<p>অনেক জল্পনাকল্পনার অবসান ঘটিয়ে অবশেষে পাকিস্তানে দ্বিতীয়বারের মতো পিএমএল-এন এবং পিপিপির মধ্যকার জোট সরকার যাত্রা শুরু করল। এর মধ্য দিয়ে দেশটিতে প্রথমবারের মতো সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হওয়া সত্ত্বেও সরকার গঠন করতে পারল না পিটিআই। তবে এখানে যে বিষয়টি স্পষ্ট তা হচ্ছে, পিটিআই দলগতভাবে নির্বাচন করতে পারেনি, এটি যেমন একটি কারণ, অপর এবং সবচেয়ে বড় কারণটি হচ্ছে দ্বিতীয় ও তৃতীয় অবস্থানে থাকা দলগুলোর কোনোটির সঙ্গেই পিটিআই জোট গঠন করে সরকার গঠন করতে চায়নি। অন্যভাবে বলা হচ্ছে, সেসব দলও পিটিআইয়ের সঙ্গে জোট গঠনে আগ্রহ দেখায়নি। আপাতদৃষ্টিতে দেশটিতে রাজনৈতিক সংকট কাটিয়ে নতুন সরকার গঠন করা গেলেও এই জোট সরকার কত দিন স্থায়ী হবে, তা নিয়ে সন্দেহ থেকেই যাচ্ছে।</p> <p>পিএমএল-এন এবং পিপিপির মধ্যকার জোট সরকার বলা হলেও কার্যত এবার এই জোটের মধ্যে ভিন্নতর বোঝাপড়া কাজ করেছে। দীর্ঘ আলোচনায় পিপিপির জন্য দর-কষাকষির অনেক সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল এবং পিপিপি সেটি পুরোপুরি কাজে লাগাতে সক্ষম হয়েছে বলেই ধারণা করা যায়। এ ক্ষেত্রে দলটির চেয়ারম্যান বিলাওয়াল ভুট্টো বয়সে অপেক্ষাকৃত তরুণ হলেও রাজনীতিতে মুনশিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন। তিনি অতীতের পাকিস্তানের সরকারগুলোর, বিশেষ করে জোট সরকারের অভিজ্ঞতার আলোকে হয়তো অনুধাবন করেছেন যে বর্তমান সংসদ অনেক কারণেই তার পুরো মেয়াদ পূরণ করতে পারবে না। তাই নওয়াজ শরিফের পক্ষ থেকে পিএমএল-এন ও পিপিপির মধ্যে প্রথম তিন বছর এবং পরের দুই বছর মেয়াদের প্রধানমন্ত্রিত্বের ভাগাভাগির প্রস্তাব তিনি প্রত্যাখ্যান করেছেন। ধারণা করা হয়েছিল, পিএমএল-এনের সঙ্গে পিপিপির সরকার গঠনের আলোচনার এক পর্যায়ে পিটিআইয়ের সঙ্গেও সরকার গঠনের আলোচনা চালিয়ে গিয়েছিল দলটি। এর এক পর্যায়ে পিটিআইয়ের পক্ষ থেকে উপরোক্ত দুটি দলের কারো সঙ্গেই সমঝোতার সম্ভাবনা নাকচ হয়ে গেলে আবারও পিএমএল-এন ও পিপিপির মধ্যকার জোট সরকার গঠিত হয়। সঙ্গে এমকিউএমসহ আরো কয়েকটি ক্ষুদ্র দল রয়েছে। সরকার গঠনের স্বার্থে পিএমএল-এনকে পিপিপির কিছু দাবি মেনে নিতে হয়, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে আসিফ আলী জারদারিকে প্রেসিডেন্ট পদটি ছেড়ে দেওয়া, সিনেটের চেয়ারম্যানের পদ ছাড়াও জাতীয় পরিষদের ডেপুটি স্পিকারের পদ, পাঞ্জাব ও খাইবারপাখতুনখোয়ার গভর্নরের পদ পিপিপির জন্য বরাদ্দ দেওয়া ইত্যাদি। আপাতদৃষ্টিতে পিপিপির পক্ষ থেকে মন্ত্রিসভায় কাউকে না নেওয়া হলেও সরকার পরিচালনায় প্রশাসনের অনেক ক্ষেত্রেই তাদের প্রচ্ছন্ন প্রভাব থাকবে, এটি ধারণা করা যায়। সব কিছু মিলে পাকিস্তানের নতুন সরকার গঠনের ক্ষেত্রে পিপিপি যথেষ্ট লাভবান হয়েছে বলে মনে করা যেতে পারে।</p> <p>অনেক অনিশ্চয়তা কাটিয়ে পাকিস্তানে নতুন সরকার দায়িত্ব নিল, নতুন প্রেসিডেন্টও এরই মধ্যে তাঁর পদে অভিষিক্ত হয়েছেন। তার পরও কথা থেকে যায়। পাকিস্তানের রাজনীতিতে যেভাবে পরোক্ষভাবে সেনাবাহিনীর প্রভাব লক্ষ করা যায়, এর থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় যে বেসামরিক সরকারের ভবিষ্যৎ পুরোপুরিই নির্ভর করছে সেনাবাহিনী কত দিন এবং কতটুকু তাদের ওপর সন্তুষ্ট আছে, এর ওপর। নির্বাচনের সাম্প্রতিক ফলাফল থেকে যে বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠে তা হলো পাকিস্তানের সবচেয়ে জনপ্রিয় দল পিটিআই কী মাত্রায় সেনাবাহিনীর ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছে! দলের চেয়ারম্যান ইমরান খানকে নির্বাচন থেকে বিরত রাখা, তাঁর দলের নির্বাচনের প্রতীক কেড়ে নেওয়াসহ আরো অনেক ষড়যন্ত্রই করা হয়েছে। এত কিছুর পরও নির্বাচনে পিটিআই সমর্থিত নেতারা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করে সর্বাধিক (৯৩টি) আসন লাভ করেন।</p> <p>আগেরবারের নির্বাচনে ইমরান খানের নেতৃত্বে পিটিআই কিছু ক্ষুদ্র দলের সমর্থন নিয়ে সরকার গঠন করেছিল। পরবর্তীকালে সেনাবাহিনীর সঙ্গে দ্বন্দ্বের জেরে জাতীয় পরিষদে অনাস্থা ভোটের মধ্য দিয়ে ২০২২ সালে ইমরান খানকে পদচ্যুত হতে হয়। সেই সময় থেকে পাকিস্তানের রাজনীতিতে দুই চিরবৈরী পিএমএল-এন ও পিপিপির সমন্বয়ে জোট সরকার গঠন করা হয়। এবারের নির্বাচনের আগে এই জোট সরকার ইমরানোত্তর সময়ের অবশিষ্ট ১৬ মাস ক্ষমতায় থাকলেও তাদের মধ্যে বোঝাপড়ার জায়গাটি খুব একটা সুখকর ছিল না। সে কারণে পিপিপি এবার পিএমএল-এনের সঙ্গে জোট সরকার গঠনের বিষয়ে প্রথমে কিছুটা অনীহা প্রকাশ করে। কিন্তু নির্বাচনে অনিয়মের বিরুদ্ধে তুমুল বিক্ষোভ শুরু হলে এবং সরকার গঠনের সময় ফুরিয়ে আসায় দুই দলকে সমঝোতায় আসতে হয় এবং নতুন সরকার গঠিত হয়। এর পেছনে নিঃসন্দেহে সেনাবাহিনীর পরোক্ষ চাপ থাকার বিষয়টি উড়িয়ে দেওয়ার অবকাশ নেই।</p> <p>পাকিস্তানের বর্তমান অবস্থা বিবেচনায় বর্তমান জোট সরকারের জন্য সফল হওয়া বেশ কঠিন। রাজনৈতিক অচলাবস্থার বাইরে কয়েক বছর ধরে দেশটি ব্যাপক অর্থনৈতিক দুরবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। দেশটিতে মূল্যস্ফীতির হার বর্তমানে ৩০ শতাংশ এবং সরকারি হিসাবেই দারিদ্র্যসীমা ৪০ শতাংশের ওপর অবস্থান করছে। আইএমএফের অর্থায়ন অব্যাহত রাখার বিষয়টি দেশটির বেসামরিক সরকারের ধারাবাহিকতার সঙ্গে সম্পর্কিত ছিল বিধায় আপাতত একটি জোটের ভেতর হলেও সেই ধারাবাহিকতা রক্ষা হয়ে আসছে। এর মধ্য দিয়ে দেশটির জন্য আইএমএফের পরবর্তী কিস্তিগুলোর অর্থায়ন নিশ্চিত হলেও এর সদ্ব্যবহার নিয়ে শঙ্কা থেকে যায়। সেই সঙ্গে কেবল আইএমএফ নয়, ব্যাপক জনসংখ্যার পাকিস্তানের অর্থনীতির চাকাকে সচল করতে হলে দরকার ব্যাপক মাত্রায় আরো বিদেশি অর্থায়ন, আমদানি-রপ্তানির মধ্যকার ব্যবধান কমানো এবং বৈদেশিক বিনিয়োগ, যা আশানুরূপ নয়। একসময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সুসম্পর্ক থাকলেও তাদের অধিক মাত্রায় চীননির্ভরতা এবং সেই সঙ্গে চীনের তরফ থেকে পাকিস্তানের জন্য অর্থায়নের বিষয়টি কমে যাওয়া এবং চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডরটি পাকিস্তানের অর্থনীতির জন্য সুফল বয়ে না আনার ফলে তারা ক্রমেই অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়ছে। নতুন সরকারের জন্য এই চ্যালেঞ্জগুলো উতরে ওঠা খুবই কষ্টকর বিষয় হবে। আগামী এক বছর সময়ের মধ্যে তারা যদি দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি সাধন করতে না পারে, তাহলে জনবিক্ষোভের মাত্রা ক্রমেই লাগামহীন হয়ে উঠবে। সব কিছু মিলিয়ে তাদের এখন অনেক বেশি মাত্রায় অভ্যন্তরীণ সক্ষমতা বৃদ্ধির পাশাপাশি বৈদেশিক সম্পর্ককে ঢেলে সাজাতে হবে।</p> <p> </p> <p> লেখক : অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ</p> <p>চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়</p> <p>mfulka@yahoo.com    </p> <p> </p>