<article> <p style="text-align: justify;">নির্বাচনে প্রতিপক্ষকে হারানোর জন্য অন্য পক্ষ সব সময় রণকৌশল রচনা করে। এটা নতুন কিছু নয়। তবে প্রতিহিংসার রাজনীতি এবং ভোটের মুখে প্রতিপক্ষকে দুর্বল করার জন্য সরকারি রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করা, এগুলো নিশ্চয়ই সুষ্ঠু রাজধর্মের পরিচায়ক নয়। ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের দামামা বেজেছে ভারতে।</p> </article> <article> <p style="text-align: justify;">বহুদিন ধরেই বিরোধীরা অভিযোগ করছিল, সিবিআই এবং এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেটকে দিয়ে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার রাজনীতি করছে শাসকদল বিজেপি। এবার দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়ালকে ভোটের মুখে গ্রেপ্তার করার পর শুধু দেশে নয়, গোটা পৃথিবীতে প্রশ্ন উঠেছে একটাই— Has the BJP over reached? তা না হলে যেনতেন প্রকারেণ চাণক্যের রণকৌশল, সাম-দাম-দণ্ড-ভেদ, সেটা পালন করার নামে এভাবে প্রতিটি বিরোধী পক্ষকে নাস্তানাবুদ করা কি উচিত রাজনীতি? এই প্রশ্নটা এত দিন উঠছিল। কিন্তু কেজরিওয়ালকে গ্রেপ্তারের পর উল্টো বিজেপির আক্রমণাত্মক রাজনীতি নিয়েই প্রশ্ন উঠেছে।</p> <p style="text-align: justify;">জার্মানি-যুক্তরাষ্ট্রের পর জাতিসংঘ কেজরিওয়ালের গ্রেপ্তারির পর মুখ খুলেছে।</p> </article> <article> <p style="text-align: justify;">জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসের মুখপাত্র স্টিফেন দুজারিক বলেছেন, ‘আমরা আশা রাখি, ভারতসহ যেসব দেশে নির্বাচন হচ্ছে, সেখানে রাজনৈতিক এবং নাগরিক অধিকার সুরক্ষিত থাকবে, যাতে অবাধ সুষ্ঠু এবং ভয়হীন পরিবেশে প্রত্যেকে ভোট দিতে পারেন।’ তাঁকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়ালের গ্রেপ্তার এবং কংগ্রেসের অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ করা নিয়ে। সেটা নিয়ে তিনি সরাসরি কোনো মন্তব্য করেননি। তবে মহাসচিবের পক্ষে যে বার্তাটা দিয়েছেন, তা কিন্তু যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ বলেই মনে করছে আন্তর্জাতিক মহল।</p> </article> <article> <p style="text-align: justify;">সবচেয়ে যেটা গুরুত্বপূর্ণ, ভারতে এর আগে অনেক নির্বাচন হয়েছে। ভারত তো একটা প্রবীণ গণতন্ত্রের দেশ। ভারতের রাজনৈতিক অস্থিরতা নিয়ে এভাবে কেউ কখনো প্রশ্ন তোলেনি। এখন কী এমন ঘটল যে ভারতের নির্বাচনী রাজনীতিকে পলিটিক্যাল আনরেস্ট বলা হচ্ছে?</p> <p style="text-align: justify;"><img alt="সমালোচনার মুখে ভারতের রাজনীতি" height="300" src="https://cdn.kalerkantho.com/public/news_images/share/photo/shares/1.Print/2024/04.April/01-04-2024/556_kaler-kantho--3-2024.jpg" width="500" />আসলে কেজরিওয়ালকে গ্রেপ্তার করা হলেও দিল্লিতে কেজরিওয়ালের পক্ষে একটা সহানুভূতির হাওয়া আছে। প্রথমত, কেজরিওয়াল তস্কর—এমন ভাবমূর্তি এখনো বহু মানুষই মানতে রাজি নয়।</p> </article> <article> <p style="text-align: justify;">কেজরিওয়াল নিজে কোনো দপ্তরের দায়িত্বে ছিলেন না। তাঁর স্বাক্ষরের ভিত্তিতে কোনো কাজ হয়নি। কেজরিওয়াল যেহেতু আম আদমি পার্টির প্রধান কাণ্ডারি, সুতরাং তাঁকে ভোটের সময় জেলের মধ্যে পুরে রাখলে আপের রাজনৈতিক কার্যকলাপে অসুবিধা হবে, এমনটাই মনে করা হচ্ছে। দিল্লিতে সাতটা লোকসভা আসন। সেই সাতটা আসনেই বিজেপি জয়ী। ১০ বছর পরও সাতটা আসনে একইভাবে জয়লাভ করা খুব কঠিন কাজ। কংগ্রেস এবং কেজরিওয়ালের মধ্যে দিল্লিতে নির্বাচনী বোঝাপড়া হওয়ার সম্ভাবনা আছে জেনেই বিজেপি এই ধরনের আক্রমণাত্মক লাইন নিয়েছে—এমনটাই বলা হচ্ছে।</p> <p style="text-align: justify;">কেজরিওয়ালকে বলা হয়েছিল, যাতে কংগ্রেসের সঙ্গে তিনি বোঝাপড়া না করেন। পাঞ্জাবে বোঝাপড়া না হলেও গুজরাট এবং দিল্লির মতো রাজ্যগুলোতে তিনি কংগ্রেসের সঙ্গে বোঝাপড়া করেছেন। কেজরিওয়ালের সমর্থনে দিল্লিতে জনসভা হচ্ছে এখন। সেখানে কাতারে কাতারে মানুষ রাস্তায় নেমে পড়েছে। কেজরিওয়ালের পক্ষে সোচ্চার হয়েছে বহু মানুষ। কেজরিওয়ালের দল আদালতে গেছে। কেননা কেজরিওয়ালের মুখ্যমন্ত্রিত্ব নিয়ে নেওয়ার কথা এসেছিল। কেন তিনি মুখ্যমন্ত্রী থাকবেন—এ মর্মে জনস্বার্থে মামলা হয়েছে। সেটা আদালত থেকে বলা হয়েছে, তিনি জেলে বসেও মুখ্যমন্ত্রিত্ব করতে পারেন।</p> <p style="text-align: justify;">মুখ্যমন্ত্রীর স্ত্রী সুনিতা কেজরিওয়াল এগিয়ে এসেছেন। তিনি প্রতিদিন ভিডিও কনফারেন্স করছেন। সেখানে তিনি বলছেন, কেজরিওয়ালকে সরিয়ে দিয়ে কিভাবে আপের রাজনৈতিক অস্তিত্বকে দুর্বল করা হয়েছে। ফলে সব মিলিয়ে বিজেপির অন্দরমহলেও একটা প্রশ্ন উঠেছে যে এটা কি বিজেপির জন্য ভালো হলো? যেখানে নরেন্দ্র মোদি এত শক্তিশালী একজন নেতা। তাঁর এত ব্র্যান্ড ইকুইটি আছে। যেখানে নরেন্দ্র মোদির পররাষ্ট্রনীতির সাফল্যের জাতিসংঘ বারবার স্বীকৃতি দিয়েছে, যেখানে আজকে অযোধ্যায় বালক রামের মন্দির নির্মাণ করে গোটা দেশে রামের অনুভূতিতে ভোটপর্ব হচ্ছে হিন্দি বলয়ে; সেখানে বিজেপির যথেষ্ট সুবিধা হয়েছে। এতৎসত্ত্বেও কি বিজেপির মধ্যে কোথাও একটা নিরাপত্তার অভাববোধ আছে? সে জন্যই কি বিজেপি এই রকমভাবে কেজরিওয়াল এবং কংগ্রেসের বিরুদ্ধেও উঠেপড়ে লেগেছে?</p> <p style="text-align: justify;">যখন আর তিন সপ্তাহ পরে লোকসভা নির্বাচনের ভোটগ্রহণ পর্ব শুরু হয়ে যাবে, তখন আয়কর দপ্তর কংগ্রেসকে নতুন করে এক হাজার ৮২৩ কোটি টাকার আয়কর নোটিশ পাঠিয়েছে! পাঁচ বছর আগে ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে কংগ্রেস সব মিলিয়ে ৮৬০ কোটি টাকা খরচ করেছিল। ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনের আগে আয়কর দপ্তর তার দ্বিগুণের বেশি অর্থ দাবি করায় কংগ্রেসই এখন মোদি সরকারের এই কাজকর্মকে সন্ত্রাস বলে তকমা দিয়েছে। কংগ্রেসের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে আগেই আয়কর দপ্তর ১৩৫ কোটি টাকা তুলে নিয়েছে। কংগ্রেসের অভিযোগ, এবার আরো এক হাজার ৮২৩ কোটি টাকা দাবি করে মোদি সরকারের নির্দেশে আয়কর দপ্তর প্রধান বিরোধী দলকে পুরোপুরি নিঃস্ব করে দিতে চাইছে। একইভাবে সিপিএম এবং সিপিআইকেও আয়কর মেটানোর জন্য নোটিশ পাঠানো হয়েছে।</p> <p style="text-align: justify;">ভোটের রাজনীতি হোক বিভিন্ন নির্বাচনী কর্মসূচি নিয়ে। সেখানে গত ১০ বছরে নরেন্দ্র মোদি কত লোককে চাকরি দিয়েছেন, দেশের অর্থনৈতিক কী কী উন্নতি হয়েছে, আর্থিক অসাম্য কতটা দূর হয়েছে, সেসব বিষয়ে আলাপ-আলোচনা হোক। তার বদলে যেভাবে বিরোধী পক্ষকে দুর্বল করার জন্য এনফোর্সমেন্ট এবং সিবিআইকে ব্যবহার করা হচ্ছে, আর একের পর এক নেতাকে জেলে পোরা হচ্ছে, সেটা নিয়ে সমালোচনার মুখে পড়ছে নরেন্দ্র মোদি সরকার।</p> <p style="text-align: justify;">দিল্লিতে যে সবাই কেজরিওয়ালভক্ত, এমনও নয়। যাঁরা কেজরিওয়ালভক্ত নন, দিল্লির সেই নাগরিকরা, যাঁদের সঙ্গে চায়ের আড্ডায় বা রাস্তাঘাটে দেখা হচ্ছে, তাঁরা একটাই কথা বলছেন, ‘থোরা জ্যাদা হি হো রাহা হ্যায়।’ তাঁরা কেউই কেজরিওয়ালপন্থী নন, কিন্তু তাঁরা মনে করছেন, এটাতে না কেজরিওয়ালেরই লাভ হয়ে যায়। তাঁরা মনে করছেন, মোদি সরকার এতটা না করলেই পারত।</p> <p style="text-align: justify;">কেজরিওয়াল বলে দিয়েছেন, তিনি মুখ্যমন্ত্রী পদে ইস্তফা দেবেন না। এখন মুখ্যমন্ত্রী পদে ইস্তফা না দিলে যদি কেজরিওয়াল আরো সহানুভূতি পান, তাহলে কি রাষ্ট্রপতি শাসন করে বিজেপি ভোটের দিকে যাবে? এসব প্রশ্নও উঠছে। এই পরিস্থিতিতে আপের ভেঙে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হতে পারত, কিন্তু সেটাও হচ্ছে না। আপ ভেঙে গিয়ে বিজেপিতে একটা অংশ চলে যাবে, যেমনটা হয়েছিল মহারাষ্ট্রে, ঠিক তেমনটা কিন্তু দিল্লিতে হলো না।</p> <p style="text-align: justify;">এর আগে কেজরিওয়ালের দলের দুজন মন্ত্রীকে জেলে পোরা হয়েছে। এবার খোদ মুখ্যমন্ত্রীকে। তাঁকে বারবার সমন করা হয়েছে। তিনি যেতে চাইছিলেন না, কিন্তু সমনে সাড়া দিতে না দিতেই তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এই প্রক্রিয়াটাকে অনেকেই অগণতান্ত্রিক বলে মনে করছে। এতে ভোটের ফল কী হবে, সেটা এখনই বলা যায় না। শুধু এইটুকু বলা যায় যে নরেন্দ্র মোদির কার্যকলাপ নিয়ে গোটা দেশের বৃহৎ সমাজে একটা প্রশ্ন উঠছে।</p> <p style="text-align: justify;"><strong>লেখক </strong>: নয়াদিল্লিতে কালের কণ্ঠ’র বিশেষ প্রতিনিধি</p> </article>