<p><strong>বিশ্বায়নের যুগে সংগীতরুচির পরিবর্তন ঘটেছে। সব অশুভ প্রবণতা অতিক্রম করার জন্য প্রয়োজন সাংস্কৃতিক জাগরণের। সৌহার্দ্য ও প্রীতির বন্ধন দৃঢ় হোক, বাঙালি জাতিসত্তার উন্মোচন ঘটুক </strong></p> <p> </p> <p>যেসব দিনপঞ্জির প্রচলন রয়েছে গ্রেগরিয়ান (ইংরেজি), আরবীয় বা চৈনিক, তাদের নতুন বছরের আদিপর্ব থেকে আগমন ঘটে মূলত আনন্দ আয়োজনে। বাঙালির নববর্ষ ঐতিহাসিকভাবে এর পাশাপাশি স্বতন্ত্র বার্তা বহন করে, যা পরিবর্তিত পরিস্থিতি সত্ত্বেও বর্তমানে প্রাসঙ্গিক। বাংলা নববর্ষের এই বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে উপমহাদেশের দেশভাগ থেকে বাংলাদেশ সৃষ্টি ও বর্তমান সমাজের মনোজগতের পরিবর্তনের পরোক্ষ সম্পর্ক লক্ষ করা যাবে।</p> <p>এ অঞ্চলের মুসলিম সমাজে ধর্ম বিশ্বাসের সঙ্গে তার জাতিসত্তাকে কেন্দ্র করে যে আত্মপরিচয়ের সংকট, সেটি গভীরতর হয়েছে ধর্মীয় দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্র সৃষ্টিতে। সব দেশে বিভিন্ন জাতি ও ধর্মাবলম্বী মানুষের মধ্যে স্বাতন্ত্র্যবোধ থাকা স্বাভাবিক। কিন্তু এই বোধ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে উসকে না দিলে এটি সাংঘর্ষিক হয় না। উপমহাদেশে ঐতিহাসিক তথ্য অনুযায়ী, ব্রিটিশ শাসক ও উভয় পক্ষের জাতীয় নেতারা এই স্বাতন্ত্র্যবোধকে উসকে দিয়েছেন কিংবা নিরস্ত করার চেষ্টা করেননি। বহুকাল ধরে গ্রামীণ পরিবেশে লোকগীতিকারদের সাহসী উচ্চারণ বহুত্ববাদী সমাজ গঠনে প্রভাব রাখলেও উভয় ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে বিচ্ছিন্নতা অস্বীকার করা যাবে না। আধুনিক শিক্ষা গ্রহণে তারতম্য, পারিবারিক রক্ষণশীলতা, সামাজিক ও অর্থনৈতিক উপাদান মুসলিম সমাজকে পাকিস্তান নামক ধর্মরাষ্ট্র গঠনে উদ্বুদ্ধ করে। অথচ আশ্চর্যের বিষয়, পাকিস্তান সৃষ্টির মাত্র এক বছরের মাথায় ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে প্রথম প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের মোহমুক্তির সূচনা হয়। সে নিজেকে বাঙালি জাতি পরিচয়ে চিহ্নিত করা শুরু করে, ষাটের দশকে এই জাতীয়তাবোধ বিকশিত হয় বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে মূলধারার স্বাধিকারের আন্দোলনে। ছাত্রসমাজ ও শিল্পী-সাহিত্যিক-চিন্তাবিদরা এতে পুষ্টি জোগান। উল্লেখ্য, এই কার্যক্রমে প্রধান ভূমিকা ছিল এ অঞ্চলের বিকাশমান মধ্যবিত্ত সমাজের। এ ক্ষেত্রে সময়কালের পরম্পরা লক্ষ করা যেতে পারে। ১৯৬১ সালে প্রতিরোধের মুখে অনুষ্ঠিত হলো রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী, সে বছর শীতে সংগীতের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতিসত্তাকে ধারণ করার লক্ষ্য নিয়ে ছায়ানটের জন্ম, ১৯৬২-তে ছাত্রসমাজের সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলনের সূত্রপাত, ১৯৬৬-তে বঙ্গবন্ধুর বাঙালির স্বাধিকার সংগ্রামের মূলমন্ত্র ছয় দফা ঘোষণা, যার পরণতি উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানে।</p> <p><img alt="সম্প্রীতির সুবাতাস বিস্তৃত হোক" height="333" src="https://cdn.kalerkantho.com/public/news_images/share/photo/shares/1.Print/2024/04.April/16-04-2024/5.jpg" style="float:left" width="445" />বহুকাল বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে পহেলা বৈশাখে হালখাতার উৎসব হতো, বিচ্ছিন্ন ঘরোয়া সংগীত আয়োজনেরও তথ্য পাওয়া যায়। তবে বিরাজমান রাজনৈতিক, সামাজিক পটভূমিতে নগরজীবনে ছায়ানটের রমনার বটমূলে বৃহত্তর অনুষ্ঠান নতুন মাত্রা যোগ করে বাঙালির স্বাধিকারের অভিযাত্রায়। অন্যদিকে পাকিস্তান সরকার সূচনাকাল থেকে উপলব্ধি করে যে এ অঞ্চলের জনগণের ঐক্যসূত্র তার ভাষা ও সংস্কৃতি। তাই বাঙালিকে ভাষা ও সংস্কৃতি থেকে বিচ্যুত করে পাকিস্তানের রাষ্ট্রচিন্তাকে তারা ধর্মের মোড়কে প্রতিষ্ঠিত করার নানা প্রয়াস গ্রহণ করে। রবীন্দ্রনাথ তথ্যমাধ্যমে পরিত্যাজ্য, নজরুলের সৃষ্টির প্রকাশ খণ্ডিতরূপে। রমনার বটমূলে নববর্ষের আয়োজন, সে কারণে নিছক সংগীতানুষ্ঠান তথা মিলনমেলা নয়, এর প্রতিবাদী রূপটিও স্পষ্ট। সর্বোপরি এটি হয়ে ওঠে বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনের সম্পূরক কার্যক্রম। লক্ষণীয়, জাতীয়তাবাদী আন্দোলন যতটা বেগবান হয়েছে, রমনার বটমূলে স্থান সংকূলান ততটা কঠিন হয়েছে। বস্তুতপক্ষে মূলধারার জাতীয় আন্দোলনের সঙ্গে ছাত্র আন্দোলনের তারুণ্য ও শিল্পী-সাহিত্যিকদের কর্মসূচির যুগলবন্দি দেশকে মুক্তিযুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দিয়েছে। এ কর্মযজ্ঞে বাংলা নববর্ষ উদযাপন গুরুত্বপূর্ণ অংশী। তাই বঙ্গবন্ধু ১৯৭৩ সালে সৈয়দ মুজতবা আলী ও সন্তোষ কুমার ঘোষকে যথার্থ বলেছিলেন, ‘ইন্ডিয়া ইজ আ পলিটিক্যাল ইউনিয়ন, বাংলাদেশ ইজ আ কালচারাল নেশন।’ তাই বাঙালির নববর্ষ উদযাপন অন্য সব প্রচলিত দিনপঞ্জি থেকে ভিন্ন বার্তা বয়ে আনে। এটি ইংরেজি নববর্ষের বিকল্প নয়, ভ্যালেনটাইনস ডের মতো বাণিজ্যিক আয়োজন নয়। এটি বাঙালি জাতিসত্তার উন্মোচনের দিবস।</p> <p>বাঙালির এই অভিযাত্রার দ্রুত সুফল পাওয়া গেল। সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে সর্বজনের মানবিক মর্যাদা প্রদানের অঙ্গীকার নিয়ে সে তার আপন স্বাধীন স্বদেশ ভূমি অর্জন করল, সংস্কৃতির যাত্রাপথ নির্বিঘ্ন হলো, নববর্ষ পরিণত হলো আমাদের একমাত্র ধর্মনিরপেক্ষ উৎসবে।</p> <p>এই পটভূমিতে এই নববর্ষ উদযাপনের প্রাসঙ্গিকতা বিবেচনা করা প্রয়োজন। প্রায় ছয় দশক পর বিশ্ব, দেশ, সমাজ ও ব্যক্তি জীবন ও চিন্তাধারায় বিপুল পরিবর্তন হয়েছে। বর্তমানে মধ্যবিত্ত নয়, সিদ্ধান্তগ্রহণকারীরা বিত্তবান সম্প্রদায় ধর্মীয় স্বাতন্ত্র্যবোধের সঙ্গে যুক্ত ধর্মীয় আচরণের নবতর ব্যাখ্যা সারা বিশ্বের মতো স্বদেশেও পরধর্মবিদ্বেষে ইন্ধন জোগাল। ফলে বিনষ্ট হলো সম্প্রীতির বন্ধন। তদুপরি বিশ্বায়নের যুগে সংগীতরুচির পরিবর্তন ঘটেছে। উপরন্তু কিছু ধর্মগুরুর সূত্রে সংগীত ধর্মে নিষিদ্ধ—এমন প্রচারণা অনেক পরিবারকে প্রভাবিত করছে। লোভের বিস্তৃতি থেকে সৃষ্ট আত্মকেন্দ্রিকতা ও স্বার্থপরতা আমাদের পারস্পরিক প্রীতির সম্পর্ককে সমাজ বিচ্ছিন্নতার শিকারে পরিণত করেছে। রক্ষণশীলতা ও অত্যাধুনিকতার উদ্ভট মিশ্রণ বহুজনের জীবনযাত্রা ও ব্যবহারবিধি বদলে দিয়েছে। আধুনিকতাকে অস্বীকার করি কিভাবে? তবে আমাদের পদযুগল যেন বাংলার মাটিতে থাকে। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ ছাড়া আমাদের জীবনে ও মননে নানা পরস্পরবিরোধী বিবেচনা ও অস্বাভাবিকত্ব চরম আকার ধারণ করতে উদ্যত হবে।</p> <p>আমরা সূচনাপর্বের দিনগুলোতে ফিরতে পারব না। তবে সব অশুভ প্রবণতা অতিক্রম করার জন্য প্রয়োজন সাংস্কৃতিক জাগরণের। নববর্ষের সব আয়োজনে বাংলা গানের আবহে সৌহার্দ্য ও প্রীতির বন্ধন দৃঢ় হোক, সম্প্রীতির সুবাতাস বিস্তৃত হোক, বাঙালি জাতিসত্তার উন্মোচন ঘটুক। এটি যেন এক দিনের বাঙালি সাজায় পর্যবসিত না হয়।</p> <p> </p> <p> লেখক : ছায়ানটের নির্বাহী সভাপতি</p> <p> </p> <p> </p>