয় দেখা যায়। সেই উজ্জ্বল কণাগুলোকে হকিং বিকিরণ নামে নামকরণ করা হয়েছে। কিন্তু হকিংয়ের এই তত্ত্ব আজও প্রমাণ করা সম্ভব হয়নি। তাই নোবেলবঞ্চিত হয়েই পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে হয়েছে এ যুগের শ্রেষ্ঠ পদার্থবিজ্ঞানীকে। সম্প্রতি কৃষ্ণগহ্বরের প্রথম ছবি তুলতে সক্ষম হয়েছেন বিজ্ঞানীরা। কিন্তু সেই ছবি থেকেও মেলেনি অকাট্য প্রমাণ। অকাট্য না হোক, তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানীরা একবার যখন কৃষ্ণগহ্বরের দেখা পেয়েছেন, সেটা তাদের আশা জাগাচ্ছে, খুব শিগগিরই হয়তো মিলবে হকিং রেডিয়েশনের প্রত্যক্ষ প্রমাণ। তখন এটাই হয়ে উঠবে কোয়ান্টাম ফ্ল্যাকচুয়েশনের সবচেয়ে বড় প্রমাণ। কিন্তু প্রমাণহীন একটা তত্ত্ব দিয়ে হকিং রেডিয়েশনের কথা বলবেন, এমনটা বাতুলতা।</p> <p>শূন্যস্থানে শক্তির অনেকগুলো প্রমাণ মিলেছে এর মধ্যে ল্যাম্ব শিফট যেমন আছে, আছে টপ কোয়ার্কের ভরের সাহায্যে প্রমাণ। কিন্তু সবাইকে ছাপিয়ে কোয়ান্টাম শূন্যতা প্রমাণে সবচেয়ে সফল তত্ত্বের তকমা জুটেছে কাসিমির ইফেক্ট বা কাসিমির প্রভাব পরীক্ষণের পিঠে। ১৯৪৮ সালে ডাচ পদার্থবিদ হেনড্রিক কাসিমির এই তত্ত্বের জন্ম দেন। প্রথমে এটা ছিল একটি থট এক্সপেরিমেন্ট বা মানস পরীক্ষা। পরে গবেষণাগারে এর বাস্তব প্রমাণ পাওয়া গেছে।</p> <p>কী সেই কাসিমির ইফেক্ট? </p> <p>ধরা যাক, খুব পাতলা দুটো ধাতব পাত। এই দুটোকে কাছাকাছি রাখুন। খুব কাছে। কয়েক মিলিমিটার দূরত্ব এখন এদের মধ্যে। ধাতব পাত দুটিকে তারের সাহায্যে মাটির সাথে সংযোগ দিন, অর্থাৎ যেটাকে আমরা আজ আর্থ কানেকশন বলি। ধাতব পাতের ভেতর যদি কোনো চার্জ বা আধান থাকে, আর্থ কানেকশন তার দিয়ে সেটা চলে যাবে। পুরোপুরি বিদ্যুৎ চুম্বক নিরপেক্ষ হয়ে উঠবে পাত দুটি।</p> <p>অর্থাৎ এর মধ্যে আর কোনো বিদ্যুৎচৌম্বকীয় বল থাকার কথা নয়। সুতরাং মহাকর্ষীয় বল ছাড়া আর কোনো আকর্ষণ থাকার কথা নয় পাত দুটির মধ্যে। কিন্তু পদ্ধতি খুব ছোট, এদের মধ্যে মহাকর্ষীয় আকর্ষণ এত দুর্বল যে ধর্তব্যের মধ্যে পড়ে না। বাস্তব জীবনে আমাদের চারপাশের বস্তুগুলোর মধ্যে আমরা সেটাই দেখি। আমরা কখনো একটা টেবিলকে আর একটা টেবিলকে আকর্ষণ করতে দেখি না। কারণ এদের মধ্যে মহাকর্ষীয় আকর্ষণ বলের মান এত কম, সেটা বোঝা যায় না বলতে গেলে। <br />  </p> <figure class="image"><img alt="কাসিমির ইফেক্টের পরীক্ষা" height="485" src="https://cdn.kalerkantho.com/public/news_images/share/photo/shares/online/2024/02/18/my1182/12.jpg" width="600" /> <figcaption>কাসিমির ইফেক্টের পরীক্ষা</figcaption> </figure> <p><br /> সেখানে ক্ষুদ্র দুটি ধাতব পাতের মধ্যে মহাকর্ষীয় আকর্ষণ আমাদের পরীক্ষায় কোনো প্রভাব ফেলার কথাই নয়।<br /> কাসিমির বললেন, যদি ঠিক হয়ে থাকে ভ্যাকুয়াম ফ্ল্যাকচুয়েশনের তত্ত্ব, শূন্যের ভেতর যদি ভার্সন কণাদের ভাঙা-গড়ার খেলা চলে অবিরাম, সে প্রভাব এর পদ্ধতিতে পড়ার কথা? কিভাবে সেটা? </p> <p>পদ্ধতির মাঝখানে খুব সামান্য একটু জায়গা, এদের বাকি তিন পাশে শূন্যতার সমুদ্র। পদ্ধতির মাঝখানে জায়গা যেহেতু কম, চারপাশের তুলনায় এখানকার ০ তা-ও কম। তাই কোয়ান্টাম ফ্ল্যাকচুয়েশনের ঘটনা এর মধ্যে কম ঘটবে। অন্যদিকে পাতের বাকি তিন পাশে শূন্যতা অনেক বেশি। </p> <p>তাই পাতের ভেতরের দিকের ফলের তুলনায় বিপরীত পাশের ওপর ফ্ল্যাকচুয়েশনের ফলে উৎপন্ন কণাদের জন্ম ও মৃত্যু আরো কম। সুতরাং দুই পায়ের মাঝখানে অল্প জায়গাটুকু তাতে ফ্ল্যাকচুয়েশনজনিত শক্তি ঘনত্ব পাতের বাইরের শূন্যতার চেয়ে অনেক কম। ব্যাপারটা একটু বাস্তব দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা যেতে পারে। উত্তাল সমুদ্রে কোনো এক জায়গায় কাছাকাছি দুটি দেয়াল নির্মাণ করেছেন। ধরে নিন দেয়াল দুটি সমুদ্রের তলদেশের অনেক গভীর থেকে উঠে এসেছে। </p> <p>তাই যত উত্তালই হোক, দেয়াল দুটি একটুও নড়বে না। এখন যদি আপনি খেয়াল করেন, দুই দেয়ালের মাঝখানে যে খালের মতো জায়গাটি রয়েছে, ওখানকার পানি অনেক শান্ত। গোটা সমুদ্রের তুলনায় বেশি শান্ত। কিন্তু যেকোনো একটা দেয়ালের বাইরের দিকে চলে যান যদি, তাহলে দেখবেন, সেখানকার সমুদ্রের ঢেউ অনেক বেশি উত্তাল। </p> <p>এখন যদি দেয়াল দুটি খুব মজবুত না হয়ে নড়বড়ে হয় তাহলে দুটি দেয়ালেরই বাইরে পৃষ্ঠের তুলনায় ভেতরের পৃষ্ঠে বেশি বল অনুভব করবে। যেহেতু বাইরের দিকে অনেক বেশি পানি, অনেক বেশি ঢেউ, তাই বাইরের দিকের দেয়ালে প্রতি একক ক্ষেত্রফলের সমুদ্রের পানির চাপ অনেক বেশি থাকবে। </p> <p>তুলনায় দুই দেয়ালের মাঝখানের পানি কম, ঢেউয়ের শক্তিও তাই কম, তাই দুই পাতের মুখোমুখি তলগুলোতে প্রতি একক ক্ষেত্রফলে পানির চাপ অনেক কম। এখন যদি দেয়াল দুটি নড়বড়ে হয়, তাহলে বাইরের দিক থেকে বেশি চাপ অনুভব করবে। দেয়াল দুটি পরস্পরের দিকে হেলে পড়বে, এমনকি তাদের মধ্যে সংঘর্ষ ঘটার সম্ভাবনা থাকতে পারে। ঠিক এমন ঘটনা ঘটে কাসিমিরের পরীক্ষাতেও। যেহেতু দুই পাতের মাঝখানে ফ্ল্যাকচুয়েশন জনিত শক্তি ঘনত্ব কম, তুলনায় বাইরের দিকে বেশি, তাই পাত দুটি ভেতরের দিকে হেলে পড়তে চাইবে। বাইরের চাপ পাত দুটিকে পরস্পরের দিকে ঠেলে দিতে চাইবে। এতে মনে হবে পাত দুটি পরস্পরকে আকর্ষণ করছে। </p> <p>সত্যি সত্যি ল্যাবরেটরিতে বায়ুশূন্য স্থানে যদি দুটি পাত খুব কাছাকাছি রেখে এভাবে আর্থিং করা যায়, কাসিমিরের প্রভাবটি দেখা যাবে। এটা শুধু মানস পরীক্ষা নয়, পরবর্তী সময়ে কাসিমির প্রভাব ল্যাবরেটরিতেও করে দিয়েছিলেন কাসিমির। সুতরাং কোয়ান্টাম ফ্ল্যাকচুয়েশন যে সত্যিই সত্যিই ঘটে বা ঘটে চলেছে, সে কথা প্রমাণের আর কিছু বাকি থাকে না।</p> <p>সূত্র : নিউ সায়েন্টিস্ট</p>