বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের হত্যা, অপহরণ, নির্যাতন ও হুমকি দিয়েছে রোহিঙ্গা বিদ্রোহী গোষ্ঠীর সদস্যরা, যা যুদ্ধাপরাধের শামিল হতে পারে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা ফর্টিফাই রাইটসের এক প্রতিবেদনে এই দাবি করা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, শরণার্থী শিবিরে রোহিঙ্গা পুরুষ, নারী ও শিশুদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী গোষ্ঠীর নির্দিষ্ট কিছু কর্মকাণ্ড যুদ্ধাপরাধের আওতায় পড়ার যৌক্তিক ভিত্তি রয়েছে। এসব অপরাধমূলক ঘটনা ও মায়ানমারে চলমান সশস্ত্র সংঘাতের মধ্যে একটি সুস্পষ্ট যোগসূত্র বিদ্যমান।
গতকাল মঙ্গলবার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে সংবাদ সম্মেলনে প্রতিষ্ঠানটির এই প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। ‘বাংলাদেশ : রোহিঙ্গা বিদ্রোহীদের যুদ্ধাপরাধের জন্য জবাবদিহির আওতায় আনুন, আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার সঙ্গে সহযোগিতা করুন’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনটি অনুষ্ঠিত হয়। উপস্থিত ছিলেন সংস্থাটির পরিচালক জন কুইনলি, সিনিয়র অ্যাডভোকেসি স্পেশালিস্ট পেট্রিক ফংসাথর্ন ও নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. নাভিন মুর্শিদ।
যুদ্ধাপরাধ প্রতিষ্ঠার জন্য তিনটি অপরিহার্য উপাদান হলো একটি সশস্ত্র সংঘর্ষ বিদ্যমান থাকতে হবে; একটি নিষিদ্ধ কার্যকলাপ অবশ্যই এমন ব্যক্তির বিরুদ্ধে সংঘটিত হতে হবে, যিনি সশস্ত্র সংঘর্ষে সক্রিয়ভাবে জড়িত নন; এবং সশস্ত্র সংঘর্ষ ও সংঘটিত কার্যকলাপের মধ্যে অবশ্যই একটি যোগসূত্র থাকতে হবে।
বাংলাদেশে শরণার্থী শিবিরে সংঘটিত অপরাধগুলোতে এসব উপাদান বিদ্যমান থাকার যুক্তিসংগত ভিত্তি আছে। ফলে অন্ততপক্ষে চলমান যুদ্ধাপরাধ নিয়ে আরো তদন্ত করা উচিত।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা) এবং রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশনের (আরএসও) বিদ্রোহীরা মায়ানমারের ভেতরে সশস্ত্র সংঘর্ষে জড়িত। উভয়ই মায়ানমারের রাখাইন রাজ্যে জাতিগত সশস্ত্র সংগঠন আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে মায়ানমার জান্তার পক্ষে লড়াই করছে।
মায়ানমারের অভ্যন্তরে তাদের সশস্ত্র অভিযান জোরদার করার জন্য তারাই বাংলাদেশে শরণার্থীদের অপহরণ করেছে এবং তাদের মায়ানমারে যুদ্ধ করতে বাধ্য করছে, যা যুদ্ধের আইনের গুরুতর লঙ্ঘন এবং সম্ভাব্য যুদ্ধাপরাধ হিসেবে তদন্ত করা উচিত। সংস্থাটি আরসা ও আরএসওর সাবেক এবং বর্তমান সদস্যদের সঙ্গে কথা বলেছে, এবং তাদের অপরাধের স্বীকারোক্তি নথিভুক্ত করেছে।
প্রতিবেদনের তথ্য মতে, বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরণার্থীরা রোহিঙ্গা বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর হাতে বছরের পর বছর ধরে সহিংসতা ও হত্যার শিকার হয়েছে। ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে মোহিবুল্লাহ হত্যার পর থেকে বিদ্রোহী সহিংসতা উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। শরণার্থী শিবিরভিত্তিক বিদ্রোহীদের দ্বারা সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের সংখ্যা ২০২১ সালে ২২টি, ২০২২ সালে ৪২টি, ২০২৩ সালে ৯০টি এবং ২০২৪ সালে কমপক্ষে ৬৫টি রিপোর্ট করা হয়েছে।
জন কুইনলি বলেন, ‘রোহিঙ্গা সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো বাংলাদেশ এবং মায়ানমারে প্রায় সম্পূর্ণ দায়মুক্তির সঙ্গে ধ্বংসযজ্ঞ চালাচ্ছে। যুদ্ধাপরাধ সাধারণত সশস্ত্র সংঘাতের প্রত্যক্ষ ক্ষেত্রেই সংঘটিত হয়। তবে এই ক্ষেত্রে, বাংলাদেশে সংঘটিত নির্দিষ্ট অপরাধগুলো মায়ানমারের যুদ্ধে সরাসরি সংযুক্ত এবং যুদ্ধাপরাধের শামিল।’ তিনি বলেন, ‘সম্ভাব্য যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আওতায় আনতে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে আন্তর্জাতিক বিচার ব্যবস্থার সঙ্গে সহযোগিতা করা উচিত।’
ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের রোহিঙ্গা নেতৃত্বাধীন বিদ্রোহী গোষ্ঠী থেকে রক্ষা করতে ব্যাপকভাবে ব্যর্থ হয়েছে। বহু বছর ধরে শেখ হাসিনা বাংলাদেশে রোহিঙ্গা বিদ্রোহীদের অস্তিত্ব ও কার্যক্রমের কথা প্রকাশ্যে স্বীকার করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল। ফলে ভুক্তভোগী শরণার্থী রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশি কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে ন্যায়বিচারের সুযোগ ও যথাযথ প্রতিক্রিয়ার অভাব দেখা দেয়।’