সিরাতে ইবনে ইসহাক
‘আস সিরাতুন নাবাবিয়্যাহ লি ইবনে ইসহাক’ বা সিরাত ইবনে ইসহাক ইতিহাসের প্রথম সিরাত বা রাসুল (সা.)-এর জীবনী গ্রন্থ।
সবচেয়ে প্রাচীন, প্রামাণ্য ও গ্রহণযোগ্য গ্রন্থ সিরাত ইবনে ইসহাক। ভাষার প্রাঞ্জলতা, শব্দের বুনন ও তথ্যের নির্ভরযোগ্যতা গ্রন্থকে করেছে অনন্য। ইসলাম ও মহানবী (সা.)-এর জীবন সম্পর্কে অন্যতম প্রধান উৎস এই বই। ইসলাম ধর্ম, মহানবী (সা.) ও সে সময়ের আরবের ইতিহাস জানার জন্য সারা পৃথিবীর নিবেদিতপ্রাণ ধর্মানুসারী থেকে নিষ্ঠাবান গবেষক পর্যন্ত এই বইয়ের কাছে ফিরে ফিরে এসেছেন। মহানবী (সা.)-এর জীবনীসংবলিত এটিই ইতিহাসের প্রথম গ্রন্থ। এর আগে মহানবী (সা.)-এর জীবনী লেখা হয়নি। পরবর্তী সময়ের সব সিরাত গ্রন্থই সিরাত ইবনে ইসহাকের পোষ্য। আদম (আ.) থেকে শুরু করে নবী ও রাসুলদের জীবনী এবং ইতিহাস একত্র করা হয়েছে এই গ্রন্থে। কালের ধারাবাহিকতা রক্ষা করে অত্যন্ত সংক্ষিপ্তাকারে তিনি এই কাজ করেছেন। তবে তাঁর সব বক্তব্যে বিশুদ্ধতা নিরূপণ করা হয়নি।
বাংলা ভাষায় সিরাতে রাসুলুল্লাহ (সা.) বইটি প্রথম প্রকাশ করে ইসলামিক ফাউন্ডেশন। কথাসাহিত্যিক শহীদ আখন্দ অনুবাদ করেছিলেন। ইসলামিক ফাউন্ডেশনের সেই অনুবাদটি একটা সময় নিঃশেষিত হয়ে যায়। সম্ভবত ইসলামিক ফাউন্ডেশন ও অন্য কেউ আর বইটি প্রকাশ করেনি। ২০১৭ সালে প্রথমা প্রকাশনী বইটি প্রকাশ করে। তবে অভিজ্ঞমহল মনে করে, এই অনুবাদ প্রশ্নাতীত নয়।
সিরাতে ইবনে হিশাম
আবু মুহাম্মদ আব্দুল মালেক ইবনে হিশাম ইবনে আইয়ুব হিজরি দ্বিতীয় শতাব্দীর শেষের দিকে ‘সিরাত ইবনে হিশাম’ লিপিবদ্ধ করেন। ইবনে হিশাম বসরায় জন্মগ্রহণ করেন। সেখানে তাঁর ছেলেবেলা কাটে। পরে তিনি মিসর গমন করেন। সেখানে ইমাম শাফি (রহ.)-এর সঙ্গে মিলিত হন। উভয়ে প্রচুর আরব কাব্য চর্চা করেন। ২১৮ হিজরিতে তিনি ফুসতাত নগরীতে ইন্তেকাল করেন।
সিরাত ইবনে হিশাম তাঁর অমর কীর্তি। বইটি সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য ও প্রচারিত। এ বই তাঁকে আজও পৃথিবীর মঞ্চে জাগিয়ে রেখেছে বললে অত্যুক্তি হবে না। তিনি সিরাতে ইবনে ইসহাককে সংক্ষিপ্ত করেন। জিয়াদ আল বুখারি নামে মাত্র এক ব্যক্তির মধ্যস্থতা গ্রহণ করেছিলেন। ইবনে ইসহাক রচনার প্রায় অর্ধশতাব্দী পর এ বই লেখা হয়। তখন আব্বাসীয় খেলাফতের বিকাশকাল চলছে। এ সময় মুসলিম বিশ্বে জ্ঞান-বিজ্ঞানের অভূতপূর্ব উন্নতি ও বিকাশ ঘটে। শিক্ষা, সংস্কৃতি, চিকিৎসা, হাসপাতাল, গ্রন্থাগার, নগরায়ণ প্রতিষ্ঠায় মুসলিমরা অনেক এগিয়ে যায়।
ইবনে হিশাম পূর্ণ সততা, বিশ্বস্ততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে বইটি সংকলন করেন।
আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া
আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া বইটি লেখেন আবুল ফিদা হাফিজ ইবনে কাসির আদ-দামেশকি (রহ.)। ৭০১ হিজরিতে জন্ম। বসরার অন্তর্গত মিজদাল নামক জনপদে এই মহামনীষী জন্মগ্রহণ করেন। অষ্টম শতাব্দীর মামলুক সুলতানের শাসনামলে তিনি যৌবনকাল অতিবাহিত করেন। যৌবনের চোখ দিয়ে পর্যবেক্ষণ করেছেন সুলতানের শাসনকাল। ৭৭৪ হিজরির এক বৃহস্পতিবার মহান মালিকের ডাকে তিনি সাড়া দেন।
অষ্টম শতাব্দীতে ইবনে কাসির ছিলেন সুপণ্ডিত। তৎকালীন সেরা জ্ঞানী। তিনি ফতোয়া দিতেন। শিক্ষকতা করেছেন। তর্কযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। ফিকাহ, তাফসির ও ব্যাকরণ শাস্ত্রে এক নতুন রচনাশৈলী উদ্ভাবন করেছেন। হাদিস বর্ণনাকারী ও হাদিসের সত্যাসত্য বিচারের ক্ষেত্রে গভীর জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন। ছিলেন ভাষাবিদ। সাহিত্যিক। যুগশ্রেষ্ঠ ইতিহাসবেত্তা। ইতিহাস শাস্ত্রে তিনি সিরিয়ার ইতিহাসবিদ কাসিম ইবনে মুহাম্মদ বিরযানি দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন।
আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া তাঁর অমর কীর্তি। আরবি ভাষায় রচিত। ১৪ খণ্ডে সমাপ্ত হয়েছে বইটি। উচ্চস্তরের ভাষা ও সাহিত্যিক মানে আরবি সাহিত্যিকদের কাছে এটি ব্যাপক প্রশংসিত।
বাংলাদেশের ইসলামিক ফাউন্ডেশন বইটির অনুবাদ ১৪ খণ্ড প্রকাশ করে। বাংলা নামকরণ করা হয় ‘ইসলামের ইতিহাস : আদি-অন্ত’।
শামায়েলে তিরমিজি
শামায়েলে তিরমিজি রচনা করেন ইমাম হাফেজ আবু ঈসা মুহাম্মদ ইবনে ঈসা। হাদিস শাস্ত্রের বিখ্যাত সহিহ ছয় কিতাবের মধ্যে সুনানে তিরমিজির লেখক তিনি। তিনি ইমাম বুখারির প্রিয় ছাত্র। হাদিস শাস্ত্রে পণ্ডিত, খ্যাতনামা আলোচক, তীক্ষ স্মরণশক্তিসম্পন্ন ও প্রচণ্ড মেধাবী মনীষী ছিলেন। তিনি ২০৯ হিজরি মোতাবেক ৮২৪ খ্রিস্টাব্দে তিরমিজ শহরের যুগ নামক স্থানে জন্মগ্রহণ করেন। ২৭১ হিজরির রজব মাসের শেষের দিকে পরলোকগত হন।
তাঁর রচিত শামায়েলে তিরমিজির মধ্যে নবী (সা.)-এর দৈহিক অবয়ব, পোশাক-পরিচ্ছদ, হাসি-কান্না, আদব-আখলাক ও দৈনন্দিন আমলের বর্ণনা তুলে ধরেন। মুহাম্মদ (সা.)-এর নূরানি রূপ, অনুপম সৌন্দর্যের বৈশিষ্ট্য আলোচনা করেন। নবী (সা.)-এর ব্যবহৃত আসবাবেরও বর্ণনা করেন। বেশির ভাগ হাদিসের শুরুতে শিরোনাম দেওয়া হয়েছে। অন্যান্য প্রসিদ্ধ কিতাবের রেফারেন্স দেওয়া হয়েছে। ইমাম তিরমিজি (রহ.) তাঁর গ্রন্থে ৫৮টি বিষয়কে বিভিন্ন অনুচ্ছেদে বিভক্ত করে ৪০০টি হাদিস সংকলন করেন।
শামায়েলে তিরমিজির প্রথম অনুবাদ প্রকাশ করে ইসলামিক ফাউন্ডেশন। অনুবাদ করেন আল্লামা আবুল বারাকাত মুহাম্মদ ফজলুল্লাহ। সম্পাদনা করেন প্রফেসর ড. আবু রেজা মোহাম্মদ নেজামুদ্দিন নদভী এম পি ও ড. আবুল আলা মুহাম্মদ হোজামুদ্দিন।
আর-রাহীকুল মাখতুম
আল্লামা সফিউর রহমান মোবারকপুরী রচিত ‘আর-রাহীকুল মাখতুম’ প্রাণের নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর জীবনী গ্রন্থ। তিনি ভারতের আজমগড় জেলার হোসাইনবাদের মোবারকপুরে জন্মেছেন। আরবি ভাষা, ব্যাকরণ, সাহিত্য, ফেকাহ, উসুলে ফেকাহ, তাফসির ও হাদিস বিষয়ে জ্ঞান লাভ করেন। ১৯৬১ সালে শরিয়াহ বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করেন। শিক্ষকতা আর লেখালেখি করতেন। ১৯৮৮ সালে মদিনায় আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে রাসুল (সা.) বিষয়ক গবেষণা ইনস্টিটিউটে যোগদান করেন। ২০০৬ সালের ১ ডিসেম্বর তাঁর ইন্তেকাল হয়।
আধুনিক যুগে মুহাম্মদ (সা.)-এর জীবনী নিয়ে লেখা অন্যতম একটি সিরাত গ্রন্থ ‘আর-রাহীকুল মাখতুম’। ১৯৭৯ সালে রাবেতায়ে আলম ইসলামী কর্তৃক মুহাম্মদ (সা.)-এর জীবনীর ওপর প্রথম উন্মুক্ত সিরাত গ্রন্থ প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। বিভিন্ন দেশ থেকে এক হাজার ১৮৭টি পাণ্ডুলিপি জমা পড়ে। আল্লামা সফিউর রহমান মোবারকপুরীর সিরাত রচনাটি প্রথম স্থান অধিকার করে।
১৯৯৯ সালে খাদিজা আখতার রেজায়ী বইটির বাংলা অনুবাদ করেন। এবং আল কোরআন একাডেমি পাবলিকেশনস বইটি প্রকাশ করে। বাংলা ভাষায় অনূদিত হওয়ার পর ব্যাপক সাড়া মেলে। মাত্র ৫৫ দিনের মাথায় বইটির দ্বিতীয় সংস্করণ শেষ হয়ে যায়। এখন বইটির ২১তম সংস্করণ চলছে।
সিরাতে মোস্তফা
আল্লামা ইদরিস কান্ধলভী (রহ.) লিখিত সিরাতে মোস্তফা উর্দু ভাষায় রচিত, একটি তথ্যবহুল সিরাত গ্রন্থ। আল্লাহর রাসুলের জিহাদ জীবন, দাওয়াতের ক্ষেত্রে আপসহীনতা ও মুজিজার আলোচনা করেন। হাদিস ও তাফসিরের মূল গ্রন্থগুলোতে বর্ণিত সিরাতবিষয়ক অনেক রেওয়ায়েত তুলে ধরেছেন। সামঞ্জস্যপূর্ণ ব্যাখ্যাগুলো অত্যন্ত পারদর্শিতার সঙ্গে উপস্থাপন করেছেন। ইদরিস কান্ধলভী (রহ.) বলেন, ‘যদ্দুর সম্ভব সংগ্রহ এবং রেওয়ায়েতগুলো গ্রহণযোগ্য ও সনদযুক্ত হওয়ার দাবি করে। কিছু গুপ্ত রহস্য এবং আহকামও সন্নিবেশ করা হয়েছে। যা ইনশাআল্লাহ উপকারী ও লাভজনক প্রমাণিত করে।’
বিশ্বনবী
বিশ্বনবী বাংলা সাহিত্যের প্রথম সিরাত গ্রন্থ। লিখেছেন কবি গোলাম মোস্তফা। তিনি আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কবি। ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী। গীতিকবিতা, শিশুতোষ কবিতা, মহাকাব্য, গান, অনুবাদ, উপন্যাস, প্রবন্ধ ও গল্প লিখেছেন। মুসলিম জাগরণের কবি হিসেবে বিশেষ সমাদৃত। বিশ্বনবী কবির শ্রেষ্ঠ কীর্তি। ১৯৪২ সালের অক্টোবরে বইটির প্রথম সংস্করণ প্রকাশিত হয়। ১৯৪৬ সালে দ্বিতীয় ও ১৯৬৩ সালে অষ্টম সংস্করণ প্রকাশিত হয়। অষ্টম সংস্করণে বইটি ৫৮৭ পৃষ্ঠায় দাঁড়িয়েছে।
কবি পূর্ববর্তী বিখ্যাত অনেক সিরাত গ্রন্থ পাঠ করে বইটি লেখেন। মনের আবেগ, ভালোবাসা ও প্রেম উজাড় করে দিয়েছেন কলমের আঁখরে। কবির কলম এখানে প্রেম আর বিপুল আবেগের তরঙ্গে ঢেউ খেলেছে। অনুভূতির সব দরজা খুলে বসেছেন মুহাম্মদ (সা.)-এর যাপিত জীবনের কাছে। প্রাচীন সিরাত গ্রন্থের সহযোগিতা নিয়েছেন। করেছেন ফুটনোট। কিছু কিছু পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করেছেন। আবেগ বিশ্বাস আর যুক্তি এ গ্রন্থের সবখানে বিরাজমান। বিশ্বনবী সাধারণ পাঠকের চেয়ে বিদগ্ধ পাঠককে বেশি মুগ্ধ করবে।
সম্পর্কিত খবর
আয়াতের অর্থ : ‘সে সব ঘর যাকে সমুন্নত করতে এবং যাতে তাঁর নাম স্মরণ করতে আল্লাহ নির্দেশ দিয়েছেন, সকাল ও সন্ধ্যায় তাঁর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে।’ (সুরা : নুর, আয়াত : ৩৬)
আয়াতে আল্লাহ তাঁর ইবাদত ও জিকিরের মাধ্যমে মসজিদ আবাদের নির্দেশনা দিয়েছেন।
শিক্ষা ও বিধান
১. আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, পৃথিবীর সব মসজিদ এই আয়াতের অন্তর্ভুক্ত। অর্থাৎ সব মসজিদ আল্লাহর ইবাদত ও জিকিরের মাধ্যমে আবাদ রাখা আবশ্যক।
২. অথবা আয়াতে নবীদের প্রতিষ্ঠিত মসজিদের প্রতি অধিক যত্নশীল হওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সেগুলো হচ্ছে মসজিদুল হারাম, মসজিদে নববী, মসজিদে কুবা ও মসজিদুল আকসা।
৩. একদল তাফসিরবিদ বলেন, ‘সমুন্নত করা’ বাক্যে ইঙ্গিত মেলে যে সাধারণ বাড়ি-ঘরের তুলনায় মসজিদের কাঠামো উন্নত ও কিছুটা ভিন্ন হওয়া উত্তম।
৪. মসজিদ আবাদের সর্বনিম্ন স্তর হলো তাতে নিয়মিত আজান হওয়া এবং পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ জামাতের সঙ্গে আদায় করা।
৫. আয়াতে ব্যবহৃত সকাল-সন্ধ্যা শব্দদ্বয় থেকে বোঝা যায়, তীব্র নিরাপত্তাহীনতার মতো একান্ত অপারগতা ছাড়া মসজিদ সব সময় ইবাদতকারীদের জন্য উন্মুক্ত করা রাখা প্রয়োজন।
(তাফসিরে আবু সাউদ : ৬/১৭৮)
সুরা ঝুমার
আলোচ্য সুরায় মানব সৃষ্টির সূচনা থেকে সমাপ্তি পর্যন্ত বর্ণনা করা হয়েছে। এই সুরার প্রধান আলোচ্য বিষয় আল্লাহর একত্ববাদ, আল্লাহর অস্তিত্বের প্রমাণ, কোরআন ও ওহি। কোরআন এসেছে আল্লাহর পক্ষ থেকে—এ কথার মাধ্যমে সুরাটি শুরু হয়েছে। এরপর আল্লাহর সত্তা ও গুণাবলিতে শিরকের সম্ভাবনা নাকচ করা হয়েছে।
আদেশ-নিষেধ-হিদায়াত
১. আল্লাহ কৃতজ্ঞ বান্দাদের পছন্দ করেন। (আয়াত : ৭)
২. কেউ কারো পাপের বোঝা বহন করবে না। (আয়াত : ৭)
৩. আল্লাহকে ভুলে যেয়ো না।
(আয়াত : ৮)
৪. তাহাজ্জুদ আদায় করো।
৫. আল্লাহকে ভয় করো। (আয়াত : ১০)
৬. আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ করো। (আয়াত : ১২)
৭. পরিবারে ধর্মহীনতার চর্চা কোরো না। (আয়াত : ১৫)
৮. উত্তম কথা গ্রহণ করো। (আয়াত : ১৮)
৯. মানুষের প্রতি কঠোর হৃদয় হয়ো না।
১০. কোরআন পাঠে মুমিন হৃদয় বিগলিত হয়। (আয়াত : ২৩)
১১. কোরআন সহজ ও সাবলীল।
(আয়াত : ২৮)
১২. আল্লাহ ছাড়া কাউকে ভয় কোরো না। (আয়াত : ৩৬)
১৩. মানবীয় জ্ঞান মুক্তির জন্য যথেষ্ট নয়। (আয়াত : ৪৯)
১৪. আল্লাহর অনুগ্রহ থেকে নিরাশ হয়ো না। (আয়াত : ৫৩)
১৫. মুত্তাকিদের আল্লাহ রক্ষা করেন। (আয়াত : ৬১)
সুরা মুমিন
আলোচ্য সুরায় আল্লাহর একত্ববাদ ও পরকাল বিষয়ে বর্ণনা করা হয়েছে। সুরায় আরশ বহনকারী ফেরেশতাদের সম্পর্কে বর্ণনা করা হয়েছে। সত্য-মিথ্যার চিরন্তন দ্বন্দ্বের কথা বর্ণনা করা হয়েছে। এখানে বলা হয়েছে যে কিয়ামতের দিন জাহান্নামবাসী জাহান্নাম থেকে বের হওয়ার আবেদন করবে। কিন্তু তাদের আবেদন ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করা হবে। সুরার শেষে মহানবী (সা.)-কে ধৈর্য ধারণ করার উপদেশ দেওয়া হয়েছে, যেভাবে মুসা (আ.) ধৈর্য ধারণ করেছেন।
আদেশ-নিষেধ-হিদায়াত
১. অবিশ্বাসীদের অবাধ বিচরণে বিভ্রান্ত হয়ো না। (আয়াত : ৪)
২. আল্লাহমুখী মানুষরাই উপদেশ গ্রহণ করে। (আয়াত : ১৩)
৩. পরকালে বন্ধুত্ব কাজে আসবে না। (আয়াত : ১৮)
৪. কুদৃষ্টি ও অন্তরের পাপ সম্পর্কে আল্লাহ জানেন। (আয়াত : ১৯)
৫. উদ্ধত ব্যক্তি থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাও। (আয়াত : ২৭)
৬. ভিত্তিহীন বিতর্ক ঘৃণ্য কাজ।
(আয়াত : ৩৫)
৭. স্বজাতিকে সত্যের পথে আহ্বান করো। (আয়াত : ৩৮)
৮. আল্লাহ দ্বিনের সেবকদের রক্ষা করেন। (আয়াত : ৪৫)
৯. দ্বিনের ব্যাপারে তর্ক কোরো না। (আয়াত : ৫৬)
১০. আল্লাহকে ডাকো। কেননা তিনি বান্দার ডাকে সাড়া দেন। (আয়াত : ৬০)
১১. আল্লাহর ইবাদত থেকে বিমুখ হয়ো না। (আয়াত : ৬০)
১২. ক্ষমতার দম্ভ ও উল্লাস আল্লাহ পছন্দ করেন না। (আয়াত : ৭৫)
সুরা হা-মিম-সাজদা
এই সুরায় বলা হয়েছে, অবিশ্বাসীরা কোরআন নিয়ে চিন্তা করে না। আর নবী-রাসুলরা সবাই মানুষ ছিলেন। এই সুরায় আদ ও সামুদ জাতির ঘটনা বর্ণনা করা হয়েছে, পৃথিবীতে শক্তিমত্তায় ও ক্ষমতায় কেউ তাদের সমকক্ষ ছিল না। এই সুরায় সতর্ক করা হয়েছে যে কিয়ামতের দিন মানুষের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ তার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেবে। কিছু মানুষ কোরআন নিয়ে ব্যঙ্গ করে। কিন্তু শিগগিরই তাদের পরিণতি ভয়াবহ হবে। এমন ভবিষ্যদ্বাণীর মাধ্যমে সুরাটি শেষ হয়েছে যে প্রতিটি যুগে মানুষকে সৃষ্টিজগতের কিছু কিছু রহস্য উদ্ঘাটন করার ক্ষমতা দেওয়া হবে।
আদেশ-নিষেধ-হিদায়াত
১. কোরআনবিমুখদের অন্তর পাপাচ্ছাদিত। (আয়াত : ৫)
২. পরকালে অবিশ্বাসীরা জাকাত দেয় না। (আয়াত : ৭)
৩. দ্বিনবিমুখ মানুষদের সতর্ক করো। (আয়াত : ১৩)
৪. পরকালে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ মানুষের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেবে। (আয়াত : ২০)
৫. আল্লাহর প্রতি উদাসীনতা ধ্বংস ডেকে আনে। (আয়াত : ২৩)
৬. কোরআনচর্চায় বাধা দিয়ো না।
(আয়াত : ২৬)
৭. মানুষকে আল্লাহর পথে আহ্বান করো। (আয়াত : ৩৩)
৮. শয়তানের কুমন্ত্রণা থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় নাও। (আয়াত : ৩৬)
৯. কোরআন বিকৃতকারীদের জন্য জাহান্নাম। (আয়াত : ৪০)
১০. কোরআন মুমিনের জন্য
আরোগ্যস্বরূপ। (আয়াত : ৪৪)
১১. সম্পদের মোহ অন্তহীন।
(আয়াত : ৪৯)
গ্রন্থনা : মুফতি আতাউর রহমান
মাহমুদ আহমেদ হাশেমির বয়স ৬৭ বছর। তিনি ইসলামাবাদের বাসিন্দা। যখন তিনি তাঁর পরিবারকে সঙ্গে নিয়ে একটি রঙিন দস্তরখানে চারপাশে বসে ইফতার করছিলেন, তখন প্লেট, চামচ ও কাঁটা চামচের শব্দে চারপাশ মুখোর হয়ে উঠেছিল। তিন ছেলে, ছেলের বউ ও নাতিদের নিয়ে তাঁর সুখের সংসার আরো সুখের হয়ে উঠেছিল।
হাশেমি পরিবারের ইফতারের দিকে তাকালে যে কেউ বুঝতে পারবে পাকিস্তানের ইফতার সংস্কৃতিতে যুক্ত হয়েছে আধুনিক জীবনধারার অনেক কিছু। যেমন—চামচ ও কাঁটা চামচের ব্যবহার। মূলত রমজান সংস্কৃতি প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে চর্চিত হয় মুসলিম পরিবারে।
সারা বিশ্বের মুসলমানের কাছে মোবাইল অ্যাপসগুলো রমজান উদযাপনের অপরিহার্য অনুষঙ্গ হয়ে উঠেছে। এর মাধ্যমে মানুষ নামাজের সময়সূচি জানা, কোরআন তিলাওয়াত করা, রমজানের কর্মপরিকল্পনা সাজানো এবং ইফতার-সাহরির সময় জানা যায়। এ ছাড়া অ্যাপসের মাধ্যমে জাকাত ও সদকাতুল ফিতরের হিসাবও সহজে বের করা যায়।
আগে মানুষ রমজানে বিভিন্ন ধর্মীয় সভা-সমাবেশে যেতেন এবং দ্বিনি আলোচনা শুনতেন। কিন্তু এখন ইউটিউবের মতো সামাজিক মাধ্যমগুলো মানুষের সে প্রয়োজন পূরণ করছে।
হাতে লেখা ঈদ কার্ড মাহমুদ হাশেমির জন্য একটি সুখস্মৃতি। রমজান শেষে ঈদের সময় মানুষ পরিবার-পরিজন ও বন্ধুদের সঙ্গে হাতে লেখা ঈদ কার্ড বিনিময় করত। এখন মানুষ হোয়াটঅ্যাপ, ইমো ও ম্যাসেঞ্জারে ডিজিটাল শুভেচ্ছা বিনিময় করে। তাঁর ভাষায় ‘প্রিয়জনের কাছ থেকে ঈদ কার্ড পাওয়ার অনুভূতি কতই চমৎকার ছিল। তখন প্রিয়জন ও আত্মীয়-স্বজন কার্ড পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করত। মানুষ ঈদ কার্ডগুলো তাদের বসার ও শোয়ার ঘরে প্রদর্শন করত। এখন আপনার কাছে শুধু একটি ছবি ছাড়া আর কিছুই আসবে না।
মাহমুদ আহমেদ হাশেমি বলেন, আমাদের শৈশবে শুধু ঘরে তৈরি খাবার দিয়ে ইফতার ও সাহরি করা হতো। বড় জোর আশপাশের দোকান থেকে কোনো ইফতারসামগ্রী কিনে আনা হতো। ইফতার ও সাহরিতে পরিবারের সবাই একই খাবার খেত। কিন্তু দিন দিন অ্যাপসের মাধ্যমে নিজের পছন্দের খাবার অর্ডার করার প্রবণতা বাড়ছে। মাহমুদ হাশেমি তাঁর শৈশব ও কৈশোরের অনেক রমজান সংস্কৃতি হারিয়ে যাওয়া এবং তাতে পরিবর্তন আসায় দুঃখ প্রকাশ করেন।
মাহমুদ আহমেদ হাশেমির ছেলের নাম মিরাজ মোস্তফা হাশেমি। তিনি পাকিস্তানের ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির অধ্যাপক। তিনি বলেন, ডিজিটাল উদ্ভাবনগুলো যেমন মোবাইল অ্যাপ মানুষের দৈনন্দিন জীবনকে সহজ করেছে। একই সঙ্গে তা রমজানের ঐতিহ্যকেও লালন করে। ফুডপান্ডার মতো অ্যাপগুলো ঐতিহ্যবাহী ইফতার বাজারে উপস্থিত হওয়ার বিকল্প মাত্র। এর দ্বারা জনসাধারণ উপকৃত হচ্ছে, বিশেষত চাকরি ও অন্যান্য কারণে যাদের হাতে পর্যাপ্ত সময় থাকে তারা।
মিরাজ হাশেমি মনে করেন প্রযুক্তির উন্নয়ন সমাজের জন্য একটি ইতিবাচক পরিবর্তন নিয়ে এসেছে। কেননা তাঁর মতো বহু মানুষ যাদের বাজারে যাওয়ার ইচ্ছা থাকলেও সময়ের অভাবে তা হয়ে ওঠে না। এ ছাড়া ডিজিটাল প্ল্যাটফরমগুলো মানুষের জন্য সমাজসেবামূলক কর্মকাণ্ড এবং অন্যকে সহায়তা করার কাজকেও সহজ করেছে, যা পবিত্র রমজানের অন্যতম দাবি। তবে অতীতের কিছুদিন মিরাজ হাশেমির স্মৃতিতে সুখস্মৃতি হিসেবে ফিরে আসে। যখন আত্মীয়-স্বজনরা ভিডিও কলে কথা বলতে পারত না, তখন পারিবারিক ও সামাজিক অনুষ্ঠানে সবার সঙ্গে দেখা হতো, অনেক আনন্দের সময় কাটত। একইভাবে শৈশবে দাদা-দাদির সঙ্গে ঈদের কেনাকাটার স্মৃতিটাও ছিল বেশ আনন্দের।
অ্যারাব নিউজ অবলম্বনে
পবিত্র রমজান মাসের গুরুত্বপূর্ণ ইবাদতের মধ্যে ইতিকাফ অন্যতম। অতীতের নবী-রাসুলরাও ইতিকাফ করেছেন। কাবাগৃহ নির্মাণের পর মহান আল্লাহ ইবরাহিম (আ.) ও ইসমাঈল (আ.)-কে নির্দেশ দেন যেন তাঁরা ইতিকাফকারীদের জন্য তা (আল্লাহর ঘর) পরিষ্কার রাখেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘এবং আমি ইবরাহিম ও ইসমাঈলকে নির্দেশ দিয়েছি, তোমরা আমার ঘরকে সেসব লোকের জন্য পবিত্র করো, যারা (এখানে) তাওয়াফ করবে, ইতিকাফ করবে এবং রুকু ও সিজদা আদায় করবে।
রাসুল (সা.) মদিনায় হিজরতের পর প্রতি রমজানের শেষ ১০ দিন ইতিকাফ করেছেন। নবীপত্নীরাও নিজ নিজ ঘরে ইতিকাফ করতেন।
ইতিকাফের জন্য সর্বোত্তম স্থান হলো পবিত্র মসজিদুল হারাম। এরপর পবিত্র মসজিদে নববী।
(ইবনে মাজাহ, হাদিস : ১৪০৬)
প্রতিবছর রমজানে মক্কা ও মদিনায় ভিড় করেন বিশ্বের নানা প্রান্তের মুসল্লিরা।
নিম্নে তা নিয়ে আলোচনা করা হলো—
মসজিদুল হারাম ও মসজিদে নববীতে ইতিকাফের জন্য আগে থেকে নিবন্ধন করতে হয়। সাধারণত পঞ্চম রমজান থেকে অনলাইনে নিবন্ধন কার্যক্রম শুরু হয়।
eserv.wmn.gov.sa বা মোবাইল অ্যাপ Visitors ডাউনলোড করতে হবে। যেকোনো প্রাপ্তবয়স্ক মুসলিম পুরুষ ও নারীরা নিবন্ধন করতে পারবেন। এরপর সৌদি নাগরিকরা জাতীয় পরিচয়পত্র দিয়ে আর অন্যদের পাসপোর্ট বা ভিসা নম্বর দিয়ে রেজিস্ট্রেশন করতে হবে। রেজিস্ট্রেশন সম্পন্ন হলে ধাপে ধাপে প্রয়োজনীয় তথ্য দিয়ে আবেদন সম্পন্ন করতে হবে। এরপর মেইলে একটি কনফরমেশন মেসেজ যাবে। অতঃপর নির্দিষ্ট সময়ের পর ইতিকাফ কোড ও অনুমোদনপত্র পাওয়া যাবে। কোডটি মসজিদে অবস্থানকালে প্রয়োজন হয়। কারণ অনুমোদন পাওয়া সব মুসল্লির জন্য কোড অনুসারে একটি লকার বরাদ্দ থাকে। এতে মুসল্লিরা নিজেদের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র রাখতে পারেন।
মক্কা ও মদিনার পবিত্র দুই মসজিদবিষয়ক জেনারেল অথরিটির পক্ষ থেকে ইতিকাফের মুসল্লিদের জন্য বিভিন্ন সেবার ব্যবস্থা থাকে। নির্ধারিত স্থানে মুসল্লিদের থাকা-খাওয়া, প্রয়োজনীয় জিনিসের সুরক্ষার ব্যবস্থাসহ উন্নতমানের ব্যবস্থাপনা রয়েছে। মুসল্লিদের সুবিধার্থে বিশেষ সহায়তা ডেস্ক, ব্যক্তিগত জিনিসপত্র রাখার লকার, ফার্স্ট এইড সুবিধাসহ মেডিক্যাল ক্লিনিক, বহুভাষিক অনুবাদ সেবা এবং ধর্মীয় শিক্ষার ব্যবস্থা রয়েছে। তা ছাড়া ইফতার, রাতের খাবার, সাহরি এবং মোবাইল চার্জিং স্টেশনের সুবিধাও রয়েছে। প্রত্যেক মুসল্লিকে একটি কেয়ার কিট ও রিস্টব্যান্ড দেওয়া হয়েছে, যা তাদের চলাচল ও নির্ধারিত এলাকায় প্রবেশ সহজ করবে।
রমজানের শেষ সময়ে পবিত্র দুই মসজিদে মুসল্লিদের উপচে পড়া ভিড় রয়েছে। পবিত্র মসজিদুল হারামে গত ২৩ রমজান সারা দিনে ৩০ লাখেরও বেশি মুসল্লির উপস্থিতি ছিল। এদিকে পবিত্র মসজিদে নববীতে এবার ১২০টি দেশের চার হাজার পুুরুষ ও নারী মুসল্লি ইতিকাফে বসেছেন। তাঁদের মধ্যে পুরুষ মুসল্লিরা মসজিদের পশ্চিম দিকের ছাদের অংশে এবং নারী মুসল্লিরা উত্তর-পূর্ব অংশে অবস্থান করছেন। পুরুষরা ৬ ও ১০ নম্বর সিঁড়ি এবং নারীরা ২৪ ও ২৫ নম্বর দরজা দিয়ে নির্ধারিত স্থানে প্রবেশ করতে পারবেন।
সূত্র : অ্যারাব নিউজ ও আল-হারামাইন ওয়েবসাইট