<p>আজ ৮ মার্চ, আন্তর্জাতিক নারী দিবস। দেশে দেশে নারীর সমতা ও সাম্যতা অর্জনের লক্ষ্যে সব নারীর মেলবন্ধনের দিন। নারী শ্রমিকের অধিকার আদায়ের আন্দোলন থেকে উদ্ভূত হয় নারী দিবসের ধারণা। ১৯০৮ সালে কর্মসময় আট ঘণ্টা নির্ধারণ, কর্মপরিবেশ উন্নয়নের দাবিতে ১৫ হাজার নারী শ্রমিক নিউ ইয়র্কের রাস্তায় আন্দোলনে নেমেছিল। এই পটভূমিকায় ১৯১০ সালে কোপেনহেগেনে অনুষ্ঠিত নারীদের দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক সম্মেলনে বিশ্ব সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের নেত্রী ক্লারা জেটকিন ‘আন্তর্জাতিক নারী দিবস’ পালনের ধারণাটি উত্থাপন করেন। ১৯৭৪ সালে জাতিসংঘ ৮ মার্চ ‘আন্তর্জাতিক নারী দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে। ১৯৭৭ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে এক প্রস্তাব গ্রহণ করে বলা হয়, ‘৮ মার্চ হচ্ছে জাতিসংঘের একটি দিন, যা নারীর অধিকার এবং আন্তর্জাতিক শান্তির জন্য জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রগুলো তাদের ঐতিহাসিক ও জাতীয় ঐতিহ্য অনুসারে পালন করবে। নারীদের জন্য একটি বিশেষ দিন নির্ধারণের যুক্তি হিসেবে জাতিসংঘ মনে করে, শান্তি, সামাজিক প্রগতি নিশ্চিত করা এবং মানবাধিকার ও মৌলিক স্বাধীনতা ভোগের জন্য প্রয়োজন সমতা, উন্নয়নে নারীর সক্রিয় অংশগ্রহণ এবং আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা শক্তিশালীকরণে নারীর ভূমিকার স্বীকৃতি প্রদান। সিদ্ধান্ত হয়, এই দিনে জাতিসংঘের মহাসচিব বাণী প্রদান করবেন।</p> <p>এবারের জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক নারী দিবসের প্রতিপাদ্য হচ্ছে, ‘Invest in Women Accelerate Progress’.</p> <p><img alt="নারীর মানবাধিকার অর্জনে চাই সম্পদের ওপর অধিকার" height="429" src="https://cdn.kalerkantho.com/public/news_images/share/photo/shares/1.Print/2024/03.March/08-03-2024/44.jpg" style="float:left" width="500" />বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের নারী দিবসের স্লোগান, ‘অভিন্ন পারিবারিক আইন প্রবর্তন ও বাস্তবায়ন নিশ্চিত করবে নারীর সার্বিক ক্ষমতায়ন’।</p> <p>নারীর অধিকার আদায়ের সংগ্রাম ও আন্দোলনের সুদীর্ঘ ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় দেখা যাচ্ছে, জাতীয় ও বৈশ্বিকভাবে বিভিন্ন নীতি, উদ্যোগ ও পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে নারীর রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নে নানা অগ্রসরতার পরও নারী প্রতিনিয়ত অধস্তনতা ও নারী হওয়ার কারণে বৈষম্যের শিকার হচ্ছে।</p> <p>নারী দিবসে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, নারী তার দক্ষতা, আত্মবিশ্বাস ও সক্ষমতা নিয়ে দেশের অর্থনৈতিক বিকাশকে শক্তিশালী করছে, মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে উন্নীত করার ক্ষেত্রে দৃঢ় ভূমিকা রাখছে। কিন্তু কর্মের প্রতিটি ক্ষেত্রে নারীকে বৈষম্য মোকাবেলা করতে হচ্ছে ও দ্বৈত দক্ষতার প্রমাণ দিতে হচ্ছে, সে কাজ যে পর্যায়েরই হোক না কেন। এ বছর নোবেল পুরস্কার বিজয়ী মার্কিন অর্থনীতিবিদ ক্লডিয়া গোল্ডিন ২০০ বছরের নারীশ্রমের বিভিন্ন দিক নিয়ে কাজ করেছেন। তাঁর গবেষণায় দেখা যায়, ২০০ বছরে নারীর শ্রমের ইতিহাসে অনেক পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু শ্রমজীবী নারীর অর্থনৈতিক, সামাজিক অবস্থার উন্নতি হয়নি। তিনি আরো বলেন, বিশ্ব উন্নত হচ্ছে, আধুনিকতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু কর্মজীবী নারীর প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি এখনো আগের মতো রয়ে গেছে। এই দৃষ্টিভঙ্গির স্বরূপ হয়তো একেক দেশে ও সমাজে একেক রকম। এ প্রসঙ্গে বলা যায়, নারীর নিজের জীবন বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকার এখনো তেমন দৃশ্যমান নয়।</p> <p>সমাজে, রাষ্ট্রে এবং পরিবারে নারীর অধঃস্তনতার একটি প্রধান কারণ হচ্ছে সম্পদ-সম্পত্তিতে নারীর অধিকারহীনতা, যা সব ক্ষেত্রে বিদ্যমান। শ্রমে নেই সমমজুরি, গৃহস্থালি ও সেবামূলক কাজ এখনো অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড হিসেবে স্বীকৃত নয়, কৃষিকাজে নারীর ব্যাপক অংশগ্রহণের পরও নারী কৃষক হিসেবে স্বীকৃতি পাচ্ছে না, গ্রামীণ নারীর অকৃষি খাতের কাজ এখনো কাজ হিসেবে স্বীকৃত নয়। অনানুষ্ঠানিক ক্ষেত্রে নারীর এসব কর্মকাণ্ডের কোনো আর্থিক মূল্যায়ন হচ্ছে না। জেন্ডারভিত্তিক শ্রম বিভাজন থেকে নারীর সম্পাদিত কর্মগুলো অর্থনৈতিক মানদণ্ডে বিবেচিত হচ্ছে না। শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণ এখনো প্রধানত অনানুষ্ঠানিক ক্ষেত্রে। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, নারী শ্রমশক্তির মাত্র ৩.২৫ শতাংশ পাবলিক সেক্টরে এবং ৮.২৫ শতাংশ প্রাইভেট সেক্টরে কাজ করছে। বাকি ৮৯.৫ শতাংশ অনানুষ্ঠানিক ক্ষেত্রে কাজ করছে। এক গবেষণা তথ্যে দেখানো হয়েছে, দেশের মোট জাতীয় উৎপাদনের কাছাকাছি নারীর অবদান। প্রতিদিন একজন নারী গড়ে একজন পুরুষের তুলনায় প্রায় তিন গুণ বেশি কাজ করেন, যা জাতীয় আয়ের হিসাবে অন্তর্ভুক্ত হয় না। এর সঙ্গে রয়েছে অর্থনৈতিক কার্যক্রমে সুযোগের ক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণের সীমাবদ্ধতা। ফলে সামগ্রিক অর্থনীতির কাঠামোতে নারীর শ্রম এখনো অদৃশ্য থেকে যাচ্ছে।</p> <p>আমাদের দেশে নারীর অধিকারহীনতার একটি বড় ক্ষেত্র হচ্ছে নারীর ব্যক্তিজীবনে অসমতা। সংবিধানে স্বীকৃত অধিকার নারীর জীবনে প্রতিফলিত হয় না। বিয়ে, বিচ্ছেদ, সন্তানের অভিভাবকত্ব ও সম্পত্তির উত্তরাধিকার—এই ক্ষেত্রগুলো নিজ নিজ ধর্মীয় বিধান অনুযায়ী পরিচালিত হয়ে থাকে। বাংলাদেশের সংবিধানের ১০, ১৬, ২৬, ২৭, ২৮, ২৯ ও ৩০ ধারা-উপধারায় নারীর সম-অধিকারের ঘোষণা রয়েছে। ২৭(১) অনুচ্ছেদে সুস্পষ্টভাবে বলা রয়েছে, ‘জাতি কেবল ধর্ম, বর্ণ বা নারী-পুরুষের জন্মস্থানের কারণে কোন নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য প্রদর্শন করিবে না।’ কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, নাগরিক হিসেবে বাংলাদেশের নারী ব্যক্তি অধিকারের ক্ষেত্রে এখনো বৈষম্যের শিকার হচ্ছে, যা কেবল পুরুষ-নারীর মধ্যে বৈষম্য সৃষ্টি করছে না, নারীতে-নারীতে বৈষম্যের সৃষ্টি করছে। বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে নারীর অধিকারের ক্ষেত্রে সমতা আনার জন্য প্রয়োজন অভিন্ন পারিবারিক আইন গ্রহণ ও বাস্তবায়ন। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ ১৯৯৩ সালে ‘অভিন্ন পারিবারিক আইন’ বিষয়ক এই প্রস্তাব বাংলাদেশের প্রথিতযশা আইনজীবীদের পরামর্শ ও সক্রিয় অংশগ্রহণে প্রণয়ন করে, যা সরকারের কাছে জমা দেওয়া হয়েছে।</p> <p>জেন্ডার সমতার লক্ষ্যে ২০০৪ সাল থেকে জেন্ডার বাজেট ঘোষিত হয়ে আসছে। কিন্তু এই বিনিয়োগ জেন্ডার সমতার ক্ষেত্রে কী ভূমিকা রাখছে সে বিষয়ে কোনো তথ্য নেই। নারীর সার্বিক ক্ষমতায়নের জন্য প্রয়োজন নারীর প্রতি প্রচলিত অধস্তন পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন। বর্তমান সময়ে নারীর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের হার এবং দৃশ্যমানতার পরও আমরা দেখি নারী প্রতি মুহূর্তে নানা বিদ্বেষপূর্ণ মন্তব্যসহ যৌন হয়রানি, উত্ত্যক্তকরণ ও সহিংসতার শিকার হচ্ছে গৃহ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কর্মক্ষেত্রসহ বিভিন্ন সামাজিক পরিসরে। সমাজের এই পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি ভিন্ন ভিন্ন আঙ্গিকে আরো জটিল হয়ে উঠছে ক্রমান্বয়ে। নারীর প্রতি সহিংসতা সামাজিক স্থিতিশীলতা নষ্টের পাশাপাশি দীর্ঘমেয়াদি প্রবৃদ্ধিকেও বাধাগ্রস্ত করছে।</p> <p>নারীর ক্ষমতায়নকে যদি নারী ইস্যু ভাবা না হয়, সমাজ ও রাষ্ট্রের উন্নয়নের সমান্তরাল হিসেবে না দেখা হয়, তবে রাষ্ট্রের গৃহীত নীতি ও পদক্ষেপ নারীর সমতায় ভূমিকা রাখতে পারবে না। অধিকার, সুযোগ ও ফলাফল একে অপরের পরিপূরক। সুযোগের প্রাপ্যতা না থাকলে অধিকার আদায় হয় না, আর অধিকার ও সুযোগের সমন্বয়ে যদি সম ফলাফল অর্জিত না হয়, তবে অধিকার বাস্তবায়িত হয়েছে বলা যায় না; যার প্রতিফলন বাংলাদেশের নারীর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে লক্ষ করা যায়।</p> <p>নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন তখনই জেন্ডার সমতা আনতে পারবে, যখন সম্পদ ও সম্পত্তিতে নারীর পূর্ণ অধিকার ও নিয়ন্ত্রণ থাকবে। এর জন্য প্রয়োজন জেন্ডার সংবেদনশীল সমন্বিত পরিকল্পনা ও তার বাস্তবায়ন; যেখানে নারীর ক্ষেত্রে বিনিয়োগ মানবাধিকার ইস্যু হিসেবে বিবেচিত হবে। জেন্ডার গ্যাপ নির্ণয় এবং সমাজে নারীর বৈচিত্র্যপূর্ণ অবস্থানের পরিপ্রেক্ষিতে, ন্যায্যতার ভিত্তিতে প্রণীত হবে জেন্ডার বাজেট।</p> <p>নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধ ও নির্মূলে নানামুখী কাজের জন্য পর্যাপ্ত বাজেট অধিক গুরুত্ব দিয়ে বরাদ্দ করতে হবে। নারীশিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাত, প্রযুক্তিতে নারীর অংশগ্রহণের সুযোগ সৃষ্টি এবং কর্মক্ষেত্রে নারী সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টির লক্ষ্যে ডে কেয়ার, কর্মজীবী হোস্টেল, নিরাপদ যানবাহন ইত্যাদি ক্ষেত্রে বিনিয়োগ। সর্বোপরি সিডও সনদের পূর্ণ বাস্তবায়ন। প্রচলিত যেসব আইন, বিধি-প্রথা ও অভ্যাস নারীর প্রতি বৈষম্য সৃষ্টি করে, সেগুলো পরিবর্তন বা বাতিল করার উদ্দেশ্যে আইন প্রণয়নসহ সব উপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ ও সে ক্ষেত্রে বিনিয়োগ। এর জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছা, প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো শক্তিশালী করা, সম্পদের সমবণ্টন, যা বাস্তবায়ন করবে স্থায়িত্বশীল উন্নয়নের পাঁচ নম্বর লক্ষ্যমাত্রা নারীর সমতা ও ক্ষমতায়ন। </p> <p> </p> <p> লেখক : যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক</p> <p>বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ</p> <p> </p>