রাষ্ট্র সংস্কারে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত সংস্কার কমিশনগুলোর করা সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের ১৬৬টির মধ্যে শতাধিক প্রস্তাবে একমত প্রকাশ করেছে এযাবৎ মতামত প্রদানকারী সব রাজনৈতিক দল। তবে রাষ্ট্রের নাম পরিবর্তনের মতো গুরুত্বপূর্ণ কিছু সংস্কার প্রস্তাবে বেশির ভাগ রাজনৈতিক দল আপত্তি জানিয়েছে।
ঐকমত্য কমিশনে এ পর্যন্ত ৩৫টি রাজনৈতিক দল লিখিত মতামত দিয়েছে। এর মধ্য থেকে ১১টি রাজনৈতিক দল কমিশনের সঙ্গে সংলাপে অংশ নিয়েছে।
আজ বৃহস্পতিবার দেশের অন্যতম বৃহৎ দল বিএনপির অনুষ্ঠিত হবে। রাজনৈতিক দলগুলোর পাশাপাশি অনলাইনে সাধারণ নাগরিকদের মতামত নেওয়া হবে। সংলাপ ও অনলাইনে পাওয়া মতামতের ভিত্তিতে যেসব বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছা সম্ভব হবে, তা বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতিতে ‘জুলাই সনদ’-এ সই হবে। এইসব প্রক্রিয়া মধ্য জুলাইয়ে শেষ হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানের পর গঠিত ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্র সংস্কারের লক্ষ্যে ১১টি সংস্কার কমিশন গঠন করে। এরপর সংস্কার কমিশনগুলোর সুপারিশ চূড়ান্ত করতে গঠন করা হয় জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। গত ১৫ ফেব্রুয়ারি কাজ শুরু করেছে এই কমিশন। প্রথম পর্যায়ে গঠিত ছয়টি সংস্কার কমিশনের মধ্যে সংবিধান, নির্বাচনব্যবস্থা, বিচার বিভাগ, জনপ্রশাসন ও দুর্নীতি দমন কমিশন সংস্কার কমিশনের গুরুত্বপূর্ণ ১৬৬ সুপারিশ বিষয়ে ঐকমত্য কমিশন ১৬৬টি প্রস্তাব তৈরি করে ৩৮টি রাজনৈতিক দল ও জোটের মতামত আহবান করে।
এ পর্যন্ত ৩২টি দল লিখিত মতামত জানিয়েছে। অন্যদিকে লিখিত মতামত প্রদানকারী দলগুলোর সঙ্গে সংস্কার প্রশ্নে সমঝোতায় পৌঁছতে গত ২০ মার্চ থেকে সংলাপ শুরু হয়েছে। এ পর্যন্ত ১১টি রাজনৈতিক দল এই সংলাপে গিয়ে তাদের মতামত তুলে ধরার পাশাপাশি আলোচনায় অংশ নিয়েছে।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের পক্ষে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ ও সমন্বয়ের দায়িত্ব পালন করছেন প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার। তিনি কালের কণ্ঠকে জানান, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সুপারিশগুলো চূড়ান্ত করার লক্ষ্যে ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর সংলাপ চলছে।
অনেক ক্ষেত্রে লিখিত মতামতে আপত্তি থাকলেও সংলাপে আলোচনার মাধ্যমে অনেক বিষয়ে দলগুলো একমত হচ্ছে। বৃহস্পতিবার (আজ) সকাল সাড়ে ১০টায় বিএনপি সংলাপে অংশ নেবে। আগামী সপ্তাহে জামায়াত, এনসিপিসহ অন্য দলগুলোর সংলাপে বসার কথা রয়েছে। তিনি আরো বলেন, সংলাপের পর যেসব সুপারিশের বিষয়ে সবাই একমত, সেগুলো আলাদা করা হবে। এ ছাড়া যেসব গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারের বিষয়ে রাজনৈতিক দলের ভিন্নমত রয়েছে, সেগুলো নিয়ে আগামী মাসের মাঝামাঝি দ্বিতীয় দফায় চূড়ান্ত সংলাপ করা হবে। সেই সংলাপে রাজনৈতিক দলের পাশাপাশি সুধীসমাজের প্রতিনিধিসহ অংশীজনের সঙ্গে চূড়ান্ত আলোচনা করবে ঐকমত্য কমিশন। এরপর সুপারিশমালা চূড়ান্ত করে সরকারের কাছে প্রতিবেদন জমা দেওয়া হবে।
কমিশন সূত্র জানায়, এরই মধ্যে মতামত জানানো রাজনৈতিক দলগুলো শতাধিক প্রস্তাবে একমত প্রকাশ করেছে। তবে জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বেশ কিছু ইস্যুতে দলগুলো পরস্পরবিরোধী অবস্থান নিয়েছে। আবার কয়েকটি বিষয়ে বেশির ভাগ দল জোর আপত্তি জানিয়েছে। বিশেষ করে রাষ্ট্রের নাম পরিবর্তনের বিষয়ে আপত্তি এসেছে। কমিশনের প্রস্তাবে বলা হয়েছে, সংবিধানের প্রযোজ্য সব ক্ষেত্রে ‘প্রজাতন্ত্র’ ও ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’ শব্দগুলোর পরিবর্তে ‘নাগরিকতন্ত্র’ ও ‘জনগণতন্ত্রী বাংলাদেশ’ শব্দগুলো ব্যবহার করা হবে। এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামীসহ বাম গণতান্ত্রিক জোট, গণতন্ত্র মঞ্চ এবং ১২ দলীয় জোটভুক্ত রাজনৈতিক দলগুলো। এমনকি জাতীয় নাগরিক পার্টিও (এনসিপি) ‘প্রজাতন্ত্র’ ও ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’ বহাল রাখার পক্ষে মত দিয়েছে।
সূত্র জানায়, এনসিপিসহ কয়েকটি দল সংবিধানে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি থেকে জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা বাদ দিয়ে কমিশন প্রস্তাবিত ‘সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক সুবিচার, বহুত্ববাদ ও গণতন্ত্র’ অন্তর্ভুক্ত করার সুপারিশের সঙ্গে একমত পোষণ করেছে। এ ক্ষেত্রে জামায়াত শুধু ‘বহুত্ববাদ’ শব্দটি নিয়ে আপত্তি জানিয়েছে। দলটি এর পরিবর্তে ‘সর্বশক্তিমান আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস, ধর্মীয় ও সামাজিক মূল্যবোধ’—এই শব্দগুলো যোগ করার প্রস্তাব দিয়েছে। তবে বেশির ভাগ দল চার মূলনীতি বাদ দেওয়ার প্রস্তাবে আপত্তি জানিয়েছে। তারা গণপরিষদ ও গণভোটের বিষয়ে আপত্তি জানানোর পাশাপাশি সংসদের মেয়াদ পাঁচ বছর বহাল রাখার পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। একাত্তর আর চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানকে একসঙ্গে মিলিয়ে ফেলা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে বিএনপিসহ বেশির ভাগ দল। কেউ কেউ এর সঙ্গে নব্বইকে যুক্ত করার দাবি জানিয়েছে। বিএনপি আপত্তি জানালেও অনেকেই সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থার সুপারিশ করেছে।
জানা গেছে, লিখিত মতামতে কোনো কোনো রাজনৈতিক দল কমিশন প্রদত্ত স্প্রেডশিট (ফরম) ব্যবহার করেনি। তারা আলাদাভাবে লিখিত মতামত দিয়েছে। শুধু নির্বাচনকেন্দ্রিক সংস্কার ছাড়া বাকি সংস্কার নির্বাচিত সংসদ দ্বারা বাস্তবায়নের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। বেশির ভাগ দলের পক্ষে বলা হয়েছে, বর্তমানে দেশে যে অস্থিরতা ও সংকট বিরাজ করছে, তা উত্তরণের একমাত্র উপায় দ্রুত সংসদ নির্বাচন। তবে এনসিপি, গণ অধিকার পরিষদসহ কয়েকটি দল সামগ্রিক সংস্কার শেষ করার পর নির্বাচনের কথা বলছে। ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি আলী রীয়াজ বলেন, ‘আগামী মে মাসের প্রথম সপ্তাহে রাজনৈতিক দল ও জোটগতভাবে প্রথম পর্যায়ের সংলাপ শেষ হবে। এরপর আমরা দ্বিতীয় ধাপে প্রবেশ করতে পারব। সে ক্ষেত্রে যেসব বিষয়ে ভিন্নমত আছে বা কোনো ক্ষেত্রে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের প্রয়োজন আছে, সেগুলো নিয়ে আগামী মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহের মধ্যে আলোচনা করতে পারব।’