স্বাস্থ্য খাতে বড় পরিবর্তন আসছে। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাবিত ‘৫ম স্বাস্থ্য, জনসংখ্যা ও পুষ্টি কর্মসূচি (৫ম এইচপিএনএসপি) বাদ যাচ্ছে। এর মধ্য দিয়ে এক লাখ ছয় হাজার কোটি টাকার কর্মসূচিও থাকছে না। এই কর্মসূচিতে সরকারের নিজস্ব অর্থায়ন ছিল ৮০ হাজার ৬৮৫ কোটি টাকা।
আর ২৫ হাজার ৪১৫ কোটি টাকা বিদেশি ঋণ ও অনুদান থেকে প্রাক্কলন করা হয়েছিল। প্রস্তাবটি বাতিল করার ফলে স্বাস্থ্যসেবা উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনার জন্য সেক্টর প্রগ্রামের সমাপ্তি ঘটবে, যা গত ২৭ বছর ধরে চালু ছিল।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী অধ্যাপক মো. সায়েদুর রহমানের সভাপতিত্বে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত সাতটি উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকের পর স্বাস্থ্যের এই বৃহত্ কর্মসূচি নিয়ে অগ্রসর না হওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে আরো জানা যায়, আগামী দুই বছরের জন্য প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা প্রদান বজায় রাখতে চায় সরকার। একই সঙ্গে গত বছরের জুনে শেষ হওয়া চতুর্থ স্বাস্থ্য, জনসংখ্যা ও পুষ্টি কর্মসূচির অসমাপ্ত মূল কাজগুলোও সম্পন্ন করা হবে। পাশাপাশি নতুন কর্মসূচির ঘাটতি পূরণ করতে তিনটি পৃথক নতুন প্রকল্প প্রণয়ন এবং অনুমোদন দ্রুত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকে।
সূত্র জানায়, সরকার ১৯৯৮ সালে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে ১২৬টি প্রকল্প একীভূত করে স্বাস্থ্য ও জনসংখ্যা খাত কর্মসূচি (এইচপিএসপি) চালু করে, যার লক্ষ্য ছিল স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়নে সমন্বয় বৃদ্ধি করা এবং উন্নয়ন অংশীদারদের কাছ থেকে খাতভিত্তিক ঋণ ও অনুদানের প্রাপ্তি সহজতর করা।
২০০৩ সালে প্রথম কর্মসূচি সম্পন্ন হয়, দ্বিতীয় খাত কর্মসূচি (এইচপিএসপি) ২০০৩ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত বাস্তবায়িত হয়, এরপর তৃতীয় (এইচপিএসপি) ২০১১ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত বাস্তবায়িত হয়। চতুর্থ কর্মসূচি (৪র্থ এইচপিএসপি) মূলত জানুয়ারি ২০১৭ থেকে জুন ২০২২ পর্যন্ত পরিকল্পনা করা হয়েছিল এবং পরে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছিল, যা এখন শেষ হয়েছে।
স্বাস্থ্যের এই বৃহত্ কর্মসূচির ধারাবাহিকতা বজায় রাখার জন্য মন্ত্রণালয়ের অধীন স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ ২০২২ সালের মাঝামাঝি সময়ে পঞ্চম পর্যায় প্রণয়ন শুরু করে এবং গত বছরের মে মাসে এটি পরিকল্পনা কমিশনে পাঠায়। কমিশনের আর্থ-সামাজিক অবকাঠামো বিভাগ এই কর্মসূচির অধীনে ৩৮টি কার্যকরী পরিকল্পনা (ওপি) মূল্যায়নের জন্য তিন মাস ধরে ৬০টি প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভা করে। পর্যালোচনা শেষে কমিশন প্রস্তাবিত কর্মসূচি বাস্তবায়নের পর একটি বহির্গমন পরিকল্পনা প্রণয়নসহ অসংখ্য সুপারিশসহ প্রস্তাবটি ফেরত দেয়।
তবে কর্মসূচির অনুমোদনের আগে বহির্গমন পরিকল্পনা চূড়ান্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দেশের স্বাস্থ্যসেবা উন্নয়ন ব্যবস্থাপনা ১৯৯৮-পূর্ববর্তী অবস্থায় ফিরে যাচ্ছে।
১৯৯০-এর দশকের শেষের দিকে বাংলাদেশ প্রথম প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচি (পিইডিপি-১) চালু করার মাধ্যমে একটি খাতভিত্তিক উন্নয়ন পদ্ধতির সূচনা করে। দাতাদের সুপারিশকৃত এই ভিত্তির ওপর ভিত্তি করে মন্ত্রণালয়গুলো মাধ্যমিক শিক্ষা, উচ্চশিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে কর্মসূচি চালু করে। তবে এই নিবেদিতপ্রাণ কর্মসূচি সত্ত্বেও মন্ত্রণালয়গুলো প্রতিটি খাতের জন্য অ্যাডহক ভিত্তিতে প্রকল্প প্রস্তাব জমা দিতে শুরু করে এবং সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এই প্রবণতা তীব্রতর হয়েছে।
পরিকল্পনা কমিশনের কর্মকর্তাদের মতে, খাতভিত্তিক কর্মসূচি এবং পৃথক প্রকল্পের সমন্বয় পদ্ধতিতে দ্বৈততা তৈরি করেছে, যার ফলে অনুমোদনপ্রক্রিয়ায় ব্যাঘাত ঘটেছে। সংশোধিত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (আরএডিপি) চলতি অর্থবছরে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের জন্য ২৬ হাজার ৮৪৭ কোটি টাকা ব্যয়ের ১৯টি পৃথক উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করেছে। স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগ আরো ১৫টি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে, যার মোট ব্যয় ১৫ হাজার ২৩ কোটি টাকা।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক সৈয়দ আবদুল হামিদ বলেন, স্বাস্থ্য খাতে আর্থিক ব্যবস্থাপনায় শৃঙ্খলা অপরিহার্য। পৃথক প্রকল্প প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন একটি বিস্তৃত, খাতভিত্তিক কর্মসূচির সঙ্গে একত্রে চলতে পারে না।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বাস্তবায়নকারী সংস্থা, পরিকল্পনা কমিশন, অর্থ বিভাগ, অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) ও বিশ্বব্যাংক, জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা (জাইকা), এফসিডিও, এসআইডিএ, ইউএনএফপিএ, ডব্লিউএইচও, ইউনিসেফসহ গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন অংশীদারদের প্রতিনিধিদের সঙ্গে পরামর্শ করে এই কর্মসূচি থেকে বেরিয়ে আসার কৌশল নির্ধারণের ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করেছে।
কর্মকর্তারা জানান, স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ ২৩টি অপারেশনাল প্ল্যান (ওপি) বাস্তবায়ন করবে, যার সম্মিলিত ব্যয় ৬৬ হাজার ৪৯২ কোটি টাকা। অন্যদিকে চিকিৎসা শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগ আরো ১৫টি অপারেশনাল প্ল্যান বাস্তবায়ন করবে, যার আনুমানিক ব্যয় প্রায় ৩৯ হাজার ৬০৮ কোটি টাকা।