টাঙ্গুয়ার হাওরপারের গ্রাম জয়পুরের কৃষক আলমগীর বাড়ির পেছনের বাগমারা জলমহাল দেখিয়ে বললেন, ‘আমরা ছোটবেলা তনে দেখছি, টাঙ্গুয়ার আশপাশে বহুত জাগা গভীর আছিল। ই গভীর এখন বান্দের মাইট্যে ভরি গেছে। আগে পানি থাকত। অনে গরু ঘাস খায়, আমরার বাচ্চাকাইচ্চারা খেলে।
’ টাঙ্গুয়ার হাওরের মিঠাপানির মাছের আধার ঐতিহ্যবাহী বিল চোখের সামনে হারিয়ে যেতে দেখে এই কৃষকের কণ্ঠে আফসোস ঝরে। শুধু বাগমারা খালই নয়, ছড়ার বিলসহ অন্তত ১০টি বিল হারিয়ে যাওয়ার পথে।
বিশ্ব ঐতিহ্য টাঙ্গুয়ার হাওর সুন্দরবনের পর বাংলাদেশের দ্বিতীয় রামসার সাইট। মাদার ফিশারিজ হিসেবে পরিচিত দেশের ছয়টি স্পটের একটি এই হাওর।
‘নয়কুড়ি কান্দার ছয় কুড়ি বিল’ এই প্রবাদটি টাঙ্গুয়ার হাওরের বিপুল মৎস্য সম্পদের ঐতিহ্যের আধার জলাশয় এবং উদ্ভিদবৈচিত্র্যের আধার কান্দার প্রতিনিধিত্ব করত। মাছের সঙ্গে নানা প্রজাতির জলজ-স্থলজ জীববৈচিত্র্যেরও বাস্তুসংস্থান ছিল বিল-কান্দায়। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণ ও অপরিকল্পিত ফসলরক্ষা বাঁধের মাটিতে এখন ভরাট হয়ে ‘নয় কুড়ি’ বিলের হাওরটি সংকটে। জলাশয়গুলো শুকিয়ে এখন গোচারণ ভূমিতে পরিণত হয়েছে। চোখের সামনে উজাড় হচ্ছে কান্দা।
আইইউসিএনের ‘বায়োডাইভারসিটি অব টাঙ্গুয়ার হাওর : এ রামসার সাইট অব বাংলাদেশ’ দ্বিতীয় ভলিয়ামে বলা হয়েছে, টাঙ্গুয়ার হাওরে প্রায় ৫৪টি বিল (জলাশয়) ছিল। সূত্র মতে, টাঙ্গুয়ার হাওরের জলাশয়ের সম্মিলিত আয়তন প্রায় তিন হাজার ৬৫১.৮৭ হেক্টর। সর্বশেষ জরিপে বাফার জোনে ৪০টি ও কোর জোনে ৯টি জলাশয়ের উল্লেখ রয়েছে। সূত্র মতে, টাঙ্গুয়ার হাওরের মোট আয়তন ১৬০ বর্গ কিলোমিটার।
এর মধ্যে দুই হাজার ৮০২.৩৬ হেক্টরই স্থায়ী জলাশয় বা বিল। এখনো টাঙ্গুয়ার হাওর দক্ষিণ এশিয়ার ‘গুরুত্বপূর্ণ’ জলাভূমি হিসেবে বিবেচিত। আইইউসিএনের জরিপে এই হাওরে ১০৮টি কান্দা রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছিল।
সূত্র জানায়, ১৯৯৭ সালের এক জরিপে টাঙ্গুয়ার হাওরের বিলগুলোতে ৩৫ পরিবারের ১৪১ জাতের মাছ পাওয়া গিয়েছিল। দেশের মিঠাপানির মাছের অর্ধেক আছে এই হাওরটিতে। ছিল বিপন্ন মহাশোল মাছও। আলমের ডোহার নামের জলাশয়টি চিতল মাছের জন্য বিখ্যাত ছিল।
গত ২৪ ফেব্রুয়ারি টাঙ্গুয়ার হাওর সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে পাটলাই নদীর দুই তীরে জাঙ্গাল কেটে হাওরের ফসলক্ষা বাঁধের মাটি কাটা হচ্ছে। কোথাও কোথাও মাটি কেটে খালের রূপ পেয়েছে কান্দা। কোথাও জমির রূপ পেয়েছে। অবাধে মাটি কাটার ফলে কান্দার মূল্যবান নানা প্রজাতির উদ্ভিদও বিলুপ্ত হচ্ছে। কমে যাচ্ছে গবাদিপশুর বিচরণস্থল ও উদ্ভিদবৈচিত্র্যের বাস্তুসংস্থান।
বাগমারা গ্রুপ জলমহালে গিয়ে দেখা যায়, কান্দার পশ্চিম-পূর্ব দিকের জলাশয় শুকিয়ে গেছে। বকের দল খাবার খাচ্ছে। জলাশয়ের পূর্বের অংশে গবাদিপশু চরছে। নারীরা লাকড়ি কুড়াচ্ছে। ভেসে উঠছে বর্ষায় মাছধরার কিরণমালা ছাই। টানেরগুল, মাঝেরগুল, লামারগুল বিলও শুকিয়ে গেছে। এগুলোর পাশাপাশি রাঙামাটি, সমসাগর, এরাইল্যাকুনা, নাইন্দা, সংসা, ছড়ার বিলও শুকিয়ে গেছে। বেরবেরিয়া বাগমারা বিলের আরো কয়েকটি গ্রুপ বিলও বিপন্ন।
হাওরের লামাগাঁও, ভবানীপুর, শ্রীলাইন তাহিরপুর, জয়পুর, মন্দিআতা, গোলাবাড়িসহ বিভিন্ন এলাকার অধিকাংশ কান্দাই উজাড় হয়ে গেছে। জয়পুর গ্রামের কৃষক মো. নূরুল আমিন বলেন, এমন দিনও আসবে, হাওর ও জলাশয় খনন করা লাগবে। একই গ্রামের কৃষক মনির উদ্দিন বলেন, ‘বিল চর অইগেছে। অনে পাখিও নাই মাছও নাই। বাঁধ দেওয়ানে বিল চর অইগিছে।’ একই গ্রামের আবুল কালাম বলেন, ‘আস্তে আস্তে জাঙ্গাল কমতাছে। হাউরোর বান্দে মাটি কাইট্যা জাঙ্গাল শেষ হয়ে যাচ্ছে। গাছ কমতাছে, পাখি কমতাছে।’
পরিবেশকর্মী শাহ কামাল বলেন, নদীর নাব্য কমে পলিমিশ্রিত পানি হাওরে ঢুকে ভরাট হয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে হাওরের ভৌগোলিক অবস্থা ও প্রতিবেশ বিবেচনায় না নিয়ে বাঁধ নির্মাণও এই ক্ষতির কারণ। সুনামগঞ্জ পরিবেশ আন্দোলনের সহসভাপতি সাইফুল আলম সদরুল বলেন, কুগ মিশন পরিকল্পনার অংশ হিসেবে গঠিত পানি উন্নয়ন বোর্ড পরবর্তী সময়ে যত বাঁধ, স্লুইস গেইট, হাওর রক্ষা বাঁধ কার্যক্রম বাস্তবায়ন করেছে, সবখানে প্রাকৃতিক বিপর্যয় ডেকে এনেছে।
প্রাণবৈচিত্র্য গবেষক পাভেল পার্থ বলেন, হাওর-জলাশয়-নদী ভরাট হওয়ার দুইটি কারণ। একটি কারণ অভ্যন্তরীণ। এটা পাউবোর বাঁধের ফলে। আরেকটি কারণ আন্তরাষ্ট্রীয়। ভারতের মেঘালয়ের পাশে অবস্থিত হওয়ায় পলি-বালির স্তূপও আসছে। তাই আন্তরাষ্ট্রিক সংলাপের মাধ্যমে এই সমস্যার সমাধান করতে হবে।
তাহিরপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আবুল হাসেম বলেন, ফসলরক্ষার প্রয়োজনে হাওরের কান্দা থেকে কিছু মাটি নেওয়া হয়। যদিও নীতিমালা অনুযায়ী টাঙ্গুয়ার হাওরে এমন কিছু করা উচিত নয়। তবে বিল ও নদী ভরাটের বিষয়টি তিনি স্বীকার করেন।