<article> <p style="text-align: justify;">‘Opinion is the medium between knowledge and ignorance’- Plato দেশের সার্বিক পরিস্থিতি কেমন, তা নিয়ে খোদ অর্থনীতিবিদরাই একমত নন। এমনিতেই তাঁদের বদনাম রটেছে এই বলে যে দুজন অর্থনীতিবিদ থাকা মানে পাঁচটা মত। তা ছাড়া অর্থনীতিবিদ (তথা সমাজবিজ্ঞানী) এবং আমজনতার ধারণা যে এক হয় না, সে কথা বেশ পুরনো। যেমন—একটি দেশ শনৈঃ শনৈঃ উন্নতি করছে, কিন্তু কোনো কারণে আমার সন্তান বেকার, দেশটি জাহান্নামে গেছে বলে আমার ধারণা হতে পারে।</p> </article> <article> <p style="text-align: justify;">সম্ভবত তার সূত্র ধরে এসেছে পাবলিক পারসেপশন বা জনগণের অভিমত কথাটি। তাই এককালের মতো আর্থ-সামাজিক বিষয়াদি বিশ্লেষণে আজকাল কেবলই পরিমাণগত পরিমাপে গবেষক তুষ্ট নন; তাঁদের বেছে নিতে হয় বিভিন্ন গুণগত পরিমাপ। এবং সেই লক্ষ্যে অনেকটা মিশ্র পদ্ধতি ব্যবহার করে আজকাল দেশের অবস্থা সম্পর্কিত জনগণের ধারণা নেওয়ার প্রয়াস চালানো হয়। অবশ্য সমাজবিজ্ঞানী এবং সমাজের লোকজনের ধারণা কতটুকু কাছাকাছি কিংবা দূরে, তা পরিমাপ করার পদ্ধতিও আছে, তবে আপাতত সে ব্যাপারটি তাকে তোলা থাক।</p> </article> <article> <p style="text-align: justify;">সম্প্রতি দি এশিয়া ফাউন্ডেশন ও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স (বিআইজিডি) সারা দেশে কিছুসংখ্যক নমুনা-উত্তরদাতার ওপর এক সমীক্ষা চালিয়েছে। নাগরিকদের ওপর পরিচালিত এই সমীক্ষার মূল উদ্দেশ্য ছিল শাসন, উন্নয়ন এবং সমাজ সম্পর্কিত বিভিন্ন দিকের বর্তমান অবস্থান নিয়ে নাগরিকদের মতামত তুলে ধরা। সারা দেশের ৬৪ জেলার ১০ হাজারের একটু বেশি, সমানুপাতে বণ্টিত নারী ও পুরুষ নমুনা হিসেবে সমীক্ষায় অংশগ্রহণ করেছেন; মোট নমুনা-নাগরিকের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ পল্লী এবং এক-তৃতীয়াংশ নগর থেকে নেওয়া।</p> <p style="text-align: justify;">বর্তমান সমীক্ষাটির শক্তিশালী দিক হচ্ছে এর লঙ্গিটিউডানল বা দ্রাঘিমাসংক্রান্ত অবয়ব অর্থাৎ ২০১৪ সাল থেকে এ ধরনের সমীক্ষা চলে আসছে—সম্ভবত পাঁচ বছর পর—এবং যারা উত্তর দিচ্ছেন, তাঁরা এর আগেও মতামত দিয়েছিলেন।</p> </article> <article> <p style="text-align: justify;">প্রসঙ্গত বলা প্রয়োজন যে এবং অনুমান করি, পরিবর্তিত পরিস্থিতির আলোকে কিছু উৎসাহ-উদ্দীপক নতুন প্রশ্ন অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল, যাতে সমীক্ষাটি প্রথাগত রূপ ধারণ না করে।</p> <p style="text-align: justify;"><strong>দুই.</strong></p> <p style="text-align: justify;">এবার সমীক্ষা থেকে প্রাপ্ত পর্যবেক্ষণগুলোর দিকে দৃষ্টি দেওয়া যাক। বর্তমান নিবন্ধে সমাজ, রাজনীতি এবং অর্থনীতি নিয়ে কথা হবে, এর প্রধান কারণ নিবন্ধকারের অন্যান্য বিষয়ের ওপর আপেক্ষিক সুবিধার অভাব কিংবা সোজা কথায় তাঁর অজ্ঞতা। উত্তরদাতাদের প্রায় অর্ধেক মনে করে, দেশের রাজনৈতিক গতিপথ ভুল দিকে যাচ্ছে অথচ ২০১৯ সালের সমীক্ষায় এমন নেতিবাচক মন্তব্য করেছিলেন মাত্র এক-তৃতীয়াংশ উত্তরদাতা। এর মানে দেশের রাজনৈতিক গতিপথ ভুল দিকে চলছে বলে যাঁরা ভাবতেন, তাঁদের তাঁবুতে আরো মানুষ যোগ দিয়েছে।</p> </article> <article> <p style="text-align: justify;">অন্যদিকে বর্তমান সমীক্ষায় প্রায় ৪০ শতাংশ উত্তরদাতা ভেবেছেন চলমান রাজনৈতিক গতিপথ ঠিক আছে, কিন্তু ২০১৯ সালে <img alt="নাগরিকের দৃষ্টিতে দেশ" height="462" src="https://cdn.kalerkantho.com/public/news_images/share/photo/shares/1.Print/2024/03.March/02-03-2024/Untitled-1.jpg" width="500" />অনুপাতটি ছিল ৬৪ শতাংশ। আঞ্চলিক আঙ্গিকে আশাবাদীর আধিক্য দেখা যায় ময়মনসিংহ, বরিশাল ও রংপুরে। অপরদিকে নিরাশাবাদীর আধিক্য ঢাকা, সিলেট ও রাজশাহীতে। যাঁরা বলেছেন ‘সঠিক পথে চলছে রাজনীতি’, তাঁদের কাছে কারণগুলো নিম্নরূপ—রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, দেশের উন্নয়ন, মানবাধিকারের উন্নয়ন, রাজনৈতিক সহিংসতা হ্রাস এবং অবকাঠামো। অন্যদিকে ‘ভুল সবই ভুলের’ পক্ষে যুক্তি হচ্ছে : অস্থিতিশীলতা, এক দলের প্রভাব, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড এবং ভোট দিতে না পারা। তবে লক্ষণীয় যে শহরের তুলনায় গ্রামে আশাবাদীর অনুপাত বেশি।</p> <p style="text-align: justify;">অপরদিকে অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় ২০১৯ সালে যেখানে ৭০ শতাংশ উত্তরদাতা মনে করেছিলেন অর্থনৈতিক গতিপথ সঠিক ছিল, ২০২২ সালে এমন মত প্রকাশ করেছে উত্তরদাতাদের মাত্র এক-চতুর্থাংশ। আবার একই সময়ে ভুল পথ বিবেচনা করেছেন যথাক্রমে ২৮ ও ৭০ শতাংশ উত্তরদাতা। যাঁরা অর্থনীতির ভালো অবস্থার কথা বলেছেন, তাঁদের যুক্তির মধ্যে আছে ভালো অর্থনৈতিক অবস্থা, সার্বিক উন্নয়ন, উন্নত অবকাঠামো, কর্মসংস্থান, মানসম্মত জীবন ইত্যাদি। অপরদিকে যাঁরা অর্থনীতির খারাপ অবস্থার কথা বলেছেন (৭০ শতাংশ উত্তরদাতা), তাঁদের ব্যক্ত কারণগুলোর মধ্যে আছে জিনিসপত্রের উচ্চমূল্য (৮৪ শতাংশ), খারাপ অর্থনৈতিক অবস্থা (৩৫ শতাংশ), কর্মসংস্থানের অভাব (১৬ শতাংশ) ইত্যাদি।</p> <p style="text-align: justify;">সব শেষে সামাজিকভাবে বাংলাদেশের গতিপথ সঠিক আছে—এমন প্রবক্তার অনুপাত ২০১৯ সালের ৭৭  থেকে ২০২২ সালে নেমেছে ৫৮ শতাংশে। মোটকথা, ২০১৯ সালের তুলনায় ২০২২ সালে হতাশার চিত্রটি প্রকট এবং আশার চিত্র ম্লান হয়। এর কারণ কী, তার ব্যাখা নেই। তবে একটি দেশের উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের ‘প্রত্যাশার’ প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধি পায় বলে এমনটি হয় কি না ভাবার অবকাশ থেকেই যায়। দ্বিতীয়ত, নানা কারণে ২০২২ সাল বিশ্বব্যাপী অস্থির একটা সময়, যা ফলাফলকে প্রভাবিত করে থাকতে পারে বলে আমাদের ধারণা।</p> <p style="text-align: justify;"><strong>তিন.</strong></p> <p style="text-align: justify;">এবার অন্য কিছু বিষয়ে সাধারণ নাগরিকের অভিমত দেখা যেতে পারে; যেমন—সমীক্ষার ফল থেকে দেখা যাচ্ছে যে বেশির ভাগ উত্তরদাতা স্থানীয় সংসদ সদস্যদের কাজে তুষ্ট এবং প্রায় ৯০ শতাংশ উত্তরদাতা তাঁদের চেয়ারম্যান বা মেয়র সঠিক শনাক্ত করতে পেরেছেন।</p> <p style="text-align: justify;">মর্যাদার সঙ্গে বাঁচতে হলে একজন নাগরিকের তিনটি প্রয়োজনীয় উপাদান কী—এমন এক প্রশ্নের উত্তরে পর পর উঠে এসেছে অর্থ, শিক্ষা, ভালো আচরণ এবং খাবারের কথা। মুক্তভাবে বাঁচার জন্য কী লাগে? এ ক্ষেত্রেও এক-তৃতীয়াংশ উত্তরদাতা বলেছেন টাকার কথা এবং ক্রমান্বয়ে এসেছে চলাচলের স্বাধীনতা, শিক্ষা, নিরাপত্তা, খাদ্য, কর্মসংস্থান এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতা, যদিও এই প্রতিটি পর্যায়ে উত্তরদাতার অনুপাত ১০ঃ৪ শতাংশ। বিস্ময়ের ব্যাপার, যে দেশে নাগরিকের স্বাধীনতা নিয়ে এত হৈচৈ দেশের ভেতরে এবং বাইরে, সে দেশে নাগরিকদের সমীক্ষায় মুক্তভাবে বাঁচার জন্য মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে গুরুত্ব দিয়েছেন প্রতি ১০০ উত্তরদাতার মধ্যে মাত্র চারজন! তবে হ্যাঁ, উত্তরদাতার শিক্ষাস্তর অনুযায়ী অর্থের ভূমিকা কমেছে অর্থাৎ অপেক্ষাকৃত অল্প শিক্ষিতের কাছে মুক্তভাবে বাঁচার প্রধান হাতিয়ার অর্থ—যেন অর্থই জীবনের সব অর্থের মূল। এর মানে কি এই দাঁড়ায় যে মতামতের স্বাধীনতাকে তাঁরাই গুরুত্ব দিয়ে থাকেন, যাঁদের অর্থনৈতিক সংকট অপেক্ষাকৃত কম?</p> <p style="text-align: justify;"><strong>চার.</strong></p> <p style="text-align: justify;">পাঠককুলের মধ্যে যাঁরা চোখের পাতা এক করতে পারছেন না ‘গণতন্ত্রের’ আওয়াজ নেই বলে, তাঁদের জন্য এই সমীক্ষায় কিছু প্রণিধানযোগ্য পর্যবেক্ষণ উঠে এসেছে। যেমন—মোট উত্তরদাতার এক-তৃতীয়াংশের কিছু বেশি, তারা জানে না একটি দেশকে কখন গণতান্ত্রিক বলে ঠাহর করা হয়। ২০১৯ সালে মাত্র ৫ শতাংশ এ রকম উত্তর দিয়েছিল। উত্তরদাতাদের প্রায় ২০ শতাংশ বলেছে, ‘সবার জন্য সমান অধিকার’, এর কাছাকাছি উত্তর মানুষের স্বাধীনতা (১৭ শতাংশ), জনগণের দ্বারা সরকার (১৫ শতাংশ), মত প্রকাশের স্বাধীনতা (১১ শতাংশ) ইত্যাদি। উত্তরদাতাদের ৭০ শতাংশ বলেছে, তারা বিগত স্থানীয় সরকার নির্বাচনে ভোট দিয়েছে এবং ৫২ শতাংশ দিয়েছে সংসদ নির্বাচনে এবং প্রায় শতভাগের ইচ্ছা আগামী নির্বাচনে ভোট দেওয়ার। উত্তরদাতাদের একটি শক্তিশালী অংশ (৭২ শতাংশ) ‘অনুভব করা যেতে পারে যে রাজনীতি/শাসনে এক দলের আধিপত্য দৃশ্যমান‘—এমন বক্তব্যের সঙ্গে সহমত পোষণ করে, যেখানে ২০১৯ সালে ৮৬ শতাংশ বলেছিল এই কথা। তবে যাঁরা মনে করেন কর্তৃত্বময় দল ব্যবস্থা রাজনীতির জন্য ইতিবাচক, তাঁদের অনুপাত কমেছে ২০১৯ সালের ৪৫ থেকে ২০২২ নাগাদ ১৯ শতাংশ। উত্তরদাতার এলাকায় রাজনৈতিক মত প্রকাশ করতে পারেন কি না—এমন প্রশ্নের উত্তরে ৪৩ শতাংশ বলেছে হ্যাঁ, যা ২০১৯ সালের ৩৭ শতাংশের চেয়ে বেশি।</p> <p style="text-align: justify;">বাংলাদেশের চলমান চ্যালেঞ্জ বলতে গিয়ে যেসব সমস্যার কথা উঠে এসেছে তার মধ্যে আছে মূল্যস্ফীতি (৪৪ শতাংশ), ব্যবসা-বাণিজ্যে মন্দা (১১ শতাংশ), বেকারত্ব (১০ শতাংশ), রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা (৮ শতাংশ) এবং দুর্নীতি (৩ শতাংশ)।</p> <p style="text-align: justify;"><strong>পাঁচ.</strong></p> <p style="text-align: justify;">সামগ্রিক অর্থে সমীক্ষায় প্রাপ্ত পর্যবেক্ষণ থেকে সাধারণ নাগরিক থেকে শুরু করে নীতিনির্ধারক মহল, সমাজবিজ্ঞানী, গবেষক, শিক্ষক, সাংবাদিক, ছাত্র-ছাত্রী সবাই উপকৃত হতে পারে। সমীক্ষা থেকে সরকারের বিভিন্ন সাফল্যের কথা যেমন উঠে এসেছে, তেমনি সাধারণ নাগরিকরা তাদের দুর্বল দিকগুলো চিহ্নিত করেছেন। এমনকি নমুনাকৃত নাগরিকরা দেশ ও সমাজের স্বার্থে কিছু সুপারিশ রেখেছেন। সরকারের দায়িত্ব দাঁড়ায় নাগরিক প্রদর্শিত নেতিবাচক নির্দেশকগুলোকে ইতিবাচক দিকে মোড় ঘোরানোর ব্যবস্থা করা। আর একটি কথা, মূল প্রতিবেদনটি শুধু রাজনীতি, অর্থনীতি আর সমাজনীতি নিয়ে নয়, এটি আরো বিস্তৃত এবং ব্যাপক পরিসরে ব্যাপৃত। সময় সাপেক্ষে আমরা কেবল কিছু অংশ নিয়ে—যাকে বলে ‘টিপ অব দি আইসবার্গ’ আলোচনা করলাম। ভবিষ্যতে অন্যান্য দিকে দৃষ্টি দেওয়ার আশা রাখি।</p> <p style="text-align: justify;">‘There is no such thing as public opinion. There is only published opinion’- Winston Churchill.</p> <p style="text-align: justify;"><strong>লেখক : </strong>অর্থনীতিবিদ, সাবেক উপাচার্য জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়</p> </article>