মৌলভীবাজারের লাউয়াছড়া বনসহ বিভিন্ন এলাকার বন উজাড় হওয়ায় বন্য প্রাণীরা বন ছেড়ে লোকালয়ে এসে প্রতিনিয়ত মানুষের হাতে ধরা পড়ছে। এ ছাড়া গাড়িচাপা ও মানুষের হাতে মারা যাচ্ছে তারা।
বন বিভাগের লোকজনকে সঙ্গে নিয়ে অক্ষত অবস্থায় প্রাণী উদ্ধার করে বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগে হস্তান্তর করা হয়। ১৩ বছরে খাদ্য, পানি ও আবাসস্থল সংকটে বন ছেড়ে লোকালয়ে আসা ৬৫২টি বন্য প্রাণী উদ্ধার করেছে বাংলাদেশ বন্য প্রাণী সেবা ফাউন্ডেশন।
জানা গেছে, ১৯৬৫ সালে শ্রীমঙ্গল উপজেলার পশু প্রেমিক সিতেশ রঞ্জন দেব নিজ উদ্যোগে সদর ইউনিয়নের নেয়াগাঁও গ্রামে প্রতিষ্ঠা করেন বন্য প্রাণী আশ্রয়কেন্দ্র। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় আশ্রয়কেন্দ্রটি ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। ১৯৭২ সালে শ্রীস চন্দ্র দেবের ছেলে সীতেশ রঞ্জন দেব তার আরকে মিশন রোডের বাসায় ক্ষুদ্র পরিসরে ফের চালু করেন আশ্রয়কেন্দ্রটি।
পরে রূপসপুর গ্রামে নিজের সাড়ে পাঁচ বিঘা জমির খামারবাড়িতে এটি স্থানান্তর করেন সীতেশ রঞ্জন দেব।
সরকারের অনুমোদন সাপেক্ষে যার নামকরণ করা হয় বাংলাদেশ বন্য প্রাণী সেবা ফাউন্ডেশন। ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে বন ছেড়ে খাদ্য ও বাসস্থানের সন্ধানে লোকালয়ে আসা প্রাণীদের উদ্ধার করে নিবিড় পর্যবেক্ষণ, সেবা ও চিকিৎসা দিয়ে পুনরায় বনে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। যে প্রাণীগুলো বনের পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারে না বা সুস্থ নয়, এমন প্রাণীদের এখানে রেখেই পরিচর্যা করা হচ্ছে বলে জানান বাংলাদেশ বন্য প্রাণী সেবা ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান সীতেশ রঞ্জন দেব।
বর্তমানে বাংলাদেশ বন্য প্রাণী সেবা ফাউন্ডেশনে অর্ধশতাধিক বিপন্ন ও বিরল প্রজাতির প্রাণী রয়েছে বলে জানান ফাউন্ডেশনের পরিচালক স্বপন দেব সজল।
তিনি জানান, এখানে উল্লেখযোগ্য প্রাণীদের মধ্যে মেছো বিড়াল (যা মেছো বাঘ নামে পরিচিতি), ভল্লুক, উল্লুক, চশমা হনুমান, গাধা, লজ্জাবতী বানর, চিত্রা হরিণ, মায়া হরিণ, ইমু পাখি, গন্ধগোকুল, অজগর, শঙ্খিনীসহ বিভিন্ন প্রজাতির সাপ, সাধারণ প্রজাতির বানর, ধূসর বানর, সোনালি বিড়াল, বন বিড়াল, হিমালয়ান পাম সিভিট, হনুমান, বনরুই, গুইসাপ, বন্য শূকর, উড়ন্ত কাঁঠবিড়ালি, বোম্বেটিনকেট গ্লেইক, ধনেশ পাখি, কাছিম, পেঁচা, বাজপাখি, শকুন, ময়নাসহ বিভিন্ন প্রজাতির পাখি রয়েছে।
বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের সহকারী বন সংরক্ষক (এসিএফ) জামিল মোহাম্মদ খান বলেন, ‘বন্য প্রাণী সেবা ফাউন্ডেশন থেকে অক্ষত অবস্থায় যেসব বন্য প্রাণী আমাদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছিল সেসব জীবিত বন্য প্রাণীকে লাউয়াছড়া বনে অবমুক্ত করেছি এবং মৃত প্রাণীকে মাটি চাপা দিয়েছি।’
বন্য প্রাণী সেবা ফাউন্ডেশন সূত্র জানায়, বিভিন্ন দিবসে বিভিন্ন দিনে বন বিভাগ ও প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে বন্য প্রাণীগুলোকে বনে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। ২০১২-২০২৫ সালের ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত ৬৫২টি বন্য প্রাণী অবমুক্ত করা হয়েছে। অজগর সাপ ১৩১টি, লজ্জাবতী বানর ৪০টি, গন্ধগোকুল ৪৬টি, মেছো বিড়াল ৩৩টি, বানর ২৭টি, তক্ষক ১৭টি, সোনালি বিড়াল ৫টি, বনবিড়াল ৪৫টি, হিমালয়ান পাম সিভেট ১টি, কালনাগিন সাপ ৪টি, হনুমান ১টি, বনরুই ১টি, গুঁইসাপ ৪টি, বন্য শূকর ৩টি, উড়ন্ত কাঠবিড়ালী ৫টি, লেজহীন চিকা ১টি, বোম্বেটিনকেট স্নেক ১টি, ধনেশ পাখি ১টি, কাছিম ৩টি, পেঁচা ১৮টি, সবুজ বুড়াল সাপ ১৪টি, শঙ্খিনী সাপ ১২টি, ফনিমনসা সাপ ৮টি, বিভিন্ন প্রজাতির পাখি ১৩৯টি, শিয়াল ১টি ,পদ্মগোখরা সাপ ৩টি, হিমালয়ান ধূরা সাপ ৫১টি, দুধরাজ সাপ ২টি, দাঁড়াশ সাপ ৭টি, সবুজ বুড়াল সাপ (পিট ভাইপার সাপ) ৬টি, বাজপাখি ২টি, খইয়া গোখরা সাপ ২টি, সবুজ ফনিমনসা সাপ ৩টি, কোবরা (কালা খড়িশ) সাপ ১টি, বিরল লালডোর সাপ ১টি, আইডক্যাট স্নেক ৫টি, কালো বক ১টি, নিশি বক ১টি, রেসাস বানর ১টি, ঘর গিন্নি সাপ ৩টি, গ্রে কেট স্নেক ১টি, ক্যান্টরের (কুকরী সাপ) ১টি, মেটে সাপ ১টি বনে অবমুক্ত করা হয়েছে।
বন্য প্রাণী সেবা ফাউন্ডেশনের পরিচালক সজল দেব বলেন, আহত বন্য প্রাণীকে সেবা দিয়ে সুস্থ করে বনে অবমুক্ত করা হয়। এখানে জন্ম নেওয়া প্রাণীগুলো এককভাবে জীবনযাপনে সক্ষম হলেই বনে ছেড়ে দেওয়া হয়। তবে বনে ছাড়ার পরও খাদ্য ও বাসস্থানের সংকটে অনেক প্রাণী আবার বনের বাইরে এসে ধরা পড়ে। বিশেষ করে শিক্ষার্থীদের মধ্যে এই সচেতনতা বেশি। তারা ফাউন্ডেশনে ঘুরতে এসে প্রাণীদের সম্পর্কে জানে।’