<p>ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী একটি সংগঠন ‘হামাস’ গত ৭ অক্টোবর গাজায় ইসরায়েলি দখলদার বাহিনীর ওপর হামলা চালানোর পর থেকেই ইসরায়েল গাজায় ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে আসছে। হামাসকে সমর্থন করছে আরো কয়েকটি স্বাধীনতাকামী ফিলিস্তিনি সংগঠন এবং মধ্যপ্রাচ্যের আরো কিছু সংগঠন। বর্তমান পরিস্থিতিতে যেকোনো সময় সেখানে একটি বড় ধরনের যুদ্ধ বেধে যেতে পারে বলে বিশ্বের অনেক রাজনৈতিক ও সামরিক বিশ্লেষক মনে করছেন।</p> <p>দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জাতিসংঘ সিদ্ধান্ত নিয়েছিল হাজার বছরের ফিলিস্তিনকে ইহুদি ও মুসলমানদের মধ্যে ভাগ করে দুটি পৃথক রাষ্ট্র সৃষ্টি করা হবে, অনেকটা বানরের পিঠা ভাগের মতো। এই সব ইহুদির বেশির ভাগই এসেছিল ইউরোপ থেকে, যেখানে তারা শত বছর ধরে নির্যাতিত ও গণহত্যার শিকার হয়েছে। এই ইহুদিরা ‘জায়নবাদে’ দীক্ষিত, যার অর্থ হচ্ছে তাদের দেশে অন্য কোনো ধর্মের মানুষ প্রথম শ্রেণির নাগরিক হিসেবে থাকতে পারবে না। জাতিসংঘের এমন সিদ্ধান্ত ছিল চরম অন্যায়। কারণ ফিলিস্তিনে সব ধর্মের ও বিশ্বাসের মানুষ হাজার বছর ধরে শান্তিতে বসবাস করেছে।</p> <p>যে অঞ্চলটি নিয়ে মধ্যপ্রাচ্য গঠিত, তা কয়েক শ বছর ধরে উসমানীয় (তুর্কি) সাম্রাজ্যের অধীনে ছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ইঙ্গ-ফরাসি-মার্কিন বাহিনীর হাতে জার্মানি ও তাদের মিত্র তুরস্কের পরাজয়ের পর জাতিসংঘের পূর্বসূরি লীগ অব নেশনসের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ব্রিটেনকে এই অঞ্চলের রক্ষাকর্তা নিয়োগ করা হয়। ১৯১৮ থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত ব্রিটেন আরব ভূমির এই অঞ্চলকে শাসনের নামে লুণ্ঠন করে আর ভবিষ্যতে লুণ্ঠন চালু রাখার জন্য নানা রকমের অস্থিতিশীলতার বীজ বপন করে রেখে যায়। এই সময়ে তারা এই অঞ্চলে সৃষ্টি করে অনেক তাঁবেদার রাষ্ট্র।</p> <p>শুধু মধ্যপ্রাচ্য বা আরব ভূমিতেই নয়, সারা দুনিয়ায় যেখানেই ব্রিটেনের ঔপনিবেশিক শাসন বজায় ছিল, সেই সব স্থানে তারা এই কাজটি অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে করেছে। পরবর্তীকালে তাদের সব অপকর্মের দোসর হয়েছে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের ফেরিওয়ালা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ফিলিস্তিন দখল করার পরপরই ব্রিটেনের ইন্ধনে সেখানে জায়নবাদী ইহুদিদের দ্বারা গঠিত হয়েছিল ‘হাগানা’ নামের একটি সন্ত্রাসী সংগঠন। বলা হয়েছিল, তারা ইউরোপ থেকে স্থানান্তরিত ইহুদিদের স্বার্থ রক্ষা করবে। অবশ্য ‘হাগানা’ সৃষ্টির পেছনে ব্রিটেনের যে হাত আছে, তা তারা সব সময় অস্বীকার করে এসেছে। এই সন্ত্রাসী সংগঠন থেকে পরবর্তীকালে একাধিক ব্যক্তি ইসরায়েলের সরকার বা রাষ্ট্রপ্রধান অথবা সেনাপ্রধান হয়েছেন।</p> <p>যে জাতিসংঘের সৃষ্টি বিশ্বে শান্তির পরিবেশ সৃষ্টি করার জন্য, সেই বিশ্ব সংস্থার যাত্রা শুরু হয় এই অঞ্চলে অশান্তির বীজ বপনের মাধ্যমে। সেই অশান্তি বর্তমানে বিশ্বকে আরেকটি বড়মাপের অস্থিতিশীলতার দিকে ঠেলে দিয়েছে। সাতচল্লিশে বিশ্ব দেখেছে ফিলিস্তিনকে ভাগ করে দুটি রাষ্ট্র সৃষ্টির ঘটনা। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দেখেছে তেলসমৃদ্ধ আরব অঞ্চলে তাদের ৫১তম অঙ্গরাজ্য প্রতিষ্ঠা হিসেবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি কখনো তাদের নিজের স্বার্থের বাইরে গিয়ে কোনো সামষ্টিক স্বার্থের পক্ষে নিরঙ্কুশভাবে অবস্থান নেয়নি। নিজের স্বার্থে তারা দেশে দেশে গণহত্যা চালিয়েছে বা মদদ দিয়েছে।</p> <p>অন্যদিকে তারা নিজ দেশে আইন পাস করিয়েছে গণহত্যার দায়ে তাদের কখনো কোনো আন্তর্জাতিক আদালতে বিচার করা যাবে না, তা যদি হয় নেদারল্যান্ডসের হেগে অবস্থিত জাতিসংঘের ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিসে। যদি যুক্তরাষ্ট্রের কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে গণহত্যার দায়ে এই আদালতে বিচারের মুখোমুখি করা হয়, তাহলে যুক্তরাষ্ট্র হেগ দখল করতে পারবে। আরো অবাক করার বিষয় হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রের কোনো গণমাধ্যমে ‘গণহত্যা’ বা ‘এথনিং ক্লিনজিং’ অথবা ‘অধিকৃত এলাকা’র মতো শব্দ ব্যবহার করার ওপর অলিখিত নিষেধাজ্ঞা আছে। অথচ দেশটি নিয়মিত গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে গলাবাজি করে।</p> <p>আরো পরিতাপের বিষয় হচ্ছে, ১৯৪৭ সালের পর থেকে ফিলিস্তিনে যে গণহত্যা চলছে বা ফিলিস্তিনের আদি বাসিন্দাদের নিয়মিত উচ্ছেদ করে সেখানে ইহুদি বসতি স্থাপন করা হচ্ছে, এলাকা দখল হচ্ছে, তা নিয়ে কোনো আরব রাষ্ট্র কদাচিৎ প্রতিবাদ করে। প্রতিবাদ করলে তাদের ভাগ্য ইরাক, সিরিয়া বা লিবিয়ার মতো হতে পারে। অন্যদিকে জর্দানের মতো দেশ সব সময় এই অঞ্চলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তথা ইসরায়েলের পক্ষে দাঁড়ায়। ইসরায়েল যেসব সামরিক যান ব্যবহার করে, তার সব কটিই চলে আরব দেশগুলোর তেলে। আরো দুঃখের বিষয় হচ্ছে, তুরস্ক, যাদের মুসলমানদের একটি উদীয়মান শক্তি হিসেবে দেখা হয়, তারাও ফিলিস্তিন নিয়ে জোরেশোরে কিছু বলে না। বরং তুরস্ক সম্প্রতি ইসরায়েলের কাছে কিছু অস্ত্র বিক্রি করেছে এই বলে যে এসব অস্ত্র ক্রীড়াক্ষেত্রে ব্যবহৃত হবে! শুক্রবার তুরস্কের প্রেসিডেন্ট বর্তমান উত্তেজনাকর পরিস্থিতির জন্য ইসরায়েল ও ইরানকে সমানভাবে দায়ী করেছেন। শুধু বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী জাতিসংঘসহ একাধিক বিশ্ব ফোরামে বিষয়টি উত্থাপন করে ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে চলমান গণহত্যা বন্ধ করার দাবি জানিয়েছেন।</p> <p>নিয়তির নির্মম পরিহাস, আজ যে হামাসকে নিয়ে ইসরায়েল ও পশ্চিমা বিশ্ব জেরবার, সেই হামাস সৃষ্টি করেছিল ইসরায়েল। শুরু থেকে যে কয়টি প্রতিষ্ঠান ফিলিস্তিনকে ইসরায়েলের দখলমুক্ত করার লক্ষ্যে কাজ করছিল, তার একটি ছিল ইয়াসির আরাফাতের নেতৃত্বাধীন প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন বা পিএলও। এটি ছিল একটি ধর্মনিরপেক্ষ আধুনিক সংগঠন। এই সংগঠনের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেওয়ার জন্য ইসরায়েল তখন সৃষ্টি করেছিল জঙ্গিবাদী হামাস। তারা তাদের লালন-পালন করেছে, অস্ত্র দিয়েছে, আর্থিক সহায়তা করেছে। ইসরায়েল এই লক্ষ্য পূরণে অনেকটা সফল হয়েছে। ইয়াসির আরাফাতের মৃত্যুর পর পিএলও এখন অনেকটা মৃত।</p> <p>পশ্চিমা পরাশক্তিগুলো সব সময় মধ্যপ্রাচ্যকে একটি অস্থিতিশীল অঞ্চল হিসেবে দেখতে চেয়েছে। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে এই অঞ্চলের তেল ও গ্যাস সম্পদ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় বড় বড় তেল কম্পানি সব সময় এই অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে থাকে। প্রয়োজন হলে তারা সাদ্দাম হোসেন বা মুয়াম্মর গাদ্দাফিকে উত্খাত করে তাঁদের হত্যা করতেও দ্বিধা করে না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এমন অযাচিত হস্তক্ষেপ শুরু হয়েছিল ১৯৫৩ সালে ইরানে। ১৯৫১ সালে জাতীয়তাবাদী নেতা ড. মোহাম্মদ মোসাদ্দেগ জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে সরকার গঠন করে ইরানের সব তেলক্ষেত্র জাতীয় করেন। এসব তেলক্ষেত্র আগে ব্রিটেনের দখলে ছিল। ১৯৫৩ সালে ড. মোসাদ্দেগকে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে উত্খাত করে ইরানের সব তেলক্ষেত্র দখল করে যুক্তরাষ্ট্র। এরপর প্রায় তিন দশক ধরে ইরানের তেলসম্পদ লুণ্ঠন করেছে যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনের তেল কম্পানিগুলো। তাদের সহায়তা করেছেন ইরানের রেজা শাহ পাহলবি, যিনি উত্খাত হন ১৯৭৯ সালে ইরানের ইসলামী বিপ্লবে। সেই যে মধ্যপ্রাচ্যে পশ্চিমা পরাশক্তিগুলোর নয়া উপনিবেশবাদ শুরু হলো, তা এখন আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী। কারণ তাদের এই উপনিবেশবাদকে সহায়তা করার জন্য তারা সৃষ্টি করতে পেরেছে অনেক তাঁবেদার রাষ্ট্র, শাসকগোষ্ঠী ও শিক্ষিত নাগরিক সমাজ।</p> <p>বর্তমানে ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় যে গণহত্যা চলছে, তাতে সর্বাত্মক সহায়তা দিচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেন। সেই গণহত্যার ফলে এযাবৎ ৩৪ হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছে, যার ৭০ শতাংশই নারী ও শিশু। কোনো কারণ ছাড়াই ইসরায়েল সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কে ইরানের দূতাবাসে ড্রোন হামলা চালিয়ে তাদের সাতজন কর্মকর্তাকে হত্যা করে, যাঁদের মধ্যে ছিলেন সেনাবাহিনীর তিনজন জেনারেল। যুক্তরাষ্ট্রসহ কোনো পশ্চিমা শক্তি ইসরায়েলের এই দুর্বিনীত আচরণের জোরালো কোনো নিন্দা করেনি। শুধু পিঠে হাত বুলিয়ে বলেছে, ‘এমন আর কোরো না বাছা।’</p> <p>মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তাঁবেদার ইরান আর বর্তমানে পারমাণবিক শক্তির অধিকারী ইরান যে এক নয়, তা অনেক সময় ইসরায়েল তো বটেই, পশ্চিমা বিশ্বও বুঝতে পারে না। ঘরে ঢুকে ইসরায়েল নিজ দেশের মানুষ হত্যা করবে, তা ইরান কেন মেনে নেবে? তারা ১৩ এপ্রিল রাতে ইসরায়েলে আকাশপথে হামলা চালাল কয়েক শ মিসাইল আর ড্রোন দিয়ে। সেই হামলা প্রতিহত করতে ইসরায়েল ব্যবহার করেছে মার্কিন অস্ত্র ও সরঞ্জাম। ইসরায়েল দাবি করেছে, তাদের তেমন কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। পশ্চিমা পরাশক্তিগুলো ইসরায়েলকে মৃদুভাবে অনেকটা লোক-দেখানোর জন্য অনুরোধ করল, তারা যেন ইরানে কোনো পাল্টা হামলা না করে। কিন্তু ঠিকই ইসরায়েল শুক্রবার ভোররাতে ইরানে পাল্টা হামলা চালাল, যদিও ইরান এমন হামলার কথা স্বীকার করেনি। এই ঘটনার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে ফিলিস্তিনকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে তাকে জাতিসংঘের পূর্ণ সদস্য পদ দেওয়ার প্রস্তাবকে ভেটো দিয়ে নাকচ করে দেয় যুক্তরাষ্ট্র। কারণ এই অঞ্চলে অশান্তি বিরাজ করলে সব দিক দিয়ে তাদেরই লাভ। ক্ষতি বিশ্বসম্প্রদায়ের। ইরান যদি তাদের হরমুজ প্রণালি বন্ধ করে দেয়, তাহলে বিশ্বতেলের বাজারে যে ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে, তা সামাল দেওয়া অনেক দেশের পক্ষে সম্ভব হবে না। শুক্রবার মালয়েশিয়া ইসরায়েলে ইরানের মিসাইল ড্রোন হামলা সমর্থন করেছে। নিজ দেশের স্বার্থ রক্ষা করা সবার স্বীকৃত অধিকার। কুয়েত ইসরায়েলের সঙ্গে সব সম্পর্ক ছিন্ন করার কথা ঘোষণা দিয়েছে। আর কয়েক মাস পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। সেই নির্বাচন সামনে রেখে যুক্তরাষ্ট্র তাদের মধ্যপ্রাচ্যনীতি কত দূর নিয়ে যেতে পারে, তা দেখার পালা।</p> <p><em>লেখক : বিশ্লেষক ও গবেষক</em></p>