ঈমানের পর মুসলমানের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত হলো নামাজ। মুসলমানের জন্য সর্বাবস্থায় নামাজ আদায় করা ফরজ। কারাগারে বন্দি ব্যক্তিও নামাজের বিধানের বাইরে নয়। আলোচ্য প্রবন্ধে বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করা হলো।
ঈমানের পর মুসলমানের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত হলো নামাজ। মুসলমানের জন্য সর্বাবস্থায় নামাজ আদায় করা ফরজ। কারাগারে বন্দি ব্যক্তিও নামাজের বিধানের বাইরে নয়। আলোচ্য প্রবন্ধে বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করা হলো।
নামাজ সর্বাবস্থায় ফরজ
নামাজ শরিয়তের এমন একটি বিধান, যা সর্বাবস্থায় মুকাল্লাফ (শরিয়তের বিধান প্রযোজ্য এমন) ব্যক্তির ওপর ফরজ। চাই সে সুস্থ হোক বা অসুস্থ, নিরাপদে থাকুক বা বিপদগ্রস্ত, বাড়িতে থাকুক বা সফরে, নিরাপদে থাকুক বা যুদ্ধে। ব্যক্তির যতক্ষণ হুঁশ-জ্ঞান ঠিক থাকে ততক্ষণ তার জন্য নামাজ আদায় করা আবশ্যক। মহান আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা নামাজের প্রতি যত্নবান হবে, বিশেষত মধ্যবর্তী নামাজের এবং আল্লাহর উদ্দেশ্যে তোমরা বিনীতভাবে দাঁড়াবে; যদি তোমরা আশঙ্কা করো তবে পদচারী অথবা আরোহী অবস্থায় নামাজ আদায় করবে।
ইমরান ইবনুল হুসাইন (রা.) বলেন, ‘আমার পাঁজরে ব্যথাজনিত রোগ ছিল। আমি নবী (সা.)-কে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বললেন, তুমি দাঁড়িয়ে নামাজ আদায় করবে, তাতে সক্ষম না হলে বসে আদায় করবে এবং তাতেও সক্ষম না হলে শুয়ে সালাত আদায় করবে।’
(সুনানে আবু দাউদ, হাদিস : ৯৫২)
বন্দি ব্যক্তির নামাজের বিধান
শরিয়তের আলোকে বন্দি ব্যক্তির নামাজের বিধান বর্ণনা করা হলো—
১. অজু, কিবলা ও দাঁড়ানোর বিধান : ফকিহ আলেমরা বলেন, অপারগতার সময় নামাজের শর্ত ও রোকনগুলো স্থগিত হয়ে যায়।
(সুরা : হজ, আয়াত : ৭৮)
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘আমি যখন তোমাদের কোনো বিষয়ে আদেশ দিই, তখন তোমরা সাধ্যানুযায়ী তা আদায় করবে।’
(সহিহ বুখারি, হাদিস : ৭২৮৮)
সুতরাং কেউ যদি জেলে কিবলা নির্ধারণ করতে না পারে, তবে সে মনের সাক্ষ্যের ভিত্তিতে যেকোনো দিকে নামাজ আদায় করবে। দাঁড়াতে না পারলে বসে এবং বসে না পারলে ইশারায় নামাজ আদায় করবে।
(ফাতাওয়ায়ে হিন্দিয়া : ১/৩৪৩; রদ্দুল
মুহতার : ১/২৪৩)
২. কসরের বিধান : আটক ব্যক্তিকে যদি নিজ শহরে বন্দি রাখা হয়, তবে সে মুকিম ব্যক্তির মতো পূর্ণ নামাজ আদায় করবে। চাই তাকে যত অল্প সময়ের জন্য বন্দি করা হোক না কেন। আর তাকে যদি সফর পরিমাণ দূরত্বে তথা ৪৮ মাইল দূরের কোনো স্থানে ১৫ দিনের কম সময়ের জন্য বন্দি রাখা হয়, তবে সে কসর আদায় করবে। যে বন্দি তার জেলজীবনের মেয়াদ সম্পর্কে জানে না, সে তার প্রবল ধারণা অনুযায়ী আমল করবে। অর্থাত্ যদি তার ধারণা হয়, ১৫ দিনের কম সময়ে মুক্তি বা জামিন পাবে, সে কসর পড়বে। আর এর থেকে অধিক সময় বন্দি থাকার সম্ভাবনা থাকলে মুকিমের মতো নামাজ আদায় করবে।
(আদ দুররুল মুখতার : ২/১৩২)
৩. জুমা ও ঈদের নামাজ : বন্দি ব্যক্তির ওপর জুমা ও ঈদের নামাজ ওয়াজিব নয়। সে জেলে জুমার পরিবর্তে জোহরের নামাজ আদায় করবে। তবে জেলখানায় যদি জুমা ও ঈদের নামাজের ব্যবস্থা করা হয়, তবে বন্দি ব্যক্তির তাতে অংশ নেওয়ার অবকাশ আছে। জেলখানায় অনুষ্ঠিত জুমা ও ঈদের নামাজে অংশ না নেওয়ারও অবকাশ আছে। তবে অংশ নেওয়াটাই উত্তম। (আদ দুরার আমার রদ : ১/২৮ ও ৩২ এবং ২/১০০)
তবে বন্দি ব্যক্তি সামর্থ্যবান (শরয়ি নিসাবের মালিক) ও মুকিম হলে তার ওপর কোরবানি ওয়াজিব হবে। সে চাইলে জেলখানা বা তার বাইরে কোরবানি করতে পারবে। একইভাবে বন্দি ব্যক্তি নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হলে তার ওপর সদকাতুল ফিতর ওয়াজিব, যা সে জেলের ভেতরে বা বাইরে হকদার ব্যক্তিকে অর্পণ করতে পারবে। (রদ্দুল মুহতার : ৬/৩১২)
৪. বন্দি ব্যক্তির ইমামতি : বন্দিত্ব ইমামতির জন্য কোনো বাধা নয়। জেলে বন্দি ব্যক্তি বন্দি ও মুক্ত উভয় শ্রেণির মানুষের ইমামতি করতে পারবে। কোনো বন্দি ইমামতি করলে জেলখানার কর্মীরা তার পেছনে নামাজ আদায় করতে পারবে। শর্ত হলো তার ভেতরে ইমামতির শর্তগুলো বিদ্যমান থাকা। তা হলো নামাজের মাসলা-মাসায়েল জানা, কোরআন তিলাওয়াত শুদ্ধ থাকা, প্রকাশ্য কবিরা গুনাহ থেকে বেঁচে থাকা। ধারাবাহিকভাবে এসব বিষয়ে যে যত বেশি অগ্রগামী হবে সে ইমামতির জন্য তত বেশি যোগ্য বিবেচিত হবে। (ফাতাওয়া শামি : ১/৫৫৭)
তবে জেলখানায় যদি কোনো ইমাম নিযুক্ত থাকেন এবং তাঁর ভেতরে ইমামতির গুণাবলি পাওয়া যায়, তবে নির্ধারিত ইমামই নামাজের ইমামতি করবেন। কেননা শরিয়তের আলোকে মসজিদের নির্ধারিত ইমামই ইমামতির হকদার। তাই ইমামতির উপযুক্ত নির্ধারিত ইমামের উপস্থিতিতে তাঁর অনুমতি ছাড়া অন্য কারো ইমামতি করা শরিয়তসম্মত নয়। অনুমতিবিহীন ইমামতি করলে নামাজ আদায় হয়ে গেলেও তিনি গুনাহগার হবেন। (মুসলিম, হাদিস : ৬৭৩; বাদায়িউস সানায়ে : ১/১৫৮)
৫. জানাজা নামাজ : জানাজার নামাজ ফরজে কেফায়া। যেকোনো একদল মানুষ তা পড়লে সবার পক্ষ থেকে তা আদায় হয়ে যায়। সুতরাং কারাবন্দি ব্যক্তির ওপর জানাজার নামাজ ফরজ নয়। তবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তাকে অনুমতি দিলে সে তাতে জানাজার নামাজে অংশ নিতে পারবে। জেলখানায় যদি কোনো মুসলমান মারা যায় এবং জানাজা পড়ার মতো অন্য কোনো মুসলমান না থাকে, তবে সুযোগ পেলে বন্দি মুসলমানের জন্য জানাজা পড়া আবশ্যক।
(আদ দুররুল মুখতার : ১/৫১৭)
আল্লাহ সবাইকে দ্বিনের সঠিক বুঝ দান করুন। আমিন।
সম্পর্কিত খবর
আয়াতের অর্থ : ‘তারা আল্লাহর পরিবর্তে এমন কিছুর ইবাদত করে, যা তাদেরকে উপকার করতে পারে না এবং তাদের অপকারও করতে পারে না, কাফির তো স্বীয় প্রতিপালকের বিরোধী। আমি তোমাকে কেবল সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপেই প্রেরণ করেছি। বলো, আমি তোমাদের কাছে এর জন্য কোনো প্রতিদান চাই না, তবে যে ইচ্ছা করে সে তার প্রতিপালকের দিকের পথ অবলম্বন করুক। তুমি নির্ভর করো তাঁর ওপর, যিনি চিরঞ্জীব, যিনি মরবেন না এবং তাঁর সপ্রশংস পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করো...।
আয়াতগুলোতে দ্বিনি কাজের প্রতিদান ও তাওয়াক্কুলের আলোচনা করা হয়েছে।
শিক্ষা ও বিধান
১. আয়াত দ্বারা বোঝা যায়, মুমিনের জন্য উপকার লাভের মতো ক্ষতি থেকে আত্মরক্ষা করা আবশ্যক।
২. মানুষের সুপথপ্রাপ্তিতে দ্বিনের পথে আহ্বানকারী এত খুশি হয়, যেন এটাই তার আত্মত্যাগের প্রতিদান।
৩. তাওয়াক্কুল হলো দ্বিধাহীন আস্থার সঙ্গে নিজের সব বিষয় আল্লাহর ওপর ন্যস্ত করা।
৪. তাওয়াক্কুলের নির্দেশ দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হামদ ও তাসবিহ পাঠের নির্দেশ দেওয়া হয়ছে। এতে ইঙ্গিত মেলে জিকির আল্লাহর প্রতি বান্দার আস্থা দৃঢ় করে।
৫. আস্থা ও ভরসার প্রকৃত স্থল কেবল আল্লাহ তাআলা, কেননা তিনি ছাড়া অন্য সব কিছু ধ্বংসশীল ও দুর্বল এবং তাঁর করুণার মুখাপেক্ষী।
(আত-তাহরির ওয়াত-তানভির : ১৯/৫৬)
উচ্চারণ : লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার, ওয়া লা-হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ।
অর্থ : আল্লাহ তাআলা ছাড়া কোনো উপাস্য নেই, আল্লাহ সুমহান, আল্লাহর সাহায্য ছাড়া পাপ মুক্তির কোনো পথ নেই, আল্লাহর সাহায্য ছাড়া ইবাদতের কোনো শক্তি নেই।
সূত্র : আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুল (সা.) বলেছেন, পৃথিবীর বুকে যে ব্যক্তি বলে, ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার, ওয়া লা-হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ’ তার অপরাধগুলো ক্ষমা করে দেওয়া হয়, যদিও তা সাগরের ফেনারাশির মতো (বেশি পরিমাণ) হয়। (তিরমিজি, হাদিস : ৩৪৬০)
।
এমন ব্যক্তিকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ কোরো, যে ক্ষুব্ধ হলেও তোমার দুর্নাম বলে না।
—সুফিয়ান সাওরি (রহ.)
।
সৎকাজে আদেশ ও অসৎ কাজে নিষেধ—এটি উম্মতের দায়িত্ব। এই দায়িত্বের মাধ্যমেই মহান আল্লাহ উম্মতকে শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমরাই হলে সর্বোত্তম উম্মত, যাদেরকে মানুষের জন্য বের করা হয়েছে। তোমরা ভালো কাজের আদেশ দেবে এবং মন্দ কাজ থেকে বারণ করবে, আর আল্লাহর প্রতি ঈমান পোষণ করবে।
(সুরা : আলে ইমরান, আয়াত : ১১০)
সাধ্যমতো অন্যায়ের প্রতিবাদ করা প্রত্যেক মুসলমানের ঈমানি দায়িত্ব। রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘তোমাদের মধ্যে যেকোনো অন্যায়কারীকে দমনে সে যেন হাত দিয়ে প্রতিরোধ করে, যদি তা করতে না পারে তবে সে যেন মুখ দিয়ে প্রতিহত করে। যদি সে মুখ দিয়েও না পারে তাহলে যেন অন্তর দিয়ে ঘৃণা পোষণ করে; আর এটাই দুর্বল ঈমানের পরিচয়।’ (বুখারি)
সময়মতো যদি অন্যায়ের প্রতিবাদ করা না হয়, তাহলে এর ফল গোটা জাতিকে ভোগ করতে হয়।
কিন্তু আমাদের সমাজে এখন আর অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে অনেকে আগ্রহ দেখায় না। চোখের সামনে ঘটে যাওয়া হাজারো অন্যায়কে ঠাণ্ডা মাথায় এড়িয়ে চলে। অন্যায়ের প্রতিবাদকে তারা অযথা ঝামেলায় জড়ানোই মনে করে।
রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘মানুষ যখন কোনো অত্যাচারীকে দেখেও অন্যায় থেকে তার হাতকে প্রতিরোধ করবে না, শিগগিরই আল্লাহ তাদের সবার ওপর ব্যাপক আজাব নাজিল করবেন।’ (তিরমিজি ও আবু দাউদ)
সমাজ থেকে অপরাধ নির্মূল করতে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করার কোনো বিকল্প নেই। একটা সমাজে অপরাধ তখনই বেড়ে যায়, যখন অপরাধী বারবার অপরাধ করে পার পেয়ে যায়। তাই মহান আল্লাহ সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার প্রতি অধিক গুরুত্ব দিয়েছেন।
এই আয়াতে মহান আল্লাহ তাআলা তাঁর প্রিয় বান্দাদের বিচারের ক্ষেত্রে কোনো ধরনের আত্মীয়তা, ধন-সম্পদ কিংবা ব্যক্তিগত স্বার্থের প্রভাব থেকে মুক্ত থাকতে নির্দেশ দিয়েছেন। কারণ এগুলোও অন্যায়কে প্রশ্রয় দিতে প্রলুব্ধ করে।