উপমহাদেশে বেশির ভাগ মুসলমান হানাফি মাজহাব অনুসরণ করে থাকে। তাই হানাফি মাজহাব অনুসারে নামাজ পড়ার সংক্ষিপ্ত নিয়ম উল্লেখ করা হল-
প্রথমে অজুসহকারে দাঁড়িয়ে যান। নামাজের নিয়ত করে উভয় হাত কান পর্যন্ত উঠান। তাকবিরে তাহরিমা বলার পর বাঁ হাতের ওপর ডান হাত রেখে নাভির নিচে রাখুন।
জেনে নিন নামাজ পড়ার সংক্ষিপ্ত নিয়ম
মাওলানা সাখাওয়াত উল্লাহ
অর্থ : হে আল্লাহ! আমরা তোমারই পবিত্রতা ও প্রশংসা বর্ণনা করছি, তোমার নামই বরকতপূর্ণ এবং তোমার গৌরবই সর্বোচ্চ, তুমি ছাড়া অন্য কোনো উপাস্য নেই। (নাসায়ি, হাদিস : ৮৮৯)
এরপর অনুচ্চৈঃস্বরে আউজুবিল্লাহ (আউজু বিল্লাহি মিনাশ শায়তানির রাজিম), তারপর বিসমিল্লাহ (বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম) পড়ুন। (তাহাবি : ১/৩৪৭)
এবার সুরা ফাতিহা পড়ুন।
সুরা ফাতিহা শেষ হলে একটি সুরা অথবা তিনটি ছোট আয়াত, যা কমপক্ষে লম্বা একটি আয়াতের সমতুল্য হয় পড়ুন। (আবু দাউদ, হাদিস : ৬৯৫)
এই পরিমাণ তিলাওয়াত নামাজ শুদ্ধ হওয়ার জন্য আবশ্যক। তবে নামাজে কোরআন তিলাওয়াতের সুন্নত পরিমাণের বিবরণও ফিকহের কিতাবে উল্লেখ রয়েছে।
অতঃপর আল্লাহু আকবার বলে রুকুতে যান। রুকুতে মাথা নিতম্বের বরাবর করুন।
রুকুতে আঙুলগুলো ছড়িয়ে দিয়ে হাঁটু আঁকড়ে ধরুন। (মুজামে সাগির ২/৪৯৭)
রুকুতে কমপক্ষে তিনবার ‘সুবহানা রাব্বিয়াল আজিম’ পড়ুন। (তিরমিজি, হাদিস : ২৪২)
এবার রুকু থেকে ‘সামিয়াল্লাহু লিমান হামিদাহ’ বলে মাথা উঠান। মুক্তাদি হলে অনুচ্চৈঃস্বরে শুধু ‘রাব্বানা লাকাল হামদ’ বলুন। এরপর তাকবির তথা আল্লাহু আকবার বলে সিজদায় যান। (সহিহ বুখারি, হাদিস নম্বর : ৭৪৭)
সিজদায় যাওয়ার সময় প্রথমে হাঁটু, তারপর হাত, তারপর উভয় হাতের মধ্যে কপাল মাটিতে রাখুন। নিজের পেট রান থেকে এবং বাহুকে পার্শ্বদেশ থেকে পৃথক করে রাখুন। হাত ও পায়ের আঙুলকে কিবলামুখী করে রাখুন। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৭৮৫)
সিজদায় কমপক্ষে তিনবার ‘সুবহানা রাব্বিয়াল আলা’ পড়ুন। (তিরমিজি, হাদিস : ২৪২)
এরপর সিজদা থেকে উঠার সময় সর্বপ্রথম মাথা উঠিয়ে উভয় হাত রানের ওপর রেখে স্থিরতার সঙ্গে বসে পড়ুন। এরপর তাকবির বলে দ্বিতীয় সিজদা করুন। দ্বিতীয় সিজদায়ও কমপক্ষে তিনবার তাসবিহ পড়ুন। বিজোড় সংখ্যায় এর বেশিও পড়া যাবে। অতঃপর জমিনে হাত দ্বারা ঠেক না দিয়ে এবং না বসে সরাসরি তাকবির বলে দাঁড়িয়ে যান। এ পর্যন্ত প্রথম রাকাত সম্পন্ন হলো।
এখন দ্বিতীয় রাকাত আরম্ভ হলো। এতে হাত উঠাবেন না, ছানাও পড়বেন না, আউজুবিল্লাহও পড়বেন না। তবে আগের মতো সুরা ফাতিহা ও সঙ্গে অন্য একটি সুরা পড়ে রুকু-সিজদা করবেন। দ্বিতীয় সিজদা শেষ করে ডান পা খাড়া করে বাঁ পা বিছিয়ে দিয়ে তার ওপর বসে যাবেন। তখন আপনার হাত থাকবে রানের ওপর এবং ডান পায়ের আঙুলগুলো থাকবে কিবলামুখী। (মুসলিম, হাদিস : ৯১২)
অতঃপর নিম্নের তাশাহহুদ পড়বেন। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৭৮৮)
উচ্চারণ : ‘আত্তাহিয়্যাতু লিল্লাহি ওয়াস সালাওয়াতু ওয়াত তায়্যিবাত। আসসালামু আলাইকা, আইয়্যু হান্নাবিয়্যু ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহ। আস সালামু আলাইনা ওয়া আলা ইবাদিল্লাহিস সালিহিন। আশহাদু আল-লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়া আশহাদু আন্না মুহাম্মাদান আবদুহু ওয়া রাসুলুহ।’
তাশাহহুদ পড়ার সময় ‘আশহাদু আল-লা ইলাহা’ পড়ার সময় শাহাদাত আঙুল উঁচু করে ইশারা করবেন। আর ‘ইল্লাল্লাহু’ বলার সময় আঙুল নামিয়ে ফেলবেন।
তবে তাশাহহুদের বাক্য ও আঙুল দিয়ে ইশারা করার বিষয়ে অন্য নিয়মও ইমামদের বক্তব্যে দেখা যায়। তাই বিষয়টি নিয়ে বাড়াবাড়ি কাম্য নয়।
যদি দুই রাকাতবিশিষ্ট নামাজ হয়, যেমন—ফজরের নামাজ ইত্যাদি, তাহলে তাশাহহুদের পর নিম্নের দরুদ শরিফ পাঠ করবেন। (মুসলিম, হাদিস : ৬১৩)
উচ্চারণ : ‘আল্লাহুম্মা সাল্লি আলা মুহাম্মদ, ওয়ালা আলি মুহাম্মদ, কামা সাল্লাইতা আলা ইবরাহিমা ওয়া আলা আলি ইবরাহিম, ইন্নাকা হামিদুম মাজিদ। আল্লাহুম্মা বারিক আলা মুহাম্মদ, ওয়ালা আলি মুহাম্মদ, কামা বারাকতা আলা ইবরাহিমা ওয়া আলা আলি ইবরাহিম, ইন্নাকা হামিদুম মাজিদ।’
এরপর পবিত্র কোরআন ও হাদিসে বর্ণিত যেকোনো দোয়া পাঠ করবেন। (মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা, ১/২৯৮)
যেমন—এই দোয়া পড়তে পারেন। এটাকে দোয়ায়ে মাসুরা বলা হয়। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৭৯)
উচ্চারণ : ‘আল্লাহুম্মা ইন্নি জালামতু নাফসি জুলমান কাসিরাও ওলা ইয়াগফিরুজ জুনুবা ইল্লা আনতা, ফাগফিরলি মাগফিরাতাম-মিন ইনদিকা, ওয়ার হামনি ইন্নাকা আনতাল গাফুরুর রাহিম।’
অথবা এই দোয়া পড়বেন—উচ্চারণ : ‘রাব্বানা আতিনা ফিদ-দুনইয়া হাসানাহ, ওয়া ফিল আখিরাতি হাসানাহ, ওয়া কিনা আজাবান-নার।’
এরপর ‘আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ’ বলতে বলতে ডানে এবং বাঁয়ে মাথা ফেরাবেন। সালাম ফেরানোর সময় আপনার পাশের নামাজি ব্যক্তি এবং ফেরেশতাদের কথা স্মরণ করবেন।
যদি নামাজ তিন রাকাতবিশিষ্ট হয়, যেমন—মাগরিবের নামাজ, তখন প্রথম বৈঠকে তাশাহহুদের পর আর কিছু পড়বেন না। বরং ‘আল্লাহু আকবার’ বলে সোজা দাঁড়িয়ে যাবেন। (তিরমিজি, হাদিস : ২২৪)
তবে তৃতীয় রাকাতে শুধু সুরা ফাতিহা পড়বেন। আর নামাজ যদি চার রাকাতবিশিষ্ট হয়, যেমন—জোহর, আসর ও এশার নামাজ, তখন চতুর্থ রাকাতেও শুধু সুরা ফাতিহা পড়বেন। এরপর প্রথম দুই রাকাতের মতো রুকু-সিজদা করে দুই রাকাত সম্পন্ন করে শেষ বৈঠকে বসবেন। সেখানে উল্লিখিত পদ্ধতিতে তাশাহহুদের পর দরুদ এবং এরপর দোয়ায়ে মাসুরা পড়ে উভয় দিকে সালাম ফেরাবেন।
না দেখে পণ্য কেনার ক্ষেত্রে যেসব বিষয় গুরুত্বপূর্ণ
মুফতি আবদুল্লাহ নুর
পণ্য ক্রয়-বিক্রয়ের সময় তা উপস্থিত থাকাই উত্তম। তবে শরিয়তে পণ্য অনুপস্থিত রেখেও ক্রয়-বিক্রয় করা যায়। পণ্য যদি অনুপস্থিত থাকে তখন সুস্পষ্টভাবে গুণ ও বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করার দ্বারা কিনতে হয়। এটা বাইয়ে সালামের (অগ্রিম কেনা) ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।
আবার গুণাগুণ বর্ণনা করা ছাড়াও কেনা যেতে পারে। তখন পণ্য যে স্থানে রাখা হয়েছে তার দিকে ইঙ্গিত করা হবে কিংবা এমন সম্পর্ক উল্লেখ করা হবে, যার দ্বারা পণ্যটি অন্য বস্তু থেকে পৃথক হয়ে যাবে।
তবে শাফেয়ি মাজহাব অনুসারে অনুপস্থিত পণ্যের ক্রয়-বিক্রয় বৈধ নয়। গুণ ও বৈশিষ্ট্য বর্ণনার মাধ্যমে যদি বিক্রি সম্পন্ন হয় এবং পণ্যটি দেখার পর বিবরণের সঙ্গে তা মিলে যায়, তবে ক্রয় করা আবশ্যক হবে।
আর মিল পাওয়া না গেলে বেশির ভাগ ফকিহের মতে ক্রয়চুক্তি ভঙ্গ করার ইখতিয়ার থাকবে। যাকে ফিকহি পরিভাষায় খিয়ারুল খুলফ বলা হয়। হানাফি মাজহাব অনুসারে না দেখে কোনো পণ্য কিনলে ক্রেতা খিয়ারে রুয়াত বা দেখার ইচ্ছাধিকার (পণ্য দেখার পর প্রাপ্ত ইচ্ছাধিকার) লাভ করবে। অর্থাৎ ক্রেতা চুক্তি বহাল রাখা বা ভেঙে ফেলার ইচ্ছাধিকার পাবে।
যদি পণ্যের নমুনা বা মডেল দেখে তা ক্রয় করা হয় এবং পণ্যটির নমুনার বিপরীত না হয়, তবে ক্রেতা দেখার ইচ্ছাধিকার পাবে না। ক্যাটালগ ধরে বিক্রি করা অথবা নমুনা দেখিয়ে বিক্রি করা হলে এবং ক্যাটালগ ও নমুনার সঙ্গে তার মিল থাকলে বেচাকেনা বৈধ হবে। যেমন এক কেজি গম দেখিয়ে এক স্তূপ গম বিক্রি করা।
না দেখে পণ্য কেনার পর যদি তা ক্রেতা বা বিক্রেতার প্রত্যাশার চেয়ে পরিমাণে কম বা বেশি হয় এবং তা অনুমানের ওপর নির্ভর করে বিক্রি করা হয়, তবে বিক্রিতে তার কোনো প্রভাব পড়বে না। আর যদি তা পরিমাপ করে বিক্রি করা হয়, তবে নির্ধারিত পরিমাণের চেয়ে কম বা বেশি হলে তা বিক্রিতে প্রভাব ফেলবে।
এ ক্ষেত্রে দেখতে হবে পণ্য বিভিন্ন অংশে ভাগ করলে তার কোনো ক্ষতি হয় কি না। পণ্যটি যদি এমন হয় যে তা বিভিন্ন অংশে ভাগ হলে ক্ষতি হবে না, তবে পণ্য বেশি হলে তা বিক্রেতা ফেরত পাবে এবং কম হলে পণ্য দ্বারা তার ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে অথবা মূল্য হ্রাস করা হবে। যেমন পাত্রে পরিমাপ করে গম বিক্রি করা। আর পণ্যটি যদি এমন হয় যে তা বিভিন্ন অংশে ভাগ করলে পণ্যের ক্ষতি হয়। তবে পরিমাণ বেশি বা কম হলে বিক্রয় চুক্তি ভঙ্গ করার অধিকার থাকবে।
আল মাউসুয়াতুল ফিকহিয়্যা অবলম্বনে
জাকারিয়া (আ.) ফিলিস্তিনের যে স্থানে ইবাদত করতেন
আবরার আবদুল্লাহ
পবিত্র কোরআনে বর্ণিত নবী-রাসুলদের অন্যতম জাকারিয়া (আ.)। কোরআনের একাধিক স্থানে তাঁর বর্ণনা এসেছে। আল্লাহ তাঁকে নেককার ও অনুগ্রহপ্রাপ্ত বান্দা হিসেবে উল্লেখ করেছেন। যেমন—ইরশাদ হয়েছে, ‘আর জাকারিয়া, ইয়াহইয়া, ঈসা ও ইলিয়াসকেও সৎপথে পরিচালিত করেছিলাম।
অন্য আয়াতে জাকারিয়া (আ.)-কে মারিয়াম (আ.)-এর অভিভাবক আখ্যা দেওয়া হয়েছে। আল্লাহ বলেন, ‘অতঃপর তার প্রতিপালক তাকে (মারিয়াম) ভালোরূপে কবুল করলেন এবং তাকে উত্তমরূপে লালন-পালন করলেন এবং তিনি তাকে জাকারিয়ার তত্ত্বাবধানে রেখেছিলেন। যখনই জাকারিয়া কক্ষে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যেত তখনই তার কাছে খাদ্যসামগ্রী দেখতে পেত।
ঐতিহাসিকরা বলেন, জাকারিয়া (আ.) ছিলেন ফিলিস্তিনের অধিবাসী এবং তিনি মসজিদুল আকসায় ইবাদত-বন্দেগি করতেন। তাঁর পরিবার ছিল মসজিদুল আকসার সেবায় নিবেদিত।
ঐতিহাসিকরা বলেন, জাকারিয়া (আ.)-কে তাঁর মুসল্লা বা মিহরাবে ইবাদতরত অবস্থায় শহীদ করা হয়েছিল। বনি ইসরাঈলের লোকেরা তাঁকে হত্যা করেছিল বলে জানা যায়।
ধারণা করা হয়, দীর্ঘকাল অতিক্রান্ত হওয়ার ফলে জাকারিয়া (আ.)-এর মিহরাবের কয়েকবার স্থান বদল হয়েছে। বর্তমানে এটি আল-আকসা কমপ্লেক্সে ৪০ শহীদের মসজিদের দক্ষিণ দেয়ালে অবস্থিত, যা মূলত ওমরি বা কিবলি মসজিদের অন্তর্ভুক্ত। ক্রুসেড যুদ্ধের সময় আল-আকসা প্রাঙ্গণের এই স্থানে ৪০ জন মুসলিমকে শহীদ করা হয়েছিল। পরে তাঁদের স্মরণে এখানে একটি প্রার্থনাকক্ষ তৈরি করা হয়।
ক্রুসেডাররা ১০৯৯ খ্রিস্টাব্দে জেরুজালেম দখল করে। তারা মসজিদে আকসাকে ভবন (সামরিক ও আবাসিক) হিসেবে এবং ডোম অব দ্য রককে গির্জা হিসেবে ব্যবহার করত। তখন খ্রিস্টানরা মিহরাবে জাকারিয়াকে ‘চ্যাপেল’ বা বিশেষ প্রার্থনাকক্ষ হিসেবে ব্যবহার করত। ১১৮৭ খ্রিস্টাব্দে ক্রুসেডারদের হাত থেকে জেরুজালেমকে উদ্ধার করেন সুলতান সালাহুদ্দিন আইয়ুবি (রহ.)।
আবার কোনো গবেষকের ধারণা, মিহরাবে জাকারিয়া আল-আকসা প্রাঙ্গণের পূর্ব দেয়াল কাছে এবং পূর্ব প্রবেশপথের বিপরীতে অবস্থিত। যে দুটি স্থানকে মিহরাবে জাকারিয়া হিসেবে চিহ্নিত করা হয় তার একটিতে ‘মিহরাবে জাকারিয়া’ লেখা শিলালিপি আছে এবং অন্যটিতে মামলুক রীতিতে সুরা মারিয়ামের একটি আয়াত লেখা আছে।
তথ্যঋণ : মাদায়েন প্রজেক্ট, উর্দু পয়েন্ট ডটকম ও ইসলামিক ল্যান্ডমার্কস ডটকম
মদের বোতলে পানি রাখা প্রসঙ্গে ইসলাম কী বলে
অনলাইন ডেস্ক
মাদকের ভয়ংকর থাবায় বিশ্বব্যাপী বিপন্ন মানবসভ্যতা। এর সর্বনাশা ছোবলে অতীতে বহু জাতি ধ্বংস হয়ে গেছে। বর্তমানে ভেঙে পড়ছে অসংখ্য পরিবার। বিঘ্নিত হচ্ছে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা।
মহানবী (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘প্রত্যেক নেশাদ্রব্যই মদ আর যাবতীয় মদই হারাম।’ (মুসলিম ও মেশকাত, হাদিস : ৩৬৩৮)
সমাজের বেশির ভাগ অপরাধের জন্য মুখ্যভাবে দায়ী এই মাদকতা। এ জন্য রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘মদ পান কোরো না। কেননা তা সব অপকর্মের চাবিকাঠি।
ইসলাম পর্যায়ক্রমে মাদকতা নিষিদ্ধ করেছে। সুরা বাকারার ২১৯ নম্বর আয়াতে মাদকতা ও জুয়া খেলাকে মহাপাপ বলা হয়েছে। এরপর সুরা নিসার ৪৩ নম্বর আয়াতে মদ্য পান করে নেশাগ্রস্ত অবস্থায় নামাজ পড়তে নিষেধ করা হয়েছে। তারপর সুরা মায়েদার ৯০-৯১ নম্বর আয়াতে মদ চিরতরে হারাম করে দেওয়া হয়েছে। সুরা মায়েদার ৯০ নম্বর আয়াতে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, ‘তোমরা এসব (মদ, জুয়া ইত্যাদি) থেকে বিরত থাকো।
মদ ও মাদকদ্রব্য কিছুতেই ইসলামের সঙ্গে যায় না। মদের সঙ্গে সম্পৃক্ত ১০ শ্রেণির মানুষকে হাদিসে অভিশাপ দেওয়া হয়েছে। তারা হলো, মদের নির্যাস বেরকারী, মদ্যপায়ী, পরিবেশক, বিক্রেতা, ক্রেতা, উৎপাদনকারী কর্মচারী, উৎপাদক, পরিবাহক, আমদানিকারক ও লভ্যাংশ ভোগকারী। (তিরমিজি ও মেশকাত, হাদিস : ২৭৭)
প্রশ্ন হলো, মদ যখন এতই ঘৃণিত জিনিস, তাহলে যেসব বোতলে মদ রাখা হয়, সেসব বোতলে পানি রেখে তা পান করা কি বৈধ? দেখা যায়, বিভিন্ন রেস্টুরেন্টে বা অতিথিশালায় মদের বোতলে রাখা পানি পান করতে দেওয়া হয়, এমতাবস্থায় করণীয় কী?
এ প্রশ্নের জবাব হলো, যদি ভালোভাবে মদের বোতল পরিষ্কার করা হয়, এর মধ্যে মদের কোনো চিহ্ন না থাকে, তাহলে এমন পাত্র বা বোতলে রাখা পানি পান করা বৈধ।
যদিও ইসলামের প্রথম যুগে মদের পাত্রে রাখা পানি পান করতে নিষেধ করা হয়েছিল। ইসলামের প্রথম যুগে মূলত ৩টি কারণে মদের পাত্রে রাখা পানি পান করতে নিষেধ করা হয়েছিল।
এক. সেসব পাত্রে মদের চিহ্ন অবশিষ্ট ছিল।
দুই. সে সময় সবেমাত্র মদ হারাম করা হয়েছিল। তাই মদের পাত্রে পানি পান করলে মদের কথা স্মরণ হয়ে যেতে পারত। তাই সতর্কতামূলক এই নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছিল।
তিন. মদের প্রতি যেন পরিপূর্ণ ঘৃণা সৃষ্টি হয়, সে জন্য তখন মদের পাত্র ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। পরে যখন মদ হারাম হওয়ার বিষয়টি সবার জানা হয়ে যায় এবং সাহাবিদের মধ্যে মদের প্রতি প্রচণ্ড ঘৃণা জন্মে যায়, তখন ওই সব পাত্র ভালোভাবে পরিষ্কার করে তাতে রাখা পানি পান ইত্যাদি নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়। (তাকমিলা ফাতহুল মুলহিম : ৩/৩৫১)
এ প্রসঙ্গে একটি হাদিস পাওয়া যায়। হজরত বুরাইদা (রা.) তার পিতা থেকে বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘আমি তোমাদের কিছু পাত্রের ব্যাপারে (মদ রাখার পাত্র) নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিলাম। আসলে পাত্র কোনো কিছুকে হালাল বা হারাম করতে পারে না। তবে প্রতিটি মাদকদ্রব্য হারাম।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস নম্বর : ৫৩২৬, তিরমিজি, হাদিস নম্বর : ১৮৬৯)
উল্লিখিত হাদিস থেকে জানা যায়, মদের বোতল বা পাত্র ভালোভাবে পরিষ্কার করে তাতে পানি রাখলে সে পানি পান করা বৈধ।
খলিফা হওয়ার পর উমর বিন আবদুল আজিজের জীবনযাপন যেমন ছিল
মুফতি মাহমুদ হাসান
উমর ইবনে আব্দুল আজিজ (রহ.) উমাইয়া খেলাফতের অষ্টম খলিফা। সত্যনিষ্ঠা, খোদাভীরুতা ও ন্যায়-ইনসাফের কারণে মুসলিম উম্মাহ তাঁকে খুলাফায়ে রাশিদিনের মধ্যে গণ্য করে। তাঁকে পঞ্চম বা ষষ্ঠ খলিফায়ে রাশেদও বলা হয়। এ ছাড়া তাঁকে ‘দ্বিতীয় উমর’ বলেও স্মরণ করা হয়।
মদিনার গভর্নর নিযুক্তির মাধ্যমে শাসনকার্যের সূচনা
৮৭ হিজরিতে খলিফা আব্দুল মালিক ইবনে মারওয়ান উমর ইবনে আব্দুল আজিজকে মদিনার গভর্নর নিযুক্ত করেন। ৯১ হিজরিতে তিনি তায়েফসহ পুরো হেজাজের গভর্নর হন। গভর্নর নিযুক্তির পর প্রথম দিনই তিনি মদিনার বিজ্ঞ আলেমদের ডেকে বললেন : ‘আপনারা আমাকে সৎ পথে চলতে সহযোগিতা করবেন, আমি আপনাদের পরামর্শ ছাড়া কোনো কাজ করব না।
মুসলিম উম্মাহর খেলাফতের দায়িত্ব গ্রহণ
৯৯ হিজরিতে সুলাইমান ইবনে আব্দুল মালিকের ইন্তেকালের পর উমর ইবনে আব্দুল আজিজ (রহ.) উম্মাহর খলিফা নিযুক্ত হন। খলিফার দায়িত্ব গ্রহণের আগে তাঁর চলাফেরা ও বেশভূষায় ছিল একজন শৌখিন যুবকের ছাপ।
খেলাফত গ্রহণের পর সর্বপ্রথম ভাষণেই তিনি বলেন, ‘হে লোকসকল! আমি কোনো আইন প্রণেতা নই, বরং আমি শরিয়তের আইন বাস্তবায়নকারী।
শাসনব্যবস্থার বিরল বৈশিষ্ট্য ও কার্যাবলি
দায়িত্ব গ্রহণের পর খেলাফতব্যবস্থার সংস্কারে দৃঢ় পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। সুশাসন প্রতিষ্ঠা, মজলিসে শুরা বা উপদেষ্টা পরিষদ গঠন, অত্যাচার-নিপীড়নমূলক সব নীতিমালা পরিহার, জনসাধারণের মধ্যে ইলমের প্রচার-প্রসার ও হাদিস সংকলনের সূচনাসহ অনেক কল্যাণমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করেন তিনি। উমরের আড়াই বছরের সংক্ষিপ্ত খেলাফতকালে এমনই প্রাচুর্য হয়েছে যে মানুষ দান করার জন্য মাল বোঝাই করে দরিদ্রদের খুঁজত, কিন্তু কোনো দরিদ্র খুঁজে না পেয়ে সেগুলো নিয়ে ঘরে ফিরে আসত। আলেমদের মধ্যে যারা দ্বিনি শিক্ষাকার্যক্রমের কারণে আয়-রোজগারের পেছনে সময় দিতে পারতেন না, তিনি তাঁদের জন্য কোষাগার থেকে ভাতা চালু করেন। (সিরাতে উমর বিন আব্দুল আজিজ, ইবনে আব্দুল হাকাম পৃ: ১১০, ১৪১)
তিনি তাঁর মহান পূর্বসূরি খলিফা উমর ইবনুল খাত্তাব (রা.)-এর ন্যায় মানুষের দুঃখ-দুর্দশার খোঁজ নিতে ছদ্মবেশে জনপদে বের হতেন, মানুষের সমস্যার সমাধা করতেন, অত্যাচারিত ব্যক্তির পাশে দাঁড়াতেন। (প্রাগুক্ত, পৃ: ১১১, ১১৫)
উমর ইবনে আব্দুল আজিজের স্ত্রী ফাতেমা বলেন : একদা আমি তাঁকে দেখলাম জায়নামাজে বসে অঝোরে কাঁদছেন। আমি জিজ্ঞেস করলাম, কোনো দুর্ঘটনা ঘটেছে? তিনি বললেন : ফাতেমা! আমি মুহাম্মাদ (সা.)-এর উম্মতের দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়েছি, তাই আমি ক্ষুধার্ত দরিদ্রদের কথা ভাবছি, অসুস্থ, বস্ত্রহীন, দূরদেশে শত্রুদের হাতে বন্দি, শোষিত, অশীতিপর বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, প্রত্যন্ত অঞ্চলের অভাবগ্রস্ত পরিবারের কথা ভাবছি। আমাকে আমার রব হাশরের দিন এদের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করবেন এবং তাদের পক্ষে খোদ মুহাম্মাদ (সা.) দাঁড়াবেন। এ কথা ভেবে ভয়ে কাঁদছি যে সেদিন আমার কী অবস্থা হবে। (সিয়ারু আলামিন নুবালা : ৫/১৩২)
আমর ইবনে মুহাজির বলেন : উমর ইবনে আব্দুল আজিজ (রহ.) যখন সরকারি কাজে ব্যস্ত থাকতেন, তখন সরকারি বাতি ব্যবহার করতেন, কিন্তু যখন সরকারি কাজ শেষ হতো তা নিভিয়ে নিজ মালিকানাধীন বাতি জ্বালাতেন। (প্রাগুক্ত : ৫/১৩৬)
অনাড়ম্বর জীবন ও খোদাভীরুতার কিছু দৃষ্টান্ত
খলিফা হিসেবে দায়িত্ব পালন করলেও সার্বিক জীবনযাপনে তাঁর মতো সাদাসিধা অনাড়ম্বর খোদাভীরু শাসক সত্যিই ইতিহাসের পাতায় বিরল। মাইমুন (রহ.) বলেন, আমি উমর ইবনে আব্দুল আজিজের কাছে ছয় মাস অবস্থান করেছি, আমি তাঁকে একটি জামার বেশি ব্যবহার করতে দেখিনি, যা প্রতি জুমার দিন ধুয়ে শুকানোর পর আবার গায়ে দিতেন। একদা জুমায় আসতে দেরির কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন : ‘জামাটি ধুয়ে দিয়েছিলাম, তা শুকাতে দেরি হয়েছিল।’ (সিয়ারু আলামিন নুবালা : ৫/১৩২)
একদা উমর ইবনে আব্দুল আজিজ (রহ.) অসুস্থ হলে মাসলামা (রহ.) দেখতে যান। তখন তাঁর জামা ময়লা দেখতে পেয়ে স্ত্রী ফাতেমা, যিনি মাসলামার বোন, তাঁকে জামা ময়লা কেন জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন, কী করব? তাঁর এ ছাড়া কোনো জামা নেই, এটি ধুয়ে দিলে জামা ছাড়াই থাকতে হবে। (সিরাতে উমর, ইবনে আব্দুল হাকাম : পৃ: ৪৮)
খেলাফতের দায়িত্ব গ্রহণের পর তাঁর ঘরে সর্বদা অভাব-অনটন লেগেই থাকত। একবার তিনি ঘরে এসে দেখলেন, তাঁর মেয়েরা কথা বলার সময় মুখে হাত চাপা দিচ্ছে। তিনি বললেন, কী ব্যাপার? তারা বলল, আজ ঘরে কোনো তরকারি ছিল না, আমরা পেঁয়াজ দিয়ে রুটি খেয়েছি, আপনার কষ্ট হবে তাই আমরা মুখে হাত চেপে রেখেছি। এতদশ্রবণে তাঁর দুই চোখ অশ্রুসজল হলো। তিনি বললেন, ‘তোমরা কি চাও, তোমরা বিভিন্ন মুখরোচক খাবার খাবে, আর তোমাদের বাবা জাহান্নামের আগুনে জ্বলবে!’ এরপর তাঁরা সবাই কাঁদতে লাগলেন। (প্রাগুক্ত : পৃ: ৫৪)
একবার তাঁর এক কন্যা কানের দুল বানিয়ে দেওয়ার আবেদন করে কাউকে পাঠালে তিনি কন্যার কাছে দুটি জ্বলন্ত অঙ্গার পাঠিয়ে বললেন : ‘যদি তুমি এ দুটি তোমার কানে পরতে পার, তাহলে আমি তোমাকে কানের দুল বানিয়ে দেব।’ (প্রাগুক্ত, পৃ: ১৩৮)
স্ত্রী ফাতেমা বলেন : উমর খুব বেশি নফল পড়তেন না, নফল রোজা রাখতেন না। কিন্তু আল্লাহর কসম, আমি তাঁর মতো অধিক আল্লাহভীরু কাউকে দেখিনি। বিছানায় শুয়ে আল্লাহর কোনো নির্দেশ স্মরণ হলে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতেন এবং বলতেন : ‘হায়! আমার আর এই খেলাফতের দায়িত্বের মধ্যে যদি পূর্ব-পশ্চিমের দূরত্ব হতো।’ আল্লাহর কসম, খেলাফত গ্রহণের পর থেকে আমি তাঁকে কখনো হাসতে দেখিনি। (প্রাগুক্ত, পৃ: ৪৭)
তাঁর ব্যাপারে তাঁর ছেলেকে জিজ্ঞেস করা হলো যে খেলাফত গ্রহণের সময় তিনি কী পরিমাণ সম্পদের মালিক ছিলেন? তিনি বললেন, ৫০ হাজার দিনার (স্বর্ণ মুদ্রা)। এরপর জিজ্ঞেস করা হলো, তাঁর মৃত্যুর সময় কী পরিমাণ সম্পদের মালিক ছিলেন? বলা হলো ২০০ দিনার। (সিয়ারু আলামিন নুবালা : ৫/১৩৪)
১০১ হিজরি সনের ২০ রজব মুসলিম উম্মাহর এই মহান খলিফা মৃত্যুবরণ করেন। তখন তাঁর বয়স ছিল ৩৯ বছর। তাঁর শাসনকাল ছিল মাত্র দুই বছর পাঁচ মাস। মুসলিম উম্মাহ আজও সহস্রাধিক বছর যাবৎ আরেকজন উমর ইবনে আব্দুল আজিজের অপেক্ষায় আছে। আসবে কী সেই প্রতীক্ষিত উমর!