<p>পাঁচ দশক চট্টগ্রামের রাজনীতি একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণে রাখা এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরীর মৃত্যুর পর নানা ক্ষেত্রে বিশাল শূন্যতা দেখা দিয়েছে। আওয়ামী লীগ, ভ্রাতৃপ্রতিম ও সহযোগী সংগঠনের রাজনীতিতে তাঁর প্রশ্নাতীত অভিভাবকত্ব ছিল। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে গণতান্ত্রিক, স্থানীয় ও জাতীয় নানা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ও সংকটে তাঁর অগ্রণী ভূমিকা ছিল। এ রকম ‘ক্যারিসমেটিক’ নেতৃত্বের অধিকারী মহিউদ্দিন চৌধুরী শুধু চট্টগ্রামের নয়, জাতীয় রাজনীতিতেও ছিলেন একটি আলোচিত নাম।</p> <p>বর্ষীয়ান এ নেতার আকস্মিক মৃত্যুতে সবাই শোকে মুহ্যমান। মহিউদ্দিন চৌধুরীর মৃত্যুতে রাজনৈতিক অঙ্গনে যে শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে তা পূরণ করতে কে এগিয়ে আসবেন—এটাই এখন সবার আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। শুধু রাজনৈতিক অঙ্গন নয়, নাগরিক সমস্যা নিয়ে গণমানুষের হয়ে কে কথা বলবেন এবং প্রতিবাদে সোচ্চার হবেন, সেটাও এখন ভাবছে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ।</p> <p>মৃত্যুর আগ পর্যন্ত মহিউদ্দিন চৌধুরী প্রায় একযুগ চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন। এর আগে প্রায় ১৫ বছর সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৭-৬৮ সালে নগর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হয়ে তাঁর ‘ক্যারিসমেটিক’ রাজনীতির শুরু হয়েছিল। এরপর যুবলীগ, শ্রমিক লীগ হয়ে আসেন মূল দলে। ১৯৭৯ ও ১৯৮০ সালে নগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম আহ্বায়ক ছিলেন তিনি। বর্তমানে মহানগর আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ, শ্রমিক লীগ, মহিলা আওয়ামী লীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগসহ বিভিন্ন সংগঠনের নেতৃত্বে থাকা প্রায় সবাই মহিউদ্দিন চৌধুরীর অনুসারী।</p> <p>নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক নেতাকর্মীর মতে, মহিউদ্দিনের শূন্যতা পূরণ হতে অনেক সময় লাগবে। কারণ তিনি ৫০ বছরেরও বেশি সময় ধরে চট্টগ্রামের আওয়ামী ও সহযোগী সংগঠনের রাজনীতির সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন। সেই সঙ্গে তিন দফায় প্রায় ১৭ বছর চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়রের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। এসব কারণে মহিউদ্দিন চৌধুরী ও চট্টগ্রামের রাজনীতি অনেকটা এক সূত্রে গাঁথা হয়ে গেছে। তাই মহিউদ্দিনের অনুপস্থিতিতে তাঁর স্থলে চট্টগ্রাম মহানগরে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে কে হাল ধরবেন তা এখন ‘টক অব দ্য টাউন’।</p> <p>মহিউদ্দিন চৌধুরীর বড় ছেলে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল। রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনা হচ্ছে বাবার অবর্তমানে নওফেল কি মহিউদ্দিনের অনুসারীদের ঐক্যবদ্ধ রাখতে পারবেন? না কি দ্বিধাবিভক্ত হয়ে যাবে তারা। যেহেতু নওফেল কেন্দ্রীয় রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। নগরের রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ কার হাতে থাকবে? এ প্রশ্নও উঠছে।</p> <p>চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের ৭১ সদস্যবিশিষ্ট কমিটিতে সহসভাপতির ৯টি পদ আছে। তাঁরা হলেন মাহতাব উদ্দিন চৌধুরী, নঈম উদ্দিন চৌধুরী, সুনীল সরকার, বৈদেশিক ও কর্মসংস্থান মন্ত্রী নুরুল ইসলাম, সংসদ সদস্য ডা. আফছারুল আমীন, ইব্রাহিম হোসেন চৌধুরী বাবুল, খোরশেদ আলম সুজন, জহিরুল আলম দোভাষ ও আলতাফ হোসেন চৌধুরী বাচ্চু। তাঁদের মধ্যে কাউকে ভারপ্রাপ্ত হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে, নাকি সরাসরি সভাপতি পদে কাউকে নিয়োগ দেবে কেন্দ্রীয় কমিটি—তা নিয়ে এখন নানা জল্পনা-কল্পনা চলছে।</p> <p>এ বিষয়ে জানতে চাইলে মহানগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ও বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের সদস্য ইব্রাহিম হোসেন চৌধুরী বাবুল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা মনে করি মহিউদ্দিন চৌধুরী যে মাপের নেতা ছিলেন, সে মাপের নেতা আর হবে না। ওনার মতো আর কোনো নেতা আমরা দেখছি না। তাঁর স্থলাভিষিক্ত হওয়ার মতো নেতা এখন নেই।’ তিনি আরো বলেন, ‘আমাদের সভাপতি এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরীর মৃত্যু ও তাঁর দাফনের পর আমরা গত শুক্রবার রাতে বসেছিলাম। একটা সিদ্ধান্ত হয়ে, শূন্য পদে ভারপ্রাপ্ত নাকি কাউকে সরাসরি সভাপতির দায়িত্ব দেবেন তা কেন্দ্রের সিদ্ধান্ত। তবে আপাতত দলীয় অনুষ্ঠানে ৯ জন সহসভাপতির মধ্যে যিনি সিনিয়র থাকবেন আপাতত তিনিই সভাপতিত্ব করে যাবেন।’</p> <p>একই বিষয়ে মহানগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এম রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, ‘মহিউদ্দিন চৌধুরীর মৃত্যুতে চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে বড় সংকট সৃষ্টি হয়েছে। তিনি পাঁচ দশক ধরে চট্টগ্রামের রাজনীতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন। সে সঙ্গে বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামে তিনি অগ্রণী ভূমিকা রেখেছেন। এ রকম নেতা রাজনীতিতে এখন বিরল। তাঁর মৃত্যুতে হঠাৎ করে নেতৃত্বের সংকট তো পূরণ হবে না। নিয়ম অনুসারে সহসভাপতিদের মধ্যে জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে কাউকে ভারপ্রাপ্ত দায়িত্ব দেওয়া হতে পারে। তবে এ বিষয়ে এখনো কোনো সাংগঠনিক সিদ্ধান্ত হয়নি। সেটা কেন্দ্র বিবেচনা করবে।’</p> <p>শিক্ষা সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ও চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি সাবেক মন্ত্রী ডা. আফছারুল আমীন বলেন, ‘মহিউদ্দিন চৌধুরীর রাজনৈতিক জীবন ছিল গণমুখী। কোনো কর্মকাণ্ড দলের পক্ষে যাচ্ছে নাকি দলের ভেতরে যাচ্ছে তা তিনি দেখতেন না। তিনি সব সময় দেখতেন গণমানুষের স্বার্থ। জনস্বার্থ দেখলেই তিনি সেখানে এগিয়ে যেতেন। মানুষের পাশে থাকতেন। পতেঙ্গায় বে-টার্মিনালবিরোধী, ভ্যাটবিরোধী, ঝুলন্ত ব্রিজবিরোধী, নগরের রানির দিঘি ভরাটের বিরুদ্ধে—এরকম অনেক জনস্বার্থমূলক কর্মকাণ্ডে তিনি এগিয়ে গেছেন। বন্দরের স্বার্থ নিয়ে তিনি সব সময় সোচ্চার ছিলেন। নাজিরহাট এবং দোহাজারী রেললাইন চালুর দাবিতে তিনি আন্দোলন করেছিলেন।’</p> <p>চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির সিনিয়র সহসভাপতি আবু সুফিয়ান বলেন, ‘মহিউদ্দিন চৌধুরী মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতির পরও তিনি কিন্তু দলের বাইরে গিয়ে গণমুখী ও সাধারণ মানুষের স্বার্থ সংরক্ষণে সব সময় এগিয়ে আসতেন। এ কারণে তিনি মানুষের মনে স্থান করে নিয়েছেন। রাজনীতিতে যখন নোংরা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল তখন জমিয়তুল ফালাহ মসজিদ ময়দানে আরাফাত রহমান কোকোর গায়েবানা জানাজায় মহিউদ্দিন চৌধুরী অংশগ্রহণ করেছিলেন। শুধু এটি নয়, তিনি চট্টগ্রামে করবিরোধীসহ বিভিন্ন দাবি-দাওয়ার বিষয়ে সব সময় জনগণের পাশে ছিলেন। এরকম নেতা বিরল।’</p>