ইসলামে সমাজব্যবস্থার মূল ভিত্তিই হলো আনুগত্য। নিরঙ্কুশ আনুগত্য ছাড়া পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র কোথাও শান্তি-শৃঙ্খলা আসে না। সর্বত্রই দেখা দেয় সীমাহীন অরাজকতা ও বিশৃঙ্খলা। অস্থির হয়ে ওঠে পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র ও বিশ্ব।
ইসলামে সমাজব্যবস্থার মূল ভিত্তিই হলো আনুগত্য। নিরঙ্কুশ আনুগত্য ছাড়া পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র কোথাও শান্তি-শৃঙ্খলা আসে না। সর্বত্রই দেখা দেয় সীমাহীন অরাজকতা ও বিশৃঙ্খলা। অস্থির হয়ে ওঠে পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র ও বিশ্ব।
এ আয়াতে ‘উলুল আমর’ বা নেতৃস্থানীয়দের আনুগত্যের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ‘উলুল আমর’ সেই সব ব্যক্তি, যারা মুসলিমসমাজের পরিচালক। আলেম-উলামা, ন্যায়সংগত শাসক, বিচারপতি এবং সর্দার-মাতব্বরসহ নেতা-সেনাপতি সবাই উলুল আমরের মধ্যে গণ্য।
আনুগত্যের সীমারেখা
ইসলাম আনুগত্যের সীমাহীন গুরুত্ব দেওয়ার পাশাপাশি তার সীমারেখাও টেনে দিয়েছে মজবুতভাবে।
১. ইসলামবিরোধী কাজে কারো আনুগত্য নয়
আমির বা নেতার আদেশ ততক্ষণ মানা যাবে, যতক্ষণ তিনি ইসলামের সীমার ভেতর থাকেন। ইসলামবিরোধী কাজে কারো আনুগত্যের সুযোগ নেই। এ ব্যাপারে নবীজি (সা.) বলেন, ‘নিজেদের নেতৃবৃন্দের কথা শোনা ও মেনে চলা মুসলমানদের জন্য অপরিহার্য, তা তার পছন্দ হোক বা না হোক, যে পর্যন্ত না তাকে গুনাহ ও নাফরমানির হুকুম দেওয়া হয়। আর যখন তাকে নাফরমানির হুকুম দেওয়া হয়, তখন তার সে হুকুম শোনা ও আনুগত্য করার অবকাশ নেই। (বুখারি, হাদিস : ৭১৪৪; মুসলিম, হাদিস : ১৮৪৯)
২. আনুগত্যের মানদণ্ড দ্বিনদারি ও যোগ্যতা : আনুগত্যের প্রশ্নে ইসলাম ব্যক্তি বা বংশকে প্রাধান্য দেয়নি।
৩. অন্ধ অনুকরণ নিষিদ্ধ : বিবেক-বুদ্ধি বিসর্জন দিয়ে কোনো কিছুর অন্ধ অনুকরণ ইসলামে অনুমোদিত নয়। ইরশাদ হয়েছে, ‘যখন তাদের বলা হয়, এসো আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন তার দিকে এবং রাসুলের দিকে। তারা বলে, আমরা আমাদের পূর্বপুরুষদের যার ওপর পেয়েছি তা-ই আমাদের জন্য যথেষ্ট। যদিও তাদের পূর্বপুরুষরা কিছু না জানে এবং সুপথপ্রাপ্ত না হয়, তার পরও তারা তাদের অনুসরণ করবে?’ (সুরা মায়িদা, আয়াত : ১০৪)
আনুগত্যহীনতার কারণ : আনুগত্যহীনতার কিছু কারণ আছে। যেমন—(১) আখিরাতের তুলনায় দুনিয়ার জীবনকে অগ্রাধিকার দেওয়া। (২) আনুগত্যের গুরুত্ব সম্পর্কে অজ্ঞতা। (৩) গর্ব ও অহংকার। (৪) হিংসা ও বিদ্বেষ। (৫) সিনিয়রিটি জুনিয়রিটি মনোভাব (৬) মেজাজের ভারসাম্যহীনতা। (৭) পদের প্রতি মোহ। (৮) দায়িত্বশীল পছন্দ না হওয়া। (৯) দায়িত্বশীলের সঙ্গে তিক্ত সম্পর্ক। (১০) দায়িত্বশীলের ব্যাপারে সন্দেহ প্রবণতা। (১১) নিজের মতামতের কোরবানি করতে না পারা। (১২) হূদয়ের বক্রতা। (১৩) মাত্রাতিরিক্ত প্রশ্ন করার প্রবণতা। (১৪) নিজেকে অন্যের চেয়ে যোগ্য মনে করা। (১৫) সুযোগ সন্ধানী/ জাগতিক লাভের মনোভাব, ইত্যাদি।
লেখক : ইমাম, খতিব ও মুহাদ্দিস
সম্পর্কিত খবর
আয়াতের অর্থ : ‘তারা আল্লাহর পরিবর্তে এমন কিছুর ইবাদত করে, যা তাদেরকে উপকার করতে পারে না এবং তাদের অপকারও করতে পারে না, কাফির তো স্বীয় প্রতিপালকের বিরোধী। আমি তোমাকে কেবল সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপেই প্রেরণ করেছি। বলো, আমি তোমাদের কাছে এর জন্য কোনো প্রতিদান চাই না, তবে যে ইচ্ছা করে সে তার প্রতিপালকের দিকের পথ অবলম্বন করুক। তুমি নির্ভর করো তাঁর ওপর, যিনি চিরঞ্জীব, যিনি মরবেন না এবং তাঁর সপ্রশংস পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করো...।
আয়াতগুলোতে দ্বিনি কাজের প্রতিদান ও তাওয়াক্কুলের আলোচনা করা হয়েছে।
শিক্ষা ও বিধান
১. আয়াত দ্বারা বোঝা যায়, মুমিনের জন্য উপকার লাভের মতো ক্ষতি থেকে আত্মরক্ষা করা আবশ্যক।
২. মানুষের সুপথপ্রাপ্তিতে দ্বিনের পথে আহ্বানকারী এত খুশি হয়, যেন এটাই তার আত্মত্যাগের প্রতিদান।
৩. তাওয়াক্কুল হলো দ্বিধাহীন আস্থার সঙ্গে নিজের সব বিষয় আল্লাহর ওপর ন্যস্ত করা।
৪. তাওয়াক্কুলের নির্দেশ দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হামদ ও তাসবিহ পাঠের নির্দেশ দেওয়া হয়ছে। এতে ইঙ্গিত মেলে জিকির আল্লাহর প্রতি বান্দার আস্থা দৃঢ় করে।
৫. আস্থা ও ভরসার প্রকৃত স্থল কেবল আল্লাহ তাআলা, কেননা তিনি ছাড়া অন্য সব কিছু ধ্বংসশীল ও দুর্বল এবং তাঁর করুণার মুখাপেক্ষী।
(আত-তাহরির ওয়াত-তানভির : ১৯/৫৬)
উচ্চারণ : লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার, ওয়া লা-হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ।
অর্থ : আল্লাহ তাআলা ছাড়া কোনো উপাস্য নেই, আল্লাহ সুমহান, আল্লাহর সাহায্য ছাড়া পাপ মুক্তির কোনো পথ নেই, আল্লাহর সাহায্য ছাড়া ইবাদতের কোনো শক্তি নেই।
সূত্র : আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুল (সা.) বলেছেন, পৃথিবীর বুকে যে ব্যক্তি বলে, ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার, ওয়া লা-হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ’ তার অপরাধগুলো ক্ষমা করে দেওয়া হয়, যদিও তা সাগরের ফেনারাশির মতো (বেশি পরিমাণ) হয়। (তিরমিজি, হাদিস : ৩৪৬০)
।
এমন ব্যক্তিকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ কোরো, যে ক্ষুব্ধ হলেও তোমার দুর্নাম বলে না।
—সুফিয়ান সাওরি (রহ.)
।
সৎকাজে আদেশ ও অসৎ কাজে নিষেধ—এটি উম্মতের দায়িত্ব। এই দায়িত্বের মাধ্যমেই মহান আল্লাহ উম্মতকে শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমরাই হলে সর্বোত্তম উম্মত, যাদেরকে মানুষের জন্য বের করা হয়েছে। তোমরা ভালো কাজের আদেশ দেবে এবং মন্দ কাজ থেকে বারণ করবে, আর আল্লাহর প্রতি ঈমান পোষণ করবে।
(সুরা : আলে ইমরান, আয়াত : ১১০)
সাধ্যমতো অন্যায়ের প্রতিবাদ করা প্রত্যেক মুসলমানের ঈমানি দায়িত্ব। রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘তোমাদের মধ্যে যেকোনো অন্যায়কারীকে দমনে সে যেন হাত দিয়ে প্রতিরোধ করে, যদি তা করতে না পারে তবে সে যেন মুখ দিয়ে প্রতিহত করে। যদি সে মুখ দিয়েও না পারে তাহলে যেন অন্তর দিয়ে ঘৃণা পোষণ করে; আর এটাই দুর্বল ঈমানের পরিচয়।’ (বুখারি)
সময়মতো যদি অন্যায়ের প্রতিবাদ করা না হয়, তাহলে এর ফল গোটা জাতিকে ভোগ করতে হয়।
কিন্তু আমাদের সমাজে এখন আর অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে অনেকে আগ্রহ দেখায় না। চোখের সামনে ঘটে যাওয়া হাজারো অন্যায়কে ঠাণ্ডা মাথায় এড়িয়ে চলে। অন্যায়ের প্রতিবাদকে তারা অযথা ঝামেলায় জড়ানোই মনে করে।
রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘মানুষ যখন কোনো অত্যাচারীকে দেখেও অন্যায় থেকে তার হাতকে প্রতিরোধ করবে না, শিগগিরই আল্লাহ তাদের সবার ওপর ব্যাপক আজাব নাজিল করবেন।’ (তিরমিজি ও আবু দাউদ)
সমাজ থেকে অপরাধ নির্মূল করতে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করার কোনো বিকল্প নেই। একটা সমাজে অপরাধ তখনই বেড়ে যায়, যখন অপরাধী বারবার অপরাধ করে পার পেয়ে যায়। তাই মহান আল্লাহ সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার প্রতি অধিক গুরুত্ব দিয়েছেন।
এই আয়াতে মহান আল্লাহ তাআলা তাঁর প্রিয় বান্দাদের বিচারের ক্ষেত্রে কোনো ধরনের আত্মীয়তা, ধন-সম্পদ কিংবা ব্যক্তিগত স্বার্থের প্রভাব থেকে মুক্ত থাকতে নির্দেশ দিয়েছেন। কারণ এগুলোও অন্যায়কে প্রশ্রয় দিতে প্রলুব্ধ করে।