<p>মেরি কুরি, যিনি বিজ্ঞান জগতে এক অন্যতম মহত্তম নারী হিসেবে পরিচিত। একাধারে তিনি ছিলেন এক রসায়নবিদ এবং পদার্থবিদ। তার অসামান্য গবেষণা এবং অবদান বিজ্ঞানের ইতিহাসে এক অনন্য স্থান দখল করেছে। রসায়ন ও পদার্থবিদ্যায় বিশেষ অবদানের জন্য তিনি দুবার নোবেল পুরষ্কার পেয়েছিলেন।</p> <p>মেরি কুরি ১৮৬৭ সালে পোল্যান্ডের ওয়ারশ শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তার আসল নাম ছিল মারিয়া স্ক্লোডোভস্কা। তিনি শৈশবে থেকেই অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন এবং বিজ্ঞান ও গণিতের প্রতি বিশেষ আগ্রহী ছিলেন। অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতার কারণে তিনি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সুযোগ ততটা পাননি, তবে তার নিজস্ব অধ্যবসায় ও অধ্যয়ন তাকে সফলতার দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়।</p> <p>১৮৯১ সালে মেরি প্যারিসে চলে আসেন এবং সোরবোন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। সেখানে তিনি পদার্থবিদ্যা ও গণিতের পড়াশোনা করেন। </p> <p>এরপর গবেষণার ইচ্ছে তাঁর। কোথায় করবেন। টাকা-পয়সারও প্রচ- অভাব। তখন তাঁর শিক্ষক জোসেফ কাওয়ালাস্কি তাঁকে পরিচয় করিয়ে দিলেন তরুণ গবেষক পিয়েরে কুরির সাথে। কুরির বাবা ইউজিন কুরি নিজের বাড়িতেই একটা গবেষণাগার গড়ে তুলেছিনে। সেখানেই ভাই জাকা কুরি আর বাবাকে নিয়ে রাতদিন গবেষণা করতেন।</p> <p> মেরিকে দেখেই প্রেমে পড়ে গেলেন পিয়েরে। প্রথম দেখায় পিয়েরেকেও ভালো লেগেছিল মেরির। কিন্তু কাজিমির সাথে ভারোবাসার তিক্ত অভিজ্ঞতা ভুলতে পারেননি। তাই প্রথমদিকে এ বিষয়টাকে এড়িয়েই চলেতেন।</p> <p> যাইহোক, কুরিদের গবেষণাগারে গবেষণার সুযোগ পান মেরি। দুজন মিলে চুম্বক নিয়ে গবেষণায় মেতে ওঠেন। সেই সাথে তীব্র ভালোলাগার অনুভূতি- জন্ম নেয় এক বৈজ্ঞানিক প্রেমের উপখ্যান। পিয়েরেই বেশি আগ্রহী ছিলেন। অন্যদিকে মেরি বাস্তববাদী। শেষমেষ প্রস্তাবই দিয়ে বসেন পিয়েরে। মেরি সরাসরি না বলেননি, তবে বেশকিছু অজুহাত তুলে এড়িয়ে যেতে চেয়েছিলে। আসেলে কুরি তাঁর নিজ দেশ পোল্যান্ডে ফিরে যেতে চেয়েছিলেন। সেখানাকার স্কুলে শিক্ষকতা করতে চান। জবাবে পিয়েরে জানিয়েছিলেন তিনিও গবেষণা-টনা ছেড়ে পোল্যান্ডে যেতে রাজি। সেখানে গিয়ে তিনিও না হয় শিক্ষকতা করবেন।</p> <p>এরপর আর ‘না’ বলতে পারেননি মেরি। দুই পরিবারের সম্মতিতে বিয়ে হয়। ১৮৯৫ সালের ২৬ জুলাই। সংসার, গবেষণা আর ভালোবাসা যেন হাত ধরাধরি করে চলছিল। পিয়েরে ও মেরি দুজনেই পিএইচডি ডিগ্রি নিয়েছেন। করেছেন তেজস্ক্রিয়তা নিয়ে গবেষণা। স্বামী-স্ত্রীর সেই যৌথ গবেষণার সূত্র ধরেই আবিষ্কার হয়ে রেডিয়াম এবং পোলোনিয়াম নামক দুটি নতুন মৌল আবিষ্কার হয়।</p> <p>রেডিয়াম আবিষ্কারের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯০৩ সালে নোবেল কমিটিতে পদার্থবিজ্ঞানে জন্য সুপারিশকরা হয় দুটি নাম। হেনরি বেকরলে ও পিয়েরে কুরি। মেরির নাম ছিল না। পিয়েরে আপত্তি তোলেন। জানান রেডিয়াম আবিষ্কারের কৃতিত্ব তাঁর একা নয়। মেরি তাঁর সাথে না থাকলে মিলত না রেডিয়ামারে দেখা। নোবেল কমিটি বাধ্য হয় মেরির নাম যুক্ত করতে। ১৯০৩ সালে তেজস্ক্রিয়তা আবিষ্কারে যৌথভাবে তিন বিজ্ঞানী নোবেল পান পদার্থবিজ্ঞানে।</p> <p>বেশ সুখেই কাটছিল মেরি আর পিয়েরে বৈজ্ঞানিক ভালোবাসাময় জীবন। তাঁদের ঘর আলো করে আসে দুই কন্যা আইরিন কুরি ও ইভ কুরি। দুজন যোগ দিলেন সরবন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক পদে। হঠাৎ তাঁদের সুখের জীবনে নেমে এলো বিষাদের ছায়ায়। গাড়ি-দুর্ঘটনায় মর্মান্তিক মৃত্যু হলো পিয়েরের। ১১ বছরের ভালোবাসার সমাপ্তি সেখানেই!</p> <p>মেরি কুরি দ্বিতীয়বার ১৯১১ সালে রসায়নে। দ্বিতীয়বার যখন নোবেল পাচ্ছেন মেরি, তখন নোবেল কমিটি আবদার করেছিল, কুরি যেন নোবেল নিতে না আসেন। পুরস্কার তাঁর বাসায় পৌঁছে যাবে। কেন কুরির সঙ্গেই বার বার এমনটা হচ্ছে বার বার? </p> <p>প্যারিসের আকাশে-বাতাসে তখন বিষাক্ত বাতাসের মতো ছড়িয়ে পড়েছে মেরির অবৈধ প্রেমের কাহিনি। সেখানে খলনায়কের ভূমিকায় পল ল্যাজভাঁ, যিঁনি বয়সে কুরির চেয়ে বছর পাঁচেকের ছোট।</p> <p>লাজভাঁ কুরি দম্পত্তির অধীনে পিএইচডি করেছেন এবং তাঁদের ভালো বন্ধুও ছিলেন। পিয়েরর মৃত্যুর মেরি ও ল্যাজভাঁর বন্ধুত্বটা আরও গভীর হয়। মেরি একাকীত্বে ভুগছিলেন, অন্যদিকে লাজভ্যাঁ চরম পারিবারিক অশান্তিতে দিন কাটাচ্ছিলেন। তাই মেরি কুরির গবেষণাগারেই দিন কাটে লাজভাঁ। সুতরাং তাঁদের মধ্যে একটা সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল। সেই সম্পর্কের কথা পত্র-পত্রিকায় ছাপা হয় রসিয়ে রসিয়ে। দেশের মানুষ এক ছিঃ হাজার ছিঃ করছে। তাই নোবেল কমিটিও বিব্রত বোধ করছে ঢাক-ঢোল পিটিয়ে নোবেল মঞ্চে কুরিকে হাজির করতে। তাই নোবেল কমিটির হর্তাকর্তার কুরিকে অনুরোধ করেছিলেন, তিনি যেন নোবেল নিতে স্টকহোমে না আসেন। কিন্তু কুরি সে কথা পাত্তা না দিয়ে নোবেল মঞ্চে ঠিকই হাজির হয়েছিলেন।</p> <p>কলঙ্কের খবর রটে যাওয়ার পর গোটা ফ্রান্সের বুদ্ধিজীবি থেকে সাধারণ মানুষ পর্যন্ত চেয়েছিল কুরিকে দেশ থেকে বের করে দেওয়া হোক। সরকার কী করত কে জানে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ এসে পাল্টে দেয় সব হিসাব। যুদ্ধাহত ফরাসী সৈন্যদের বাঁচাতে মেরি ছূটলেন যুদ্ধের ময়দানে। নিজের তৈরি অনেক গুলো এক্সরে যন্ত্র নিয়ে। বহু সৈন্যের প্রাণ বাঁচল কুরির কারণে। বিদেশিনী কলঙ্কিনী কুরি পরিণত ফলেন ফরাসীদের জাতীয় বীরে। </p> <p>তবে তেজস্ক্রিয় পদার্থ নিয়ে এত ঘাঁটাঘাঁটি করার ফল ভালো হলো না। ক্ষতিকর রশ্মির প্রভাবে কুরির শরীরে  ঘাতক ব্যাধি ক্যানসার। ১৯৩৪ সালের আজকের দিনে (৪ জুলাই) শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন মেরি কুরি। কালের কণ্ঠের পক্ষ থেকে এই মহিয়সী বিজ্ঞানীর প্রতি রইল বিনম্র শ্রদ্ধা।</p>