<p>নাগরিকত্ব সংশোধন আইন ২০১৯। নরেন্দ্র মোদি সরকারের সদ্যোগৃহীত এক ক্যাবিনেট সিদ্ধান্তে ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের মুখে ভারতের নানা রাজ্যে তুলকালাম কাণ্ড ঘটতে শুরু করেছে। অসন্তোষের আগুন বইছে পশ্চিমবঙ্গ, আসামসহ দক্ষিণ ভারতেরও বেশ কিছু এলাকায়।</p> <p>৪০ বছর সাংবাদিকতা করার পর এখন মনে হয়, ভোট বড় বালাই। ভোটের হিন্দুত্ববাদী সমর্থন আদায় করার জন্য নরেন্দ্র মোদি সরকার এমন একটা কাণ্ড করে বসল! সে এক শাঁখের করাত! বিজেপি সূত্রে জানতে পারছি, দলের মধ্যেই একটা বড় অংশ এখন দ্বিধাদ্বন্দ্বে জর্জরিত। এই আইন করে হিন্দু ভোটের মেরুকরণ এবং বিশেষত পশ্চিমবঙ্গে হিন্দু ভোটের শ্রীবৃদ্ধি ঘটানোর উদ্দেশ্য কাউন্টার প্রডাক্টিভ না হয়ে যায়! এর কারণ দেশের ভেতরেও প্রশ্ন উঠেছে অনেক।</p> <p>যে মতুয়া সম্প্রদায়ের দাবিতে এই নাগরিকত্ব দেওয়ার কথা উঠল, সেই মতুয়া সম্প্রদায়ের মধ্যেই নানা সংশয়। প্রথম প্রশ্ন, নাগরিকত্ব অর্জনের জন্য যদি এই আইনের প্রয়োজন হয়, ভারতের আধার কার্ড যদি নাগরিকত্বের পরিচায়ক না হয়, তাহলে মতুয়া গোষ্ঠীর বিজেপি নেতা শান্তনু ঠাকুর—তিনি এত দিন ধরে কেন্দ্রের মন্ত্রী হয়ে আছেন কী করে? তিনি নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে বাংলাদেশে পর্যন্ত গিয়েছিলেন মতুয়া সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতার জন্মভিটা দর্শন করতে। সেই শান্তনু ঠাকুর কি তাহলে অ-নাগরিক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী? তিনি কি তাহলে এখন নাগরিকত্ব অর্জন করবেন এই আইনের পর? আর সেটা যদি তাঁর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য না হয়, তাহলে অন্য মতুয়াদের এই নাগরিকত্ব আইন আজ হঠাৎ ২০২৪ সালে প্রয়োজন হলো কেন?</p> <p>এই আইন প্রণয়নের কথা কয়েক বছর আগে বিজেপি বলেছিল। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বলেছিলেন, এই নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল হওয়ার পর আসবে এনআরসি। সেটাতে রেজিস্ট্রেশন করা হবে। নাগরিকত্বের জাতীয় নথিভুক্তিকরণ। আর সেটা যখন হবে, তখন যারা হিন্দু শরণার্থী, তারা ভারতে থাকবে, কিন্তু বাংলাদেশ, আফগানিস্তান, পাকিস্তান থেকে আসা মুসলমান সমাজকে তাদের নিজের দেশে ফিরে যেতে হবে। তাদের ডিটেনশন ক্যাম্পে রাখাও শুরু হয়ে গিয়েছিল আসামে। বাংলাদেশে তখন বিরোধী দল নয়, শাসকদলের পক্ষ থেকেও মোদি সরকারের কাছে অভিযোগ আনা হয়েছিল। আওয়ামী লীগ যথেষ্ট চাপ সৃষ্টি করেছিল। ভারতবিরোধিতা নয়, ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক রেখেও তুমুল রাজনৈতিক দর-কষাকষিতে নেমেছিল আওয়ামী লীগ। তখন নরেন্দ্র মোদি সরকার আসামের রাজনীতির পরিপ্রেক্ষিতে আসাম ভোটের আগে এবং পরে যা-ই বলুক না কেন, নাগরিকত্ব আইন থেকে পিছিয়ে আসে।</p> <p>তখন কার্ড বিলিয়ে মতুয়াদের নাগরিকত্বের আশ্বাস দিয়েছিল বিজেপি। সেই কার্ডের নিচে সংসদ সদস্যের সই আছে। পরিবারের অভিভাবকদের নামে ওই কার্ড ইস্যুও করে দেওয়া হয়। পরিবারের কতজন সদস্য রয়েছে, সেটাও লেখা হয়। বিধানসভা নির্বাচনের আগে বিভিন্ন সভায় এই কার্ডটাকে তুরুপের তাস হিসেবে বিজেপি ব্যবহারও করে। সম্প্রতি কেন্দ্রীয় সরকার নাগরিকত্ব পাওয়ার জন্য যেসব নথি জমা করতে বলেছে, তাতে সেই কার্ডের উল্লেখ নেই। তা জানার পর থেকেই বিজেপির বিরুদ্ধে মতুয়ারা ক্ষোভ উগরে দিচ্ছে। পূর্ব বর্ধমান, নদীয়া, হুগলি, উত্তর চব্বিশ পরগনাসহ বিভিন্ন জেলার বহু পরিবারের কাছে ওই কার্ড পৌঁছে দেওয়া হয়েছিল। বলা হয়েছিল, ওই কার্ড থাকলে নাগরিকত্ব পাওয়ার ক্ষেত্রে অসুবিধা হবে না।</p> <p>২০১৯ সালের শেষ দিকে বিজেপি সংসদ সদস্য কার্ড বিলি করেছিলেন। বিধানসভা নির্বাচনের আগে অনেককে এই কার্ড দেওয়া হয়েছিল। কয়েক দিন আগে জামালপুরে তৃণমূলপন্থী মতুয়া নেত্রী মমতাবালা ঠাকুর প্রতিবাদ সভা করে কেন্দ্রীয় সরকারকে তোপ দাগছেন। তৃণমূল নেতা অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সভায়ও মতুয়াদের ভিড় ছিল চোখে পড়ার মতো। তারা এখন বিজেপির বিরুদ্ধে স্লোগান দিতে শুরু করেছে যে যেভাবে তাদের মা-বাবা, ঠাকুরদা-ঠাকুরমার জন্ম সার্টিফিকেট চাওয়া হচ্ছে, তাতে তো পূর্ববঙ্গ থেকে আসা উদ্বাস্তু হিন্দুরা বলছে, আমরা যদি জন্ম সার্টিফিকেট নিয়েই আসতাম, তাহলে আমরা উদ্বাস্তু হলাম কেন? উদ্বাস্তু হয়ে এসেছি, মানে তখন প্রবল নিরাপত্তার অভাবে আমরা সব ছেড়ে দিয়ে চলে এসেছিলাম। তখন ছিল পাকিস্তানি শাসকদল। সেই সময় পাকিস্তানি শাসকদলের অত্যাচারে যারা ভারতে এসেছে, বিপুলভাবে সেই শরণার্থীসমাজকে আশ্রয় দিয়ে ভারত আন্তর্জাতিক স্তরে একটা বিরাট সম্মান লাভ করেছিল।</p> <p>আজ নরেন্দ্র মোদির এই সিদ্ধান্ত একদিকে যেমন আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে, অন্যদিকে দেশের ভেতরেও নানা প্রশ্ন তুলেছে। তবে সব রাজ্যে এই আইন কার্যকর হয়নি। পশ্চিমবঙ্গে হবে, আসামে হবে। তাহলে গুজরাটের মুসলমানদের কেন এখনই পাকিস্তানে চলে যেতে বলা হচ্ছে না? কচ্ছের সীমান্তে থাকা মুসলমান সমাজ, তাদের তো এখন এই ভোটের আগে নাগরিকত্ব আইন হচ্ছে না? তবে কেন শুধু বাঙালিদের ক্ষেত্রে এই কোপ হবে? সেটা অবাঙালিদের ক্ষেত্রে হবে না কেন?</p> <p>সুতরাং এই নাগরিকত্ব আইনের সঙ্গে বাঙালি-অবাঙালি প্রশ্নটাও ভারতের রাজনীতিতে জড়িয়ে গেছে। আবার যারা মাড়োয়ারি বা গুজরাটি বা সিন্ধি, তারা বলছে, আধার কার্ড যদি নাগরিকত্বের পরিচায়ক না হয়, আমাদেরও তো তাহলে নাগরিক কার্ড দরকার। আমরা বাঙালি নই, কিন্তু কলকাতায় বহু বছর ধরে আছি। আমরা যে মাড়োয়ারি সম্প্রদায়, তার নাগরিকত্ব প্রমাণ করব কী করে, যদি আধার কার্ড আমাকে নাগরিকত্ব আইনের অধিকার না দেয়? এই রকম অসংখ্য প্রশ্ন নিয়ে যখন দেশ উত্তাল, তখন প্রশ্ন উঠছে, এত তাড়াহুড়া করে ভোটের আগে এই আইন প্রণয়ন না করে, এটা নিয়ে আরো আলাপ-আলোচনা করে, সব দলের নেতাদের সঙ্গে বসে, বিভিন্নভাবে একটা ফুলপ্রুফ ম্যানেজমেন্ট করা যেতে পারত।</p> <p>এখন প্রচুর মামলা সুপ্রিম কোর্টে হয়েছে এই আইনের বিরুদ্ধে। সুপ্রিম কোর্ট স্থগিতাদেশ দেননি। এতে ভোটের আগে হয়তো আরো নৈরাজ্য সৃষ্টি হতো। শুনানি হবে এবং এটা নিয়ে বিচার-বিবেচনার আশ্বাস সুপ্রিম কোর্ট দিয়েছেন। সুতরাং এখন চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত কী হবে, সেটা বোঝা যাবে ভোটের পর।</p> <p>রাজনৈতিকভাবে ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচন হয়ে যাওয়ার পর, আমার মনে হয়, বিজেপির নরেন্দ্র মোদি সরকার ক্ষমতায় এলেও এটা নিয়ে তারা আবার ‘গো স্লো’ করবে। আবার ভোটের মুখে তাদের রাজনৈতিক তুরুপের তাস হিসেবে ব্যবহার করবে। ঠিক যেভাবে অনুপ্রবেশ নিয়ে ২০১৪ সালের আগেও নরেন্দ্র মোদি অনেক কথা বলেছিলেন। ভোটের পর কিন্তু ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কটা তাঁর কাছে অনুপ্রবেশ রোধের থেকেও অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।</p> <p>মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিচ্ছেন। তিনি বলছেন, অনুপ্রবেশ রোধ করার দায়িত্ব তো বিএসএফের। তারা সীমান্তরক্ষী। বিএসএফের নিয়ন্ত্রণ রাজ্যের মধ্যে বেশ কয়েক কিলোমিটার বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, যাতে তারা এই অনুপ্রবেশ রোধ করতে পারে। সেখানে কাঁটা তারের বেড়া লাগানোর কথা বলা হচ্ছে। আর এই দায়িত্বে আছেন খোদ কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। তাহলে বিএসএফের মন্ত্রী অমিত শাহ অনুপ্রবেশ রোধ করতে পারছেন না, অথচ পশ্চিমবঙ্গে সব উদ্বাস্তুকে বিদায় করার দায়িত্ব নেওয়া হবে, এমনটা কেন?</p> <p>নরেন্দ্র মোদি যখন ‘প্রতিবেশী প্রথম’—এই পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে এগোচ্ছেন, তখন এই ঘটনাটা তাঁর পররাষ্ট্রনীতিকে ধাক্কা দিয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পর্যন্ত এই ঘটনার প্রতিবাদ জানিয়েছে। জার্মানি থেকে নাগরিকত্ব বিলের প্রতিবাদ হয়েছে। এখন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিবাদ সম্পর্কে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, ওরা দেশভাগ জানে না। ভারতে কী হয়েছিল, সেটাও জানে না। সেই জন্য ওরা প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছে। আমরা দেশভাগ জানি। কাকে বলে দেশভাগ, কাকে বলে অনুপ্রবেশ, সেটা আমরা জানি। সেই কারণে আমাদের এটা করতে হয়েছে।</p> <p>দেশভাগ সম্পর্কে বাঙালি অন্য কোনো ভারতীয় থেকে খুব কম জানে না। বাঙালিকে দুটি দেশভাগ সামলাতে হয়েছে। ১৯০৫ সালেও বঙ্গভঙ্গ হয়েছে। ১৯৪৭ সালে হয়েছে। এখন সেখানে বাঙালিদের সঙ্গে এই ফেডারেল স্ট্রাকচারে আলাপ-আলোচনার পথে না গিয়ে ওপর থেকে একটা স্টিম রোলার দিয়ে নাগরিকত্ব বিল চাপিয়ে দিলে এটাতে লাভের থেকে লোকসান বেশি হয়ে যেতে পারে।</p> <p>বাংলাদেশ এই মুহূর্তে আমাদের সবচেয়ে বড় বন্ধু-প্রতিবেশী রাষ্ট্র। চারপাশের প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলো আমাদের সঙ্গে শত্রুতার পথে হাঁটছে। চীনের ড্রাগনের নিঃশ্বাস দেশকে করায়ত্ত করছে, যেখানে মালদ্বীপের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ককে সুষ্ঠু করা গেল না। চীনের নিয়ন্ত্রণ ক্রমেই আরো বেশি করে প্রতীয়মান হচ্ছে। শ্রীলঙ্কা, মিয়ানমার, এমনকি ভুটানের মতো ছোট রাজ্য—তাদের সঙ্গেও একটা অস্বস্তির সম্পর্ক হয়েছে। সেই ডোকলামে যখন চীন আগ্রাসন হলো, সেই সময় থেকে। এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশই একটিমাত্র কনসিসটেন্ট বন্ধু রাষ্ট্র। সেখানে ভারত সরকারের এমন কিছু করা উচিত নয়, যাতে ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশের সংস্কৃতিতে আঘাত লাগে এবং জামায়াতের মতো মৌলবাদী শক্তি, যার কড়া সমর্থক বিএনপি, তাদের হাত শক্ত হয়ে যায়। এই মুহূর্তে ভারতীয় পণ্য বিসর্জন দেওয়ার জন্য যে আন্দোলন বাংলাদেশে শুরু হয়েছে, সেটা কি ভারতের জন্য খুব সুখকর ঘটনা?</p> <p>বাংলাদেশের মানুষকে ভারতের বিরুদ্ধে খেপানোর জন্য এই নাগরিকত্ব আইনকে ব্যবহার করা হচ্ছে। সেটা যেমন মোদি সরকারের জন্য দেশের ভেতরেও বিপদ, বাংলাদেশের ভারতবিরোধিতার সংস্কৃতির শ্রীবৃদ্ধি—সেটাও মোটেই এই আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিতে সুখকর নয়। ভূ-কৌশলগত অবস্থানে বাংলাদেশ অতীব গুরুত্বপূর্ণ। সেটা ভারত বোঝে। তাহলে বুঝেও কেন এ ধরনের নির্বাচনী রাজনীতির ঘটনা ঘটে, তা নিয়ে ভারতেরই রথী-মহারথীদের অনেক বড় প্রশ্ন! ভারতের বিরোধীদের হাতেও এটা একটা অস্ত্র, যা শাসকদল তুলে দিয়েছে। এর ফলে যে প্রতিপক্ষ ভারতে একদম সম্পূর্ণ টুকরা টুকরা হয়ে গিয়েছিল, তারাও এই প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যে এই আইনটাকে মূলধন করে মোদিবিরোধিতার রাজনীতি শুরু করে দিয়েছে। যদি আমরা গণতন্ত্রকে ভালোবাসি, যদি আমরা ভারতের স্থায়িত্ব চাই, যদি আমরা নরেন্দ্র মোদির পররাষ্ট্রনীতিকে আরো বেশি করে কার্যকর করতে চাই, যদি আমরা ভারত-বাংলাদেশের মৈত্রী আরো শক্তিশালী করার কথা ভাবি, তাহলে আর যা-ই হোক, এই আইন কার্যকর করা থেকে আমাদের আপাতত পিছিয়ে আসা প্রয়োজন।</p> <p>লেখক : নয়াদিল্লিতে কালের কণ্ঠ’র</p> <p>বিশেষ প্রতিনিধি</p> <p> </p>