ফলে ইহুদিরা দীর্ঘকাল ধরে ভোগ করে আসা সেই সুযোগ ও অনুগ্রহের কথা ভুলে যায় এবং ফিলিস্তিনের পবিত্র ভূমিতে আগ্রাসন শুরু করে। এর ফলে এই শান্তিপূর্ণ ভূমি এক অসহ্য নরকে পরিণত হয়, যা মুসলিম ও আরব জাতির হৃদয়ে এক গভীর ক্ষতের সৃষ্টি করে।
আমরা বলি ‘ইহুদি জাতির এক বড় অংশ’। কারণ তাদের অনেকেই এই অন্যায়, অত্যাচার ও উন্মত্ততাকে প্রত্যাখ্যান করে এবং ইসলামের অধীনে তাদের প্রাপ্ত শান্তির স্বীকৃতি দেয়। যেমন হাইফা, জাফা ও আল-কুদসে আরবদের বিরুদ্ধে চালানো বর্বর হামলার প্রতিবাদে সামারিয়ান ইহুদিদের প্রধান, নাবলুসের গভর্নরের কাছে পাঠানো এক প্রতিবাদপত্রে লিখেছেন,
‘আমরা, সামারিয়ান সম্প্রদায়ের সদস্যরা—নারী-পুরুষ উভয়ই— হাইফা, জাফা এবং বায়তুল মুকাদ্দাসে নিরপরাধ আরবদের ওপর কিছু ইহুদির বর্বর আক্রমণের তীব্র প্রতিবাদ জানাই এবং এসব ভয়াবহ ঘটনা যেন ভবিষ্যতে না ঘটে, সে বিষয়ে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের জোর দাবি জানাই। আমরা স্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা করছি, সংখ্যায় স্বল্প হওয়া সত্ত্বেও আমরা কয়েক হাজার বছর ধরে আমাদের আরব প্রতিবেশীদের সঙ্গে শান্তিতে বসবাস করছি এবং কখনো তারা আমাদের ওপর আক্রমণ করেনি বা নির্যাতন চালায়নি।’
অভিশপ্ত জায়নবাদ ও ব্রিটিশ উপনিবেশ একত্র হয়ে এই বিপর্যয় ডেকে আনার আগ পর্যন্ত হাজার বছর ধরে এই ছিল ফিলিস্তিনের সাধারণ অবস্থা।
এখানে সমস্যা সব ইহুদি ও সকল মুসলমানের মধ্যে নয়; বরং এক পক্ষে জায়নবাদ ও ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতা, আর অন্য পক্ষে ইসলাম ও আরবদের মধ্যে সংঘাত। ফিলিস্তিন হচ্ছে এই সংঘাতের ভুক্তভোগী। আর এই সংঘাতে শহীদ হচ্ছে আল-কুদসের মহান রক্ষকগণ। এর ময়দান হলো মসজিদুল আকসা।
তাই সেখানে যত প্রাণহানি ঘটছে, যত শিশু এতিম হচ্ছে, যত নারী বিধবা হচ্ছেন, যত সম্পদ বিনষ্ট হচ্ছে, যত ঘরবাড়ি ধ্বংস হচ্ছে এবং সর্বোপরি যত ইজ্জত-সম্ভ্রম লুণ্ঠিত হচ্ছে—সবকিছুর দায়ভার প্রত্যেক মুসলমানের কাঁধে। তাঁদেরকে আল্লাহ তাআলার দরবারে জবাবদিহি করতে হবে। তাঁরা যেন মনে রাখেন— এই ঘটনাগুলো যেন মক্কা ও মদিনাতেই ঘটছে। তাই যার যার সাধ্যানুযায়ী এই অত্যাচার বন্ধে কাজ করা জরুরি।
ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকরা জায়নবাদীদের ব্যবহার করে মুসলিমদের বিভক্ত করতে চায়। এই লক্ষ্য বাস্তবায়নে তারা পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে জায়নবাদী ইহুদিদের পবিত্র ভূমিতে একত্রিত করছে এবং ফিলিস্তিনকে পদদলিত করছে। এজন্যই তারা সৈন্য জমায়েত করছে, অর্থ জোগান দিচ্ছে এবং নিরপরাধ মানুষের রক্তে আল-আকসার পবিত্র প্রাঙ্গণ রক্তাক্ত করছে।
এইসব ঘটছে আর সারা মুসলিম ও আরব বিশ্ব এর প্রতিবাদ করছে। আরব ও মুসলিম শাসকগণ ব্রিটিশদের কাছে দাবি জানাচ্ছে। কিন্তু ব্রিটিশদের কানে কোনো আওয়াজ পৌঁছাচ্ছে না। তাদের হৃদয় পাথর হয়ে গেছে।
আমরা বলছি ‘ইসলামী ও আরব বিশ্ব’, কারণ এর বাইরে আর কারও পক্ষ থেকে কোনো প্রকৃত প্রতিবাদ বা সংহতি আমরা দেখিনি। যাদের আমরা অন্যদের দুঃখে তর্জন-গর্জন করতে দেখি এবং সম্ভবপর সব উপায়ে সাহায্য করতে দেখি, ফিলিস্তিনের প্রশ্নে তারা নীরব, তাদের হাত বন্ধ।
আমরা মুসলমানরা ইসলামের প্রকৃতি অনুযায়ী জুলুমের শত্রু। মজলুমের সহানুভূতিশীল। এমনকি সে আমাদের শত্রু হলেও। কিছুদিন আগে এক মুসলিম ব্যবসায়ী আমাকে জার্মানিতে ইহুদিদের ওপর অত্যাচারের খবর পড়ে শোনালেন এবং বললেন, ‘শাইখ! এটা তো ইসলামে হারাম। ইসলাম চায় সবাই তাদের ধন-সম্পদ নিয়ে শান্তিতে ও নিরাপদে থাকুক।’ উত্তরে আমি বললাম, ‘অবশ্যই।’ এবং তাকে বোঝালাম, ইতিহাসে ইহুদিরা কীভাবে ইসলামের ছায়ায় শান্তিতে বসবাস করেছে। অথচ এই ব্যবসায়ী একজন সাধারণ ধার্মিক মুসলিম, যিনি আল-কুদসে ইহুদিদের হাতে চলমান হত্যাযজ্ঞ সম্পর্কে অবগত। তারপরও সে তাদের ওপর নির্যাতনে দুঃখ প্রকাশ করছে এবং প্রতিবাদ জানাচ্ছে।
দেখুন, আজ জার্মানি থেকে ইহুদিদের বিতাড়িত করা হয়েছে। তাদের সম্পত্তি নিলামে বিক্রি করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ভবিষ্যতে সম্পত্তি অধিগ্রহণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। চিকিৎসা পেশা থেকে সম্পূর্ণভাবে তাদের নিষিদ্ধ করা হয়েছে। গ্রিস তাদের নিজের ভূখণ্ডে প্রবেশ করতে দিচ্ছে না—এমনকি পর্যটক হিসেবেও না। ইতালি তাদের ওপর ‘বৈজ্ঞানিক’ পদ্ধতিতে নির্যাতন চালাচ্ছে। ফ্রান্সেও একই হাওয়া বইছে।
এই পরিবর্তিত অবস্থায় ইহুদিরা আজ খ্রিস্টীয় ইউরোপে অবাঞ্ছিত। মধ্যযুগের মতোই তারা নিজেদের স্ত্রী-পরিবার ও ধন-সম্পদের বিষয়ে মুসলিম বিশ্ব ছাড়া আর কোথাও নিরাপদ বোধ করছে না। তা সত্ত্বেও তারা আল-কুদসের ভূমিতে মুসলিমদের বিরুদ্ধে জুলুম চালিয়ে যাচ্ছে। এতদ্বসত্ত্বেও তাদের আদেশ-উপদেশ দেওয়ার মতো যেন কেউ নেই!
এমনও হতে পারে যে, ইউরোপে তাদের ওপর যে জুলুম-নির্যাতন নেমে এসেছে, তা হয়তো ফিলিস্তিনের ভূমিতে তাদের অন্যায়-অত্যাচারের ফল। পবিত্র ভূমিতে তাদের ন্যায়ের অস্বীকার এবং অন্যায়ে নীরব থাকার শাস্তি। আল্লাহ জালেমকে জালেম দিয়েই শাস্তি দেন। তারপর উভয় পক্ষকে পাকড়াও করেন।
{وَاتَّقُوا فِتْنَةً لَا تُصِيبَنَّ الَّذِينَ ظَلَمُوا مِنْكُمْ خَاصَّةً ۖ وَاعْلَمُوا أَنَّ اللَّهَ شَدِيدُ الْعِقَابِ}
‘আর তোমার এমন ফিতনার ভয় করো, যা কেবল তোমাদের মধ্যে জালেমদের পাকড়াও করবে না। এবং জেনে রাখো, আল্লাহ কঠিন শাস্তিদাতা।’ (সুরা আনফাল, আয়াত : ২৫)