<p style="text-align: justify;">সমাজ ও রাষ্ট্রের শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষায় আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা অপরিহার্য। আর আইনের শাসন হলো যেখানে সরকারের সব কার্যক্রম আইনের অধীনে পরিচালিত হয় এবং যেখানে আইনের স্থান সব কিছুর ঊর্ধ্বে। আইনের শাসন তখনই বিদ্যমান থাকে, যখন সরকারি ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের অনুশীলন সাধারণ আদালতের পর্যালোচনাধীন থাকে, যে আদালতের শরণাপন্ন হওয়ার অধিকার সব নাগরিকের সমান। (বাংলা পিডিয়া)</p> <p style="text-align: justify;"><strong>সর্বত্র শান্তি-শৃঙ্খলা কাম্য : </strong>পৃথিবীতে ইসলামের আগমন ঘটেছে মানুষের অধিকার ও শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য। আর শান্তি-শৃঙ্খলাই সমাজের সমৃদ্ধি নিশ্চিত করে। পবিত্র মক্কা নগরীর গোড়াপত্তনের সময় ইবরাহিম (আ.) দোয়া করেন, ‘হে আমার প্রতিপালক! এই নগরীকে নিরাপদ কোরো।’ (সুরা : ইবরাহিম, আয়াত : ৩৫)</p> <p style="text-align: justify;">অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে, ‘আমি কি তাদেরকে এক নিরাপদ হারামে প্রতিষ্ঠিত করিনি, যেখানে সর্বপ্রকার ফলমূল আমদানি হয় আমার দেওয়া জীবিকাস্বরূপ?’ (সুরা : কাসাস, আয়াত : ৫৭)</p> <p style="text-align: justify;"><strong>বিশৃঙ্খলার বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান : </strong>ইসলাম সমাজ ও রাষ্ট্রের শান্তি-শৃঙ্খলা বিনষ্টকারীর বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তি ঘোষণা করেছে। আরফাজা (রা.) বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে বলতে শুনেছি, ‘তোমাদের এক নেতার অধীনে একতাবদ্ধ থাকা অবস্থায় যে ব্যক্তি এসে তোমাদের শক্তি খর্ব করার চেষ্টা করবে অথবা তোমাদের ঐক্য বিনষ্ট করবে তাকে তোমরা হত্যা করবে।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ৪৬৯২)</p> <p style="text-align: justify;"><strong>আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা কার দায়িত্ব : </strong>ইসলামী রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রপ্রধান, ইসলামী রাষ্ট্রের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান ও তাঁর দায়িত্বশীলদের দায়িত্ব হলো আইনের শাসন তথা ইসলামী বিধি-বিধান বাস্তবায়ন করা। শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া (রহ.) বলেন, ‘শরয়ি দণ্ডবিধি প্রয়োগ করা ছাড়া সত্কাজের আদেশ ও অসত্কাজ থেকে নিষেধ (যার নির্দেশ কোরআনে দেওয়া হয়েছে) তা পূর্ণতা লাভ করে না।... ইসলামী দণ্ডবিধি যথাযথভাবে প্রয়োগ করা রাষ্ট্রপ্রধানের দায়িত্ব। এই দায়িত্ব পালন করা হয় যখন করণীয় কাজ ত্যাগ এবং বর্জনীয় কাজে লিপ্ত হওয়ার কারণে শাস্তি দেওয়া হয়।’ (আল-হিসবাহ, পৃষ্ঠা-৪৫)</p> <p style="text-align: justify;"><strong>কঠোরতায় রক্ষা পাবে সমাজ :</strong> আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় রাষ্ট্রকে বাহ্যত কঠোর হতে হয়। কিন্তু এই কঠোরতার মধ্যে নিহিত আছে সমাজ ও রাষ্ট্রের নিরাপত্তা। মহান আল্লাহ বলেন, ‘হে বোধসম্পন্ন ব্যক্তিরা! কিসাসের (মৃত্যুদণ্ড) মধ্যে তোমাদের জন্য আছে জীবন। যাতে তোমরা সাবধান হতে পারো।’ (সুরা : বাকারাহ, আয়াত : ১৭৯)</p> <p style="text-align: justify;"><strong>অপরাধীর জন্য কল্যাণকামিতা : </strong>ইসলামী দণ্ডবিধি শুধু সমাজের অপরাধপ্রবণতা কমায় না, বরং অপরাধীকেও পাপমুক্ত হতে সাহায্য করে। উবাদা বিন সামিত (রা.) বলেন, আমরা একবার নবী (সা.)-এর কাছে এক মজলিসে ছিলাম। তখন তিনি বললেন, তোমরা আমার কাছে এই বাইআত করো যে আল্লাহর সঙ্গে কোনো কিছু শরিক করবে না, চুরি করবে না এবং ব্যভিচার করবে না। এরপর তিনি এই আয়াত পুরো তিলাওয়াত করলেন—‘তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি (বাইআতের শর্তগুলো) পুরো করে তার বিনিময় আল্লাহর কাছে। আর যে ব্যক্তি এটা থেকে কিছু করে বসে আর তার জন্য শাস্তি দেওয়া হয়, তবে এটা তার জন্য পাপের প্রতিদান হয়ে যায়। আর যদি কেউ এটা থেকে কিছু করে বসে আর আল্লাহ তা গোপন রাখেন, তবে এটা তাঁর ইচ্ছাধীন। তিনি ইচ্ছা করলে তাকে ক্ষমা করবেন, ইচ্ছা করলে শাস্তি দেবেন।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৬৭৮৪)</p> <p style="text-align: justify;"><strong>আইন প্রয়োগে নবীজি (সা.)-এর দৃঢ়তা :</strong> আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় মহানবী (সা.) অত্যন্ত কঠোর ছিলেন। উসামা (রা.) এক নারীর ব্যাপারে নবী (সা.)-এর কাছে সুপারিশ করলেন। তখন তিনি বললেন, ‘তোমাদের আগের সম্প্রদায়গুলো ধ্বংস হয়ে গেছে। কেননা তারা নিম্নশ্রেণির লোকদের ওপর শরিয়তের শাস্তি বাস্তবায়ন করত। আর অভিজাত লোকদের অব্যাহতি দিত। সেই সত্তার শপথ! যাঁর হাতে আমার জীবন, ফাতিমাও যদি এমন কাজ করত, তাহলে অবশ্যই আমি তার হাত কেটে দিতাম।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৬৭৮৭)</p> <p style="text-align: justify;"><strong>নিরপেক্ষতার গুরুত্ব : </strong>আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার প্রধান শর্তই হচ্ছে আইন প্রয়োগে রাষ্ট্রের সব নাগরিক সমান হওয়া, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা নিরপেক্ষ হওয়া। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘ব্যভিচারিণী ও ব্যভিচারী—তাদের প্রত্যেককে এক শ কশাঘাত করবে। আল্লাহর বিধান বাস্তবায়নে তাদের প্রতি দয়া যেন তোমাদেরকে প্রভাবান্বিত না করে, যদি তোমরা আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাসী হও; মুমিনদের একটি দল যেন তাদের শাস্তি প্রত্যক্ষ করে।’ (সুরা : নুর, আয়াত : ২)</p> <p style="text-align: justify;"><strong>চাই পর্যবেক্ষক দল : </strong>সুরা নুরের দ্বিতীয় আয়াতে আল্লাহ বলেছেন, ‘মুমিনদের একটি দল যেন তাদের শাস্তি প্রত্যক্ষ করে।’ আল্লামা ইবনে কাসির ও ইবনে জারির তাবারি (রহ.) উল্লিখিত আয়াতাংশের ব্যাখ্যায় একাধিক মতামত উল্লেখ করেছেন, যা থেকে পর্যবেক্ষণের প্রধান তিনটি উদ্দেশ্য স্পষ্ট হয়। তা হলো—</p> <p style="text-align: justify;">১. শাস্তি প্রয়োগে ভারসাম্য রক্ষা করা হচ্ছে কি না তা যাচাই করা। অর্থাত্ কঠোরতা ও শিথিলতা হচ্ছে কি না তা লক্ষ রাখা।</p> <p style="text-align: justify;">২. শাস্তি প্রয়োগ দেখে সতর্ক হওয়া এবং অন্যদের সতর্ক করা।</p> <p style="text-align: justify;">৩. অপরাধীদের তাওবার আহ্বান জানানো। (তাফসিরে ইবনে কাসির ও তাফসিরে তাবারি)</p> <p style="text-align: justify;"><strong>আইনের শাসন না থাকার পরিণতি : </strong>কোনো সমাজে আইনের শাসন না থাকার ভয়াবহতা সম্পর্কে সতর্ক করে মহানবী (সা.) বলেন, ‘হে মানবমণ্ডলী! নিশ্চয়ই তোমাদের আগের লোকেরা পথভ্রষ্ট হয়ে গেছে। কেননা কোনো সম্মানী ব্যক্তি যখন চুরি করত তখন তারা তাকে ছেড়ে দিত। আর যখন কোনো দুর্বল লোক চুরি করত তখন তার ওপর শরিয়তের শাস্তি প্রয়োগ করত।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৬৭৮৮)</p> <p style="text-align: justify;"><strong>দ্বৈত নীতি নিষিদ্ধ : </strong>উল্লিখিত হাদিসের আলোকের হাফেজ ইবনে হাজার আস্কালানি (রহ.) শরিয়তের কয়েকটি বিধান নির্ণয় করেছেন। তার কয়েকটি হলো—</p> <p style="text-align: justify;">১. বিচারকের জন্য একই বিষয়ের রায় দানে দ্বৈত নীতি অবলম্বন করা নিষিদ্ধ।</p> <p style="text-align: justify;">২. হদ বা দণ্ডের ব্যাপারে সুপারিশ নিষিদ্ধ। কেউ তা করলে প্রত্যাখ্যান করা আবশ্যক।</p> <p style="text-align: justify;">৩. শাসকের কাছে বিচার পৌঁছলে তাঁর দায়িত্ব ও কর্তব্য হলো আইন বাস্তবায়ন করা।</p> <p style="text-align: justify;">৪. হদ বা দণ্ড অপরিহার্য হয়ে পড়েছে এমন ব্যক্তির ওপর দণ্ড বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে পক্ষপাতিত্ব নিষিদ্ধ। যদিও সে তার ছেলে অথবা নিকটাত্মীয় অথবা মর্যাদাবান ব্যক্তি হোক।</p> <p style="text-align: justify;">৫. হদ বা দণ্ড প্রয়োগে সব ধরনের নমনীয়তা পরিহার করা আবশ্যক। (ফাতহুল বারি)</p> <p style="text-align: justify;"> <br />  </p>